জীবন

জীবন !! Part- 03

৫ বছর পর,

পৃনয়ী,এই পৃনয়ী,
এদিকে একটু আয় তো মা।

-কি হয়েছে আম্মু?
-এদিক টায় একটু দাঁড়া না,আমি একটু ও দিক টা দেখে আসছি।

-আচ্ছা আমি আছি এখানে।তুমি যাও দেখে এসো।

কিছু ক্ষণ পর,

-কি করে রে আমার মামুণি?এখানে দাঁড়িয়ে কেন?

-কি আর করবো আব্বু,
আম্মু আমাকে এখানে দাঁড় করিয়ে রেখে গেলো।
বল্লো ওদিক টা দেখতে যাবে।

-কি আর করবে বল,বাসায় তো আর কেউ নেইও যে একটু হেল্প করবে।
তোর খালামণিরাও তো এলোনা।
বললাম,আগে আগেই চলে আসতে অথচ তারা নাকি আগামীকালই আসবে।একেবারে হলুদের দিন।

তাই তোর মা আর আমি সব দিক দেখতে দেখতে পাগল হয়ে যাচ্ছি।

-উফফ আব্বু,এত চিন্তা করোনাতো।সব ঠিক ঠাক মত হয়ে যাবে।আমি আছি এখানে।তুমি আম্মুর কাছে যাও।

দেখতে দেখতে পাঁচটা বছর কেটে গেছে।
কত কিছু বদলে গেছে এই ৫ বছরে।

আমাদের বাসার পাশে থাকা বিশাল বড় কদম গাছটি আর নেই।

বাসা থেকে কয়েক মিনিট দূরে গেলেই একটা পুকুর ছিলো।

পুকুর টাতে সারাবছর মাছেরা খেলা করতো।
অথচ আজ পুকুর টাই নেই।পুকুর টা ভরাট হয়ে ঘর বাড়ী তৈরী হয়ে গেছে।

আম্মু আব্বুর কালো কালো চুল গুলোর মধ্য থেকে অল্প কিছু চুল সাদা রঙ ধারণ করেছে।

আব্বুর আগের সেই রাগ টাই যে আর নেই।
অথচ এক সময় কতই না রাগ ছিলো তার।

সব কিছু বদলে গেছে।
বদলেতো গেছি আমিও,সেই ছোট্ট আমি টা এখন কত্ত বড় হয়ে গেছি।

চোখে এখন একটা চশমাও যোগ করেছি।
আবার আগামীকাল আমার গায়ে হলুদও।
পরশু বিয়ে।

বাবা মা আমাকে এখন সংসারী দেখতে চান।
চিন্তামুক্ত হতে চান।

রাতে খাবার টেবিলে,

-করছো কি করছো কি পৃনয়ীর মা,
-কি করবো,তরকারী দিচ্ছি।

-মাছের মাথা টা আমাকে কেন দিচ্ছো?
পৃনয়ীকে দাও।ও খাক আমি দেখি।

-না আব্বু,মাথা খাবোনা আমি।তুমি খাও।

-খা না মা,এমন করছিস কেন?তোর না মাছের মাথা খুব প্রিয়?
আবার কবে তোকে সামনে বসিয়ে মাছের মাথা খাওয়াবো আর আমি দেখবো তার ঠিক আছে?

-এমন ভাবে বলছো যেন আমি আর কোন দিন তোমাদের সাথে খাবোইনা।

-কাল বাদে পরশুই তো তুই তোর নতুন বাড়ী চলে যাবি।
তখন কি আর যখন তখন তোর মাছের মাথা খাওয়া দেখতে পারবো?

-বাবা,বিয়ে দিচ্ছো মানে এই না যে আমি পর হয়ে যাচ্ছি।
বা তোমাদের ছেড়ে চিরদিনের মত চলে যাচ্ছি।
এভাবে বলোনাতো,আমার কষ্ট হয়।

-ওই দেখো,আমার পাগলী মেয়ে কান্না করে দিয়েছে।

আয় এদিকে আয়,বাবার কাছে আয়।
আমি নিজেই খাইয়ে দিচ্ছি তোকে।

-আর সাথে তুমিও খাও।

খাওয়াদাওয়া শেষ করে ঘুমোতে চলে গেলাম।

শুয়ে চোখ বন্ধ করে আছি,

আর হঠাৎ ই চোখের সামনে সেই রাতের স্মৃতি ভেসে উঠে,যে রাতে আমি সালমানকে প্রত্যাক্ষান করেছিলাম।

আমি তাড়াতাড়ি করে উঠে বসে পড়লাম।

ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি পান করে নিলাম।

তারপর আবার চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম।
আমি ওসব ভয়ংকর অতীত মনে করতে চাইনা।

