জীবন

জীবন !! Part- 02

ভাইয়ার কথা শুনে আমার গলা শুকিয়ে গেলো।
হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেলো।
রাত পেরুলেই ভাইয়ার বিয়ে।
আর ভাইয়া এসব কি বলছে?
আর আমিই বা এখন কি করবো?

মাথা কোন কাজ করছেনা।
একদিকে চিন্তা হচ্ছে ভাইয়া যদি সত্যি সত্যি ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে তার জীবন দিয়ে দেয়,তখন কি হবে?
আবার ভাবছি,ভাইয়ার জীবন বাঁচাতে যদি আমি ভাইয়ার সাথে পালিয়েও যাই,তাহলে শুধু তার জীবনটাই বাঁচানো হবে।
না পাবে সে আমার কাছ থেকে ভালবাসা না পাবে স্বামীর সম্মান।
আর এদিকে তিন পরিবারের মান সম্মান নষ্ট হবে।

কি করবো ভাবতে ভাবতে ভাইয়া একটা মেসেজ দিলো।

-তুই কি আসবি?
নাকি আমি আমার জীবন দিয়ে দিবো?

আমি মেসেজ দিলাম,

-না ভাইয়া আমি আসছি,আপনি আমাদের বাসার মেইন গেটের সামনে এসে দাঁড়ান।

আমি আস্তে আস্তে আমার রুমের দরজা দিয়ে বেড়িয়ে বাইরে যাই।

ভাইয়া আমাদের বাড়ীর গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে।

অথচ তার বাসায় ধুম ধারাক্কা নাচ গান হচ্ছে।

বাড়ীর সবাই আত্মীয় স্বজন সবাই মিলে আনন্দ করছে।

-এসেছিস?
চল এখন হাত ধর আমার,তারপর আমরা অনেক দূরে চলে যাবো।
তারপর বিয়ে করে নিবো।পরিস্থিতি যখন স্বাভাবিক হয়ে যাবে তখন আবার চলে আসবো।

ভাইয়া এ কথা বলেই আমার হাত ধরে।

-ভাইয়া দাঁড়ান।
-কি হলো আবার?
-কেন আজ এমন ডিসিশন নিলেন আপনি?
আপনার মনে যদি এই ছিলো তাহলে কেন বিয়ের আয়োজন করলেন?কেন এত টাকা খরচ করালেন দুই পরিবারের?

-দেখ এত কিছু জানিনা আমি,তবে আমার পক্ষে অন্য কাউকে বউ হিসেবে মেনে নেয়া সম্ভব না।
আমি হলুদের আসরে বসেছি ঠিকই,কিন্তু চোখ বন্ধ করলে আমি তোকেই হলুদ শাড়ীতে দেখেছি।
আমাকে যখন সবাই হলুদ দিয়েছে,
আমি কল্পনায় ওই মেয়ে কে না,আমি তোকে দেখেছি,আমি চোখ বন্ধ করলে দেখেছি আপুরা তোকে হলুদ দিচ্ছে।
আমি একটা মেয়েকে এভাবে ঠকাতে পারবোনা।
আর সারাজীবন নিজে ঠকে যেতে পারবোনা।

জীবন তো একটাই বল?
কে চায়,নিজের জীবন টা এভাবে নষ্ট হতে দিতে?
তাও আবার জেনে শুনে?

আমি তোকে ভুলতে পারবোনা।
আমি তোর স্মৃতি মুছতে পারবোনা।

-সেটা আগে ভাবা দরকার ছিলো।বিয়ে ঠিক হবার আগে।

এখন আমি যদি আপনার জীবন বাঁচাতে আপনার হাত ধরে পালাই তাহলে কি হবে জানেন?

