তোকে চাই

তোকে চাই – Season 2 ! Part- 62

– প্রেগনেন্ট মানে? এতো তাড়াতাড়ি? মানে,, আসলে,,, কেমনে কি?
আমি কৌতূহলে সোজা দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না অথচ শুভ্রর মুখ ভাবলেশহীন। উনি শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে আমার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে বলে উঠলেন,
— দেখছো? আমার পরে বিয়ে করে বাচ্চার বাবা হয়ে যাচ্ছে সবাই। আর আমি?
উনার কথায় মেজাজটায় খারাপ হয়ে গেলো আমার৷ আমি কি জিগ্যেস করছি আর উনি বলছেন টা কি? অদ্ভুত! দু তিনবার জোড়ে জোড়ে শ্বাস টেনে নিয়ে নিজেকে শান্ত করে বলে উঠলাম,
— একদম কথা পেঁচাবেন না। যা জিগ্যেস করেছি তার উত্তর দিন। বিয়ে কবে করলেন? আর প্রেগনেন্ট কিভাবে!
উনি অবাক হওয়ার চেষ্টা করে চোখ বড় বড় করে তাকালেন। ঠোঁটের কোণে দুষ্ট হাসি ঝুলিয়ে বলে উঠলেন,
— প্রেগনেন্ট কিভাবে সেটা মুখে কিভাবে বলবো রোদপাখি? তুমি যদি চাও তো..
এটুকু বলতেই বিছানা থেকে বালিশ নিয়ে উনার মুখের উপর ছুঁড়ে মারলাম আমি৷ চোখ রাঙিয়ে বলে উঠলাম,
— চুপপপপ! একদম চুপ। ফালতু কথা না বলে, আসল কথাটা বলুন কবে করলো বিয়ে?
উনি বালিশ হাতে নিয়ে হাসতে হাসতে বিছানায় গিয়ে শুলেন৷ আমার হাতটা টেনে পাশে বসিয়ে মিষ্টি হেসে বলে উঠলেন,
— আগে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে একফালি স্বর্গ এনে দাও আমায়। তারপর বলছি।

আমি ধীরে ধীরে উনার চুলে হাত বুলাতেই চোখদুটো বন্ধ করে নিলেন উনি। আমার দৃষ্টি উনার মুখটাতে স্থির। যতবার উনার দিকে তাকাই ততবারই কেনো জানি বুকটা কেঁপে উঠে খুব। মনে হয় এই বুঝি হারিয়ে ফেললাম৷ এই বুঝি শেষ হলাম আমি! উনি কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থেকে চোখ বন্ধ করেই বলে উঠলেন,
— চিত্রার বিয়ের কিছুদিন পরই বিয়ে করে নিয়েছে ও। প্রায় সাড়ে পাঁচমাস কি ছয়মাস তো হবেই। বউ কেমন দেখতে জানি না। তবে, সাহেল যেহেতু পছন্দ করেছে স্পেশাল কিছু নিশ্চয় আছে। মেয়েটার নাম সরি ভাবির নাম হলো নাবিলা। সাহেল বলেছে, বউ দেখলে নাকি সারপ্রাইজড হয়ে যাবো আমি তাই ছবি পাঠানো চলবে না তাছাড়া, ছবি দেখার ইন্টারেস্টও আমার ছিলো না। আর প্রেগনেন্সির বিষয়টি ওরা প্ল্যানিং করে করে নি। ইউ নো, এক্সিডেন্টলি। তবে সাহেল অনেক হ্যাপি সাথে আমিও হ্যাপি। দু দুটো চ্যাম্প আসছে বলে কথা। আমি তো ডাবল চাচ্চু হয়ে গেলাম রোদু।
কথাটা বলেই উল্টো হয়ে শুয়ে শক্ত করে কোমর জড়িয়ে ধরলেন উনি। পেটে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে উঠলেন,
— তোমার বিশ বছর চলছে তাই না, রোদু? কিছুদিন পর আমাদের ঘরেও ছোট্ট প্রিন্সেস আসবে দেখো। একদম আধো আধো গলায় ‘”বাবা” বলে ডাকবে আমায়। ছোট ছোট হাতে গলা জড়িয়ে ধরবে। এখন তো তোমার এই ছোট্ট পেটে জায়গায় হবে না। আমার প্রিন্সেসের কষ্ট হবে তো। তাই আগে ঝটপট আরেকটু বড় হয়ে নাও…কেমন?
আমি কিছু বললাম না। চুপ করে বসে আছি। মাথায় ঘুরছে সাহেল ভাইয়ের বউয়ের কথা। আচ্ছা দেখতে কেমন হবে মেয়েটা? অনেক সুন্দরী? নাকি মোটামুটি সুন্দরী? অহংকারী ধরনের হবে কি? বিদেশে থাকে নিশ্চয় সবার সাথে কথা বলতেই বিরক্ত হবে সে!! কথাটা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি। উনি পেটে নাক ঘষতে ঘষতে বলে উঠলেন,
— এতো চিন্তা করতে হবে না। ওরা আজকেই আসছে। দু’দিন আমাদের বাড়ি থাকবে তারপর সাহেলদের বাড়ি যাবে। সাহেল তো পার্মানেন্টলি চলে আসছে এবার। এখানেই একটা ব্যবসা শুরু করবে ভাবছে। বিদেশে আর ভালো লাগে না ওর। দেশের মাটির গন্ধটা বড্ড টানে।
কথাগুলো বলে মাথা তুলে তাকিয়েই বলে উঠলেন উনি,
— এই? তুমি ভার্সিটি যাবে না?
— হুম যাবো। কিন্তু আপনি এসময় ফিরলেন কেন?
— এমনি চলে এলাম। ভালো লাগছিলো না। তুমি ভার্সিটি যাও…গো!

পলাশ স্যারের ক্লাসে পাশাপাশি বসে আছি আমি আর চিত্রা। স্যার লেকচার দিচ্ছেন আর আমরা দু’জন ফিসফাস করছি। আমাদের ফিসফাসের প্রধান কারণ হলো সাহেল ভাইয়ার প্রেগনেন্ট বউ।৷ আমরা যখন সাহেল ভাইয়ের অনাগত সন্তানকে নিয়ে ব্যস্ত ঠিক তখনই পলাশ স্যার গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,
— রোদেলা, চিত্রা স্ট্যান্ট আপ!
স্যারের ধমকে ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়ালাম দু’জনেই। স্যার একটু হেসে বলে উঠলেন,
— কি ব্যাপার? আমাদের ভার্সিটির সবচেয়ে স্ট্রিক্ট দুজন স্যারের ওয়াইফরা ক্লাসে বসে গল্প করছে। ডিসিপ্লিন ব্রেক করছে….স্যারদের কি ব্যাপারটা জানানো উচিত?
কথাটা শুনেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো আমার। সামনে রাখা বইটা নিয়ে স্যারের মাথায় বাড়ি দেওয়ার ইচ্ছেটাও প্রবল হয়ে উঠলো মুহূর্তেই। আরে, আমরা কি প্রাইমারি তে পড়ি নাকি যে বাসায় বিচার দিবে? আজব! কিন্তু রাগটাকে প্রশ্রয় না দিয়ে চিত্রার পায়ে জোড়ে একটা পাড়া দিয়ে অসহায় ফেইস নিয়ে বলে উঠলাম,
— এক্চুয়েলি স্যার, চিত্রার প্রচুর পেট ব্যাথা করছে। ভয়ানক ব্যাথা। সেটাই বলছিলো আমাকে। ওকে নিয়ে আমি বাইরে যাই স্যার? প্লিজ?
আমার কথায় চিত্রা অবাক চোখে তাকালো। নিজের পেটে হাত রেখে একবার পেটের দিকে তাকিয়ে মুখ তুলে আমার দিকে তাকালো। তারপর আবারও মুখ ঘুরিয়ে স্যারের দিকে তাকালো সে,
— বলো কি? শিশির স্যারকে ফোন দিতে হবে? দিবো?
— নাহ। একদম না। আই মিন আমাদের কাছে ফোন আছে। আপনি কেন শুধু শুধু কষ্ট করবেন? উই উইল ম্যানেজ স্যার। আসি?
— আচ্ছা, আচ্ছা। জলদি যাও…
— থেংকিউ স্যার।
ক্লাস থেকে বেরিয়ে মাঠের একপাশে বটতলায় বসেই দু’জনে ফিক করে হেসে উঠলাম। হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাই টাইপ অবস্থা। চিত্রা কোনোরকম হাসি থামিয়ে বলে উঠলো,
— আজ নিয়ে চতুর্থ বার পলাশ স্যারকে বোকা বানালাম আমরা। এনিওয়ে সাহেল ভাইয়াকে নিয়ে কি জানি বলছিলি? বিয়ে করেছেন মানে কি? তা নাহয় করলো। বিয়ে করতেই পারেন। আজকাল বিয়ে করাটা কোনো ব্যাপার না। স্বাভাবিক। কিন্তু বাচ্চা!! এটা কেমনে দোস্ত? তোর বিয়ের তো একবছরের বেশি হয়ে গেলো তাও তো বাচ্চার “ব” ও কানে এলো না আর সাহেল ভাইয়া এতো পরে বিয়ে করে সরাসরি বাচ্চা?? মাই গড। বউ দেখতে কেমন রে?
— আমি দেখেছি নাকি?
— দেখিস নি? আমার তো এখনই দেখে ফেলতে ইচ্ছে করছে রে রোদ। কেমন হবে কে জানে?
— আজ সন্ধ্যায় আসছে। চল না আমাদের বাড়ি। দারুন হবে…
আমার কথায় মুখ ফুলালো চিত্রা। মুখটা কালো করে বলে উঠলো,
— যেতে দিবে না আমায়। দিনে হলে সমস্যা নেই বাট সন্ধ্যার পর কোথাও যেতে দেয় না আমায়। শাশুড়ীমাকে যদিও রাজি করাই ও কিছুতেই রাজি হবে না।
— ওওওওওওওওও বাহ ‘ও”? তোরা সব কটায় দেখি সো ফাস্ট। আমি এতোদিনেও উনাকে তুমি করে বলতে পারলাম না। আর তোরা ওগো শুরু করে দিছিস।
চিত্রা আমার কথার উত্তর না দিয়েই নিজের মনে বলে উঠলো,
— শুভ্র ভাইয়া তোকে কিছুতেই মানা করে না। আমার তো ধারনা উনি তোর সব কিছুতেই ‘ওকে, ওকে’ বলতে থাকেন। ভার্সিটির সবাই বলে উনি বিশাল রাগী অথচ তোকে একটা ধমকও দেয় না। অদ্ভুত!
— অদ্ভুতের কি দেখলি?উনি না করতে পারেন এমন কোনো কাজ আমি করিই না তো না করবে কিভাবে? উনাকে ছাড়া কোথাও যেতে আমার নিজেরই ভালো লাগে না। যেখানে যাওয়ার হয় উনাকে বলি উনিই নিয়ে যান সেটা সকাল হোক, দুপুর হোক বা মধ্যরাত। এছাড়া নিষেধ করার আর কিছু আছে নাকি?
— তবুও। তুই মানিস আর না মানিস শুভ্র ভাইয়া তোর সব কথায় মেনে নেন। এব্রিথিং। আমি খেয়াল করে দেখেছি। এজ লাইক, তুই যদি এখন একটু মুখ ফুলিয়ে উনাকে বলিস “ভার্সিটির জব ছেড়ে দেন। মেয়েরা তাকিয়ে থাকে আমার ভালো লাগে না। ” দেখবি কালই রেজিগনেশন লেটার জমা দেওয়া শেষ।৷ আর আমার হাজবেন্ড!! পুরোই উল্টো।
— এসব ফাউল চিন্তা তোর মাথাতেই আসতে পারে চিত্রা। কিন্তু আমা…
এটুকু বলতেই ফোন বেজে উঠলো আমার৷ কে ফোন দিয়েছে দেখার আগেই ফোনটা খপ করে কেড়ে নিলো চিত্রা। ফোনটা রিসিভ করে লাউড স্পিকারে দিয়ে মুখ টিপে হাসলো। আমি ফোনটা নেওয়ার বৃথা চেষ্টা করে রাগী চোখে তাকালাম।
ঠিক তখনই ওপাশ থেকে ভরাট কন্ঠে বলে উঠলেন শুভ্র,
— ক্লাস শেষ হয় নি তোমার রোদ? না শেষ হলেও চলে আসো। ভালো লাগছে না। আমি কি তোমায় নিতে আসবো?
