তুই যে শুধুই আমার

তুই যে শুধুই আমার ! সিজন- ২ !! Part- 11

জান্নাত এক দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলা স্টার্ট করে।

জান্নাতঃ সায়রা মোটেও আগে এত দুষ্টু ছিল না। ও অনেক শান্ত শিষ্ট আর চাপা স্বভাবের মেয়ে ছিল। ওর জিদ ছিল অনেক কিন্তু তা ও সকলের সামনে প্রকাশ করতো না। ও সব সময় চুপচাপ থাকতো কোন কথা বলতো না তাই ওর তেমন বেশি ফ্রেন্ডস ও ছিল না আমি আর সাহিবা আপু বাদে।

আরুশঃ এই সাহিবা কে?

জান্নাতঃ সায়রার বড় বোন। সাহিবা আপু সায়রা থেকে ১ বছরের বড় ছিলেন। সায়রা আর সাহিবা আপুকে এক সাথে পাশে বসালে কেউ বলতেই পারতো না তারা বোন। কেন না দুইজনের স্বভাবে ছিল আকাশ পাতালের তফাৎ। সায়রা যেমন ছিল ভদ্র, সাহিবা আপু ছিল তেমন মারাত্মক দূষ্টু। সায়রা এখন ঠিক যেমন সাহিবা আপুও ঠিক তেমনই ছিলেন। সব সময় ঘরবাড়ি মাতিয়ে রাখতেন।
সায়রা চুপচাপ থাকলেও সাহিবা আপু থাকতেন না। কিন্তু যত যাই হোক দুইবোনে মিল ছিল অনেক। দুইজন ছিল দুইজনের প্রাণভমরা। একজনকে ছাড়া আরেকজন একদিনও থাকতে পারতো না। তাদের মধ্যে এতো ভালবাসা দেখে দুই একসময় আমার এই হিংসে হত যে কেন আমার এমন একটা বোন নেই। কিন্তু হয়তো তাদের এই ভালবাসায় কাউরো নজর লেগে যায়।।
২বছর আগে সায়রা জিদ ধরে বসে সে সাহিবা আপুর কাছ থেকে স্কুটি চালানো শিখবে। সায়রা কখনো সাহিবা আপু থেকে কিছু চাই নি এই প্রথম কিছু চাওয়ায় তিনি মানা করতে পারেন নি। সাহিবা আপুর আগে থেকেই স্কুটি ছিল সে ওই স্কুটি দিয়েই সায়রাকে শিখানো শুরু করে। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই সায়রা স্কুটি চালানো শিখে যায়,, সেই কি খুশি এই না হয়েছিল সায়রা। কিন্তু ওর এই খুশিতে মনে হয় কাউরো নজর লেগে যায়। ওর জীবনে অন্ধকার নেমে আসে।

আরুশঃ মানে! ভ্রু কুচকিয়ে

জান্নাত এক দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলা শুরু করে।

🍂
জান্নাতঃ সেইদিন সায়রা ওর নিজের ড্রাইভিং লাইসেন্স পায় আর সেই খুশিতে ও সাহিবা আপুকে ট্রিট দেওয়ার জন্য বের হয়। সায়রা সেদিন নিজেই ড্রাইভ করে। সাহিবা আপু না করেছিল কেন না সে এখনো নতুন তাই কিন্তু সায়রা কথা শুনে নি। ও নিজেই ড্রাইভ করা শুরু করে।
কিন্তু বিপত্তি ঘটে মাঝ রাস্তায় গিয়ে। মাঝ রাস্তায় তাদের মেজোর একটা এক্সিডেন্ট হয় যেখানে সায়রা আর সাহিবা আপু গুরুতরভাবে আহত হন। দুইজনকেই পাশের হসপিটালে এডমিট করা হয়। আঙ্কেল আন্টি এইসব জানার সাথে সাথে সেইখানে চলে আসেন। সায়রার অবস্থা একটু ভালো হলেও সাহিবা আপুর অবস্থা ছিল ভয়াবহ। তিনি বাম সাউডে অনেক জ্বরেই আঘাত পান যার ফলে তার একটা কিডনি ডেমেজ হয়ে যায়। ডাক্তাররা বলে তার দ্রুত অপারেশন করতে হবে তা না হলে ইনফেকশন হয়ে যাবে আর সাথে সাথে তিনি পেরালাইজড হয়ে যাবেন। এই শুনে আঙ্কেল আন্টি একদম ভেঙ্গে পড়ে। কিন্তু নিজেকে সংযত রেখে তারা অপারেশনের জন্য হ্যাঁ বলে।
এরই মধ্যে সায়রা জ্ঞান ফিরে আর ও বাইরে এসে এইসব শুনে ফেলে আর পাগলের মত সাহিবা আপুর নাম নিতে থাকে।
ওর একটাই কথা ও সাহিবা আপুর কাছে যাবে। অনেক বলেও যখন ওকে বুঝানো যায় নি তখন ডাক্তার রা ওকে পারমিশন দেয় দেখা করার। তখন সায়রা ভিতরে গিয়ে সাহিবার আপুর দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে। মুখটা একদম মলিন হয়ে আছে। সায়রা সাহিবা আপুর কাছে গিয়ে বসে আর বলে।

