পরিণয়ে পরিণতি !! Part- 02
মুনতাহা গায়ের কাপড় টা ঠিক করে চোখ মুছে নিলো। নিজেকে শক্ত করে দরজার ওপাশ থেকে জবাব দিলো,,
— আসছি মা।
বের হয়ে অসহায় চোখ দুটি সাইমুন কে খুঁজছে। না আসে পাশে কোথাও নেই হয়ত নতুন মেহমান দের সময় দিচ্ছে। দুদিন পর বিয়ে করবে তাদের সাথে কথা না বললে কি হয়!!
মুনতাহার শাশুড়ী মা এত বেশি অস্থিরতা দেখাচ্ছে যেন আগে কোন দিন মেহমান আসে নি। রাগে গজ গজ করে সাইমুনের বোন রাহি কে বলছে,
— তাড়াতাড়ি হাত চালা। ডিমের পুডিং টা ফ্রিজ থেকে বের কর। আমি আর তুই না করলে দেখবি সময় মত কেউ খেতে পারবে না।
— মা বাদ দাও না। এখন এসব কথা থাক। আমার ভাইয়ের বিয়ে আমাকে করতে হবে। আজকাল ভাবীর এসবে মন নেই। ভাবি চায় না ভাইয়ের বিয়ে হোক। ভাবী কে তো ইচ্ছে করে আমরা কষ্ট দিচ্ছি না। ভাবীর ও পরিস্থিতি বুঝা দরকার। বুঝিনা ভাবী কি চায় না এ সংসারে সুখ শান্তি আসুক??
মুনতাহা রাহির কথায় নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। রাহির হাত থেকে কাঁচের প্লেট নিয়ে বলল,,
— রাহি ভেব না বোন। আমি তোমাদের সংসারের সুখ শান্তিতে বাঁধা দিব না। তোমার ভাইয়ার বিয়ের সকল কাজ আমি নিজ হাতে করব।
— দেখ ভাবি আমরা ইচ্ছা করে কেউ তোমস্কে কষ্ট দিচ্ছি না। তুমি তো জানো মায়ের নাতি নাতনীর কত শখ। তার উপর আমাদের এক মাত্র ভাই।
— হুম কেউ আমাকে কষ্ট দিচ্ছে না। আমার কষ্ট গুলো একান্ত আমার নিজের। সেগুলোর ভাগ অন্তত আর কাউকে নিতে হবে না। আমাকে দয়া করে তোমরা থাকতে দিয়েছ এটাই অনেক।
মুনতাহার শাশুড়ী কথার মোড় ঘুরিয়ে বলে,,
অনেক্ষন হয়ে গেছে নাস্তা রেডি হয়নি নতুন মেহমানরা যে কি ভাববে।
— মা আমি করে দিচ্ছি আপনি ড্রয়িং রুমে গিয়ে উনাদের সাথে কথা বলুন।
মুনতাহা রাহির আচরণে আজকাল অবাক হয়। রাহি তো শুধু ওর ননদ না নিজের ছোট বোনের মত ছিলো। বিয়ের পরে কত ভালো সময় কাটিয়েছে রাহির সাথে ভাবতেই মুনতাহার চোখে পানি চলে আসে।
নিজের জন্য কিছু কেনার আগে রাহির জন্য কিনেছে। রাহির কখন কি খেতে ইচ্ছে করে সেটা মুখ ফুটে বলার আগে মুনতাহা তৈরি করে দিয়েছে।
একটা ডাক্তারি রিপোর্ট মুনতাহার জীবন কতখানি বদলে দিলো। বিয়ের পরে সব মেয়ের একটাই স্বপ্ন থাকে তার কোল জুড়ে ফুটফুটে সন্তান আসবে। মা হতে পারবে না সেখানে মুনতাহার তো কোন হাত নেই। মানুষ চাইলে তার সব ইচ্ছে পূর্ণ করতে পারে না। আল্লাহ না দিলে বান্দার পক্ষে কিছু কিছু ইচ্ছা কখনো পূরন করা সম্ভব না।
মুনতাহার এখন ও মনে পড়ে .
