পরিণয়ে পরিণতি

পরিণয়ে পরিণতি !! Part- 17

রাশেদের সাথে মুনতাহা কে দেখে সাইমুনের মনে রাগ অভিমান অভিযোগ সব এক সাথে দানা বেঁধেছে। সাইমুন না চাইতেও হাজারো অভিমান জড়ো হয়ে সাইমুনের মনে হামলা করছে।
আবার মুনতাহার হাসি মাখা মুখ দেখে ভালো ও,লাগছে,,
কতদিন পরে মুনতাহা কে প্রাণ খুলে হাসতে দেখছে। থাকুক না মেয়েটা সুখে। অনেক তো কাঁদলো এখন না হয় একটু সুখে থাকুক।
সাইমুন চাইছে না হিংসা করতে তারপরে মনে অজস্র হিংসা উঁকি দিচ্ছে। নিজের ভালোবাসা কে অন্য কারো সাথে দেখলে বোধয় সবার হিংসে হয়। অবচেতন মন চায় পাশের মানুষ টি কে খুন করে বুকের জ্বলন্ত আগুন নিভিয়ে দিতে।
আচ্ছা আমার এত কষ্ট হচ্ছে কেন?? মুনতাহা সুখে আছে বলে নাকি আমাকে ছাড়া অন্য কারো সাথে আছে বলে।
এ কষ্ট কাউকে বুঝানো যায় না শুধু ভিতরটা পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
সাইমুন আজ বুঝছে ভালোবাসার মানুষকে ভাগ করার যন্ত্রণা কেমন!! নিজের ভালোবাসা হারানোর সময় তো মুনতাহার আত্মচিৎকার কেউ শুনতে পাইনি তাই আজ সাইমুনের ভিতরের
আত্ম নার্দ হাহাকার শুনার মত কেউ নেই। অই যে যতক্ষন না ভুক্তভোগীর জায়গায় নিজে না যায় ততক্ষণ কারো বুঝার সাধ্য নেই কষ্টের ভার কতটা ভারি হয়।
আল্লাহ ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে সব পরিশোধ করে দেয়। আমরা মানুষ রা অধম বলে বুঝিনা কেন আমাদের জীবনে এসব ঘটছে।
মানুষ মাত্রই এমন যতক্ষণ নিজের থাকে যত্ন করে না দূরে চলে গেলে সব আন্তরিকতা ভালোবাসা উপচে পড়ে। প্রথম ভালোবাসা নাকি জীবনে অমর থেকে যায়। সেখান থেকে পাওয়া সুখ দুঃখ কিছুই ভুলে না।
সাইমুন আর এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না। বাইরে প্রচন্ড বৃস্টি সেদিকে সাইমুনের খেয়াল নেই। রাস্তায় একা হাটছে কোথায় যাবে গন্তব্য জানা নেই। কিছুক্ষণ পর পর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে বজ্রপাত হচ্ছে। আশেপাশের সবাই দোকানের নিচে বিল্ডিং এর নিচে আশ্রয় নিচ্ছে।
চোখের জল বৃস্টির জল মিলেমিশে একাকার। আকাশ যেন সাইমুন কে আগাম সমবেদনা জানাচ্ছে।
বৃস্টিতে সাইমুন কাক ভেজা হয়ে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ডাঃ রাহাত সাইমুন কে দেখে কয়েকবার ডেকে উঠলো,,
— সাইমুন সাহেব…
আপনি এখানে?? এভাবে ভিজছেব কেন?? আসুন চেম্বারে এসে বসবেন
ডাঃ৷ রাহাতের জোরাজুরিতে সাইমুন চেম্বারে যেতে রাজি হলো। ফ্রেশ হয়ে বসার পর,,
— কি খবর আপনার কেমন চলছে দিনকাল।
— চলছে কোনরকম।
— আপনাকে এত বিমর্ষ দেখাচ্ছে কেন??
— ও কিছুনা আজ তাহলে আসি অন্য দিন আসব ।
— বসুন গরম গরম চা খেতে খেতে গল্প করি।
আপনার ট্রিটমেন্ট কোথা থেকে নিচ্ছেন।
— কিসের ট্রিটমেন্ট??
— মিসেস মুনতাহা রিপোর্টের ব্যাপারে কিছু বলেনি!!
— না আমাকে তো এ নিয়ে কিছু বলেনি।
সিরিয়াস কিছু??
— অইদিন কোন একটা সমস্যার জন্য আপনাদের রিপোর্ট অন্য একজনের রিপোর্টের সাথে এক্সচেঞ্জ হয়ে গেছে। পরে দেখলাম…….
