পরিণয়ে পরিণতি

পরিণয়ে পরিণতি !! Part- 18

রাহি না পারছে সাইতে না পারছে কাউকে বলতে। কেউ তো জানেনা রাহি লুকিয়ে তারেক কে বিয়ে করেছে। তারেক ও কাউকে জানাতে নিষেধ করছে। কয়েকদিন ধরে রাহি লক্ষ্য করছে তারেক কেমন গা ছাড়া ভাব নিয়ে কথা বলে
কথার মাঝে আন্তরিকতা ভালোবাসা নেই। আগের মত কল দিলে কথা ও বলতে চায় না। যতক্ষণ কথা বলে মনে হয় যেন বাধ্য হয়ে কথা বলে। সারাক্ষন ব্যাস্ততার অজুহাত দেখায়। রাহি তারেকের এ পরিবর্তন মেনে নিতে পারছে না।
ভালোবাসলে বুঝা যায় ভালোবাসার মানুষের কোন কথা টা সত্যি বলে আর কোন টা অজুহাত। তারেকের এভাবে এড়িয়ে চলা রাহির রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে কোন সমস্যা হয়েছে কিনা। তারেক কথা বাড়াতে চায় না।
ভালোবাসার মানুষ এভোয়েড করলে পুরো দুনিয়া অন্ধকার লাগে মেয়েরা স্বভাবতই ভালোবাসলে নির্ভরশীল হয়ে যায়। প্রিয় মানুষ কে নিজের দুনিয়া বানিয়ে ফেলে। নিজের অস্তিত্ব ভালোবাসার মানুষের ভিতর খুঁজতে শুরু করে এটাই একসময় জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ায়। কারণ মানুষ মরে গেলে পঁচে যায় বেঁচে থাকলে বদলায়। মানুষের স্বভাব সময়ের সাথে বদলানো…
তাই ভালোবেসে নিজেকে এতটাই দূর্বল করা ঠিক না যেখানে বিবেক বুদ্ধি বলতে কিছুই থাকে না। নিজের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়।
ধীরে ধীরে তারেক রাহি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে এটা রাহি অনুভব করতে পারছে। তারেকের অবহেলা রাহি কে একটু একটু করে শেষ করে দিচ্ছে। তার উপর পিরিয়ড অফ ১ মাস।
রাহি ভীষণ টেনশনে আছে না জানি প্রেগন্যান্ট!! তারেক কে কয়েকবার বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু বলে উঠতে পারেনি। তারেক রাহির কোন কথা শুনতে আগ্রহী না।
রাহি একটু একটু করে অথৈই সমুদ্রে তলিয়ে যাচ্ছে।
.
.
সাইমুন নিজেকে ঘর বন্দী করে রেখেছে। ঠিকমতো কারো সাথে কথা বলে না। সারাক্ষণ মন মরা হয়ে থাকে। বারান্দায় আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করে কথা বলে।
সাইমুনের মায়ের চোখের পানি যেন স্থায়ী হয়ে গেছে। ছেলের মুখের দিকে তাকাতে পারে না।। সেদিন যদি ছেলেকে বিয়ে করার জন্য জোর না দিত তাহলে সংসার টা বেঁচে যেত। আফসোস করে নিজের স্বার্থের জন্য ছেলের সুখ কেড়ে নিয়েছে।
.
.
আমার পাপের জন্য আজ আমার ছেলেটা এত শাস্তি পাচ্ছে।। ও তো মুনতাহা কে খুব ভালোবাতো সেটা আমি জেনেও ওকে আগুনে ফেলে দিলাম। একবার ছেলের সুখ কিসে জানতে চাইলাম না।
মুনতাহা কিছু না করলেও কারণে অকারণে যাতা কথা শুনিয়ে দিয়েছি। সেদিন মুনতাহার কান্না আমার কলিজা ভিজেনি তাই আজ আমার কান্না আল্লাহর দরবারে পৌছাবে না। মুনতাহা কোথায় তুই, একবার এসে দেখে যা মা আমরা কেউ ভালো নেই। তোর অভিশাপে আমরা শেষ হয়ে গেলাম। তুই ঠিক বলতি কারো সুখ কেড়ে নিয়ে কেউ সুখী হয় না।
এসব বলতে বলতে সাইমুনের মা বুকে চাপড়িয়ে কেঁদে উঠলেন…
সাইমুন অবন্তিকার সাথে আগে যা একটু কথা বলতো এখন তাও বলে না। অবন্তিকা হাঁফিয়ে উঠেছে না পারছে যেতে না পারছে এখানে থাকতে। এদের প্রতি আগে যা একটু মায়া হত সব জানার পর এদের জন্য মন থেকে ঘৃণা আসে।
সাইমুন অবন্তিকার বাবা কে আসার জন্য বলেছে। অবন্তিকার সামনে পুরো জীবন পড়ে আছে। এতদিনে সাইমুন বুঝেছে অবন্তিকা এ বিয়ে নিয়ে খুশি না। অবন্তিকা অন্য কাউকে ভালোবাসে। সাইমুন জানে ভালোবাসার হারানোর কষ্ট কি তাই চায় না অবন্তিকা সে কষ্ট পাক।
অবন্তিকার বাবা জরুরি তলব পেয়ে মেয়ের শুশুর বাড়ি এসেছে। আসার সময় ঘর ভর্তি জিনিস এনেছে মেয়ের শুশুর বাড়ি বলে কথা। অবন্তিকা কিছুটা অবাক হলো ওতো বাবা কে আসতে বলেনি,,
— বাবা তুমি এখানে!!
— কেন আসা যাবে না তোর শুশুর বাড়ি?
— সেটা বলিনি হঠাৎ এখানে!! তোমাকে কি কেউ আসতে বলেছে??
— হুম সাইমুন বলেছে জরুরি কথা আছে। তোর নাকি এখানে ভালো লাগছে না বাড়ির কথা খুব মনে পড়েছে ।
তোর মুখ এমন শুকনো কেন কিছু কি হইছে !
— সেটা তোমার বেয়াইন আর জামাই কে জিজ্ঞেস কর।
সাইমুন এগিয়ে এসে সালাম করে,,
— বাবা সুস্থ আছেন?
— হুম ভালো আছি। আমাকে কেন ডেকেছ বাবা?? অবন্তিকা কি কিছু করেছ?
— না অবন্তিকা কিছুই করেনি। যা করার আমরা করেছি।
— কি হইছে খুলে বলো আমার টেনশন বাড়ছে।
—বাবা আজ লুকানোর কিছু নেই। আপনি যা শাস্তি দিবেন আমরা মেনে নিব।
— কিসের শাস্তি কি বলছ??
— অবন্তিকা কে বিয়ে করার সময় জানানো হয়েছিলো আমার প্রথম স্ত্রী পালিয়ে যায় আসলে এটা মিথ্যা কথা তখন আমার প্রথম স্ত্রী এ বাসায় ছিলো। ওর বাচ্চা হবে না বলে মা চেয়েছেন আমি বিয়ে করি কিন্তু এখন….
সব শুনে অবন্তিকার বাবা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। মুহুর্তের মধ্যে চেহেরা বদলে গেলো। জেনে শুনে কেন তার মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে। তাদের দেখে ছাড়বে এত বড় বিশ্বাসঘাতকতার জন্য।
সাইমুনের মা অবন্তিকার বাবা কে নরম হয়ে বলছে,,
— বেয়াই আমাদের অপরাধের শাস্তি আমরা পাচ্ছি। আপনার মেয়ের সাথে আমার ছেলের কোন সম্পর্ক নেই। আপনার মেয়ে কে আমরা কোন কষ্ট দি নাই।
— এসব বললে কি লোকে বিশ্বাস করবে। আমরা মান সম্মান নিয়ে টানাটানি করছেন সেটা কি ফিরে পাব। আমার মেয়েটার কি হবে ভেবে দেখেছেন!! ওর জীবন টা যে নষ্ট হয়ে গেছে। আমার ভুল হয়েছে সেদিন আপনার কথা বিশ্বাস করা। বাহ! আপনি তো দেখি কম চালাক না প্রথম বউ ঘরে রেখে ছেলেকে আবার বিয়ে দিলেন। আমরা কেউ কিছু টের পেলাম না। আপনাদের আমি জেলের ঘানি টানাবো।
অবন্তিকা ওর বাবার কথাতে মুখ বন্ধ রাখতে পারলো না। রাগ করে বলে উঠলো,,
— আমার জীবন টাতো তুমি নষ্ট করেছ। এখন খুব ভাবছ আমার জীবন নিয়ে। আহানাফ থেকে আমাকে আলাদা করে তো অনেক আগে আমাকে মেরে ফেলেছ। খুব তো চেয়েছিলে বড় ঘরে বিয়ে দিবে নিজের ইচ্ছামতো। এখন তোমার শখ মিটেছে।৷
—- অবন্তিকা চুপ কর!
— কেন চুপ করব বাবা। আজ আমাকে বলতে দাও। তোমার মেয়ের যে আগে একটা বিয়ে হয়েছে সেটা বলেছিলে?? তুমি ও তো বিশ্বাসঘাতকতা করেছ।যে যেমন তার সাথে সেটাই হয়। তুমিও সমান অপরাধে অপরাধী। মাঝেমধ্যে মা বাবারা সন্তানদের জীবন নষ্ট করে নিজেদের ইচ্ছে গুলো সন্তানের উপর চাপিয়ে দেয়। সন্তানদের সুখের কথা না ভেবে নিজেদের সুখের কথা ভাবে।
সাইমুনের কাছে কোন কিছু অবাক লাগছে না খারাপ লাগাও নেই। সাইমুন অবন্তিকা কে লক্ষ্য করে,,
— অবন্তিকা এখন এসব কথা থাক। তুমি গিয়ে রেডি হয়ে বাবার সাথে যাও আমি কয়েকদিনের মধ্যে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিব।
অবন্তিকার বাবা তাচ্ছিল্যের সুরে বলছে,,
— হুম তুই রেডি হয়ে আয় এখানে আর এক মুহুর্তও না। যে ছেলে কখনো তোকে মা ডাক শুনাতে পারবে না তার সাথে কোন ভবিষ্যৎ নেই।
অবন্তিকার বাবার কথা তীরের মত সাইমুন আর ওর মায়ের বুক ছেদ করে বের হলো। এখন বুঝতে পারছে মুনতাহা কে বললে মুনতাহার ঠিক কেমন কষ্ট হতো।
— বাবা জানি আমার কোন কথা শুনবেন না তাও বলব অবন্তিকা কে ওর ভালোবাসার মানুষের কাছে ফিরিয়ে দিন। ভালোবাসা ছাড়া কেউ বাঁচতে পারে না।
— সেটা আমি বুঝব তোমার না ভাবলেও চলবে। নিজেকে নিয়ে ভাবো তোমার কি হবে।
অবন্তিকা চেয়েছে কিছুদিন পরে যেতে কিন্তু ওর বাবা চায় না এখানে থাকুক। অনেকটা বাধ্য হয়ে অবন্তিকা কে বাবার সাথে চলে যেতে হচ্ছে। যাওয়ার আগে সাইমুন কে বলল,,
— আমি চলে যাচ্ছি। একটা কথা বলব নিজের ভালোবাসা কে হারাতে দিয়েন না। আমি জানি আপনি মুনতাহা আপুকে খুব ভালোবাসেন মুনতাহা আপুও আপনাকে ভালোবাসে। আপুর সাথে যা হয়েছে খুব খারাপ হয়েছে। আপনার ডাকে আপু ঠিক সাড়া দিবে।
— আমি ওকে খুব ভালোবাসি। তখন পরিস্থিতির চাপে পড়ে ভুল করেছি। কিন্তু এখন আমি মুনতাহার সামনে যেতে চাই না।
ওর কাছে গেলে আমি আবার স্বার্থপর হয়ে যাব। তখন ভাববে আমার সমস্যা আছে বলে ওকে ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছি। আমি আর অপরাধী হতে চাই না। যে অপরাধ জীবনে করেছি সেটার ভার বহন করার সাধ্য আমার নেই।
তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি ভালো থেকো…..
.
.
মুনতাহার সবকিছু ভালো ভাবে চললেও কেন জানি মনে শান্তি পাচ্ছে না যতই বাহির থেকে সুখে থাকার চেষ্টা করুক মুনতাহা সুখে নেই। যখন তখন সাইমুনের কথা মনে করে চোখের কোণে জল আসেন দিন টা ব্যাস্ততার সাথে কাটলেও রাত টা কাটতে চায় না। সকল মন খারাপ একসাথে বাসা বাঁধে। রাত যত গভীর হয় সাইমুনের স্মৃতি গুলো মুনতাহা কে ঘুমাতে দেয় না৷
রাশেদ চেষ্টা করছে সব সময় মুনতাহা কে হাসি খুশি রাখতে। রাশেদ বুঝাচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব অতীত থেকে নিজেকে বের করে নিতে। অফিস শেষে রাশেদ মুনতাহা কে উকিলের কাছে নিতে চাচ্ছে। মুনতাহার হাত ধরে,,
— দেখো মুনতাহা আর সময় না নিয়ে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেয়া দরকার। যত দেরি হবে তোমার মন খারাপের সময় বেড়ে যাবে। আজ হোক কাল হোক ডিভোর্স তোমাকে দিতে হবে।
— হুম জানি। কিন্তু মন যে মানে না। শত হলেও আমি সাইমুন কে একটাসময় ভালোবেসেছি। ও কিভাবে পারলো আমার সাথে এটা করতে।
— কষ্ট হলেও নিজেকে শক্ত করে ডিভোর্স টা তোমাকে দিতেই হবে।
— হুম চলো। আমি আর এ মিথ্যা সম্পর্কের বাধঁনে থাকতে চাই না।
.
.
রাহি সিদ্ধান্ত নিয়েছে অনেক কেঁদেছে আর না এবার তারেকের সাথে দেখা করে সব ক্লিয়ার করতে হবে।
কষ্ট টা তখন বেশি লাগে যখন শেয়ার করার মত কেউ থাকে না। আজ মুনতাহার কথা খুব মনে পড়ছে। মুনতাহা রাহি কে বোনের মত আগলে রেখেছিলো। মুনতাহা থাকলে সঠিক পরামর্শ দিতো।
রাহি ভাবছে আগে সিউর হতে হবে ও প্রেগন্যান্ট কিনা। বাজার থেকে বোরকা পরে লুকিয়ে প্রেগ্ন্যাসির কিট কিনে এনেছে যাতে কেউ চিনতে না পারে।
টেস্ট করতে গিয়ে রাহির শরীর ঘেমে যাচ্ছে। ভয়ে টেনশনে হাত পা কাঁপছে।
যখন দেখেছে প্রেগ্ন্যাসি পজেটিভ। রাহি নিজের মধ্যে নেই। এ মুহুর্তে তারেক ছাড়া কেউ ওকে হেল্প করতে পারবে না। বিয়ের কথা কেউ জানে না এর মধ্যে প্রেগন্যান্ট হলে লোক সমাজে মুখ দেখাবে কিভাবে!!
প্রতিটি মেয়ের জন্য মা হওয়া সুখকর অনূভুতি। কিন্তু রাহির কোন অনুভূতি কাজ করছে না। মা হওয়া টা তার কাছে বিপদ মনে হচ্ছে।
কেউ মা হওয়ার জন্য কত কিছু না করে, কারো সংসার টিকে না। আর কেউ মা হওয়াকে অভিশপ্ত মনে করে পৃথিবীতে আসার আগে শেষ করে দেয়।
তারেক কে না বলে ওর অফিসের সামনে গিয়ে রাহি অপেক্ষা করছে কখন তারেক বের হবে।
কি হয়েছে তারেকের?? ও তো কখনো এমন করে না। তারেক কি চায় না আমাদের সম্পর্ক টা থাকুক। কিন্তু আমরা তো বিয়ে করেছি সেটা কি ওর মাথায় নেই। না না আমার এত বড় সর্বনাশ তারেক কিছুতেই করতে পারে না। আমি ওর আইনসম্মত বউ আমাকে এভাবে ছেড়ে যেতে পারে না।
রাহি চোখ থেকে অনবরত পানি পড়ছে।
তারেক অফিস থেকে বের হয়ে আচমকা রাহিকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে চোখ মুখ কালো করে রাহির কাছে আসলো….
.
…..চলবে……