সায়রাঃ এই আপু তুই এইভাবে চুপচাপ শুয়ে আছিস কেন। তোকে না এমন চুপচাপ একদম মানাচ্ছে না। তোকে কেন যেন সায়রা সায়রা লাগছে। সাহিবা সাহিবা লাগছে না। উঠ তুই আর কথা বল আমার সাথে। এই আপু উঠ না।

অনেক ডাকাডাকির পর সাহিবা ধীরে ধীরে চোখ খুলে আর সায়রা দিকে চায়। সাহিবাকে চোখ খুলতে দেখে সায়রা খুশি হয়ে যায়। সে উৎফুল্লের সাথে বলতে থাকে।

সায়রাঃ আপু তুই ঠিক আছিস তহ?? দেখিস তোর কিছু হবে না সব আগের মত ঠিক হয়ে যাবে।

সাহিবা তখন ধীরে ধীরে নিজের অক্সিজেন মাস্ক খুলতে থাকে তা দেখে সায়রা বাঁধা দিতে নিলে সাহিবা মানা করে। সাহিবা নিজের অক্সিজেন মাস্ক খুলে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে।

সাহিবাঃ সা,,য়,,রা দে,,খ বো,ন আ,,মা,,র কা,,ছে,, বে,,শি স,,ম,য় নেই। তা যা ব,ল,ছি তা ম,ন দি,,য়ে শো,,ন

সায়রাঃ কি সব বলছো তুমি। তোমার কিছু হবে না তুমি একদম ঠিক করে যাবে। সব আমার দোষ না আমি ড্রাইভ করার জিদ করতাম আর না এইসব হতো।

সাহিবাঃ আরে,,হ ধুর পা,,গ,লি। এই,,সবে,, ত৷ তোর দো,,ষ নেই। যা হও,,য়া,,র ছিল তা হ,,য়ে,,ছে। কি,,ন্তু তার আ,,গে তুই আ,,মা,,য় ক,,থা দে আমি যা ব,,ল,,বো তুই তা ক,,র,,বি। কাঁপা কাঁপা গলায়

সায়রাঃ বল কি কথা চাই তোমার?

সাহিবাঃ আ,,মি চ,,লে যাওয়ার প,,র তুই মা বাবাকে দেখে রা,খি,,স। আ,,মি যে,,ম,,ন সব,,সময় বা,,ড়ি,,ঘর মা,,তি,,য়ে রা,খ,তা,ম তুই ও অম,,নেই রাখ,,বি। এক ক,,থায় আমি যে, মনে চল,,তাম ওম,,নেই চলবি। আমা,,র স্বপ্ন,,টা তু,ই পূ,,রণ করবি।। আমাকে তুই নিজের ভিতরের বাঁচিয়ে রাখবি কথা দে।।
হাত উঁচু করে।

সায়রা সাহিবার হাত ধরে বলে।

সায়রাঃ না তোমার কিছু হবে না আমি কিছু হতে দিব না তোমায়।

সাহিবা এক মুচকি হাসি দেয় যার মানে ছিল ভালো থাকিস আর নিজের খেয়াল রাখিস। সায়রা কি তা আদো বুঝেছিল কি জানি না
কিন্তু সাহিবা আপু আর কিছু বলতে পারে না এর আগেই ওর শ্বাসকষ্ট উঠে যায়। সায়রা তখন পাগলের মত চিৎকার করতে থাকে। সায়রার চিৎকার শুনে ডাক্তার আর নার্সরা ছুটে আসে আর সব চেক করে বলে সাহিবাকে এখনই অপারেশন থিয়েটারে নিতে হবে। সায়রা পাগলামো করছিল বলে সায়রাকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দেয়া হয়।
সাহিবা আপুকে অপারেশনের জন্য নেওয়া হয় কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর তার অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে। তিনি কোন মেডেসিনেই রেসপন্স করছিলেন না। ডাক্তাররা নিজেদের বেস্ট ট্রাই করছিলেন কিন্তু ততক্ষণে সব যেন হাতের বাইরে চলে আর সাহিবা আপু ও চলে যায় এই দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে।

সায়রা যখন ঘুম থেকে উঠে তখন সাহিবা আপুকে খুঁজতে থাকে। এইদিকে আঙ্কেল আন্টিও পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিলেন। তখন আমি সায়রাকে আর আমার বাবা মা সায়রার বাবা মাকে সামলায়। সায়রা কিছুতেই সাহিবা আপুর মৃত্যু মেনে নিতে পারছিল না। এক প্রকার পাগলামো শুরু করে দিয়েছিল। তাই ওকে বাধ্য হয়ে আবার ঘুমের ইঞ্জেকশন দিতে হয়।
প্রায় একদিন বেলা শেষে সায়রা ঘুম থেকে উঠে আর সেই থেকে একদম চুপ হয়ে যায়। সাহিবা আপুর জন্য একটুও কাদে নি ও। নিজেকে দোষারোপ করতো সাহিবা আপুর মৃত্যুর জন্য।। আমরা অনেক বুঝিয়েছি ওকে।।
কিন্তু সে বুঝেনি বরং সেইদিনের পর থেকেই সায়রা প্রায় নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিল।। প্রায় ২ মাস সায়রা নিজে ঘর বন্ধি করে ফেলে। কাউরো সাথে কোন কথা বলে না। আন্টিও বেশ ভেঙে পড়েছিলেন কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই নিজেকে সামলিয়ে নেন সায়রার জন্য। কিন্তু সায়রাকে তিনি সামলিয়ে উঠাতে পারেন নি। সকলেই যখন সব আশা ছেড়ে দিয়েছিল তখন সায়রা রুম থেকে বাইরে এসে আন্টি আর আঙ্কেল জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দেয়।।
প্রায় ২ মাস পর ও কান্না করেছিল। মন খুলে কান্না করেছিল। আর সেইদিনের পর থেকেই সায়রা একদম চেঞ্জ হয়ে যায়। নিজেকে সাহিবা আপুর মত গড়ে তুলে। শান্ত শিষ্ট সায়রা থেকে ও হয়ে উঠে দুষ্টু সায়রা। সাহিবা আপুর মত সব সময় হাসি খুশি প্রানবন্তর হয়ে উঠে। কান্না কি তা ভুলেই যায়।নিজের মাঝে সাহিবা আপুকে বাঁচিয়ে রাখতে ওর যত প্রচেষ্টা। সাহিবার আপুর স্বপ্ন ছিল ফ্যাশন হাউজে কাজ করার তাই সায়রাও এইটাকে নিজের স্বপ্ন করে তুলে আর লেগে পড়ে সেই স্বপ্ন সত্যি করতে।।
কিন্তু আজ আপনিই ওর এই স্বভাব আর কাজ নিয়ে ওকে এত কথা শুনালেন। আপনার জন্য আজ ওর চোখের সেই কান্না আসে। যার সন্ধান আমরা এই দুই বছরে পাই নি।

এইসব শুনে আরুশের চোখ ছলছল করছে মনে হচ্ছে এখনই যেন তা টুপ করে গড়িয়ে পড়বে।। কিন্তু না আরুশ নিজেকে সংযত রেখে বলে।

আরুশঃ থ্যাংক ইউ আমাকে সব বলার জন্য। এখন আমি আসি।
এই বলে আরুশ এক মুহুর্ত সেখানে না দাড়িয়ে হনহনিয়ে চলে আসে আর জান্নাত আরুশের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে এক দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।


রাত ১২ টা বাজে,,
এক আবছা অন্ধকার রুমে বসে আছে আরুশ। নিচে বসে খাটের সাথে মাথাটাজে হেলিয়ে বসে আছে সে। রুমের সকল আসবাপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। কোথাও কোথাও কাঁচের সূক্ষ্ম টুকরা তহ কোথাও সাজিয়ে রাখা সোপিজ গুলো। আরুশের চোখ দুটো একদম লাল হয়ে আছে। চুল গুলো উষ্কশুষ্ক। এক হাতে খানিকটা রক্ত জমাট বেঁধে আছে আর অন্য হাতে একটা বিয়ারের ক্যান। যা সে একটু পর পর খাচ্ছে আর এক ধ্যানে সামনে থাকা এক ছবিটির দিকে তাকিয়ে আছে। রুমের মধ্যে থাকা জলন্ত ফ্যারিলাইটের আলোয় ছবিটা বেশ স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে। ছবিটি আর কাউরো না বরং…



#চলবে