তিন টি পরিবারের মান সম্মান ধূলোয় মিশে যাবে।
আপনি কি চান এটা?
রাস্তায় আপনার মা বাবা,আমার মা বাবা এমনকি আপনার হবু বউ এর মা বাবা বেরুতে পারবেনা।
সবাই আবোলতাবোল কথা বার্তা বলবে।

-শোন,দু মাস পরই সব ঠিক হয়ে যাবে।
কেউ আর কাউকে নিয়ে আজ কাল এত ভাবেনা।

-কিন্তু একটা বার ওই মেয়েটার কথা কি ভেবে দেখেছেন?যে আপনার নামে হাতে মেহেদী লাগিয়েছে।
যে আপনার বাসা থেকে দেয়া হলুদ গায়ে মেখে নতুন সকাল টার অপেক্ষা করছে।

দু চোখ ভরে স্বপ্ন সাজিয়ে বসে আছে,
কখন লাল টুকটুকে বেনারসিতে বউ সাজবে।

ভেবে দেখেছেন একটা বার ওই মেয়েটার কথা?
তার কি হবে?
লোক লজ্জার সম্মুখীন হবার আগে মেয়েটা যদি সুইসাইড করে?

-আরে ধুর,একটা বিয়ে ভাংলে আরেকটা হয়ে যাবে।তুই এত কিছু ভাবিস নাতো।

-আমার ভাবতে হয়,কারণ আমিও একটা মেয়ে।

যখন মেয়েটা রাস্তায় বের হবে সবাই তাকে দেখে কি বলবে জানেন?

সমাজের লোক কি বলবে জানেন?

বলবে,

ওই যে ওই মেয়েটার না হলুদ হয়েছে কিন্তু বিয়ে হয় নাই।
আহারে বেচারি।

আবার কেউ বলবে,নিশ্চই মেয়েটার কোন সমস্যা আছে তাইতো ছেলে পক্ষ বিয়ের দিন বিয়ে ভেঙে দিয়েছে।

আর যেই ছেলে পক্ষই তাকে দেখতে আসবে,আশেপাশের লোক জন বলবে মেয়ের একবার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো,হলুদ হয়েছে কিন্তু বিয়ের দিন আর বিয়ে হয়নি।

আবার কেউ কেউ বলবে,মেয়ের কিন্তু আগেও একটা বিয়ে হয়েছিলো।

আর এই কথা শুনলে কোন ছেলে বিয়ের জন্য আগাবে বলতে পারেন?

কেউ সেটা দেখবেনা যে,হবু বর হলুদের রাতে পালিয়ে গেছে।
কারণ হবু বর একজন ছেলে।
তার দোষ টা সমাজে আড়াল হয়ে যাবে।

দোষ না থাকা সত্বেও দোষী হবে নিষ্পাপ মেয়েটা।
কারণ সে একজন মেয়ে।আপনার মত সে ছেলে না।যে সমাজ রার দোষ ঢাকবে।

আর এসব হবার আগেই মেয়েটা যদি সুইসাইড করে নেয় তখন নিজেকে মাফ করতে পারবেন তো?

পারবেন তো একটা জীবন অকালে নষ্ট করার অপরাধী হয়ে সারাজীবন বাঁচতে?

পারবেন,খুনী না হয়েও খুনী হয়ে বাঁচতে?

ভাইয়া চুপচাপ আমার কথা গুলো শুনে যাচ্ছে।
কোন কথা বলছেনা।
তবে তিনি এখনো আমার হাত ছাড়েন নি।

আর সব চেয়ে বড় কথা কি জানেন ভাইয়া?
আমি আজ আপনার সাথে পালিয়ে গিয়ে আপনার জীবন ভিক্ষা দিতে পারবো ঠিকই।
কিন্তু কোন দিন আপনাকে আমি স্বামীর মর্যাদা দিতে পারবোনা।
আমি আপনাকে ছোট বেলা থেকে শুধু ভাই ভেবে এসেছি।সেই ভাই এর আসন থেকে সরিয়ে আপনাকে আমি স্বামীর আসনে বসাতে পারবোনা।

আপনি আমার দেহ পাবেন,
কিন্তু ভালবাসা আর মন কোন দিনও পাবেন না।
ডায়লগ টা সিনেমার মত হয়ে গেলেও এটাই সত্যি।

কথাটা বলার সাথে সাথে ভাইয়া আমার হাত ছেড়ে দিয়ে গালে একটা ঠাস করে থাপ্পড় লাগিয়ে দেয়।