সকাল হতেই বাসায় মেহমান আসতে শুরু করলো।

বাড়ী ভরে গেলো লোকজনে।
আজ গায়ে হলুদ আমার।

দুপুর হতেই সবাই সাজগোজ শুরু করলো।

আমাকেও সাজানো হচ্ছে,
কাঁচা ফুলের মালা দিয়ে।

আমার খুব শখ ছিলো কাঁচা ফুলের মালা দিয়ে সাজার।
আজ আমার শখ পূরণ হচ্ছে।

-কিরে,তুই খুশি তো?হি হি হি।(বান্ধবী)
-হুম।
-কিন্তু তোকে দেখেতো মনে হচ্ছেনা তুই খুশি।
আজ তোর গায়ে হলুদ কি একটু হাসি খুশি থাকবি,নাচানাচি করবি তা না।
মুখ ভাড় করে বসে আছিস।

-আসলে মা বাবাকে ছেড়ে যাবো,ভাবতেই খুব কষ্ট হচ্ছে।
তাই আরকি।

-হুম তা তো খারাপ লাগবেই।

মাহি এই মাহি,বান্ধবীকে কি সাজানো হলো?
ছেলে পক্ষের লোক জন গেইটে দাঁড়ানো।
তাদের বরণ করতে হবেতো।

-আসছি আন্টি।সাজ কমপ্লিট।

ছেলে পক্ষ আমাকে হলুদ দিয়ে চলে গেছে।

সর্ব প্রথম আম্মুর পর ছেলের বাড়ীর লোক জনের মধ্যে যিনি আমাকে হলুদ দিলেন তিনি আর কেউ নন,

আমারই হবু বর।

সে যখন আমাকে হলুদ দিচ্ছিলেন,
মনে মনে ঠিকই বলছিলাম,

মানুষটার আসলেই কোন লজ্জা শরম নেই।
তা না হলে পাত্র হয়ে কনে কে কি হলুদ দিতে আসে?
বা হলুদ দেয়?

হলুদের পর্ব শেষ।

রাতে নাচ গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
সবাই হৈহুল্লোড় হাসি আনন্দ করে।

বান্ধবীরা আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েও নাচায়।

ঘুমাতে ঘুমাতে অনেক লেট হয়ে যায়।

রাতে ঘুমানোর উদ্দেশ্যে শুয়েছি,

দেখি আম্মু এসেছে।

-কিছু বলবে আম্মু?

-ঘুমাসনি এখনো?

-না।

আম্মু আমাকে এসে জড়িয়ে ধরে।

কাল থেকে তোর পরিচয় শুধু আমাদের মেয়েই না।
তোর শশুড় বাড়ীর বউ ও।
এবং একজনের স্ত্রী।

তুই যেমন আমাদের মান সম্মানে কখনো কোন আঁচ লাগতে দিস নি।
তেমনি তোর শশুড় বাড়ীর সম্মান টাকেও এভাবে আগলে রাখবি।আর পরিবারটাকেও।

সবাইকে সম্মান করবি।
এটাই আমার চাওয়া।

-তুমি কোন চিন্তা করোনা আম্মু।
আমি দুই পরিবারকেই আগলে রাখবো।

-আচ্ছা ঘুমিয়ে পড়।
সারাদিন আবার তোর উপর ধকল গেছে।

-তুমিও গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।
-হুম যাচ্ছি।



আজ আমার বিয়ে।
খুব সুন্দর করে আমাকে সাজানো হয়েছে।লাল আর গোল্ডেন কালারের সংমিশ্রণে আমার পরনের শাড়ীটা।

একটা সময় লাল রঙ টা খুবই অপছন্দের ছিলো।
লাল রঙটা একদমই সহ্য করতে পারতাম না।
অনেক অনেক দিন আগে সালমান, সালমানের বোনেরা মানে আপুরা আর আমি একদিন শপিং করতে গিয়েছিলাম।এক সাথে।
আপুরা আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন।

আপুরা সবাই ড্রেস কিনবেন বলে ড্রেস চুজ করছিলেন।
তারপর বড় আপু বললেন,পৃনয়ী তুইও পছন্দ কর।

আমি বললাম,কোন টাই তো আমার পছন্দ হয়না।

পরে সালমান আমাকে একটা লাল রঙের ড্রেস হাতে দিয়ে বলেছিলো,

তুই এটা নে।
এটাতে তোকে মানাবে।একদম লাল পরী লাগবে তোকে।

-আপনার পছন্দ হয়েছে এটা?
-হুম খুব।আর আমার প্রিয় রঙ কিন্তু লাল। তাইতো তোকে নিতে বললাম।

