তোকে চাই – Season 2 ! Part- 44
জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি আমি।।আকাশে মস্ত এক চাঁদ ওঠেছে… এই বিশাল চাঁদটাকে বারবার ঢেকে দিচ্ছে এক টুকরো মেঘ।তাদের দেখে মনে হচ্ছে চাঁদের সাথে তারা এক অদ্ভুত লুকোচুরি খেলায় মত্ত হয়েছে।যেমন খেলায় মত্ত হয়েছে শুভ্র।।আজ দু’দিন হতে চললো উনি চট্টগ্রামে আছেন।।প্রতিদিন তিনবার ফোন করেন আমায়….সকাল,দুপুর,রাত….এই বিষয়ে একফোঁটা অনিয়ম নেই তার।।প্রতিবার ফোন দিয়ে গম্ভীর স্বরে বলবেন-” রোদপাখি খাওয়ার সময় হয়ে গেছে।খেয়ে নাও প্লিজ।একদম অনিয়ম করবে না।।সাবধানে থেকো… রাখছি” ব্যস এটুকু বলেই প্রতিবার ফোন কাটেন উনি… আমার কিছু বলার সুযোগই নেই।।আমার যে বুক ফেঁটে কান্না পাচ্ছে…উনাকে দেখার জন্য দম বন্ধ হয়ে আসছে তা শোনার সময় আছে নাকি তার?একদমই নেই….কতো ব্যস্ত মানুষ সে…বউয়ের পিছে পড়ে থাকলে কি চলবে তার??কথাগুলো ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলতেই দরজার বাইরে থেকে চেঁচিয়ে ডেকে উঠলো মা-
.
রোদ?এই রোদ? দরজা খোলে খেতে আয়…খাবারে মাছি বসছে তো।কখন থেকে ডাকছি…আর পারি না বাপু।এই ধিংগি মেয়ে হয়েছে তবু পিছে দৌড়ে খাওয়াতে হয়…কি রে এলি না??
.
মা তুমি যাবে প্লিজ?যাও এখান থেকে…খাবো না আমি…(বিরক্ত হয়ে)
.
খাবি না?কেন খাবি না কেন? খাওয়ার সাথে কিসের শত্রুতা তোর?চুপচাপ এসে খেয়ে যা বলছি।
প্লিজ মা যাও তো।খবরদার বিরক্ত করবে না আমায়।কি পেয়েছো টা কি তোমরা? যা বলবে তাই মানতে হবে?খেতে বললে খেতে হবে,,উঠতে বললে উঠতে হবে…এমনটা কেন??আমার একটা জীবন আছে মা…আমি কোনো রোবট নয়…প্লিজ যাও মা….(চিৎকার করে)
.
ওপাশ থেকে মার বকাঝকা শোনা যাচ্ছে।। ঘুমানোর আগ পর্যন্ত যে এই টেপরেকর্ডার চলতেই থাকবে তা বেশ বুঝতে পারছি আমি।তাই সেদিকে কান না দিয়ে ঘোলাটে চোখে দেয়ালে ঠেস দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লাম আমি।চোখ দুটো বন্ধ করতেই গালে দু’ফোটা বড় বড় অশ্রুর অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম…মনের সাথে সাথে চোখদুটোও জ্বালা করছে খুব…একগুচ্ছ জমানো আবদার নিয়ে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছি…ইচ্ছে হচ্ছে শুভ্রকে জড়িয়ে ধরে একদম বুকের মাঝে গুটিশুটি হয়ে পড়ে থাকি….জানালা দিয়ে হালকা শীতল বাতাস বয়ে চলেছে,, যার ধাক্কায় পর্দার সাথে সাথে আমার শরীরের লোমগুলোও কেঁপে উঠছে বারংবার…এই বাতাসটাকেও অসহনীয় লাগছে আজ….বাতাসের তালে যখন উড়ছে আমার চুল ঠিক তখনই হাতে থাকা মোবাইলটাও কেঁপে উঠলো মৃদু ভাবে।।আমি একদৃষ্টে সেদিকেই তাকিয়ে আছি…স্ক্রিনে “সাদা বিলাই” নামটা ভাসছে নিঃসংকোচে সাথে ভাসছে নীল পাঞ্জাবি গায়ে জড়ানো তার হাসি মুখ।।কি সুন্দর নিঃশব্দে হাসছেন উনি…সামনের দাঁতগুলো যেনো ঝলমল করছে….ডানপাশে একটা ত্যাড়াবাঁকা দাঁত আর বামগালে পড়া টোল।।ছবিটি দেখেই বুকের বা’পাশটায় চিনচিনে এক ব্যাথা খেলে গেলো।।কিছুক্ষণ নিঃশব্দে সেদিকে তাকিয়ে থেকেই ধীর হাতে ফোনটা তুলে নিলাম আমি….ওপাশ থেকে “রো” বলার সাথে সাথেই চাপা চিৎকার করে বলে উঠলাম আমি-
.
