তোকে চাই

তোকে চাই – Season 2 ! Part- 43

আমি একটা ঢোক গিলে উনার দিকে তাকালাম।।চোখে রাগের আগুন জ্বালিয়ে শান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন উনি।কি ভয়ানক সে চাহনী।।সামনে রাখা পানির গ্লাস থেকে এক ঢোক পানি খেয়ে নিয়ে কিছু একটা বলবো।ঠিক তখনই পাশ থেকে বলে উঠলো শ্রেয়া-
.
রোদ তুমি না খুব কিউট একটা মেয়ে।।তুমি ননদ হিসেবে কিন্তু অসাম হবে।।শুভ্র ভাইয়ার বউ কিন্তু খুব লাকি হতে চলেছে,, তোমার মতো ননদ পাবে বলে কথা।(মুচকি হেসে)
.
শ্রেয়ার কথায় বিষম খেলাম আমি।কাশতে কাশতেই উনার দিকে ফিরে তাকালাম।উনি চোখ মুখ শক্ত করে চুপচাপ বসে আছেন।।উনার চাহনী দেখেই ভেতরটা কেঁপে উঠলো আমার।।আজ যে কি হবে আমার কে জানে??নিজের বউকেই তার বউয়ের ননদ বানিয়ে দিয়েছে রাগ তো হবার কথায়….আমি টেনশনে টেবিলে রাখা চাটনীর বাটিটা নিয়ে ক্রমাগত চাটনী খেতে লাগলাম।কি বলবো কিছুই তো মাথায় আসছে না আমার….হুট করে কি বলে দিবো,, আমি শুভ্রর বউ??মাথায় যখন এতো এতো প্রশ্নের ছড়াছড়ি ঠিক তখনই ভাবনার চাদরকে ছিন্ন করে আবারও বলে উঠলো শ্রেয়া-
.
রোদ?তুমি কিছু মনে না করলে আমি কি শুভ্র ভাইয়ার সাথে একা কথা বলতে পারি??এক্চুয়েলি খুবই পার্সোনাল কিছু কথা।।প্লিজ!!
.
শ্রেয়ার কথায় ভ্রু কুঁচকে তাকালাম আমি।আমার বরের সাথে তার কিসের পার্সোনাল কথা??প্রোপোজ টপোজ করবে নাকি??করতেও পারে…..এজন্যই সুন্দর ছেলে বিয়ে করতে চাই নি আমি… কিন্তু ওইযে কপাল….আমার জামাইকে প্রোপোজ করতে আমার কাছেই পারমিশন চাচ্ছে ও…ভাবা যায়??আমার জায়গায় শুভ্র থাকলে নিশ্চয় এতোক্ষনে ধুয়ে দিতো ওকে??আর আমি?জড়বস্তুর মতো বসে আছি….ডাফার!!কথাগুলো ভেবে কড়া কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই পাশ থেকে গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন শুভ্র –
.
না।ও কোথাও যাবে না।তোমার কিছু বলার থাকলে ওর সামনেই বলো শ্রেয়া।আমার লাইফে রোদের চেয়ে পার্সোনাল কিছু নেই। রোদ ব্যতীত অন্যকোন মেয়ের সাথে আমার প্রফেশনাল কথা থাকতে পারে কিন্তু পার্সোনাল কখনোই নয়। তাছাড়া এখন দুটোর বেশি বাজে এখনও কিছু খাই নি ও।।একটু পর আমার ক্লাস সো ওকে এখনই খাওয়াতে হবে….তুমি প্লিজ যা বলার এখানেই বলো…নয়তো বলার দরকার নেই।

আমি ততক্ষণে শুভ্রর চাটনির বাটিটিও সাবার করে চলেছি…চামিচ দিয়ে চাটনীগুলো নাড়তে নাড়তে শ্রেয়ার দিকে আড়চোখে তাকালাম আমি।বেচারী যে অস্বস্তির চূড়ান্তে তা আর বুঝতে বাকি রইলো না আমার।।কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে মুখ কাঁচুমাচু করে কিছু বলতে গিয়েও আমার দিকে তাকিয়ে থেমে গেলো শ্রেয়া।।কপাল হালকা কুঁচকে অবাক চোখে বলে উঠলো সে-
.
তুমি ঠিক আছো রোদ?এতো চাটনী খাচ্ছো কেন?ক্যান্টিনের চাটনী যে টক সেটা তুমি এমনি কি করে খাচ্ছো??শরীর খারাপ করবে তো…
.
শ্রেয়ার কথায় নিজের হাতের দিকে তাকালাম আমি। সত্যি তো!! আজ নির্ঘাত পেট ব্যাথা হবে আমার।।চাটনীর বাটিটা আস্তে করে টেবিলে রাখলাম….জোড় করে একটা হাসি দিয়ে উত্তরটা দিবো ঠিক তখনই পাশ থেকে শান্ত কন্ঠে বলে উঠলো শুভ্র-
.
সমস্যা নেই শ্রেয়া। প্রেগনেন্সিতে এসব চলে…
.
“প্রেগনেন্সি” শব্দটা শুনেই আমি আর শ্রেয়া চোখ বড় বড় করে উনার দিকে তাকালাম।শ্রেয়া বিস্মিত কন্ঠে বলে উঠলো-
.
প্রেগনেন্সি মানে?রোদ তুমি প্রেগনেন্ট?তোমার বিয়ে হয়েছে?কিন্তু কবে?আমরা তো কেউ জানি না।।
.
আমি কি বলবো কিছুই বুঝতে পারছি। শুভ্র যে এমন একটা কথা কেন বললো কে জানে??আমার অস্বস্তিকে আরেকটু বাড়িয়ে দিতেই আবারও বলে উঠলো শুভ্র-
.
এক্চুয়েলি হুট করে বিয়ে হয়েছে তো তাই জানো না৷। ওর হাজবেন্ড একটু বেশিই ডেস্পারেট কিনা।।ওকে জোড় করে তুলে নিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে…
.
জোড় করে তুলে নিয়ে বিয়ে করে ফেললো??কি ডেঞ্জারাস!!! (অবাক হয়ে) আপনারা কিছু করলেন না??(আমার দিকে ফিরে)কি করে তোমার হাজবেন্ড?? কোনো গুন্ডা টুন্ডা নয় তো??
.
ওর হাজবেন্ড এই ভার্সিটিরই টিচার শ্রেয়া।।তবে গুন্ডামোও একটু আধটু করে….তবে আগের তুলনায় কম।।বিয়ে করেছে তো…বাচ্চা বউ সামলাতেই সময় যায়… এসব গুন্ডামো করার সময় কই বলো?(মুচকি হেসে)
.
কিহ!!(অবাক হয়ে) রোদের বর আমাদের ভার্সিটির টিচার??ভার্সিটির টিচার হয়ে তুলে নিয়ে বিয়ে করে ফেললো??কি অদ্ভুত!!
.
কি আর করবে বলো??ভালোবাসা মানেই পাগলামো তা কি আর এসব টিচার,, ডাক্তার দেখে কমে যায়??তাছাড়া যখন তুলে নিয়ে গেছে তখন ওর হাজবেন্ড এই ভার্সিটির স্টুডেন্ট ছিলো।।রিসেন্টলি টিচার হয়েছে….এইতো ২০ থেকে ২৫ দিন হবে।।
.
২০ থেকে ২৫ দিন??এই কয়েকদিনে তো শুধু আপ….(চোখ বড় বড় করে) আপনি??আ আ আপনিই ওর হাজবেন্ড??
.
শুভ্র হাসলো।একটু নড়ে চড়ে বসে খাবারটা আমার দিকে ঠেলে দিয়ে খেতে ইশারা করেই বলে উঠলেন –
.
হুম আমিই ওর হাজবেন্ড।। তো শ্রেয়া,কি খাবে বলো?রোদের পক্ষ থেকে তোমায় খাওয়ানোর দায়িত্ব আজ আমার….
.
শ্রেয়া কিছু না বলে ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো উনার মুখে।।তারপর চুপচাপ উঠেই ক্যাফিটেরিয়া থেকে বেরিয়ে গেলো সে।।শুভ্র ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ইগনোর করে আমার খাওয়া নিয়ে পড়ে গেলো।।আমিও চুপচাপ উনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি।। একটা মেয়ের মন কি সুন্দর ভেঙে খানখান করে দিলেন উনি।।শ্রেয়ার নজরে দেখলে উনি বড্ড নির্দয়…আর আমার নজরে দেখলে??পুরো আস্ত এক ভালোবাসা….যে ভালোবাসার চাদরে আমাকে মুড়িয়ে দিচ্ছেন ক্রমাগত।।আমার ভাবনার পথেই টেবিলের নিচে দুইপা দিয়ে আমার পা দুটো শক্ত করে চেপে ধরে বলে উঠলেন উনি-
.
আমি তোমার ভাই??তো আমাদের বাচ্চাকে কি মামু ডাকা শিখাবে??ডাফার!!(রাগী চোখে)
.
আ আমি যখন বলেছিলাম তখন তো ভাই ই ছি.. ছিলেন।(ভয়ে ভয়ে)
.
আমি কখনোই তোমার ভাই ছিলাম না৷।তুমিই এক ডাফার ছিলে যে প্রতি সেন্টেসে দু’বার করে ভাইয়া ডাকতে….ইচ্ছে তো করতো ধরে আছাড় দিই।।আমি কি তোমাকে বলেছি কখনো যে আমায় ভাইয়া ডাকো… মাথামোটা কোথাকার৷। আর কখনো এমন ব্লান্ডার করলে …… আজ ক্যান্টিনে আছো বলে বেঁচে গেলে।।এবার নাও খাও…. আমার খাবারগুলোও তুমি ফিনিশ করবে এটাই তোমার শাস্তি।।নাও স্টার্ট ডার্লিং…
.
এ এতো গুলো?? (করুণ চোখে)
.
আমার কথায় উনি মুচকি হাসলেন যার অর্থ “নাও ইউ আর গন বেইবি”
.
🍁
.
রাত কটা বাজে জানি না৷। পরম শান্তিতে ঘুমের রাজ্যে সাঁতার কাটছিলাম আমি।।কিন্তু সেই শান্তিটাকে ভেঙেচুরে ফোনটা ভেজে উঠলো তীব্র আওয়াজে।বিরক্তি নিয়ে ফোনটা কানে নিতেই ওপাশ থেকে ক্লান্ত কন্ঠে বলে উঠলেন শুভ্র-
.
রোদপাখি?
.
হুম…
.
ঘুমোচ্ছো?
.
হুম…

একটু বারান্দায় আসবে, প্লিজ?
.
কককেন?(ঘুমু ঘুমু কন্ঠে)
.
তোমায় একটু দেখবো একটু আসো…আমি নিচেই দাঁড়িয়ে আছি…একটু আসবে?
.
আমি ঘুমের ঘুরেই আধবোজা চোখে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম।। ঘুমগুলো যেনো দু’চোখ চেপে ধরেছে আমার।।কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকেই বলে উঠলাম –
.
এবার যাই?ঘুমাবো!!
.
বেশি ঘুম পাচ্ছে?আরেকটু থাকবে?তোমাকে দেখে আজ চোখটা যেনো জোড়াচ্ছেই না আমার।।কেনো যেনো মনে হচ্ছে আর হয়তো দেখতে পাবো না তোমায়।।
.
কি সব বলছেন আপনি??এমন কথা কেন বলছেন??
.
কিছু না।। যাও ঘুমিয়ে পড়ো।
.
হুম…
.
কথাটা বলেই কোনোরকম বিছানায় গিয়ে আবারও ঘুমের রাজ্যে ডুবে গেলাম আমি।।ঘুমের মাঝেই যেন শুনতে পেলাম কানের কাছে কেউ একজন বলে চলেছে- “ভালোবাসি রোদপাখি।অনেক বেশি ভালোবাসি।”সকাল বেলা ঘুম ভাঙতেই দেখি চিত্রা মুখ ফুলিয়ে বসে আছে বিছানায়।।আমি মুচকি হেসে ওর দিকে তাকালাম ।। মাথার মধ্যে যেনো ” ভালোবাসি ” কথাটা ঘোরপাক খাচ্ছে।।আচ্ছা?কাল রাতে উনি সত্যি এসেছিলেন নাকি আমার স্বপ্ন ছিলো?কথাটা ভেবেই ফোন চেক করলাম ঝটপট।।নাহ….সত্যিই এসেছিলেন উনি।।ফোনটা পাশে রেখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম আমি-
.
কি রে?এতো সকাল সকাল আমার বাসায়? কাহিনী কি?
.
……………………..
.
কি ব্যাপার?মুখ ফুলিয়ে রেখেছিস কেন??হয়েছেটা কি??
.
………………………
.
এই তুই এই মুহূর্তে আমার বাসা থেকে বের হ।চুপ করে বসে থাকার হলে রাস্তায় গিয়ে চুপ করে বসে থাক।।আমার সামনে নয়।।তুই কি বলবি নাকি চড় খাবি কোনটা??
.
রোদ…..(কাঁদো কাঁদো গলায়)
.
একদম ন্যাকামো করবি না।।কি হয়েছে বল।।
.
ওই স্যার আবারও…
.
আবারও কি?(ভ্রু কুঁচকে)
.
আবারও চুমু দিয়েছে আমায়…..(কান্না কান্না গলায়)
.
চিত্রার কথায় আমি অবাক হলেও স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠলাম-“অহ” আমার ওহ কথাটা ওর ঠিক পছন্দ হলো না বলেই মনে হলো।।করুণ চোখে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকেই মরাকান্না জুড়ে দিলো।।আমি বিছানায় পা ঝুলিয়ে ওর কান্না মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে আছি আর ভাবছি।।শিশির স্যার থাকলে হয়তো এই কান্নামাখা মুখ দেখে সেই ভুলটা আবারও করতো…..করতে হয়তো বাধ্য হতো!!!

পুরো ভার্সিটি চষেও শুভ্রকে খুঁজে পেলাম না আমি।।রাতুল ভাই বা সাকিব ভাইও বলতে পারছেন না কোথায় আছেন উনি।।একটা জলজ্যান্ত মানুষ এভাবে হাওয়া হয়ে যায় কিভাবে শুনি??বিরক্ত হয়ে আবারও ফোনটা কানে নিলাম আমি।।গলা শুকিয়ে আসছে আমার….হার্টও বিট করছে হাজার গতিতে…
এবারও কি ফোনটা বন্ধ পাবো উনার??কিন্তু নাহ…এবার আর নিরাশ হতে হলো না আমায়।।ফোনটা রিং হলো এবং ওপাশ থেকে শান্ত আর গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন শুভ্র-
.
বিজি আছি রোদপাখি।পরে কথা বলছি।
.
বিজি মানে? যতো ব্যস্ততায় থাকুক না কেন…আগে এটা বলুন,, আপনি কোথায় আছেন??আমি আপনাকে কতো খুঁজেছি জানেন??
.
আমি চিটাগং আছি।। প্রজেক্টের কাজে এসেছি।জানি না কবে ফিরবো।।দু থেকে তিনদিন লেগে যেতো পারে।।এবার ফোনটা রাখো মিটিং রুমে আমি….
.
কথাটা বলেই ফোনটা কেটে দিলেন উনি।।সাথে সাথেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো আমার।।উনার জন্য এতো কষ্ট হচ্ছে যেন হাজার বছর দেখি না উনাকে।।কতোদিন উনার নেশা ভরা চাহনী দেখি না আমি।।ইশশ…এতো কষ্ট কেনো হচ্ছে আমার??কথাটা গুলো ভাবতেই গালের উপর দু’ফোটা জলের অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম আমি….
.
#চলবে….