পরিণয়ে পরিণতি !! Part- 20
সাইমুন লোকটিকে বিদায় দিয়ে খাম টির দিকে চোখ বুলিয়ে নিলো।খাম খুলতে গিয়ে ভয় পাচ্ছে না জানি কি আছে খামের মধ্যে ! বুকের ভিতর অজানা ঝড় বয়ে যাচ্ছে। যেটার ভয় পাচ্ছে সেটা হবে নাতো। খাম নিয়ে বসে রইলো খুলার সাহস পাচ্ছে না।
প্রেরকের জায়গায় কোন নাম নেই কে পাঠিয়েছে বুঝা যাচ্ছে না।
মানুষের মস্তিষ্ক অনেক কিছু অগ্রিম অনুধাবন করতে পারলেও নিজেকে স্বান্তনা দেয়ার জন্য মন কে কোনভাবে রাজি করাতে চায় না। বার বার বুঝাতে চায় আমি যা ভাবছি ভুল।
খাম খুলে দেখে,, মুনতাহা ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েছে।
সাইমুন কিছুক্ষণের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। না আজ চোখ দিয়ে জল পড়ছে না। কথায় আছে না অল্প শোকে কাতর অধিক শোকে পাথর৷
সাইমুন ডিভোর্স লেটার হাতে নিয়ে বসে আছে। গলা থেকে কোন স্বর বের হচ্ছে না। পৃথিবীর সব ভাষা যেন থেমে গেছে।
শরীরের সব শক্তি নিয়ে ঢেকে উঠলো,,
“মা….আ….
সাইমুনের মা ছেলের চিৎকার শুনের পানির গরম পাতিল ফেলে ছেলের কাছে এসে হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন,
— কি হয়েছে বাবা এত জোরে চিৎকার দিলি কেন?? ব্যাথা পাইছিস??
সাইমুন চুপ করে এক দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে কোন কথা বলছে না।
— বল না বাবা চুপ করে থাকিস না। আমার যে ভয় লাগছে।
সাইমুন মায়ের দিকে ডিভোর্স লেটার এগিয়ে দিলো।।
— এটা কি??
সাইমুন কিছু বলছেনা দেখে সাইমুনের হাত থেকে নিয়ে খুলে পড়ে দেখে মুনতাহা ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েছে। অজান্তে মুনতাহার শাশুড়ীর চোখ থেকে দুফোটা জল ডিভোর্স লেটারের উপর পড়লো।
সাইমুনের মা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে বলছে,,
— তুই কাঁদিস না বাবা। আমার জন্য তুই কেন শাস্তি পাবি। আমি মুনতাহার সাথে কথা বলব। দরকার হলে আমি মা হয়ে ওর পা ধরে বলব আমার ছেলেটাকে যেন ছেড়ে না দেয়। মুনতাহা আমার মত স্বার্থপর না ও বুঝবে আমাদের কষ্ট।
— না মা তুমি কোন কথা বলবা না। আমি চাই না মুনতাহার মনে আমাদের নিয়ে নতুন করে ঘৃণার জন্ম হোক। ওর দুঃসময়ে আমরা দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছি আজ কোন মুখে ওর সামনে দাঁড়াবো!
— তোর তো কোন দোষ ছিলো না। যা অপরাধ করেছি আমি। আমার জন্য বাধ্য হয়ে তুই বিয়ে করেছিলি৷
— যেটাই হেক বিয়ে করেছিতো। এখন ভাব্বে আমার সমস্যা বলে ওকে ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছি।
— তোর যে সমস্যা সেটাতো স্থায়ী না তুই চিকিৎসা নিলে ভালো হই যাবি। আমাদের সংসার টা আগের মত হাসিখুশি হই যাবে।
— মা প্লিজ অনেক ভেবেছ সংসারের কথা এবার আমাকে রেহাই দাও। আমাকে আর মুনতাহার চোখে স্বার্থপর বানাইও না। তুমি যদি মুনতাহার সাথে যোগাযোগ কর আমি সব ছেড়ে চলে যাব যেদিকে দুচোখ যায়।
সাইমুনের মা আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন।
বার বার আফসোস করছেন আজ তার পাপের শাস্তি ছেলেটা কে ভোগ করতে হচ্ছে। বিয়ের পরে মুনতাহা কে নিয়ে কত সুখে ছিলো। কি থেকে যে কি হয়ে গেলো। নাতি নাতনীর লোভ সব ধ্বংস করে দিলো।
দুনিয়াতে মানুষের হরেক রমকের লোভ৷ কারো টাকার লোভ, কারো ভালোবাসার লোভ, কারো বিলাসিতার লোভ .. সব লোভ বোধয় দিন শেষে খারাপ কিছু বয়ে আনে।
সাইমুন দেখলো হঠাৎ খাম থেকে কি যেন একটা নিচে পড়লো তাকাতেই দেখছে একটা চিরকুট!! মুনতাহা দিয়েছে।।।
হাতে নিয়ে চোখমুখ মুছে পড়া শুরু করলো,,
আমি জানি সাইমুন এতদিনে ডাঃ রাহাত থেকে সব শুনেছ।
ডাঃ রাহাত আমায় সব বলেছেন। তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না। জানো আমার ও হয়েছিলো যেদিন আমার ভালোবাসার মানুষ টা আমার সামনে অচেনা রূপে আসলো। একটু একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম আমি। অই বাড়িতে আমার চোখের সামনে আমার স্বামী যাকে আমি ভালোবেসে বিয়ে করেছি তার বিয়ের আয়োজন হচ্ছে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসতো৷
একবার ও জানতে চাইলেনা ঠিক কতখানি কষ্ট বুকে চেপে রেখে হাসি মুখ নিয়ে ঘুরছিলাম। তুমি তো ভেবেছিলে আমি সব মেনে নিয়েছি। কোন মেয়ে কি সত্যি মানতে পারে!! এত উদার হওয়া কি সম্ভব!! বুঝলেনা তুমি কি চলছিলো আমার ভিতরে। কম তো বলিনি সাইমুন আমি তোমাকে ভাগ করতে পারবো না। তুমি বুঝেও হয়ত না বুঝার ভান ধরেছিলে। ভেবেছি শেষ পর্যন্ত বিয়ে টা করবে না। কিন্তু আমার ভালোবাসা কে মিথ্যে করে দিয়ে ঠিক বিয়ে করে নিলে। স্বার্থের কাছে হেরে গেলো ভালোবাসা। তোমার কাছে হেরে গেলাম আমি। সত্যি কি আমি হেরেছি!!
আজ মুক্ত করে দিলাম ভালো থেকো।।
আর হ্যাঁ আমি খুব ভালো আছি …
সাইমুন চিরকুট বুকে চেপে ধরে কাঁদতে লাগলো,,
— মুনতাহা আমি ভালো নেই। তোমায় ছাড়া আমি কিভাবে ভালো থাকবো। তুমি এত কিছু বুঝলে এটা বুঝলেনা আমি মন থেকে মেনে নিতে পারিনি। তোমার জায়গা আমি কাউকে দি নাই। এত বড় শাস্তি না দিলে পারতে। হুম মানছি আমি ভুল করেছি একটা বার কি সুযোগ দিতে পারতে না। কোনদিন কি তুমি জানতে পারবে আমি শুধু তোমাকে ভালোবেসেছি। তুমি শুধু আমার রাজ্যের রানী ছিলে থাকবে…
.
.
সাইমুনের বাসা থেকে আসার পরে রেজাউল করিমের মনে শান্তি নেই। জেনেশুনে মেয়েটার এতবড় ক্ষতি করলো। মেয়েটার গায়ে যে দুইটা বিয়ের চিহ্ন পড়ে গেলো। কেউ তো বুঝবেনা এখানে অবন্তিকার কোন দোষ নেই। সবাই অবন্তিকার দিকে আঙ্গুল উঠাবে।
ছেলেরা চাইলে দুই তিনটা বিয়ে করতে পারে কিন্তু মেয়েদের দুইটা বিয়ে হলে সবার খারাপ নজর মেয়েটার উপর থাকে। সবাই বলবে খারাপ স্বভাবের নাহলে কি দুই জায়গায় সংসার করতে পারলো না।
অবন্তিকা ভাবী সামিহা কে গিয়ে হাত ধরে বলছে,,
— ভাবী তোমার সাথে কথা আছে।।
— আমি জানি কি বলবা। আহানাফ ভাই কে নিয়ে তাইতো!।
— তুমি ছাড়া এ বাসায় কেউ আমায় বুঝে না। আর তোমার কথা বাবা কিছুটা হলেও শুনে।
— ভেব না আমি বুঝিয়ে বলব। বাবা ও আগের চাইতে নরম হয়ে গেছে। বুঝালে ঠিক বুঝবে। অইদিকে তো ডিভোর্স এর ব্যাপার টা মিটেও যাবে।
— লাভ ইউ ভাবী।
সামিহা জানে অবন্তিকা কতটা কষ্টের মাঝে এ কয়টা মাস আহানাফ কে ছাড়া কাটিয়েছে। মেয়েটা হাসতে ভুলে গিয়েছিলো। অবন্তিকা আর আহানাফ এর ভালোবাসা কে জয়ী করার জন্য সামিহা বাবা কে যেভাবে হোক বুঝাবে।
বিকালে শুশুরের চা বানিয়ে সামিহা রেজাউল করিমের রুমে গেলো। চা খেতে খেতে কথা উঠাবে,,
— বাবা আসব।
— হুম বউ মা আসো না।
— বাবা কিছু মনে না করলে একটা কথা বলব।
— হুম বলো না।
— অবন্তিকা কে নিয়ে কিছু ভেবেছেন??