— ন নাহ লাগবে না। আমি আসছি।
— ওকে। তাড়াতাড়ি এসো। মিস করছি।৷ আচ্ছা? কিছু লাগবে তোমার? আমি মার্কেটে আছি তোমার কিছু লাগলে বলো নিয়ে আসি। কিছু খাবে? আইসক্রিম, চকলেট, চিপস বা অন্যকিছু?
আমি কিছু বলার আগেই চিত্রা ফট করে বলে উঠলো,
— আমার জন্যও আনবেন ভাইয়য়য়য়য়য়য়া। চকলেট, চিপস, আইসক্রিমমমমম…(হালকা হেসে)
— আরে, শালি সাহেবা নাকি?তোমার জন্য চকলেট, আইসক্রিম না এনে একগুচ্ছ ঘাস আনবো বুঝলে? প্রতিদিন সেই ঘাসে শিশির জমাবে।
— ধেৎ! এটা কি হলো ভাইয়া? কই ভাবলাম ফোন দিয়ে রোমান্টিক রোমান্টিক কথা বলবেন আমি একটু মজা নিবো তা না উল্টো আমাকেই ফাঁসাচ্ছেন? এনিওয়ে, আপনি তো হেরে গেলেন।
— কি রকম?

— সাহেল ভাই বাচ্চার বাপ হয়ে যাচ্ছেন আর আপনি আগে বিয়ে করেও এখনও নতুন জামাইয়ের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন এসব কিছু হলো?
— আমিও সেটাই ভাবছি৷ চিত্রার শিশির যে অন্যের নদীতে ভেসে গেলো, এসব কিছু হলো?
— মানে কি?(অবাক হয়ে)
— মানে তোমার হাজবেন্ড নীল রঙের শার্ট পড়ে আমার ঠিক সামনে নদী নামের একটা মেয়ের হাত ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ইশশ! কি সাংঘাতিক।
— কিহ! সত্যি? ওকে আমি খুন করবো। ( কাঁদো কাঁদো হয়ে)
কথাটা বলতেই হুহা করে হেসে উঠলেন উনি। হাসিমুখেই বলে উঠলেন,
— মজা করছিলাম রে বাবা। বরের প্রতি বিশ্বাস নাই? আমার বউয়ের আন্সার কিন্তু অন্যরকম হতো।এনিওয়ে, রাখছি শালিকা। আমার বউটাকে একটু সেইফলি বাসায় পৌঁছে দিও। একটা মাত্র বউ বলে কথা।
কথাটা বলেই ফোনটা কেটে দিলেন উনি। সাথে সাথেই ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি। ওর হাত থেকে ফোনটা নিয়েই বললাম,
— বাই দোস্ত। পেছনে দেখ তোর প্যারা আসছে। ইনজয়….
কথাটা বলে বাম চোখটা টিপে দিয়ে উল্টো রাস্তায় হাঁটা দিলাম আমি। পেছন থেকে কানে এলো শিশির স্যারের উদ্ধিগ্ন কন্ঠস্বর,
— চিত্রা? তোমার পেট ব্যাথা? আমাকে বলো নি কেনো? পলাশ স্যার না বললে তো জানতামই না। বেশি ব্যাথা করছে? চলো ডক্টরের কাছে যাই।
কথাগুলো কানে যেতেই মুচকি হাসলাম আমি।৷আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। আকাশে হালকা সাদা মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে ক্রমাগত। মনটা বলে উঠলো,
— বেঁচে থাকুক ভালোবাসা। পৃথিবীর প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে পড়ুক ভালোবাসার উষ্ণ পরশ। সেই ভালোবাসায় উষ্ণ হয়ে উঠুক আমাদের মানবতা। আবারও শিখি, হিংস্রতাকে দূরে ঠেলে আবারও ভালোবাসতে শিখি আমরা।
🍁
সন্ধ্যা ৭ টা। উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে থাকায় সম্ভব হয়ে উঠছে না আমার। ক্রমাগত পায়চারী করে চলেছি।শুভ্র সোফায় বসে বসে হাসছেন। উনার হাসি দেখে হাঁটা বন্ধ করে চুপ করে দাঁড়ালাম আমি। চোখ রাঙিয়ে উনাকে কিছু বলবো তার আগেই পেছন থেকে ভেসে এলো পরিচিত এক কন্ঠস্বর,
— হেই সানশাইন? কেমন আছো?
#চলবে…