— ডাঃ রাহাত চুপ করে থাকবেন না প্লিজ বলুন।।
— আপনি নিজেকে শক্ত করুন। আসলে সমস্যা টা আপনার মিসেস মুনতাহার না। তবে চিন্তিত হবার কারণ নেই উপযুক্ত চিকিৎসা নিলে আপনি বাবা হতে পারবেন।
ডাঃ রাহাতের কথা শুনে সাইমুন কিভাবে রিয়েক্ট করবে বুঝতে পারছে না। বুঝার কথা ও না। এ রিপোর্ট এর জন্য যে তার জীবনের সকল রং হারিয়ে গেছে।
— ডাঃ রাহাত এত্ত বড় ভুল কিভাবে করলেন!! আপনাদের ভুলের জন্য আমাকে সারাজীবন মাশুল দিতে হবে। এখন কি করব!!
— কি হয়েছে মিঃ সাইমুন। আপনি একটু শান্ত হোন তেমন বড় সমস্যা না ঠিক হয়ে যাবে।
— কিচ্ছু ঠিক হবে না কিচ্ছু না৷ আমার সব শেষ।
সাইমুন পাগলের মত ডাঃ রাহাতের চেম্বার থেকে বেরিয়ে পড়লো। হাঁটতে গিয়ে কখনো রিক্সার সামনে পড়ছে কখনো রাস্তায় ব্যাস্ত মানুষদের সাথে ধাক্কা খাচ্ছে। ধ্যান মস্তিষ্ক কিছুই সাইমুনের নিয়ন্ত্রনে নেই।
নিজে নিজে কথা বলেই যাচ্ছে,,
এ আমি কি করলাম। নিজের হাতে সাজানো পৃথিবী শেষ করে দিলাম। এখন কি করব। মুনতাহা কেন বললে না। এত বড় শাস্তি দিলে আমায়। একসাথে কত গুলো জীবন নষ্ট হয়ে গেলো।।
মানুষ তার কৃতকর্ম ভুলে গেলেও আল্লাহ শাস্তির মাধ্যমে সেটা বুঝিয়ে দেয়। যদি সাইমুন আর একটু অপেক্ষা করত চিকিৎসা করার চেষ্টা করত তাহলে এ দিন দেখতে হত না। জীবনে কোন বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত তাড়াহুড়ো করা ঠিক না।
একটা ভুল সিদ্ধান্ত জীবন নাড়িয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।
.
.
সাইমুন মা কে গিয়ে কান্না করে বলছে,,
— কি করলে মা!! আমার জীবন টাতো শেষ হয়ে গেলো।
সাইমুনের মা ভয়ে আতংকে কেঁপে উঠলেন ছেলের কান্না দেখে।।
— কি হয়েছে তোর কাঁদছিস কেন??
— মা মুনতাহা মা মুনতাহা
— মুনতাহার কি হয়েছে!!
— মা সমস্যা মুনতাহার ছিলো না আমার ছিলো ঠিকমতো চিকিৎসা নিলে মুনতাহা মা হতে পারতো। আল্লাহ আমাদের শাস্তি দিয়েছে। আমাদের লোভ আমাদের ধ্বংস করে দিয়েছে।
— কি বলিস তোরে কে বলছে।।
— ডাক্তারের সাথে আজ দেখা হয়েছিলো তখন বলেছে।
মুনতাহার শাশাশুড়ী ফ্লোরে বসে কপাল চাপড়াতে শুরু করলেন।
আমার সংসারের কি হলো। সব আমার জন্য হয়েছে আমি আমি নাতি নাতনীর জন্য অন্ধ হয়ে গিয়েছি। মুনতাহার কষ্ট বুঝতে চাইনি। মুনতাহার অভিশাপ পড়েছে বুঝলি। আমাদের পাপের শাস্তি আমাদের ভোগ করতে হবে। স্বার্থপর রা কখনো সুখী হয় না।
আড়ালে থেকে দাঁড়িয়ে অবন্তিকা সব শুনছে।
আমি যা ভেবেছিলাম সেটাই সত্যি। মুনতাহা আপু সাইমুনের প্রথম বউ। কত কষ্ট নিয়ে আপু এ সংসার ছেড়ে চলে গেছে।
অবন্তিকা সামনে এসে বলছে,,
— আপনাদের সাথে এমন টাই হওয়া উচিত। মুনতাহা আপু আমার সাথে কথা বলেছে বলে যা নয় তা শুনাইছেন। আপনারা কি মানুষ। একটা মেয়ের বাচ্চা হবে না শুনে নাচতে নাচতে ছেলেকে বিয়ে করালেন। আপনি কিভাবে পারলেন আপনি নিজেও তো একটা মেয়ে। একটা মেয়ে হয়ে অন্য মেয়ের কষ্ট বুঝলেন না।
— মা অবন্তিকা কি বলছে এসব!! । তোমরা মুনতাহা কে কি বলেছ।
— আপনার মা আর বোন মিলে সারাদিন রাত অপমান করেছে। আর আপনি বা মুনতাহা আপুকে কেমন ভালোবাসেন বাচ্চা হবে না শুনে মায়ের কথায় নেচে নেচে বিয়ে করলেন। বাচ্চা দেয়ার মালিক আল্লাহ। এখানে কি কারো হাত আছে।
— প্লিজ চুপ করো আমি আর পারছিনা সত্যি পারছিনা।
–সব জেনেশুনে আমাকে কেন বিয়ে করালেন বাচ্চার জন্য!! আপনাদের পরিবারে একটা বাচ্চা কি শিখবে কিভাবে অন্য কে তিল তিল করে অপমান করে শেষ করে দিতে হয় সেটা ।
— প্লিজ অবন্তিকা চুপ কর। সব যেহেতু জেনে গেছ তোমার বাবা কে খবর দাও। তোমার জীবন টা কেন আমার জন্য নষ্ট করবে।
— হুম তাই করব এই নরকে থাকার ইচ্ছে নেই। কালকে বাবা কে আসতে বলব।।
সাইমুন একদিকে পড়ে আছে সাইমুনের মা একদিকে বসে কান্না করছে।। রাহি সব শুনে চুপ করে চোখের জল ফেলছে। আজকের দিনের জন্য রাহি কম দায়ী না। মুনতাহা তো বোনের মত আদর ভালোবাসা দিয়েছিলো কিন্তু রাহি…
পুরো বাসায় থমথমে পরিবেশ। অবন্তিকার একদিকে খুশি লাগছে আহানাফ এর কাছে যাওয়ার সময় চলে এসেছে। অন্য দিকে মুনতাহার জন্য কষ্ট লাগছে আবার সাইমুনের জন্যও খারাপ লাগছে।
সাইমুন সত্যি মুনতাহা আপু কে ভালোবাসে। সেজন্য সব সময় একটা চাপা কষ্ট বুকের বয়ে বেড়াতো। আমাকে যে মনের বিরুদ্ধে বিয়ে করেছে সেটা সাইমুনের আচরণ বলে দিতো।

.
মুনতাহার সব কথা শুনার পরে রাশেদের মুনতাহার প্রতি সম্মান আন্তরিকতা বেড়ে গেলো। একটা মেয়ে কত কিছু না সহ্য করে ভালোবাসার মানুষের জন্য। নিজের চোখের সামনে স্বামীর আরেক বিয়ে কয়টা মেয়ে মেনে নিতে পারে।
এমন অনেক মেয়ে আছে স্বামী মারা যাবার পরে ফুটন্ত যৌবন সামনে রেখে বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে শুধু স্বামীর স্মৃতি বুকে আগলে ধরে সারাজীবন কাটিয়ে দেয়।
এমন স্বামী খুঁজে পাওয়া দুস্কর বউ মরে যাবার পর বিয়ে না করে বউয়ের বউয়ের সাথে কাটানো স্মৃতি মনে করে বেঁচে আছে।
অনেক পুরুষ এতটাই নিষ্ঠুর হয় ৪০ দিন পার আগের বিয়ে করে নতুন বউ নিয়ে আনন্দের জোয়ারে ভাসে। তাদের দেখে মনে হয় না কখনো কাউকে ভালোবেসেছে।
কিছু পুরুষ কখনো বউয়ের অর্ধাঙ্গ হয়ে উঠতে পারে না।
রাশেদ মনের অজান্তেই মুনতাহা কে পছন্দ করতে শুরু করেছে। যত বেশি সময় মুনতাহার সাথে কাটাচ্ছে মুনতাহার প্রতি ঝুঁকে যাচ্ছে। মুনতাহা কে বলার মত সাহস পাচ্ছে না। যদি মুনতাহা ভাবে ওর অসহায়ত্বের সুযোগ নিচ্ছে। রাশেদ মুনতাহা কে আর কোন কষ্ট দিতে চায় না।
.
.
অবন্তিকা ভাবছে এ মুহুর্তে বাড়ির যে পরিবেশ একা রেখে চলে গেলে ওদের মত স্বার্থপর হয়ে যাবে। তাই বাবা কেও কিছু জানায়নি। কয়েকদিন পরে এমনি চলে যেতে হবে অবন্তিকার পক্ষে তো এখানে থাকা সম্ভব না।
অবন্তিকা মুনতাহার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে কিন্তু মুনতাহা নাম্বার চেঞ্জ করাতে সেটা হয়ে উঠেনি।
.
.
ইদানীং রাহি বেশ চুপচাপ হয়ে গেছে। কারণে অকারণে চোখে জলের আভাস দেখা যায়। অবন্তিকা কয়েক বার জানতে চেয়েছে কিন্তু রাহি কিছু বলতে চায়নি।
রাহি নিজের ভিতর নিজে শেষ হয়ে যাচ্ছে। কাউকে বলতে পারছেনা তার সাথে কি হচ্ছে। খুব ইচ্ছে করছে কলিজা ফেঁটে কান্না করতে কিন্তু কাঁদার জায়গা নেই।। চোখের নিচের কালি ফুটে উঠেছে রাহির চেহারায়। রাহি কত রাত ঘুমায় না নিজেও জানেনা…..
……চলবে……