নীরবতা

নীরবতা !! Part- 33

সন্ধ্যা পেড়িয়ে রাত নেমে এসেছে। সূর্য অস্তের সাথেসাথে অনাও ধীরেধীরে অস্ত হয়ে গেছে সকলের জীবন থেকে। পৃথিবীর সকল দুঃখকষ্টকে তুচ্ছ করে সে হারিয়ে গেছে দূর ওই বিশাল আকাশে। যেখান থেকে চাইলেও আর কখনোই ফিরতে পারবে না তাদের মাঝে। কেনো করলো অনা এমনটা? এই ছিল তার ভালোবাসা? কেনো একটিবার তাকে জানালো না তার মনের কথাগুলো? অঝোর ধারায় চোখের কোণা বেয়ে অশ্রু গড়াতেই বালিশে মুখ ডুবালো চৈতালি। কষ্ট হচ্ছে তার। বুকের ভেতরটা বারবার মুচড়ে উঠছে। বারবার কানে ভেসে আসছে অনার বলা একেকটি কথা।
-“খাইতে আয় চৈতালি।”
শেফালী বেগমের ডাক শুনে উঠে বসলো চৈতালি। চোখজোড়া মুছে ভাঙা গলায় বললো,
-“অনার মাটি হয়ে গেছে?”
-“হইছে। তোর আব্বা জানাজা করে মাত্রই আইলো।”
-“অহ..”
কষ্টগুলো দলা পেকে গলায় এসে আঁটকে গেল চৈতালির। ঠোঁট চেপে আবারও বিছানায় শরীর মেলে দিল সে। বুকের ভেতরটা তার হাহাকারে ভরে উঠেছে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে অনার হাসিমাখা মুখের প্রতিচ্ছবি। কী করে অন্ধকার ওই মাটির ঘরে একলা রাত কাটাবে অনা? আর ফিরবে না সে.. কখনোই ফিরবে না। তাকে চিতৈ পিঠা বলে ঢাকবে না। তার সঙ্গে অভিমান করবে না। তার হাতে ব্যাগ চাপিয়ে দিয়ে বলবে না তুই যা, আমি আসছি। কেনো অনা তাকে কিছু না জানিয়েই পালিয়ে গেল? কার সাথেই বা গেল? কে ওকে এইভাবে কষ্ট দিয়ে মারলো? ওরা কি অমানুষ? ওদের ভেতরে কি সামান্য মায়া নেই? যেই মেয়েকে আলতো করে ছুঁয়ে দিলেও চিৎকার করে উঠতো সেই মেয়ে কী করে সহ্য করেছে এত অত্যাচার? খুব কষ্ট হয়েছে তোর? বলনা অনা.. খুব কষ্ট দিয়েছে ওরা তোকে? কেঁদেছিস? চিৎকার করেছিস? তবুও ছাড়েনি ওরা তোকে? তুই কেনো মানুষ চিনলি না? ভুল মানুষের হাত ধরে কেনো তুই ঘরছাড়া হলি? আমি মানতে পারছিনা। আমার বুকের ভেতরটায় প্রচুর কষ্ট হচ্ছে। ফিরে আয়না অনা.. একটিবার ফিরে আয়।
-“এখন কেঁদে কেটে কী হইবো? যখন মেয়েটা চলে গেলো তখন না করতে পারোস নাই?”
অশ্রুসজল চোখে মায়ের দিকে তাকালো চৈতালি। ক্রন্দনরত গলায় বললো,
-“আমি জানলে বারণ করতাম না? মা আমি সত্যিই জানি না। অনা কিচ্ছু জানায়নি আমাকে।”
-“দুই বান্ধবীর গলায় গলায় ভাব। অথচ এই প্রেম পিরিতির কথা ও তোরে বলে নাই এইডা কেউ বিশ্বাস করবো.. বল?”
-“অন্যরা না করলো। কিন্তু আমার কাছের আপন মানুষগুলিই যদি আমায় বিশ্বাস না করে তখন মরে যেতে ইচ্ছে হয় মা।”
মেয়ের পাশে এসে বসলেন শেফালী বেগম। মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বললেন,
-“তুই আর অনা সারারাত দিন এক সাথে থাকছোস। এতে সবার মনে তোরে নিয়ে প্রশ্ন জাগা ভুল কিছু না। আমি তোর মা। তোর আপনজন। তোর কথায় আমার আস্থা থাকলেও ওদের থাকবে না।”
মুবিনের কেনো নেই? মুখে আসা কথা গিলে ফেললো চৈতালি। মুবিন যে পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে তাতে এখন ওকে বুঝিয়েও লাভ হবে না। আর কেউ না জানলেও মুবিন খুব ভালো করেই জানে অনার ঠিক কতটা কাছের মানুষ সে। সেখানে প্রেম বিষয়ক কথা অনা তাকে জানাবে না! সত্যিই এটা মানা যায়না…
-“কত কী বলতেছে পাড়ার মানুষ মেয়েটাকে। চরিত্র খারাপ, যা হইছে ভালো হইছে। বাবামায়ের মুখে যেমন চুনকালি মাইখা ভাইগা যাইতেছিল তেমন প্রেমিক তারে ভইরা দিছে। চরিত্রহীন মেয়ের কপালে চরিত্রহীন ছেলেই জোটে। হ্যান ত্যান নানান কথা। কানে নেয়ার মতো না।”
মায়ের কথার পিঠে দীর্ঘশ্বাস ফেললো চৈতালি। উঠে বসে ধীর গলায় বললো,
-“অনা ওমন মেয়ে না মা। তুমি তো জানো। ও মা তুমিও কি ওদের কথা বিশ্বাস করো?”
-“না.. এসব কথা তোরে বলার একটাই উদ্দেশ্য। পাড়ার মানুষেরা যেমন ওরে নিয়ে বাজে কথা ছড়াইতেছে তেমন তোরে নিয়েও ছড়াইতেছে। তুই নাকি সব জানতি। দুই বান্ধবি একসাথে মিলেই কলেজে যাবার নাম করে নষ্টিফষ্টি করে বেড়াতি। আবার কিছু মানুষ তো বলতেছে তুই-ই অনারে মতলব কইরা মারছোস। এমনকি এইডা অনার মাবাপও বলতেছে।”
কান্নার বেগ ক্রমশ বেড়ে গেলো চৈতালির। মায়ের দু’হাত চেপে ধরে ব্যাকুল সুরে সে বললো,
-“আমি অনারে মারিনি মা। অনা আমাকে কিছুই জানায়নি। ওরা কেনো সবাই এসব বলছে? কেনো ওরা একটিবারও আমাকে অনাকে দেখতে দিল না? ও আমার কী ছিল তা কি কেউ বোঝে না?”
-“তুই আর যাবি না ওদের বাড়িতে চৈতালি। শোন, শান্ত হ। আমার কথা মন দিয়ে শোন।”
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে শান্তনা দিলেন শেফালী বেগম। অনার মৃতদেহ থাকতেই চৈতালিকে যাতা কথা শুনিতে ওই বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে হাজীসাব। অনাকে শেষ দেখাও দেখতে দেয়নি মেয়েটাকে। এতটা পাষাণ কী করে হতে পারে মানুষজন? যেখানে তাদের কাছে ছোটবেলা থেকেই মানুষ হয়েছে চৈতালি! বুকচিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল শেফালী বেগমের। গলার স্বর খানিকটা নরম করে তিনি বললেন,
-“সবুজ আছে না? তোদের সবুজ স্যার? উনি একমাস আগে বিয়ের প্রস্তাব দিয়া পাঠাইছিল। কিন্তু তোর আব্বা তখন সময় নিছিলো। ইন্টারটা দেয়ার পর আগাইতে চাইছিলো। কিন্তু আজ অনারে মাটি দিয়া আসার পর উনি সবুজরে কল দিয়া কাল ওর বাড়ির বড় দুই একজনরে নিয়া আসতে বলছে। চুপেচাপেই আংটি পড়াইয়া রাইখা যাবে। মা, তুই তো দেখতেছিস আশেপাশের অবস্থা। মানুষ যা নয় তাই বলতেছে। অনা মরে গিয়ে বাইচা গেছে। কিন্তু তুই তো বাইচা আছোস। তোর তো একখান জীবন আছে। এসব কথা শুনলে পরের বাড়িতে কেউ তোরে নিব? নিব না। তাছাড়া সবুজ ছেলে খারাপ না। আচার ব্যবহার নাকি খুব ভালো। টাকা পয়সাও আছে।”
মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো চৈতালির। বিস্ময় নিয়ে মায়ের দিকে চাইতেই সে আবারও বলে উঠলেন,
-“যুগ জামানা তো দেখলামই। অনার সাথে ঘইটা যাওয়া ঘটনা সবার মনেই আঘাত করছেরে। এই ঘটনার পর তোর আব্বাও তোরে আর বিশ্বাস করতে পারতেছে না। উনার মনে একটাই ভয়, তুই আবার এমন কিছু ঘটাবি না তো! তার মেয়েকেও অনার মতো হারাতে হবে না তো তার!”
-“তাই বলে বিয়ে? এটা কোনো কথা?”
-“কেন? তোর এতে মত নাই?”
-“না.. কখনোই না। আমি উনাকে মরে গেলেও বিয়ে করবো না। পাগল হয়েছো তোমরা?”
মেয়ের গলার স্বর ক্রমেই উঁচু হচ্ছে দেখে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেন শেফালী বেগম। দরজার দিকে এগুতে এগুতে বললেন,
-“আমি ওসব জানি না। তোর মত না থাকলে তোর আব্বারে তুই বল। তাও ভাইগা যাইস না। অনারে তো দেখলি। ওর থেকেও যদি শিক্ষা না নিতে পারোস তাইলে এইডা আমার লালন পালনের দোষ। খাইতে আয়…”
শেফালী বেগম বেরিয়ে যেতেই উঁচু স্বরে কেঁদে উঠলো চৈতালি। এসব কী হচ্ছে তার সাথে? আব্বা.. সে কী ওর কথা শুনবে? তাছাড়া কী বলেই বা বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবে সে? মুবিনের কথা বলে? যে মুবিন তার চেহারাও দেখতে চায় না! বিছানার চাদর খামচে নিজের কাছে নিয়ে এল চৈতালি। বালিশ ছুঁড়ে ফেললো মেঝেতে। দুই হাটুর মাঝে মাথা গুঁজে দাঁতে দাঁত চেপে অঝোরে কাঁদতে লাগলো। অনা.. তুই কেনো করলি এমনটা আমার সাথে? কেনো তুই এভাবে সকলের চোখে আমাকে দোষী বানিয়ে চলে গেলি? এখন কী করবো আমি, অনা? একটা উপায় অন্তত বলে দে আমায়…
(চলবে)