পরিণয়ে পরিণতি

পরিণয়ে পরিণতি !! Part- 15

রাশেদের সাথে কথা বলে মুনতাহার নিজেকে হালকা লাগছে। যেন কোথাও থেকে আশার আলো খুঁজে পেয়েছে। সত্যি জীবনে অনেক সময় বন্ধু বান্ধবরা ভরসার মাধ্যম হয়ে উঠে। একজন ভালো বন্ধু পাশে থাকলে যে কোন কঠিন সময় নিমিষেই পার করা যায়।
মুনতাহার ভাবী এগিয়ে এসে বিরক্তি নিয়ে বলছে,,
— কিছু কি ভেবেছ?? কয়দিন এখানে থাকবা।
— আমি আসছি কয়দিন হইছে ভাবী?? তুমি কি আমি আসছি বলে শান্তিতে ঘুমাতে পারছ না।
— বেশি থেকে মজা পেয়ে গেলে পরে আর যাইতে চাইবা না আমি কি জানিনা । নাকি এখানে থেকে যাওয়ার মতলবে আছ??
— আমাদের মত সাধারণ মানুষরা মতলব নিয়ে ঘুরি না। এত হিসেবনিকেশ নেই আমাদের জীবনে।
— তোমাদের গন্ডারের চামড়া। এত কথা বলি তাও ভাতের মত হজম করে নাও।
— ভাবী তোমার এত সুন্দর কথা হজম করার সাধ্য খুব কম মানুষের আছে!
— কি বলতে চাও আমি খারাপ করে কথা বলি??
— না না মোটেও খারাপ করে বল না। তোমার কথার মুগ্ধতা চারদিকে চড়িয়ে পড়েছে।
— আমাকে খোঁচা দিলে??
— খোঁচা মারা সবার কাম্য না। এটা আবার সবার সাথে যায় না। মানুষ বুঝে যায়।
মুনতাহার কথা শুনে ওর ভাবী চিৎকার শুরু করলো,,
— তোমার তো সাহস কম না। শুনেছি নিজের কমতি থাকলে মানুষ নিশ্চুপ থাকে। তোমার তো দেখছি ডানা গজিয়েছে।
— কে বলেছে আমার কমতি আছে। কমতি দেয়ার মালিক আল্লাহ আবার দুহাত ভরে দেয়ার মালিক ও আল্লাহ। কমতি তো তাদের মধ্যে আছে যাদের সুন্দর মনের বড়ই অভাব। আসলে প্রকৃত অর্থে তারা অভাগী। তাদের জন্য আমার খুব আফসোস হয় মনে এত দূগন্ধ নিয়ে বাঁচে কেমনে!!
মুনতাহার মা মুনতাহা কে থামানোর চেষ্টা করছে।
— বাদ দে তোর ভাবী কে চিনিস না। তিল কে তাল করার স্বভাব।
— না মা জীবনে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছি আর না। এদের না বললে এরা দিন দিন আরো শুনাবে। মাঝেমধ্যে বলা দরকার।
মুনতাহা ভাবী মুনতাহা ভাই কে ডেকে বলছে,,
অই শুনছ কই গেলা?? তোমার বোন নিজের সংসার টা শেষ আমার সংসার শেষ করতে আসছে। এবার বুঝছ তো ওরা কেন ছেলের আরেক বিয়ে করিয়েছে। শুধু সন্তানের জন্য না তোমার বোনের স্বভাব চরিত্র ঠিক নাই। এখন বিশ্বাস করছ তো আমার কথা।
— আহা ভাবী আগে নিজের স্বভাব টা ঠিক কর। আমার ভাইয়ের কান টা তো তালা মেরে রাখছ??
মুনতাহার ভাবী জামাইর দিকে তাকিয়ে বলছে,,
— এখন ও চুপ করে থাকবে!! তোমার মা, বোন তোমার সমানে আমাকে অপমান করছে আর তুমি কিছুই বলছ না।
মুনতাহার ভাই খুব একটা খারাপ ছিলো না। কিন্তু মুনতাহার ভাবী সারাক্ষণ কানের সামনে ওদের নামে বদনাম করতে করতে ভালো মন টা মেরে ফেলেছে। একটা সময় গিয়ে বউয়ের সব কথা সঠিক ভেবে নেয়। মনের মধ্যে যতটুকু ভালোবাসা টান ছিলো সব টা হিংসায় পরিণত হয়ে যায়।
যে কোন মানুষের সামনে সব সময় বদনাম করতে থাকলে একটা না একটা সময় সে বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়।
মরনতাহার ভাই গরম হয়ে বলছে,,
— মুনতাহা কার সাথে কথা বলছিস জানিস তো। তোর সম্পর্কে কিন্তু বড় হয়। সম্মান দিয়ে কথা বল।
— ভাইয়া আমার টা শুধু দেখলে!! ভাবী যে সারাক্ষণ আমাকে, মা কে যাতা শুনায় সেগুলো তোমার গায়ে লাগে না। তুমি তো এমন ছিলে না কিভাবে বদলে গেলে। চোখ কান খুলে চারদিক টা দেখে ভালো মন্দের তফাৎ টা বুঝার চেষ্টা কর । সময় থাকতে বিবেকবুদ্ধি কাজে লাগাও নাহয় একসময় পঁচে যাবে।
মুনতাহার কথা শুনে মুনতাহার ভাই অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। মুনতাহার ভাবী কিছু বুঝে উঠার আগে জামাইকে ধরে ন্যাকি কান্না করে বলছে,,
— দেখছ এই বাসায় কেউ দেখতে পারে না। আমি থাকবো না। তোমার বোন সেই কখন থেকে যা নয় তা বলছে। আমি আজকে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।
মুনতাহার ভাই বউয়ের হাত ধরে বলছে,,
— আরে পপি তুমি কেন যাবে। তুমি মন খারাপ কর না।
মুনতাহা থাকছিস যেহেতু তোর ভাবী যা বলে চুপ করে শুনে থাক অকারণে ঝামেলা করবিনা।
— বুঝেছি ভাইয়া। তোমাকে বলা আর গাছের সামনে বলা একি কথা।
এর মধ্যে মুনতাহার ভাইয়ের ছেলে হুমাম এসে বলছে,,
— ফুফি খুব ভালো। তোমারা কেন আমার ফুফি কে বকছ??
মুনতাহার ভাবী ছেলের মুখ চেপে ধরে,,
— হুমাম তুমি ছোট মানুষ যাও রুমে গিয়ে পড়তে বসো।
— না আমি যাব না তোমরা ঝগড়া কেন করছ??
— বলছিনা এখান থেকে যেতে। নাহয় কানের নিচে দিব একটা।
মুনতাহা আগে এভাবে কথা বলতো না। পরিস্থিতি তাকে বদলাতে বাধ্য করেছে। কিছু মানুষ ভালো কথা সহ্য করতে পারে না।
.
.
মুনতাহা হাঁফিয়ে উঠেছে কতদিন এভাবে চলতে হয় কে জানে। কতক্ষণ এসব শুনে বেঁচে থাকবেম
মুনতাহা ভাবছে কোন চেনা জানা উকিলের কাছে গিয়ে যত দ্রুত সম্ভব ডিভোর্স পেপার রেডি করতে হবে৷ যে সম্পর্কের কোন অস্তিত্ব নেই সেটা বাঁচিয়ে রেখে লাভ কি! মৃত সম্পর্কের পিছুটান জীবনে চলার পথ বন্ধ করে দেয়।
অতীত যত বেশি বর্তমান কে আঘাত করবে বর্তমান ঠিক ততটাই পিছিয়ে পড়ে। যে মানুষ অতীত কে আঁকড়ে ধরে বসে থাকে সে বর্তমান নিয়ে কখনো সুখে থাকতে পারে না৷ অতীতের কষ্টের স্রোত বর্তমান কে ও ভাসিয়ে দিয়ে যায়।
.
.
সারাদিনে মুনতাহার দেখা না পেয়ে অবন্তিকা ওর শাশুড়ী কে জিজ্ঞেস করছে,
— মুনতাহা আপু কোথাও গিয়েছে?? সারাদিনে একবার ও দেখলাম না।
— আসলে বউমা মুনতাহা বাসা ছেড়ে চলে গেছে।
— কেন?? আপনারা আবার কিছু করেছেন?. কই আমি তো জানিনা।
— না কি করব। ও নিজের ইচ্ছেয় চলে গেছে।
— এবার বুঝেছেন আপনারা কত খারাপ। আপনাদের কথা শুনে মুনতাহা আপু চলে গেছেন। অবশ্য ভালোই হয়েছে অনেক দিন আরামে ছিলেন। এবার সারাদিন কাজ করবেন।
মুনতাহার শাশুড়ীর মাথায় বাঁশ পড়েছে। এমনি একদিন কাজ করে অবস্থা খারাপ। কিভাবে সব সামলাবে বুঝতে পারছে না।
অবন্তিকা রাহি কে ডাক দিয়ে বলছে,,
— আমার আদরের ননদিনী কষ্ট করে আমার জন্য এক কাপ চা করে আনো মাথা টা ধরেছে।।
— আমি করব!!
— হুম তুমি করবে নাতো কে করবে। মুনতাহা আপু যেহেতু নেই তোমাকে করতে হবে। শাশুড়ী আম্মা তো সারাদিন কাজ করে কোমরের ১২ টা বাজিয়ে রেখেছে।
” মা এখন কি আমাকে তোমার নতুন বউয়ের কাজ করতে হবে??
– যা না বানিয়ে দে এত কথা বলিস না। আমার শরীর আর চলছে না।
রাহি রাগ করে রান্নাঘরে চা বানাতে চলে গেলো। রাহির মা রুমে গিয়ে শুতেই চোখের জল চিকচিক করছে। সারাদিনের সব ক্লান্তি এসে পড়েছে বিছানায়। হাত পা গুলো নাড়াতে পারছে না।
এই আমি কাকে নিয়ে আসলাম। অবন্তিকার বাবা কে জানিয়ে কোন লাভ হবে না। আমি তো নাতি নাতনীর মুখ দেখব বলে বিয়ে করিয়েছি। কত স্বপ্ন দেখেছি নতুন বউ সংসার টা সুখে সুখে ভরিয়ে দিবে। নাতিদের সাথে ভালো সময় কাটাবো। এখন দেখছি আর বেশিদিন বাঁচবো না। শেষ পর্যন্ত মুনতাহার কথা সত্যি হয়ে যাবে নাতো! সব থেকেও আজ আমার কিছু নেই।
মানুষের জীবন টাই এমন যা চোখের সামনে থাকে না তা পাওয়ায় তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগে। সুখের আশায় নিতান্তই মরিচিকার পিছনে ছুটে৷ কেউ কেউ রাত দিন এক করে সত্য মিথ্যা জলে মিশিয়ে সেটা পাওয়ার জন্য পাগল হয়ে যায়। ভাবে হয়ত এটা পেলে সব সমস্যা মিটে যাবে। কিন্তু যে কাজের নিয়ত ঠিক নেই চলার পথটাই ভুল সেটা কি আর সুখের সন্ধান দিতে পারে!!
.
.
মুনতাহা রাশেদের সাথে দেখা করতে একটা রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। এতদিন পরে দেখা করতে এসে ইতস্ততবোধ করছে। কারো হেল্প চাইতে লজ্জা লাগে যদি সে মানুষ টা কিছু মনে করে। মুনতাহা এমন এক পর্যায়ে আছে লজ্জা পেয়ে পিছিয়ে যাওয়া সম্ভব না।
রেস্টুরেন্টে ঢুকতেই দেখে রাশেদ কোণের একটা টেবিলে বসে অপেক্ষা করছে। মুনতাহা কে দেখে এগিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে,,
— কেমন আছ?? কতদিন পরে দেখা। মাঝেমধ্যে যোগাযোগ তো রাখতে পারো।
— এইতো ভালো। তোমার দিনকাল কেমন যাচ্ছে??
— ভালো। বর কেমন আছে??
— ভালো খুব ভালো আছে অন্য কাউকে নিয়ে।
— মানে??.
— সে অনেক কাহিনী অন্য দিন বলব।
— চুপ করে আছ যে তুমি না কি কথা বলবে আমায়।।
— আসলে তুমি আমার একটা উপকার করলে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।
— এভাবে বলছ কেন। বন্ধুরা থাকে তো বিপদে আপদে পাশে বন্ধুর পাশে দাঁড়ানোর জন্য।
— তোমার জানামতে যদি ভালো জব থাকে আমার কথা একটু বলিও তুমি তো খুব ভালো কোম্পানিতে আছ । আজকাল রেফারেন্স ছাড়া ভালো জব পাওয়া যায় না।
— এ কথা!! এটার জন্য এত লজ্জা পাচ্ছ!! তোমার ভাগ্য ভালো আজ লোক নিয়োগের কথা বলছিলো আমার কোম্পানী তে।
— সত্যি??
— হুম। কাল তোমার সিভি টা নিয়ে চলে আসিও।
মুনতাহা মনে মনে হাজার শুকরিয়া আদায় করছে। আল্লাহ কত সুন্দর করে সব পরিকল্পনা করে রাখে। আমরা মানুষ গুলো অল্পতেই অস্থির হয়ে যাই।

.
বাড়ি ফিরার পর মুনতাহার খুব খুশি লাগছে। মনের মধ্যে আনন্দের বাতাস বইছে। জব টা পেয়ে গেলে জীবনের মোড় কিছুটা হলেও বদলে যাবে। অন্তত কারো কথা শুনে তো আশ্রিতার মত বেঁচে থাকতে হবে না। জীবনে সুখে থাকার মানে টা নিজেকে খুঁজে নিতে হয়।
মুনতাহার মোবাইলে বেশ কিছুক্ষণ রিং হচ্ছে…
এত রাতে আবার কে কল দিলো। বেশি বিরক্তি নিয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে সাইমুন কল করেছে….
……চলবে……