খাবো না আমি।।শুনেছেন আপনি?খাবো না।আপনার যদি ইচ্ছে হয় তো আপনি খান।।চাইলে খাবারের মাঝে ঢুবে থাকুন বাট আমাকে খেতে বলবেন না।
.
রোদ তুমি কি রেগে আছো?(শান্ত কন্ঠে)
.
নাহ একদম না।।রেগে থাকবো কেন?আমি তো খুবই আনন্দিত।আপনি জানেন?আমি রীতিমতো আনন্দে নাচানাচি করছি।এইযে,, আপনি ফোন রাখার পর…লাউড মিউজিকে লুঙ্গি ডান্স দিবো।।হেভ ইউ এনি প্রবলেম?
.
আমার কথায় কিছুক্ষণ চুপ করে থেকেই হালকা কন্ঠে বলে উঠলেন উনি-
.
আমার রোদপাখিটার কি হয়েছে, সে কি বলবে আমায়?তার কি আমার উপর রাগ হচ্ছে??সে…
.
কতোদিন পর উনার মুখে এমন কথাশুনে শরীরটা কেঁপে উঠলো আমার।।কান্নারা অবাধ্য হয়ে নেমে গেলো গাল বেয়ে…গলার কথাগুলোও জড়িয়ে আসছে বারবার….যেনো এইতো এখনি শ্বাসবন্ধ হয়ে মরে যাবো আমি।।তবু তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে অনেক কষ্টে ভাঙা ভাঙা গলায় বলে উঠলাম আমি-
.
খখখবরদার আমায় রোদপাখি ডাকবেন না।আমি কারো রোদপাখি নই।।আআআর আমাকে কলও করবেন না।আমাকে খাবার কথাও জিগ্যেস করবেন না।।আমার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াবেনও না…..
.
তারপর?(মুচকি হেসে)
.
ত তারপর আমায় একদম জড়িয়ে ধরবেন না।টাচও করবেন না আমায়।হুট করে আমার শাড়ির আঁচলে টানও দিবেন না।।তা..
.
তোমাকে মন ভরে দেখতে তো পারবো?সেটাই বা কম কিসে??
.
না কিচ্ছু পারবেন না।কিচ্ছু না….
.
কথাটা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়লাম আমি।।এ এক অযাচিত কান্না।।না চাইতেও যে কান্নাটা বুক ফেটে বেরিয়ে আসে এ যে সেই আকস্মিক কান্না।।ওপাশ থেকে চুপচাপ আমার কান্নার শব্দ শুনে চলেছেন উনি….কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলে উঠলেন উনি-
.
আমি আসছি রোদু!!
.
উনার এই কথা কানে যেতেই কান্নার গতি যেনো দ্বিগুণ হয়ে গেলো আমার…. উনি ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন –
.
এই দেখো বউকে আমি এতো ভালো খবর একটা দিলাম কই সে খুশিতে নাঁচবে তা না মরা কান্না জুড়ে দিয়েছে।আমি আসছি বলে কাঁদছো?? তাহলে কি আর আসবো না?এখানেই থেকে যাবো?
.
থাথাকুন..ওখানেই থাকুন।খবরদার আমার শহরে আসবেন না আপনি…একদম না।
.
বললেই হলো?তোমার শহরেই তো আমার বসবাস সুন্দরী….ওই শহরটাতেই রেখে এসেছি আমার প্রাণভোমরা.. তাকে ছেড়ে কি আমার চলে বলো?মরে যাবো তো…..
.
উনার কথায় চুপ হয়ে গেলাম আমি।।কিছুক্ষণ পর পর শুধু হেঁচকির শব্দই ওঠে আসছে কানে…উনি বেশ মনোযোগ দিয়ে শব্দগুলো শুনছেন… .. কয়েক সেকেন্ড পর গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন –
.
তুমি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। সকাল ৬ টার আগে আমি তোমার সামনে থাকবো।ট্রেন রাত ২ টোয় কিন্তু আমি এখনই বেরিয়ে যাচ্ছি….. নিজেই ড্রাইভ করে চলে আসবো…কতক্ষণ আর লাগবে বলো?ততক্ষণ কি আমার বউটা একটু ঘুমিয়ে নিবে??প্লিজ!!
.
উনার কথায় হেসে দিলাম আমি।নাক টেনে বললাম-
.
থাক…ড্রাইভ করে আসতে হবে না।।ট্রেনেই আসুন…চট্টগ্রাম টু ঢাকা কতোখানি পথ…এতোরাতে ড্রাইভ করা খুব রিস্ক…আপনি প্লিজ ট্রেন দিয়েই আসুন।
.
সরি সুন্দরী।সুন্দরী বউয়ের কান্নামাখা কিউট কন্ঠ শুনে আবরার শুভ্রের পক্ষে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করা সম্ভব নয়।
.
আপনি এতো বেশি বুঝেন কেন অলওয়েজ?? সারাদিন কাজ করার পর টায়ার্ড শরীরে ড্রাইভ করবেন?পাগল হয়েছেন আপনি?খবরদার এমন কিছু করবেন…নয়তো..
.
আমার কথা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে.. দুষ্টুমি মাখা কন্ঠে বলে উঠলেন উনি-
.
তুমি এই কথাগুলো আমার সামনে বসে বলবে প্লিজ?তোমার কন্ঠ টা একদম বউ বউ লাগছে গো।।এতোদিনে মনে হচ্ছে আমি বিয়ে করেছি।।এখন তো একসেকেন্ডও দেরি করা যাবে না….আই এম কামিং সুন্দরী…রেডি থাকো।
.
কথাটা বলেই ফোনটা কেটে দিলেন উনি।।কিছুক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে আবারও ডায়াল করতেই ফোন কেটে ম্যাসেজ পাঠালেন উনি-” ড্রায়িব করছি রোদপাখি।কল দিও না…গিয়ে কথা হবে… এখন খেয়ে শুয়ে পড়ো প্লিজ!!” আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চিন্তামাখা মুখে উঠে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।।এই চিন্তিত মনে গলা দিয়ে খাবার নামাটা ইম্পসিবল!! কে জানে এতো রাতে কিভাবে ফিরবেন উনি??সত্যিই আজকেই প্রথম নিজেকে কারো স্ত্রী বলে মনে হচ্ছে… স্বামীর জন্য দুশ্চিন্তা কাকে বলে তা আমার অস্তিত্বে মিশে যাচ্ছে।।প্রতিটি হৃৎস্পন্দনের সাথে তারজন্য দোয়া করছে এ মন….”সে ভালো থাকুক,,,সুস্থ থাকুক”
ঘুমের মাঝেই মুখে কিছুর ছোঁয়া লাগায় লাফিয়ে উঠলাম আমি।নিশ্চয় শুভ্র চলে এসেছে? কিন্তু চারপাশে তাকিয়েও কাউকে দেখতে পেলাম না আমি।।জানালার পর্দাটা বারবার আছড়ে পড়ছে গায়ে…বুঝতে পারলাম শুভ্র নয়…জানালার পর্দা ছিলো ওটা।।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ৯ টা ২০ প্রায়…এতো বেলা হয়ে গেছে??রাতে জানালাটা খোলা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি…জানালা গলিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে বাইরেটা অন্ধকার…আকাশটা ঘন মেঘে ডাকা…হয়তো ঝড় হবে…ভীষন ঝড়।।হঠাৎ শুভ্রর কথা মনে পড়ায় ফোনটা হাতে নিয়ে চেক করলাম ফোন বা ম্যাসেজ কিছু আছে কি না?কিন্তু একি সব ফাঁকা।।কিন্তু এতোক্ষণে তো উনার পৌঁছে যাওয়ার কথা৷ তবে কি উনি এসেই ঘুম দিয়েছেন??ফোনটা হাতে নিয়ে কি মনে করে ডায়াল করেই ফেললাম।।দুবার কেটে গিয়ে তিনবারের সময় রিসিভ হলো।।রিসিভ হওয়ার সাথে সাথেই বলতে শুরু করলাম আমি-
.
হ্যালো?কোথায় আপনি?ঘুমোচ্ছেন?কখন ফিরেছেন?আমায় ফোন দেন নি কেন?আপনি কি আজ ভার্সিটি আসবেন??
.
আমার প্রশ্নের বহর থামলে আমাকে অবাক করে দিয়ে ওপাশ থেকে মোটা স্বরে কথা বলে উঠলেন এক ভাদ্রলোক-
.
সরি ম্যাম।আমি আবরার শুভ্র নই।আমি ডক্টর রাহিম আলম।
.
উনার ফোন আপনার কাছে কেনো?(অবাক হয়ে)
.
এক্চুয়েলি উনি এখন ফোন ধরার পজিশনে নেই তা…
.
উনার সম্পূর্ণ কথা শেষ না হতেই বলে উঠলাম আমি-
.
কোন হসপিটাল!!
কথাটা শুনেই হাত থেকে ফোনটা খসে পড়লো আমার।মাথাটা কেমন ভো ভো করছে আমার…চিন্তা শক্তি যেনো লোপ পাচ্ছে ক্রমাগত…ব্রেনটা যেন ক্রমাগত ঘুম পারিয়ে দিতে চাচ্ছে আমায়…কিন্তু আমায় তো যেতে হবে।।শুভ্রর কাছে যেতে হবে।।যেতেই হবে….কথাটা ভেবেই বালিশের পাশে রাখা ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেলাম রুম থেকে।।ডায়নিং এ বসে থাকা বাবা-মা,ভাইয়া সবাই যে অবাক চোখে দেখছে বেশ বুঝতে পারছি….কিন্তু আমায় তো থামলে চলবে না…যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌছুতে হবে আমায়….তাকে যে আমার চাই!!খুব বেশি চাই।
.
#চলবে🍁