বিয়ের দুই দিন পরে হঠাৎ মুনতাহার মাইগ্রেন এর ব্যাথা উঠেছিলো। সাইমুন অফিসের কাজে দেশের বাইরে ছিলো। মুনতাহা কিছুক্ষণ পর পর বমি করছিলো। সারা রাত রাহি মুনতাহার সেবা করেছে। মাথা টিপে দিয়েছে। ঔষধ নিজ হাতে খাওয়াই দিছে। রাত জেগে পাশে বসে ছিলো মুনতাহার কখন কি লাগে সেটা ভেবে।
রাহির জন্য সেদিন থেকে মুনতাহার মনে ভালোবাসা দ্বিগুণ হয়ে গেলো। নিজেকে সেদিন ভাগ্যবতী মনে হয়েছে। কতটা ভাগ্যবতী হলে বোনের মত ননদ কপালে জুটে।।
— রাহি অনেক করেছ আমার জন্য। নিজের আপন বোন হলেও এতটা করত না।
রাহি একটু অভিমান করে সেদিন জবাব দিয়েছিলো,,
— আমি কি শুধু তোমার ননদ আর কিচ্ছু না!! তাহলে মনে মনে এই ভাবো আমাকে নিয়ে।
— দূর পাগলী মেয়ে। তুমি আমার একমাত্র আদরের ছোট বোন। বলতে পারো বোনের চেয়েও বেশি কিছু।
…..
সময়ের সাথে সাথে সম্পর্কের রং কত সহজে বদলে যায়। আজ রাহির মনে আমার জন্য যতটা না ভালোবাসা, সম্মান তার চাইতে বিরক্তি অনেক বেশি। ওর প্রতিটা আচরণ আংগুল দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে এ সংসারে আমার সময় ফুরিয়ে গেছে।
জীবনের সুখের সময় গুলো কেন দ্রুত চলে যায়!!কেন আপম মানুষ গুলো সময়ের সাথে সাথে বদলে যায়। এ দুনিয়াতে কেউ কারো মনের গহীনে প্রবেশ করতে চায় না। সবাই যেন মিথ্যে অভিনয়ের মাঁয়ায় নিজেকে বন্দী করে রেখেছে।
নতুন বউয়ের বাড়ির লোকদের জন্য ভালোই নাস্তা তৈরি করা হয়েছে। যতটুকু করা দরকার তার চাইতে বেশি আয়োজন করেছে। কথায় আছে না বেশি ভালো আপ্যায়ন করলে চোখে লজ্জা চলে আসে। আদর আপ্যায়নের মাধ্যমে তো সম্পর্কের বুনিয়াদ হয়
পর্দার আড়ালে সাইমুন কে দেখা যাচ্ছে। সাইমুন কে দেখে বুঝার উপায় নাই ও এ বিয়েতে খুশি নাকি দুঃখী।
— আমাদের মেয়ে অবন্তিকা হাজারে একটা। কত জনকে দেখালাম মেয়ে আমার কাউকে পছন্দ করে না। আল্লাহর অশেষ রহমতে সাইমুন বাবাজি রে মনে ধরছে।
সাইমুন নাস্তার প্লেট এগিয়ে দিচ্ছে।
আলাপের ফাঁকে অবন্তিকার চাচা মুনতাহার শাশুড়ী মা কে সম্বোধন করে বলে উঠলো,,
— যদি কিছু মনে না করেন একটা ব্যাপার জানাতাম??
— হুম বলেন। আপনারা দুদিন পরে আমার পরম আত্মীয় হবেন আপনাদের মনে যা আছে বলে ফেলুন। আপনারা না বললে কে বলবে।
— আসলে আমাদের মেয়ে কে সাইমুনের আগের বিয়ের ব্যাপারে আমরা কিছুই জানাইনি। আমরা চাই না ও কিছুই জানুক। অবন্তিকা এ বিয়ে নিয়ে অনেক খুশি। তাই আমাদের বলার সাহস হয়নি। আমাদের বড় আদরের মেয়ে।
— আচ্ছা বুঝছি বেয়াই। আপনাকে এ নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমরা ওকে বুঝতে দিব না।
আসলে কি আর বলব বিয়ের কিছুদিন পরে সাইমুনের বউ টা গয়নাগাটি নিয়ে পালিয়ে গেছে। এতে আমার ছেলেটার কি দোষ বলেন। ১০ দিনের বিয়ে কে কি সংসার বলা যায়!! তারপর থেকে ওকে বিয়ে করানোর চেষ্টা করছি অবশেষে রাজি হলো।
— আজকালকার মেয়ে দের বুঝা মুশকিল। তবে আমাদের অবন্তিকা মা আপনাদের নিরাশ করবে না।
— ঠিক বলছেন আমার নতুন বউমার মুখ দেখলেই বুঝা যায় কত মায়াবতী লক্ষীমন্ত। দেখলে মন টা ভরে যায়।
মুনতাহা নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারছে না। কি বলছে এসব ওর শাশুড়ী। এত বড় মিথ্যা কত সুন্দর করে বলে দিচ্ছে।
খারাপ সময় না আসলে আমি কখনো এদের আসল রূপ দেখতে পারতাম না। আর ওরা কেন অবিবাহিত মেয়ে কে এখানে বিয়ে দিতে চাচ্ছে! শুধু কি পছন্দ হয়েছে নাকি এসবের পিছনে অন্য কাহিনী লুকিয়ে আছে।
সত্যি মানুষ স্বার্থের জন্য কি না পারে। সব শুনেও সাইমুন শান্ত ছেলের মত বসে আছে। ওর শান্ত হয়ে বসে থাকা প্রমাণ করে দিচ্ছে ও কি আসলে চায়। কখনো ভাবিনি এ দিন আমাকে দেখতে হবে।
এ আমি কোন সাইমুন কে আবিষ্কার করছি। যাকে নিজের জীবনের চাইতে বেশি ভালোবেসেছি সে কি ও। যে আমার স্বপ্নে বসবাস করত। যে সাইমুন আমি একটু উহু করলে নিজে ব্যাথা পেত!! আপন মানুষের বদলে যাওয়া রূপ সত্যি ভীষণ ভয়ংকর!! কাউকে তিলে তিলে শেষ করার জন্য এটুকু যথেষ্ট।
মুনতাহা মিথ্যা নাটক টা আর নিতে পারছে না। রাহির দিকে তাকাতে রাহি মুখ লুকিয়ে কিছু না শুনার ভান ধরে চলে গেলো।
মুনতাহা রুমে গিয়ে ২ টা ঘুমের ঔষধ খেয়ে বালিশে হেলান দিয়ে বসে থাকলো কিছুক্ষণ । না ঘুম কোনভাবে আসছে না। ঘুম ও তাকে পর করে পালিয়ে গেছে। রাত যত গভীর হয় কষ্ট গুলো ডানা মেলে মনে আকাশে উড়ে বেড়ায়…
রাত ১ টার দিকে সাইমুন রুমে আসলো। পায়ের আওয়াজে বুঝে গেছে সাইমুন আসছে। কত চেনা শব্দ….
মুনতাহা বুঝতে পেরেও ঘুমের ভান ধরে শুয়ে আছে। সাইমুন কোন কথা না বলে বাচ্চাদের মত গুটিসুটি মেরে পাশে শুয়ে পড়লো ।
শোয়ার সাথে সাথেই সাইমুনের চোখে রাজ্যের ঘুম। তখন ও মুনতাহার চোখে ঘুমের আনাগোনা নেই। চোখের পানি ঘাড় বেয়ে পড়ে বালিশ ভিজে যাচ্ছে অথচ সাইমুন বলতেই পারবেনা তার পাশে শুয়ে থাকা মানুষটির মনে তুফান বয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ ঘুমের ঘোরে সাইমুনের হাত মুনতাহার বুকের উপর চলে গেলো………..
চলবে…