— বুঝতেছিনা কি করব। মেয়েটার মুখের দিকে তাকাতে পারিনা। আমি নিজের জিদের বশে আমার মেয়ের জীবন টা নষ্ট করে দিলাম
— বাবা রাগ করবেন না একটা কথা বলি অবন্তিকা আহানাফ ভাইয়ের সাথে সুখে থাকবে। টাকা দিয়ে সব সময় সুখ কেনা যায় না। আহানাফ ভাই খুব ভালো মনের মানুষ আমাদের অবন্তিকা কে সুখে রাখবে। একটু সময় লাগবে দেখবেন আহানাফ ভাই অনেক ভালো জায়গায় পৌছাবে একদিন।
— তুমি কি ভেবে এসব বলছ?? সত্যি কি তাই মনে হয়!
— জি বাবা আমার মনে হয় এখনো ওরা দুজন কে পছন্দ করে। আপনি একবার আহানাফের পরিবারের সাথে কথা বলেন।
— ওরা কি এখন রাজি হবে ? আমি ওদের সাথে তো কম অন্যায় করিনি। আহানাফ আর ওর মা কি আমাকে ক্ষমা করবে??
— আপনি একবার কথা বলে দেখেন। ওরা মনে কিছুই রাখবে না। আপনি অনুতপ্ত হয়ে মন থেকে ক্ষমা চাইলে উনারা মনে রাগ পুষে রাখবে না।
— ঠিক আছে বউ মা তুমি যেহেতু বলছ আমি যাব ওদের বাসায়। আমার মেয়ে সুখে থাকলে হচ্ছে আমার আর কিছুই চাই না। অনেক তো নিজের ইজ্জতের কথা ভাবলাম আর না।
.
রেজাউল করিম ভাবছে অনেক হয়েছে এবার মেয়ের সুখের জন্য যা করার সব করবে। সন্তান সুখে থাকলে মা বাবা রা সুখে থাকে। জিদ অহংকার মানুষের মন কে বিষিয়ে তুলে। সত্যি কখনো অহংকার করতে নেই। অহংকার পতনের মূল।
.
.
মুনতাহা ১ সপ্তাহ ধরে অফিসে যাচ্ছে না। রাশেদ চিন্তায় পড়ে গেলো হঠাৎ কি হলো মুনতাহার। কল করলে ও ধরে না। রাশেদ কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠেছে মুনতাহার জন্য । মুনতাহার সাথে কথা না বললে ভালো লাগে না। অফিসেও কাজে মন বসছে না।
তাই ভাবলো একবার মুনতাহার বাসায় গিয়ে দেখবে। মুনতাহা অসুস্থ নাতো। একাবাসায় মা মেয়ে থাকে কোন পুরুষ মানুষ নেই প্রয়োজন হলে করার মতো।
সাতপাঁচ না ভেবে রাশেদ মুনতাহার বাসায় চলে গেলো।
মুনতাহার মা রাশেদ কে চিনতে ভুল হয়নি। এতদিন মুনতাহার কাছে রাশেদ এর কথা শুনতে শুনতে চেহেরা কেমন হবে ধারণা হয়ে গেছে।
রাশেদ কে দেখে মুনতাহার মা হাসি দিয়ে,,
— আসো বাবা ভিতরে আসো।
— আপনি আমাকে চিনছেন??
— চিনব না কি বলো। তুমি রাশেদ তো!!
— হুম কেমনে বুঝলেন।
— মা সন্তানদের ঠিক চিনতে পারে।
— তাহলে কি আমি মা ডাকবো??
— হুম তুমি তো ছেলের মতো। তুমি ছিলে বলে আমরা এত ভালো আছি।
— কি যে বলেন মা। ভালো থাকা আপনাদের অধিকার।
মুনতাহা কে দেখছিনা ও কোথায়।
— তুমি এসেছ ভালো করেছ। সারাক্ষণ রুমে লাইট অফ বসে থাকো।
তুমি যাও আমি নাস্তা নিয়ে আসছি….
রাশেদ গিয়ে দেখে আবছায়া আলোতে মুনতাহা কে দেখা যাচ্ছে। মুনতাহা কে ভীষণ মায়াবতী লাগছে। এত সুন্দর একটা মেয়ের জীবনে কত কষ্ট। এ কম বয়সে কত কিছু না সহ্য করে ফেলেছে।
রাশেদ গিয়ে মুনতাহার মাথায় হাত দিতেই মুনতাহা আতঁকে উঠলো….
…..চলবে…..