মনে মনে বললাম,ইয়াক!লাল রঙ আবার কারো প্রিয় হয় নাকি।

আমি আর সেদিন সালমানকে না করতে পারিনি।

তাই অপছন্দের রঙ হওয়া সত্বেও আমি সেদিন লাল ড্রেস টা নিয়ে নিয়েছিলাম।

আর যেই না আমি লাল ড্রেস টা পরে আয়নায় দাঁড়িয়েছি,

দেখি আসলেই আমাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে লাল রঙে।

আর সেদিন থেকেই লাল রঙ টা ভালো লাগতে শুরু করে।

আর আজ আমি লাল রঙের বিয়ের শাড়ী গায়ে জড়িয়েই বসে আছি।

মাহি এসে বলে গেলো,বর এসে গেছে।

বুকের ভেতর কেমন যেন করছে ঠিক বোঝাতে পারবোনা।

ছেলে পক্ষের লোক জন খাওয়া দাওয়া করলেন।

খাওয়া দাওয়া শেষে কিছু ক্ষণ পরই বিয়ে পড়ানো শুরু হলো,

আমার এবার বুক ফেটে কান্না পাচ্ছে।
খুব কষ্টে নিজেকে কন্ট্রোল করে রেখেছি,

কিন্তু যেই না আমাকে কবুল বলতে বলা হলো,

আমি আর আমার কান্না ধরে রাখতে পারলাম না।

হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম।

সবাই আমাকে থামতে বলছে,
আর বলছে কবুল বলতে,

অবশেষে আমি বলে দিলাম কবুল।

সবাই বললেন আলহামদুলিল্লাহ্‌।

আমাদের বিয়ে সম্পূর্ণ হলো।

সন্ধ্যার দিকে আমি আম্মু আব্বুকে বিদায় জানিয়ে শশুড় বাড়ী পৌছে গেলাম।

সবাই আমাকে মিষ্টি মুখ করিয়ে বরণ করে নিলেন।

রাতে সবাই আমাকে খেতে বলছে,
আমার পেটে ক্ষুধা থাকা সত্ত্বেও আমি খেলাম না।

খেতে ইচ্ছে করছিলোনা।

পরে আমার শাশুড়ি মা জোড় করে আমাকে কয়েক লোকমা ভাত খাইয়ে দেন।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমার বরের এক ভাবী এসে আমাকে আমার বরের রুমে নিয়ে যান।

আমাকে খাটে বসিয়ে বলেন,
কোন কিছু দরকার হলে আমাকে ডেকো,কেমন?

আমি আচ্ছা ভাবী বললাম।

ভাবীটা আমার বরের চাচাতো ভাইয়ের ওয়াইফ।
আমার বরের কোন আপন ভাই নেই।

আমি বসে আছি,

আর দরজায় নক করে প্রবেশ করলো আমার বর।
যাকে কিছু ক্ষণ আগেই আমি কবুল বলে স্বামীর স্বীকৃতি দিয়েছি।

তিনি রুমে এসেই খাটে এসে আমার পাশে বসে পড়লেন।
আর তার বসা মাত্রই আমি বলে উঠলাম,

এই যে শুনুন,কথা টা সিনেমার ডায়লগ মনে হলেও এটাই সত্যি যে,

আপনি চাইলে আমার দেহ পাবেন কিন্তু আমার মন আর ভালবাসা পাবেন না।

আমার বর আমার কথা শুনে যেন আকাশ থেকে ধপাস করে মাটিতে পড়লো।তার হাসি ভরা মুখটা যেন বিস্ময়ে ছেয়ে গেলো।তার তার মুখে যেন একটা বড় করে আঁকা একটা প্রশ্ন বোধক মার্ক দেখছি আমি।

আর তখনই তিনি আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে জোরে শব্দ করে বললেন,

-হুয়াট?
হুয়াট আর ইউ সে’ইং?

-ওই বেশি ইংলিশ বলতে আসবেন না ওকে?
আমি আপনার থেকে বেশি শিক্ষিত।
আমি মাস্টার্স পাশ আর আপনি ইন্টার পাশ।কথাটা মাথায় রাখবেন।

আমার বর কথা টা শুনে আমার হাত ধরে আমাকে খাট থেকে এক টানে নামিয়ে হেঁচকা টানে তার বুকের কাছাকাছি এনে বলে,

তবেরে…
দাঁড়া বুঝাচ্ছি তোকে তোর শিক্ষিতগিরি..

চলবে কী?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *