অ‌চেনা আমি

অ‌চেনা আমি ! পর্বঃ- ৭

লেখাঃ শার‌মিন আক্তার
প্রায় এক মাস হ‌য়ে গে‌লো আয়াত এখন পু‌রোপ‌ু‌রি সুস্থ। মাঝখা‌নে ক‌দিন পোড়া স্থা‌নে ইন‌ফেকসন হওয়া বেশ ভুগ‌তে হ‌য়ে‌ছে ওকে। তনয়া অনেক সুস্থ ভা‌বেই আছে, নয়‌তো প্রেগ‌নে‌ন্সির শুরুর দি‌কে অনেক কম‌প্লি‌কেশন হয় কিন্তু তনয়ার বেলায় আল্লাহর রহম‌তে সেসব কিছু হচ্ছেনা এখন পর্যন্ত, হ‌বেই বা কি ক‌রে? আয়াত তনয়ার যেভাবে খেয়াল রা‌খে তা‌তে সমস্যা হবার তো কোন কথাই না।
ক‌য়েক‌দিন পর থে‌কে আয়াত আবার হস‌পিটা‌লে যাওয়া শুরু কর‌বে। বিকা‌লে আয়াত তনয়া বারান্দায় ব‌সে চা খা‌চ্ছে তনয়া বল‌ছে
তনয়াঃ আয়াত একটা জি‌নিস খেয়াল ক‌রে‌ছো?
আয়াতঃ কি?
তনয়াঃ প্রায় এক মাস আগে হাসপাতা‌লে ব‌সে যে সেই ছে‌লেটা ফোন ক‌রে‌ছি‌লো তারপর আর সে ফোন ক‌রে‌নি আর কোন মে‌সেসও আসে নি। ছে‌লেটা‌ কি ভা‌লো হ‌য়ে গে‌লো না‌কি?
আয়াতঃ হুমম আমিও সেটাই ভাব‌ছি। আমার জানাম‌তে এ ধর‌নের মানু‌ষিক রোগী সহ‌জে‌ তো ঠিক হয় না। কিন্তু ছে‌লেটা নি‌জে থে‌কে আমা‌দের জ্বালা‌নো বন্ধ ক‌রে দি‌লো। আমার বন্ধু জয়‌কে জি‌গেস ক‌রে‌ছিলাম সে কোন ধরনের খোঁজ পে‌য়ে‌ছে কিনা? কিন্তু জয় বল‌লো অনেক ঘে‌টেও আইডি দু‌টোর বিষ‌য়ে কোন ডি‌টেইলস পাওয়া যায়‌নি। এমন কি হাসপাতা‌লে দূর্ঘটনা ঘটার তেমন কোন কারন খু‌ঁজে পায়‌নি। শুধু দে‌খে‌ছে তিনতলার দু‌টো রু‌মের মেইন সুইচ এ ম‌ধ্যে কি যে‌নো সমস্যা হওয়ায় এক‌সি‌ডেন্টটা ঘ‌টে‌ছে। বা‌কি বিস্তা‌রিত তেমন কোন কারন পায়‌নি পু‌লিশ তাই দূর্ঘনা ব‌লে হাসপাতাল ক‌র্তিপক্ষ‌কে সাবধান ক‌রে কেস বন্ধ ক‌রে দি‌য়ে‌ছে। তোমার কেসটা সাইবার ক্রাইম এর আওয়াতায় এনে ব‌লে‌ছে হয়‌তো কেউ মজা ক‌রে কর‌ছে। প‌রে আবার কল বা মে‌সেস কর‌লে তখন ব্যবস্থা নি‌বে।
তনয়াঃ কিন্তু আয়াত কেউ মজা ক‌রে কর‌লে ওমন দূর্ঘটনা ঘট‌তো না আমা‌দের মা‌ঝে দ্বন্দ্ব হ‌তো না।
আয়াতঃ হুমমম সেটা তো আমিও ভাব‌ছি। কিন্তু পু‌লিশ না‌কি তেমন কোন প্রমানই পায় নি। আচ্ছা বাদ দেও তো ওসব কথা। আল্লাহর কা‌ছে দোয়া ক‌রো সব সমস্যা যে‌নো সমাধান হ‌য়ে যায়। ঐ লোকটার অভিশাপ্ত ছায়া যে‌নো আমা‌দের জীব‌নে আর না পা‌রে।
তনয়াঃ হুমম ঠিক বল‌ছো। আচ্ছা আয়াত ক‌দিন কোথাও থে‌কে ঘু‌রে আস‌লে ভা‌লো হ‌তো না? ক‌দিন পর হস‌পিটা‌লে যাওয়া শুরু কর‌লে তখন‌ তো আবার তু‌মি মা‌সের পর মাস সময় পা‌বে না।
আয়াতঃ কোথায় যা‌বে?
তনয়াঃ চ‌লো না ক‌দিন সমুদ্র দে‌খে আসি!
আয়াতঃ এ সময় এত লম্বা জা‌র্নি এ সময় সম্ভব না। এ সময় কক্সবাজার যাওয়া সম্ভব না।
তনয়াঃ আমি কখন বল‌ছি কক্সবাজার যা‌বো! সমুদ্র কি কক্সবাজার ছাড়া কোথাও নাই? কেন কুয়াকাটা যা‌বো, জা‌র্নিও কম হ‌বে।
আয়াতঃ কুয়াকাটা যে‌তেও তিন ঘন্টা জা‌র্নি করা লা‌গে ভু‌লে গে‌ছো?
তনয়াঃ নি‌জে‌দের গা‌ড়ি নি‌য়ে যা‌বো , তো প্রব‌লেম কোথায়? আমি অত শত বু‌ঝি না আমি যা‌বো ব্যাস।
‌শেষমেশ তনয়ার জেদের হার মান‌লো আয়াত। প‌রের দিন খুব সকা‌লে আয়াত, তনয়া, আস্ফি, আনিকা তার বর (সুমন) তার দুই ছে‌লে আর তনয়ার ছোট ভাই তান‌ভির রওনা দি‌লো কুয়াকাটার উদ্দে‌শ্যে। বিকালে কথা হবার পর তনয়া আনিকা আর তান‌ভির‌কে ফোন দি‌য়ে বা‌ড়ি‌তে নি‌য়ে আসে। তনয়া ওর শ্বশুর‌কে ওদের সা‌থে যে‌তে বলে কিন্তু তি‌নি যে‌তে রা‌জি হয় না। সে বল‌লো তোমরা বাচ্চারা যাও। য‌দিও এটা একটা ফ্যা‌মি‌লি টু‌রের মত হয়ে গে‌ছে। সকাল আটটার দি‌কে ওরা গা‌ড়ি‌তে বস‌লো, হো‌টে‌লে পৌছা‌তে পৌছা‌তে বেলা প্রায় বা‌রোটা বে‌জে গে‌লো। প্রথ‌মে যে যার রু‌মে ডু‌কে ফ্রেস হ‌য়ে বিশ্রাম নি‌লো। তনয়া দু বার ব‌মি করায় বে‌শি ক্লান্ত হ‌য়ে গেছে।
আয়াতঃ কি জান আরো ঘুর‌তে আসবা? শখ মি‌টে‌ছে!
তনয়াঃ তু‌মি‌ কি মজা কর‌ছো আমার সা‌থে?
আয়াতঃ হ্যা কর‌ছি! কি করবা তু‌মি?
তনয়াঃ হুহহ পঁচা হ্যাজ‌বেন্ড।
আয়াত তনয়ার পাশে শু‌য়ে তনয়া‌কে বু‌কের মা‌ঝে শক্ত ক‌রে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে বল‌লো জা‌নি‌তো পঁচা। বে‌শি খারাপ লাগ‌ছে? আরেকটু লেবুর শরবত খা‌বে?
তনয়াঃ নাহ্ তোমার বু‌কের স্পর্শ পে‌য়ে‌ছি না, এখন ঠিক হ‌য়ে যা‌বো।
আয়াতঃ লাভ ইউ।
‌বিকাল বেলা সবাই ঘুর‌তে বের হয়। এখা‌নে ঘুর‌তে আসার আরেকটা কারন আছে তা হ‌লো রায়হা‌নের সা‌থে দেখা করা, কারন রায়হানও ক‌দিন আগে একেটা কা‌জে কুয়াকাটা এসে‌ছে। তাই সবাই ভাব‌ছে এ ফা‌ঁকে রায়হান‌কেও দেখা নেয়া যা‌বে। রা‌তের খাবার টাই‌মে সবাই রায়হা‌নের সা‌থে দেখা করার সিদ্ধান্ত নি‌য়েছে। রা‌তের বেলা সবাই রায়হা‌নের সা‌থে দেখা কর‌লো, তনয়া তখ‌নো নি‌চে আসে‌নি, তনয়া নি‌চে আস‌লো তখ‌নো হিযাব প‌রে। আ‌নিকা আস্ফি কতবার বল‌লো ভা‌বি ঘুর‌তে আস‌ছো, সবাই খুব আনন্দ কর‌বো এখন হিয‌াব না পর‌লে হয় না? তনয়া বল‌লো হিযাবের সা‌থে আনন্দের কি সম্পর্ক? আমরা পর্দায় শালীন পোশা‌কে থে‌কেও আনন্দ কর‌তে পা‌রি।
আ‌স্ফিঃ তোমার সা‌থে কথায় পার‌বো না। শালীন পোশাক পরা পর্দা করা আমরাও মা‌নি তবুও—-!
তনয়াঃ থাক এ বিষ‌য়ে প‌রে কথা বল‌বো কেমন।
রায়হান তনয়া‌কে দে‌খে সালাম দি‌লো, তনয়া রায়হা‌নের গলার আওয়াজ শু‌নে চম‌কে উঠ‌লো। কাঁপা কাঁপা গলায় সালা‌মের উত্তর দি‌য়ে কুশল বি‌নিময় কর‌লো। রায়হান সবার সা‌থে কথা বল‌ছে, সবাই বেশ হা‌সি হা‌সি মু‌খে রায়হা‌নের সা‌থে আড্ডা দি‌তে‌ছে কিন্তু তনয়া চুপ ক‌রে ব‌সে র‌য়ে‌ছে। রায়হান তনয়া‌কে বল‌লো
রায়হানঃ কি হ‌লো তনয়া আপ‌নি চুপচাপ ব‌সে আছেন যে, কোন কথা বল‌ছেন না কেন?
তনয়াঃ এম‌নি ভা‌লো লাগ‌ছে না।
আয়াতঃ কি হ‌য়ে‌ছে তনয়া? শরীর ঠিক আছে তো তোমার?
তনয়াঃ শরীরটা খারাপ লাগছে। আয়াত‌ প্লিজ আমা‌কে রু‌মে দি‌য়ে আসো।
আয়াতঃ ঠিক আছে চ‌লো! আয়াত সবাই‌কে উদ্দেশ্য ক‌রে বল‌লো আপনারা সবাই কথা বল‌ুন আমি একটু পর আস‌ছি। আয়াত তনয়া‌কে নি‌য়ে রু‌মে গে‌লো। কি হ‌য়ে‌ছে তনয়া? শরীর কি বে‌শি কি খারাপ লাগ‌ছে?
তনয়‌াঃ আয়াত তুমি রায়হা‌নের গলার আওয়াজ চিন‌তে পার‌ছো?
আয়াতঃ বুঝলাম না। কেন কি হ‌য়ে‌ছে?
তনয়াঃ আয়াত রায়হা‌নের গলার আওয়াজ হুবহু সেই অজানা #অচেনা_আমি ছে‌লেটার গলার আওয়া‌জের মত।
আয়াতঃ কি বল‌ছো? আর ইউ শিওর?
তনয়াঃ হুমমম। আয়াত আমি তোমায় ব‌লে‌ছিলাম না যে, ছে‌লেটার আওয়াজ আমার খ‌ুব প‌রি‌চি‌তো লাগ‌ছে? কারন রায়হান যখন আমা‌দের বা‌ড়ি‌তে প্রথম যায় তখন আমি বাবা সা‌থে ওকে কথা বল‌তে শুন‌ছি । সেজন্যই আমার সেই ছে‌লেটার আওয়াজ এত প‌রি‌চি‌তো ম‌নে হ‌তো, ম‌নে হ‌তো আওয়াজটা কোথাও শু‌নে‌ছি । তাহ‌লে কি রায়হানই সেই ছে‌লে? কিন্তু রায়হান এসব কেন কর‌বে? আর তাছাড়া রায়হান আমার গল্প প‌ড়ে আমা‌কে কিভা‌বে চিন‌লো? আস্ফির সা‌থেই বা কি ক‌রে আলাপ হ‌লো? হাসপাতা‌লের এত ঘটনা কিভা‌বে ঘটা‌লো? কারন আস্ফি তো ভু‌লেও আমার ফোন নাম্বার কাউকে দি‌বে না, আমি এ বিষ‌য়ে আস্ফি‌কে পূর্ন বিশ্বাস ক‌রি। আর রায়হা‌নের সা‌থে আস্ফির দেখা‌ও তো তখন আমা‌দের বা‌ড়ি ব‌সে হ‌য়ে‌ছি‌লো, আর তো হয়‌নি, হ‌লে আস্ফি নিশ্চই আমা‌কে বল‌তো। তাহ‌লে রায়হান কি আস্ফি‌কে ট্রাপ ক‌রে‌ছে না‌কি? আর রায়হান নি‌জে ইচ্ছা ক‌রে আম‌া‌দের সাম‌নে কেন এলো? ওর কি কোন উদ্দেশ্য আছে? (হাজা‌রো প্র‌শ্নে তনয়ার মনটা অস্থির হ‌য়ে আছে)
আয়াতঃ আমি কিছু বুঝ‌তে পার‌ছি না। মাথায় কাজ কর‌ছে না।
এ‌দি‌কে রায়হান অল্প‌তেই নি‌জের মি‌ষ্টি কথা দি‌য়ে প‌রিবা‌রে সবার সা‌থে মি‌শে গে‌ছে।
আয়াত তনয়া রু‌মে ব‌সে ভাব‌ছে কি করা যায় এ মুহূ‌র্তে! কারন আস্ফির কথা বু‌ঝে ম‌নে হয় রায়হান‌কে খুব পছন্দ ক‌রে। আস্ফি‌কে এসব কথা বল‌লে আস্ফি‌ কি বিশ্বাস কর‌বে? এতে ওর ম‌নের উপর খারাপ প্রভাব পর‌বে। তাছাড়া পু‌রো স‌ত্যি না জে‌নে শুধু মাত্র স‌ন্দে‌হের ভি‌ত্তি‌তে রায়হান‌কে দোষী মানা কি ঠিক? রায়হান য‌দি দোষী না হয় তখন‌ তো হি‌তে বিপরীত হ‌য়ে যা‌বে। কোন কিছুর বিষ‌য়ে সম্পূর্ন না জে‌নে শু‌নে শুধু মাত্র স‌ন্দে‌হের ভি‌ত্তি‌তে একজন‌কে দোষী ক‌রে তার বিষ‌য়ে সিদ্ধান্ত নেবার মত মানুষ আয়াত না। আয়াত তনয়া‌কে কিছু কথা বল‌লো, তারপর ফোন নি‌য়ে কা‌কে যে‌নো ফোন কর‌লো আর বল‌লো কাল‌কে সকা‌লের ম‌ধ্যে সব কিছু রে‌ডি চাই। ম‌নে থা‌কে যে‌নো। তনয়া কিছু‌তেই নি‌জে‌কে শান্ত কর‌তে পার‌ছে না, কারন রায়হান য‌দি সেই ছে‌লে হয় ত‌বে সে য‌দি আবার আয়া‌তের ক্ষ‌তি ক‌রে! সে ভ‌য়ে আয়াত‌কে শক্ত ক‌রে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে রে‌খে‌ছে। আয়াত তনয়া‌কে বুঝা‌তে চেষ্টা ক‌রেও বারবার ব্যার্থ হ‌চ্ছে। অতি‌রিক্ত টেনশ‌ন করার ফলে তনয়ার মাথা ঘু‌রে ক‌রেবার ব‌মি ক‌রে ক্লান্ত হ‌য়ে পর‌লো।
আয়াত তনয়া‌র শরীর মু‌ছে দি‌য়ে তনয়া‌কে জোড় ক‌রে কিছু খাবার খাই‌য়ে দি‌য়ে ঔষধ খাই‌য়ে দি‌য়ে ঘুম পা‌রি‌য়ে দি‌য়ে‌ছে। আর আনিকা‌কে ফোন ক‌রে ব‌লে‌ছে তারা যে‌নো ডিনার ক‌রে নেয়। তনয়ার শরীরটা খারাপ তাই ওরা নি‌চে আস‌তে পার‌বে না। সবাই ডিনার ক‌রে তনয়া‌কে দেখ‌তে গে‌লো, সা‌থে রায়হানও ছি‌লো, আয়াত সবাই‌কে বল‌লো কেবল ঘু‌মি‌য়ে‌ছে, কাল সকা‌লে দেখা ক‌রো। সবাই যে যার মত রু‌মে চ‌লে গে‌লো। আয়াত তনয়ার হাত ধ‌রে ওর পা‌শে ব‌সে রই‌লো।
চল‌বে——–
ভুলত্রু‌টি ক্ষমার চো‌খে দেখ‌বেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *