পরিণয়ে পরিণতি

পরিণয়ে পরিণতি !! Part- 22

রাশেদ মনে মনে ঠিক করেছে আজ মুনতাহা কে সারপ্রাইজ দিবে। মনে সাহস জুগিয়ে প্রপোজ টা করে দিবে। ভালোবাসার মানুষ কে তাড়াতাড়ি আপন করে নিতে পারলে মন পরিপূর্ণতা খুঁজে পায়।
তাই আগে থেকে মুনতাহার জন্য একটা নীল শাড়ী কিনে রেখেছে। রাশেদের কত দিনের শখ কোন এক কুয়াশা ঢাকা ভোরে মুনতাহা নীল শাড়ী পরবে আর রাশেদ হলুদ পাঞ্জাবী পরে দুজন হাত ধরে শিশির ভেজা ঘাসের উপর আলতো পায়ে বহুদূর হাঁটবে।
রাশেদের নিজের হার্টবিট নিজে শুনতে পাচ্ছে। ভয় লাগছে মুনতাহা কি উত্তর দিবে সেটা ভেবে। বুকের ভিতর দমকা হাওয়া বইছে।
মুনতাহা বুঝবে তো আমি ওকে কতটা ভালোবেসে ফেলেছি।
ও কি অনুভব করেছে আমি প্রতিনিয়ত ওর স্বপ্ন বিভোর থাকি। ঘুমন্ত জাগ্রত অবস্থায় আমার স্বপ্ন গুলোকে রংতুলি দিয়ে নিত্যনতুনভাবে সাজিয়ে তুলি।
রাশেদ মুনতাহা কে তো বলে দিয়েছে আসার জন্য কিন্তু রাশেদের অস্থিরতা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। ভালোবাসলে বোধয় পাওয়ার আগে হারানোর আশংকা বিরাজ করে। তার উপর ভালোবাসার মানুষের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করা তো ভয়ংকর।
মুনতাহা রাশেদের কথা তে ভয় পেয়ে গেলো। রাশেদ ইমারজেন্সি কেন ডাকলো৷ কোন বিপদ হয়নি তো। বাসার জামা টা কোন রকম বদলিয়ে অফিসে চলে আসছে।
অফিসে এসে দেখে রাশেদ নেই। কয়েকজন কলিগ কে জিজ্ঞেস করছে কেউ কিছু জানে না। তারপর মুনতাহা রাশেদ কে কল দিলো,,
— রাশেদ তুমি কোথায়??
— আগে বলো তুমি কোথায়??
— আমি তো অফিসে। তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন!
— তুমি অফিসের পাশে যে রেস্টুরেন্ট আছে সেটাতে চলে আসো।
— আচ্ছা।
মুনতাহার মনে খটকা লাগছে কি বলবে রাশেদ!!
মুনতাহা কে আসতে দেখে রাশেদের মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। মনে হচ্ছে রাশেদ কোন কঠিন পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে যার উত্তর রাশেদের জানা নেই।
কি হয়েছে রাশেদ কিসের ইমারজেন্সি সব ঠিক আছে তো?? কোন সমস্যা হয় নিতো অফিসে??
— হুম না মানে এইতো সব ঠিক আছে।
— তাহলে ডাকলে কেন?? আমি তো খুব ভয় পাইছি না জানি কি হয়ে গেলো।
— দেখো মুনতাহা তুমি তো জানো আমি কখনো কিছু লুকাতে পারিনা। আমার মনে যা আছে তাই বলে দি।
— কি হইছে বল না।
— তোমার কাছে ভনিতা করে লাভ নাই। আ..আ..মি তোমাকে খুব ভালোবাসি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। আবার এটা ভেবো না তোমাকে হেল্প করে দূর্বলতার সুযোগ নিচ্ছি। আমি তোমাকে তোমার বিয়ের আগে থেকে পছন্দ করতাম সেটা কখন ভালোবাসায় রূপ নিয়েছে আমি নিজে জানিনা।
প্লিজ আমায় তুমি ভুল বুঝ না।
রাশেদ যেন এক নিঃশ্বাসে সব বলে দিলো। লজ্জায় মুনতাহার দিকে তাকাতে পারছেনা।
না জানি মুনতাহা আমাকে নিয়ে কি ভাবছে। উফফ আর একটু সুন্দর করে বলতে পারতাম সবাই কত সুন্দর করে হাঁটু গেড়ে বসে ফুল দিয়ে প্রপোজ করে আর আমি কিনা রিডিং পড়লাম। দূর কাল রাত থেকে কত কিছু না ভেবেছি। ফুল কিনে আনলাম কিন্তু কিছু মন মতো হলো না। আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না।
রাশেদ বসা থেকে উঠে মুনতাহা কে একটু সময় দেয়ার জন্য অন্য দিকে চলে গেলো।
চারদিকে নিস্তব্ধতা! মুনতাহা একদম চুপ করে বসে আছে। যেন সব কিছু এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বের হলো। মুনতাহা রাশেদ কে কিভাবে নিষেধ করবে বুঝতে পারছে না।
আমি কি করে বলব আমি যে রাশেদ কে ভালোবাসি না।
আমি শুধু ওকে বন্ধু ভাবি। আমার পক্ষে আর কখনো কাউকে ভালোবাসা পসিবল না। কোন পরিস্থিতিতে পড়লাম আমি চারদিকে যেন অন্ধকার দেখছি..
যখন কেউ বিপদের দিনে এগিয়ে আসে সে মানুষের প্রতি অন্যরকম দায়বদ্ধতা তৈরী হয়। চাইলে তার মুখের উপর না করে দেয়া যায় না।
মুনতাহার চুপ করে বসে থাকা দেখে রাশেদ এগিয়ে এসে,,
— মুনতাহা এখন তোমাকে কোন উত্তর দিতে হবে না। তুমি যত খুশি সময় নাও,আমার কোন তাড়া নেই। তবে যা সিদ্ধান্ত নিবে মন থেকে নিও আমি সত্যি তোমাকে খুব ভালো রাখব। আমি তোমাকে হেল্প করেছি এ চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে না।
— আমি যা সিদ্ধান্ত নিব তুমি মেনে নিবে তো??
— হুম আমি কখনো চাই না তুমি মনের বিরুদ্ধে কিছু কর। তবে একটা কথা মাথায় রেখো তুমি আসে পাশে থাকলে আমার ভালো লাগে। আমি তোমাকে নিয়ে নতুন করে বাঁচতে চাই। সাইমুন তোমাকে যে কষ্ট দিয়েছে আমার ভালোবাসা দিয়ে সেটা ভুলিয়ে দিতে চাই। প্লিজ আমায় একটা সুযোগ দিও।
— আমাকে এক সপ্তাহ সময় দাও। আজ উঠি শরীর ভালো লাগছে না।
— কিছু খেয়ে বের হই?
— ওকে।
— শুনো তোমার জন্য সামান্য একটা উপহার এনেছি না করিও না প্লিজ।
— কি এটা?
— বাসায় গিয়ে দেখিও।
রাশেদ এর কথা গুলো মুনতাহার কানে বেজে চলেছে। কখনো কি ভেবেছিলো সাইমুন ছাড়া আর কেউ তার জীবনে আসবে। রাশেদ সত্যি মুনতাহা কে পছন্দ করে কিন্তু মুনতাহা নিরুপায়। রাশেদের মতো ছেলেদের নিয়ে তো মেয়েরা স্বপ্ন দেখে। কিন্তু কিছু মানুষের জীবনে স্বপ্ন কেবল দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই না তাদের যে স্বপ্ন দেখা নিষেধ।
.
.
সাইমুন না খেয়ে থাকতে থাকতে কেমন শুকিয়ে গেছে। দাঁড়ি লম্বা হয়ে গেছে। চুল শুস্ক রুক্ষ কেউ দেখে বলবে কতকাল ঘরের বাহিরে ছিলো। চেহেরায় বয়স্কের চাপ। রাত জেগে থাকার কারণে চোখের নিচে কালি জমেছে।
ভালোবাসার সুখ পারে জীবনকে রঙিন করে রাঙ্গিয়ে তুলতে আবার ভালোবাসার কষ্ট পারে একটা জীবনের সকল আলো ছিনিয়ে নিয়ে অন্ধকারে পরিণত করতে।
সাইমুন মায়ের সাথে রাগ করে কথা বলতে চায় না। সাইমুনের একটাই কথা,, মা হয়ে কেন সন্তানের মনের কথা বুঝলো না। কেনো এত বড় অন্যায় করতে জোর করেছে। সে জন্য ওর ভালোবাসা কে চিরকালের জন্য হারিয়ে ফেলেছে।
দেখতে দেখতে ২ মাস পার হয়ে গেছে৷ দিন যত যাচ্ছে রাহির চিন্তা বেড়ে যাচ্ছে কি করবে এটা ভেবে। তারেক তো এখন কথা বলা অফ করে দিয়েছে। রাহি ওর বেস্ট ফ্রেন্ড তানিয়া কে বাচ্চার কথা বলেছে। বিয়ের কথা শুধু তানিয়া জানতো। তানিয়ে এবোরেশন করতে বলেছে। কারণ এ সমাজে কেউ সিংগেল মা কে কেউ মেনে নিবে না। নিজেরা হাজার নষ্টামি করুক অন্যের টা জানার পরে থুথু ছিটাতে দ্বিধা করে না। নিজের ঘরের খবর না রেখে বাইরের খবর নিয়ে বেশি আগ্রহ। নিজের পাপের চেয়ে অন্যের পাপ বেশি চোখে পড়ে।
রাহি যতই বলুক বিয়ে করেছে কেউ বিশ্বাস করবে না। সবাই আসতে যাইতে ওর জীবন হারাম করে দিবে। তার উপর তারেক বিয়ের কোন প্রমাণ রাখেনি।
হঠাৎ করে সাইমুন বমি করা শুরু করেছে কোন ভাবে থামছে না। সাইমুনের মা চিৎকার দিচ্ছে ছেলের না জানি কি হয়ে গেলো। তাড়াতাড়ি গাড়ি ঠিক করে হাসপাতাল নিয়ে গেলো।
সাইমুন যাই বলুক আমাকে মুনতাহার সাথে কথা বলতে হবে নাহয় আমার ছেলেটা অকালে মরে যাবে।
ডাক্তার বলেছে ঠিক মতো না খাওয়ার কারণে সাইমুন বমি করছে। সাইমুন প্রচুর রাত জাগে ঘুমায় না। এভাবে বেশিদিন চললে সাইমুনের শরীর আরো খারাপ হবে। সাইমুনেরর পরিপূর্ণ বিশ্রাম দরকার সাথে খাওয়া দাওয়া।
.
.
মুনতাহা রাশেদের কথা মা কে বলেছে। রাশেদ মুনতাহা কে বিয়ে করতে চায় এ কথা রাশেদ সেদিন মুনতাহার মা কে বলেছে। মুনতাহার মা খুব খুশি রাশেদ মুনতাহা কে বিয়ে করতে চায়। মুনতাহা কে কোলে রেখে চুলে তেল দিয়ে বিলি কাটতে কাটতে,,
— মুনতাহা তুই রাশেদের কথা তে রাজি হয়ে যা মা। এমন ছেলে হাজারেও পাবি না।
— মা সব জেনে কিভাবে বলছ??
— দেখ মুনতাহা কোন মেয়ে সারাজীবন একা থাকতে পারে না। একটা সময় গিয়ে ছোট্ট একটা সংসার পরিবারের দরকার হয়। রাশেদ খুব ভালো ছেলে তোকে খুব ভালো রাখবে।
— মা ও সাহায্য করেছে তার মানে এই না যে আমার ওকে বিয়ে করতে হবে।
— তুই এভাবে ভাবছিস কেন দুনিয়াতে কত মানুষ তো সাহায্য করে তাই বলে সবাই কি বিয়ে করতে চায়। ও তোকে সত্যি ভালোবাসে।
— মা আমার পক্ষে কাউকে বিশ্বাস করা সম্ভব না।
— তুই ওই বেইমান সাইমুন এর জন্য করছিস না??
— মা প্লিজ..
— আমি আর কয়দিন বা বেঁচে থাকবো। মরার আগে তোর সুখ বুঝি দেখে যেতে পারবো না।
এসব বলতে বলতে মুনতাহার মা কেঁদে দিলেন।
মুনতাহা কাকে বুঝাবে সব ভালোবাসা যে শেষ কাউকে নতুন করে দেয়ার মত ওর বুকে আর ভালোবাসা নেই সব যে পুরিয়ে গেছে। আজ ও কেউ ওর মন বুঝতে পারছে না।
— মা প্লিজ কেঁদ না আমার মনের অবস্থা টা একবার বুঝো।
— তুই আরেকবার ভেবে দেখ মুনতাহা। আমি মন থেকে চাই রাশেদের সাথে তুই বাকি জীবন টা সুখে শান্তিতে কাটা। মায়ের কথা টা পারলে রাখিস।
মুনতাহা অদ্ভুত মানসিক চাপে সময় কাটাচ্ছে। কোন টা ঠিক কোন টা ভুল কার কথা যে শুনবে সব কিছু মুনতাহার মাথায় তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
মায়ের কোল থেকে উঠে মুনতাহা ছাদে চলে গেছে। বাতাসে চুল উড়ছে এক পলকে আকাশে মেঘের খেলা দেখছে। চোখের কোণে জলের আনাগোনা..
আমি কি করে বুঝাবো মা আমি রোজ রাতে মরতে মরতে বেঁচে উঠি । এক মনে কয়জন কে ঠাই দেয়া যায় বলতে পারো। আমার সব টকু ভালোবাসা যে সাইমুন কে দিয়ে দিছি। আমি যে বড্ড শূন্য। আমার শরীর টুকু আছে মন টা যে অনেক আগে মরে গেছে।
এ পৃথিবীতে কেউ কেউ মরার আগে মরে যায়। তারা কেবল নামে মাত্র সবার কাছে বেঁচে থাকে।
.
.
মুনতাহার ভাবী মুনতাহা যাওয়ার পরে বেশ আনন্দে দিন কাটাচ্ছে। আগে ঘরের মধ্যে বন্ধু বান্ধব তেমন আনতে পারতো না এখন সারাক্ষণ সাজগোজ, শপিং আর বন্ধু বান্ধব নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিজের স্বামী ছেলের জন্য কোন সময় নেই।
মুনতাহার ভাই বুঝলেও বউকে মুখের উপর কিছু বলতে পারে না। সেতো বউয়ের কথার সাথে তাল মিলিয়ে মা বোন কে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। এখন নিজের বউয়ের কথা কাকে বলবে।
পপি কে বলেও লাভ হবে না ওর ধমকে মুনতাহার ভাই চুপ। বেশি বাড়াবাড়ি করলে চিৎকার করে লোকজন জড়ো করে ফেলবে তাতে সমস্যা বাড়বে৷ সবাই ভাববে বউ কে নির্যাতন বাড়ছে।
আমাদের সমাজে এমন অনেক পরিবার ভুক্তভোগী যেখানে একটা নারী যথেষ্ট পরিবার কে শেষ করার জন্য। একটা নারী পারে পরিবার কে জান্নাতের বাগান বানাতে আবার নারী পারে পরিবার কে জাহান্নাম বানাতে।
সমাজে নারী নির্যাতন নিয়ে অনেক কিছু থাকলে ও পুরুষ নির্যাতন নিয়ে তেমন কিছু নেই। কিন্তু মাঝেমধ্যে নারীরা পুরুষের চেয়ে ভয়ংকর হয়ে যায়।
মুনতাহার ভাই ও সেরকম ভুক্তভোগী। অবশ্য তার এটা প্রাপ্য। পরিবারের সকল সিদ্ধান্তে পুরুষের অনেক ভূমিকা থাকা দরকার। মেরুদণ্ডহীন পুরুষরা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের জন্য হুমকি স্বরূপ..
.
.
অবন্তিকা আহানাফ এর বিয়ের দিন কাছাকাছি চলে এসেছে। রেজাউল করিম মেয়েকে হাত ভর্তি টাকা দিয়েছেন যা খুশি শপিং করে নিতে।
রেজাউল করিম চেয়েছিলো ঘর ভর্তি জিনিস পাঠাতে কিন্তু আহানাফ মুখের উপর না করে দিয়েছে। তার যখন সামর্থ্য হবে সে কিনে নিবে। আহানাফ চায় না কেউ বলুক অবন্তিকার বাবার টাকা আছে বলে ডিভোর্সি বউ কে আবার বিয়ে করছে। সে অবন্তিকা কে ভালোবেসে বিয়ে করছে কোন নাম ডাকের জন্য না।
অবন্তিকা আহানাফ শপিং করতে বের হয়েছে। ইচ্ছেমতো শপিং করে বাসায় আসার সময় অবন্তিকা রাস্তায় মুনতাহা কে দেখতে পায়। মুনতাহা হাতে বাজার নিয়ে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরছে।
অবন্তিকা জোরে কয়েক বার ডাক দিয়ে মুনতাহা কে ডাকছে,,
— মুনতাহা আপু…
…চলবে…