আমি আমার মাথা টা নিচু করে ফেলি।

-আমি তোকে ভালবাসি,
তোর শরীর টাকে না।
কথা টা মনে রাখিস।

আর একদিন ঠিক তুই আমার ভালবাসাটাকে বুঝবি কিংবা আমার কষ্ট গুলোকে।
কিন্তু সেদিন খুব দেরি হয়ে যাবে।খুব দেরি।

জানিস,সেই ছোট বেলা থেকে তোকে আমি ভালবেসে এসেছি।
আমার জীবনে তোর আগে কোন দিন কেউ আসেনি।
কাউকে আমি ভালবাসতে পারিনি।হঠাৎ যখন তুই বড় হয়ে গেলি,
একদিন শুনি তোর জন্য একজন বিয়ের প্রস্তাব দিবে।

শুনেই বাসায় এসে ভাঙচুড় শুরু করি।
আমি সহ্য করতে পারছিলাম না।
আর ওইদিনই কাকীকে আমি বলি,
আমি পৃনয়ীকে ভালবাসি।
ওকে আমি বিয়ে করতে চাই।

সেই ছোট বেলার ভালবাসা তুই আমার।দুই এক দিন কিংবা দুই এক বছরের ভালবাসা না।
যে চাইলেই ভুলে যেতে পারবো।

তোর মনে আছে?তুই আরো কয়েক বছর আগে একবার দাড়িয়াবান্ধা খেলা খেলতে গেয়েছিলি সবার সাথে।
আর তখন খেলার মধ্যে আপুরা আর জেরিন তামান্নারাও ছিলো।জেরিন খেলার মধ্যেই তোকে আউট করার জন্য একটা থাপ্পড় দিয়েছিলো,
থাপ্পড় টা তোর জোড়ে লেগেছিলো বলে তুই কান্না করে দিয়েছিলি।

মনে আছে তোর?

সেদিন আমিও খেলায় নেমে গেলাম আর বললাম আমিও খেলবো,সবাই বল্লো আমি ছেলে আমাকে নেয়া যাবেনা।

কিন্তু খুব কষ্ট করে সবাইকে আমি রাজি করিয়ে খেলায় ঢুকলাম।

কেন ঢুকেছিলাম জানিস?

-নাতো।
-জেরিনকে থাপ্পড় মারার জন্য।আর যেই না আমি ওকে থাপ্পড় মারতে পেরেছি,তারপরই আমি খেলা থেকে বেড়িয়ে এসেছি।মনে করে দেখ।

যদিও কাজ টা আমার ঠিক হয়নি।
পরে আমি জেরিনের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলেছিও ভুলে এত জোড়ে থাপ্পড় টা লেগে গেছে।

অথচ আসল কারণ ছিলো তোর চোখের জল।
যা আমি সইতে পারিনি সেদিন।

এসব বলে তোকে আর লাভ নেই।

ভালো থাকিস।তোকে খুব জ্বালিয়েছি।পারলে আমাকে ক্ষমা করিস।

কথা গুলো বলেই ভাইয়া তার বাড়ীর দিকে পা বাড়ালেন।

আমি ভাইয়াকে পেছন থেকে ডেকে বললাম,

-ভাইয়া,জীবনে অনেক অনেক সুখী হন।
দোয়া রইলো।

ভাইয়া আমার দিকে একবার ফিরে তাকিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলেন।

আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আমার বাসার ভেতরে এসে পড়লাম।

সকাল হয়ে গেছে।

ভাইয়ার রুমের জানালা দিয়ে আমার রুমের জানালা দেখা যায়।

আমার বাসা আর ভাইয়ার বাসার মাঝ খানে অল্প একটু গ্যাপ।

ভাইয়া সকাল হতেই জানালার সামনে এসে দাঁড়ায়।

আমি তাকে দেখা মাত্রই আমার রুমের জানালা টা বন্ধ করে দেই।

আর কিচ্ছু ক্ষণ পরই ভাইয়া বর সেজে বিয়ে করতে যাবে।

হঠাৎ কেন যেন বুকের ভেতর টায় হালকা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছি।

দুপুরের আযান দিতেই আমি জানালাটা কেন যেন খুলে দিলাম।

কেন যেন মনে হচ্ছিলো,

সালমানকে একটা নজর দেখি,

দেখি ওকে বর সাজলে কেমন লাগে।

কিন্তু সালমান আমাকে জানালা খুলতে দেখে ওর রুমের জানালাটা বন্ধ করে দেয়।

আমার আর দেখা হয়না সালমান কে,
বরের সাজে।

সালমান বিয়ে করতে যাচ্ছে,

যাবার সময় সবাই চিল্লাচিল্লি করছে,

কিন্তু আমার কেন যেন এসব আওয়াজ খুব অসহ্য লাগছে।

অথচ আমার তো আজ খুশি হবার কথা,

এত দিন পর আমার বিপদ টা দূর হয়ে যাচ্ছে।

আমাকে আজ থেকে কেউ আর জ্বালাবেনা।
কেউ বলবেনা আমি তোকে ভালবাসি।কেউ জানালা ধরে দাঁড়িয়ে থাকবেনা আমার জন্য,শুধু মাত্র একটা নজর আমাকে দেখার জন্য।

বা কেউ রাতের বেলা পাগলের মত ছুটে এসে হাত ধরে বলবেনা,চল আমরা পালিয়ে যাই।

কিন্তু এ কি হচ্ছে আমার সাথে,আমার কেন চোখ ভিজে যাচ্ছে,আমি তো আজ থেকে মুক্ত পাখি।

যা ইচ্ছা করতে পারি,কেউ নেই আমার জীবনে কাঁটা হয়ে দাঁড়াবার।

হঠাৎ খেয়াল করি আমার বুকের ভেতর টা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে,

চোখ থেকে অবিরত পানি বেরুচ্ছে।

তবে কি আমি সালমান ভাইয়াকে ভালবাসি?
তা কি করে সম্ভব?আমি তো তাকে ভালবাসি না।

কিন্তু তাকে যদি আমি ভালই না বাসি,তাহলে আমার চোখে আজ কিসের অশ্রু?
আমার বুকে এটা কিসের ব্যথা?

কেন বার বার ভাইয়ার মুখ টা চোখের সামনে ভেসে উঠছে?

সেই ছোট বেলা থেকে আজ অব্ধি তাকে দেখা প্রতিটি মুহূর্ত চোখের সামনে ভেসে উঠছে।

দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার।

আমি এত দিন যেটা বুঝিনি সেটা আজ বুঝতে পারছি।
যখন খুব কাছের জিনিষটি অন্য কেউ নিয়ে যায়,বা হারিয়ে যায়,তখন যেমন লাগে,আমার আজ ঠিক তেমন লাগছে।

হ্যাঁ আমি আজ বুঝেছি,
আমিও সালমানকে ভালবাসি।
ভালবেসে ফেলেছি আমি তাকে,তার পাগলামো গুলোকে।
যেই ভালবাসা আমি কোন দিন বুঝতে পারিনি।

ভাইয়া এখন বর সেজে আমার বাসার গেইটের সামনে এসেই দাঁড়িয়েছে,

কি অদ্ভুত পরিস্থিতি ফুল দিয়ে সাজানো গাড়ীটা আমার বাড়ীর সামনেই দাঁড় করানো।ওখান থেকেই সে গাড়ীতে উঠবে।

আমি দৌড়ে গেলাম গেটের সামনে,
আর ভাবতে লাগলাম,
পরে যা হয় দেখা যাবে,
আমি ভাইয়াকে এখনই গিয়ে বলে দিবো,
সালমান,
আমি পারছিনা তোমার বর সেজে অন্যের বাড়ী যাওয়াটা সহ্য করতে।
পারছিনা আমি।

কিন্তু আমি যেতে না যেতেই,ভাইয়া গাড়ীতে উঠে গেলো।আর গাড়ীটা চলতে শুরু করলো,

আর আমি আমাদের গেটের সামনেই দুপ করে মাটিতে বসে পড়লাম।

তবে কি আমি সারা জীবনের জন্য সালমানকে হারিয়ে ফেললাম?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *