দৃষ্টির বাহিরে !! লেখাঃ ওয়ারিনা জ্যোতি
দৃষ্টির বাহিরে
বিয়ের প্রথম দিন থেকেই আমার স্বামী আমাকে খুব অত্যাচার করে। কিন্তু আজ সে সব অত্যাচারের সীমা পার করে আমার পেটে ছুরি চালিয়ে দিলো!
আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম! পুরো মেঝেতে রক্তের বন্যা বইছে!
তীর বিদ্ধ হরিনীর মতো আমি নীলের দিকে চেয়ে রইছি। নীল হলো আমার স্বামী।
ও আমার সামনে বসে হাসছে, আর চুপচাপ আমার আর্তনাদ দেখছে যেন! একবারের জন্যেও ওর চোখে আপসোস দেখছি না আমি! আস্তে আস্তে আমার চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছে! মৃত্যু যেন আমাকে গ্রাস করে নিচ্ছে।
(বিঃ দ্রঃ “ দৃষ্টির বাহিরে !! লেখাঃ ওয়ারিনা জ্যোতি ” গল্পের সবগুলো পর্ব একসাথে পেতে এখানে ক্লিক করুন)
তারপর কি ঘটেছে আমার কিছু মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরলো নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করলাম। আমি তো ভেবেছিলাম আমি মারা যাবো কিন্তু কিভাবে বাঁচলাম? সেটা শুধু আল্লাহ জানেন! কিন্তু আমাকে হাসপাতালে কে নিয়ে এলো?
আশেপাশে তো কাউকে দেখছি না!
আমি উঠার চেষ্টা করছিলাম, হঠাৎ একজন নার্স এসে বললেন, কি করছেন ম্যাম? আপনি এখনো পুরোপুরি সুস্থ হোননি, আপনার রেস্টের দরকার।
আচ্ছা একটা কথা জানার ছিলো, আমাকে হাসপাতালে কে নিয়ে আসছে বলতে পারেন??
আপনার স্বামী!
আমার স্বামী! মানে নীল! আমি ভীষন আশ্চর্য হলাম! নীলই তো আমাকে খুন করার চেষ্টা করছে, তাহলে ও কেন আমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসবে?
আমি নার্সকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা আমার স্বামী এখন কোথায়?
আপনার স্বামী জেলে।
জেলে মানে? ও কেন জেলে থাকবে? কি করেছে ও? আর আপনি তো বললেন আমাকে নীল হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। তাহলে?
আপনাকে খুনের চেষ্টার জন্যে !
খুনের চেষ্টা? আপনাকে কে বলল, ও আমাকে খুন করার চেষ্টা করেছেন?
উনি নিজেই বলেছেন, আপনাকে যখন হাসপাতালে নিয়ে আসেন আপনার স্বামী, তখন আপনার এই অবস্থা কিভাবে হয়েছে সেটা না জানলে ভর্তি নিত না হাসপাতালে, এটাই আমাদের হাসপাতালের ফর্মালিটি! আর আপনি যে অবস্থায় এসেছিলেন তাতে তো আমরা সবাই ভেবেছিলাম আপনাকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। আর আপনার স্বামী তখন সবার সামনে বলেছেন উনি আপনাকে খুন করতে চেয়েছিলেন, তারপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পুলিশকে ফোন করে আর উনাকে পুলিশ এসে তাকে নিয়ে যায়!
আচ্ছা নীলকে মানে আমার স্বামীকে কবে পুলিশ নিয়ে গেছে?
১মাস আগে প্রায়! আর ১মাস পর আপনার জ্ঞান ফিরলো আজকে। আপনার অবস্থা খুবই খারাপ ছিলো, তাই জ্ঞান ফিরতে ১মাস লেগে গেছে।
কি? আমি ১মাস ধরে হাসপাতালে আছি আর নীল জেলে?
জ্বী ম্যাম। আপনি এখন রেষ্ট নিন। আর নিজের স্বামীকে নিয়ে টেনশন করবেন না!
আপনাকে একটা কথা বলি ম্যাম কিছু মনে করবেন না। আমার আপনার স্বামী দেখে মোটেও সুবিধার লাগেনি। উনকে দেখে মনে হয় উনি একজন অমানুষ। উনি আপনাকে খুনের চেষ্টা করেছিলেন। যে স্বামী নিজের স্ত্রীকে খুনের চেষ্টা করে তাকে অমানুষই বলে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডিভর্স টা করে নিয়েন। আপনার জন্যেই ভালো।
নার্সের কথাগুলো আমার বিরক্ত লাগছিলো। আমি নীলকে ডিভর্স দিবো না, সে আমাকে খুন করলেও না।
আমি কথা ঘুরানোর জন্যে বললাম,
নার্স আমাকে হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ কবে করা হবে?
ম্যাম আপনি এখনো সুস্থ নন, এখন ২,৩ সপ্তাহ তো লাগবেই। আপনি এখন রেষ্ট নিন। আর একটু পর ডাক্তার এসে আপনাকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে যাবেন।
কথাটা বলেই নার্স চলে গেলেন।
কিন্তু তাহলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। আর নীল ১মাস ধরে কিভাবে আছে কে জানে!! কিন্তু ও যখন আমাকে খুন করার ইচ্ছেই ছিলো তাহলে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে কেন এলো? আর নিজের দোষ কেন স্বীকার করলো?
সপ্তাহখানিক পর আমাকে হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ করা হলো। যদিও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এত তাড়াতাড়ি ডিসচার্জ করত না, আমি জেদ করেই প্রায় হাসপাতাল থেকে চলে এসেছি। এখন আমার নীলকে জেল থেকে বের করতে হবে। নীল হয়ত জেলে অনেক কষ্টে আছে। আর নীলকে বের না করলে আমিও সত্তিটা জানতে পারবো না।
দুপুরে খেয়ে এক উকিলকের সাথে কথা বললাম নীলের ব্যাপারে।
যেহেতু আমি বেঁচে আছি, তাই পুলিশ স্টেশনে গিয়ে নীলকে ছেড়ে দিতে বলায় পুলিশ কেসটা বন্ধ করে দিলো। ২দিন মধ্যে নীলকে পুলিশ ছেড়ে দিলো।
নীল আজই জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে, বাসায় আসার সময় নীল আমার সাথে একটা কথাও বলেনি। বাসায় এসে নিজের রুমে গিয়ে নীল দরজা বন্ধ করে দিলো, আমিও আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না।
আমি বিছানায় শুয়ে আছি শরীরটা বেশ খারাপ লাগছে! হঠাৎ নীল আমার রুমে এসে আমাকে হিচড়ে একটা টান দিলো হাতে।
আচমকা নীলের ব্যবহারে আমি কিছুটা চমকে উঠলাম। তাড়াহুড়ো করে উঠে বললাম, কি হয়েছে? আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম একটু!
নীল কিছু না বলেই একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দিলো আমার গালে।
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম! আমি তো ভেবেছিলাম ওই ঘটনার পর ও শুধরে যাবে কিন্তু!
আমি নীলকে জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে মারলে কেন?
তোকে মারবো না তো কি আদর করবো? তুই জানিস না তোকে আমার সহ্য হয়না?
আর তুই শাড়ি পড়েছিস কেন?
এবার বুঝলাম নীল কেন আমাকে থাপ্পড় মারল! নীল আমাকে কখনো শাড়ি পড়তে দেয় না। আর আজ আমি ভুলে শাড়ি পড়ে ফেলেছি!
কি হলো বল, শাড়ি কেন পড়েছিস?
আমার পেটের ঘা টা তো এখনো শুকায়নি, আর সালোয়ার পড়লে ঔষধ লাগাতে সমস্যা হচ্ছে ক্ষতস্থানে!
মরে তো যাচ্ছিস না! তোর কষ্টে আমার কিছু যায় আছে না। শাড়িটা খোল।
কিন্তু!
কিন্তু আবার কি? তোর কি মনে হয় তুই আমাকে জেল থেকে বের করে এনেছিস জন্যে আমি তোকে ভালোবাসবো? তোর প্রতি দয়া দেখাবো?কখনোই না! তোর জন্যে আমি আমার বাবা মার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত! তোর কারনে আমার বাবা আমাকে বাসা থেকে বের করে দিছে!
এখানে আমার দোষ কোথায়? তোমার জন্যেও তো আমি বাসা ছেড়েছি! আম্মু আব্বু আমাকে সহ্য করতে পারে না! এমনকি আমার বাবা-মার মৃত্যুর সময়ও আমি তাদের দেখতে পাইনি।
তুই এখন আমাকে দোষ দিচ্ছিস? সব দোষ তোর!
বলেই আমাকে প্রচুর মারতে শুরু করলো!
আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, মারারই যখন ছিলো! তখন বাঁচালে কেন হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে? রোজ একটু একটু করে মরার থেকে তো ভালো আমি একবারে মরে যেতাম।
কারন আমি তোকে তিলে তিলে মারবো! বুঝলি? এখন শাড়িটা খুল যা!
কথাটা বলে আমাকে জোড়ে একটা ধাক্কা দিয়ে চলে গেল। আমার হাত খাটের ধারালো অংশে লেগে রক্ত বের হতে লাগল, কিন্তু নীল একবারো ফিরে তাকালো না।
আমি নিজেকে সামলে নিয়ে, শাড়ি খুলে সালোয়ার পড়লাম।
নীলকে আমি চিনি আমাদের বিয়ের দুবছর আগে থেকে। ঠিক চিনি বললে ভুল হবে! কারন আমার সাথে নীলের শুধু একবারই দেখা হয়েছিলো। ওর সাথে আমার প্রথম দেখা হয় হাসপাতালে। আমার বাবার একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিলো, উনাকে রক্ত না দিলে বাঁচানো যেত না! আমি কোথায়ও রক্ত পাচ্ছিলাম না, আমার মা খুব টেনশন করছিলেন। তখন নীল আমার বাবাকে এসে রক্ত দেয়। কিন্তু তখন আমার ওকে এরকম মনে হয়নি! মনে হয়েছিলো ও খুব মিশুক টাইপের ছেলে, সবাইকে আপন করে নিতে পারে কিন্তু এই নীলের সাথে ওর কোনো মিলই নেই। পরিস্থিতি মানুষকে বদলে দেয়! তাই বলে এতটা? আমার ধারণা ছিলো যে মানুষকে রক্ত দিয়ে বাঁচাতে পারে সে অবশ্যই একজন ভালো মানুষ।
আমার আর নীলের বিয়েটা জোর করে দেওয়া হয়। যেদিন আমাদের বিয়েটা হয়েছিলো সেদিন আমি একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম।
আমি যখন সেখানে যাই তখন নীল আমাকে বলে আমার সাথে ওর কিছু জরুরী কথা আছে, আমি যেন ওর সাথে আলাদাভাবে দেখা করি।
কিন্তু কথাটা নীল আমাকে সরাসরি বলেনি। একজন ওয়েটার আমাকে একটা চিরকুট দিয়েছিলেন, সেখানে লেখা ছিলো। আমি ওর সাথে দেখা করতে নীলের কথা মতো রুমে যাই, তারপর হঠাৎ করে আমার মাথাটা ঘুরে যায় আর আমি ফ্লোরে পড়ে যাই, যখন জ্ঞান ফিরে তখন দেখি আমি বিছানায় শুয়ে আছি, আর সব মানুষ আমাকে আর নীলকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে! আমি কিছু বুঝতে পারার আগেই, ওখানে উপস্থিত লোকেরা আমাদের বিয়ে দিয়ে দেয় জোর করে! আমাদের কিছু বলার সুযোগ দেওয়া হয়না। নীলও আমাকে বিয়ে করতে রাজি ছিলো সেটা ওর নিরবতা প্রমান করে দিচ্ছিলো কিন্তু নীলের বাবা আমাদের বিয়েটা মেনে নেন না আর আমার বাবা- মাও নেন নি!
আমার বাবা মা আমাকে বলেন যেন আমি কখনো তাদের সামনে না যাই, তারা মরে গেলেও না। সবাই আমাকে ভুল বুঝছিলো।
তবে নীলকে ওর বাবা বলেছিলো আমাকে যদি ও ডিভর্স দেয় তাহলে ওকে মেনে নিবে কিন্তু নীল এরকম কিছুই করে নি! ও আমাকে ডিভর্স দেয়নি।
উলটে বারবার অত্যাচার করে গেছে প্রত্যেকটা দিন! সেই বিয়ের প্রথম দিন থেকে।
আমাদের বাসর রাতে আমাকে ও নিয়ে যায় ওর একটা বন্ধুর বাসায়! ওখানে আমাদের বাসর ঘর সাজানো হয়। আমি বিছানায় বসে নীলের অপেক্ষা করছিলাম, কিন্তু নীল এসে হঠাৎ করে আমাকে এসে বলল, আমি যেন সোফায় ঘুমাই! আমি কিছু বুঝতেই পারলাম না, উলটে ওকে জিজ্ঞেস করায় আমার গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে বলল, একবার বললে বুঝিস না তুই? আমি সোফায় গিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু ঘুম আসছিলো না, শুধু কান্না পাচ্ছিলো।
তারপর আমরা এই বাসায় আসি। কিন্তু তারপর থেকে প্রতিদিন আমাকে অত্যাচার করে নীল।
আমাদের সম্পর্ক মোটেও কোনো স্বাভাবিক স্বামী স্ত্রীর মতো কখনো ছিলো না।
নীল আমাকে শাড়ি পড়তে দেয়! জানিনা কেনো। মাঝে মাঝে আমাকে স্টোর রুমে আটকে রাখতো অনেক ইঁদুর আর তেলাপোকার মাঝে! বিয়ের ৬মাস এভাবেই কাটে আমার তারপর একদিন আমার পেটে ছুরি চালিয়ে দেয় শুধুমাত্র তরকারিতে লবন বেশি হবার জন্যে! এটা কোনো কারন হতে পারে কি নিজের স্ত্রীকে খুন করার?
কিন্তু তবুও আমি ওকে ভালোবাসি কারন ও আমার স্বামী, তাই এখনো আমি ওকে ছেড়ে যাই নি। ডিভর্স দেবার কথাও ভাবিনি আর নীলও কখন আমাকে ডিভর্স দিতে চায়নি।
আমার বিশ্বাস নীল একদিন আমাকে ভালোবাসবে!
হঠাৎ করে নীল এসে বলল, কি রে এত কি ভাবছিস? তোকে আমার শার্ট গুলো ধুতে বলেছিলাম ধুস নি কেন এখনো? আমি কি পড়বো?
আমি আসলে ভুলে গেছিলাম, এক্ষুনি ধুঁয়ে দিচ্ছি।
আমি নীলের রুম থেকে আলমারি খুলে ওর জামা বের করচ্ছিলাম, হঠাৎ একটা কালো রঙের ডায়রি আমার চোখে পড়লো। ডায়রিটা খুলে পড়তে ইচ্ছে করছে খুব। এটা যদি নীলের ডায়রি হয় তাহলে আমার সব প্রশ্নের উত্তর এখানেই পাবো আমি। তাই ডায়রিটা খুলে পড়া শুরু করব, ঠিক সেই সময় নীল রুমে প্রবেশ করল!
চলবে?