গল্প ¦ অঙ্ক টিচার— পর্বঃ-৮
শারমিন আক্তার
__কক্সবাজারে যে দুদিন ছিলো সে দুদিন আয়াত আর তনয়া খুব সুন্দর সময় কাটিয়েছে। লিমার সাথেও ওরা দুজন অনেক জায়গায় ঘুরেছে। তনয়া আয়াতকে সুন্দর একটা শামুকের তাজমহলের শোপিচ গিফ্ট করলো। আয়াত প্রথমে নিতে চাইনি কিন্তু তনয়ার ছেলে মানুষির কাছে হার মানতে হলো।
তনয়াঃ স্যার জানেন তাজমহল হচ্ছে ভালোবাসার প্রতিক।
আয়াত তনয়ার কথার কোন উত্তর দিলো না। শুধু তনয়াকে সুন্দর একটা ওড়না গিফ্ট করেলো। তনয়া ওড়নাটা পেয়ে ভিষন খুশি।তনয়া মনে মনে ভাবছে হয়তো পরীক্ষার পর স্যার ওকে প্রপোজ করবে। হুম কিন্তু তনয়া সত্যিটা জানলে হয়তো নিজের হুশ হারিয়ে ফেলবে?
তরপর ওরা বাড়ি ফেরার দিনও তনয়া তিন বার বমি করে। আর তখন আয়াত ওকে ভিষন কেয়ার করেছিলো। বমি করার পর ক্লান্ত হয়ে তনয়া আয়াতের কাঁধেই ঘুমিয়ে ছিলো। তনয়া যখন আয়াতের কাঁদে মাথা দিয়ে ঘুমাচ্ছিল তখন গাড়ি চলার গতিতে তনয়ার মাথাটা বার বার নিচের দিকে পড়ে যাচ্ছিলো বলে আয়াত তার একটা হাত দিয়ে তনয়া মাথাটা ধরে রেখেছিলো।
আয়াত যখনই তনয়ার মুখের দিকে তাকায় তখনই অজানা এক প্রশান্তিতে আয়াতের বুকটা ভরে যায়। কেন যেনো তনয়ার থেকে নিজের চোখ সরাতে পারে না। তারপর নিজেই নিজেকে বলে মিথ্যা স্বপ্ন দেখে কোন লাভ নাই। কারন মিথ্যা সব মানুষকে শুধু মিথ্যা আশা দেয় আর কষ্ট দেয়। এর বাইরে কিছুই দেয় না।
তনয়া কিছুটা পথ ঘুমিয়ে ছিলো আর কিছুটা পথ ঘুমের অভিনয় করে ছিলো। কারন ঘুম ভাঙলে যে আয়াত তার কাঁধটা সরিয়ে নিবে। তনয়া আয়াতের কাঁধে মাথা রেখে ভাবছিলো ইশ এভাবে যদি সারা জীবন ওর কাঁধে মাথা রেখে থাকতে পারতাম! জানিনা কি লেখা আছে আমাদের ভাগ্যে? কিন্তু ভাগ্যে যাই লেখা থাকুক না কেন সারা জীবন আমি আমার অঙ্ক টিচারকেই ভালোবাসবো।
বরিশাল পৌছাতে পৌছাতে অনেক রাত হয়ে গেলো। প্রায় সব মেয়েদেরই বাড়ির লোক এসে তাদের নিয়ে গেলো। কিন্তু তনয়ার বাবা সেদিন শহরে ছিলো না তাই তনয়ার মা আয়াতকে ফোন করে বলেছে ও যেনো তনয়াকে বাড়ি পৌছে দেয়। তাই আয়াত তনয়াকে নিজের গাড়িতে করে তনয়াদের বাড়ির দিকে যাচ্ছে।
আয়াতঃ এখন কেমন লাগছে তনয়া?
তনয়াঃ জ্বি মোটামুটি ভালো।
আয়াতঃ তোমার কি জার্নি এলার্জি আছে?
তনয়াঃ জ্বি স্যার। আসলে আমি এতদূর বাসে কখনো ট্রাভেল করিনি।
আয়াতঃ ওহ! তোমার বাড়ি এসে গেছে।
তনয়াঃ ওহ! ভিতরে আসুন স্যার।
আয়াতঃ নাহ । অনেক রাত হয়ে গেছে। এখন আর ভিতরে যাবো না। বাড়ি যাবো!
তনয়াঃ ওকে! কিন্তু একবার গাড়ি থেকে বাইরে বের হন?
আয়াতঃ কেন?
তনয়াঃ আরে আগে বের হন তারপর বলছি?
আয়াত গাড়ি থেকে বের হয়ে দাড়াতেই তনয়া হুট করে আয়াতকে জড়িয়ে ধরলো। আয়াত কিছুটা হতবাগ হয়ে গেলো। তনয়া অনেক্ষন আয়াতকে জড়িয়ে ধরে বললো——
তনয়াঃ আমি জানিনা পরীক্ষার পর আপনার সিদ্ধান্ত ঠিক কি হবে? কিন্তু এই যে দুটো দিন আপনার সাথে কাটালাম। এটা আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরনীয় দিন হয়ে আমার মনের মনিকোঠায় সারা জীবন গেঁথে থাকবে। আপনি যেমন আমার মনে গেঁথে আছেন ঠিক তেমনি এই স্মৃতিগুলো গেঁথে থাকবে! ধন্যবাদ স্যার। আমার সাথে এত সুন্দর দুটো দিন কাটানোর জন্য।
আয়াত আর কিছু বললো না। নিজেকে তনয়ার থেকে ছাড়িয়ে চুপচাপ চলে গেলো।
পরে দিন থেকে সবাই লেখা পড়া নিয়ে অনেক ব্যাস্ত হয়ে পরে। কারন সামনে পরীক্ষা। আয়াত তনয়ার সাথে কথা বলে কিন্তু খুব কম। তনয়াও পড়ার প্রেসারে আপাতত ভালোবাসার পোকাগুলোকে বাক্সে বন্ধ করে রেখেছে।
ওদের পরীক্ষা শুরু হলো। পরীক্ষার মধ্যেই তনয়া আঠারোতে পা দিলো। কিন্তু পরীক্ষার করনে কোন সেলিব্রেশন হয়নি। আজ ওদের পরীক্ষা শেষ হলো। তনয়ার পরীক্ষা খুব ভালো হলো। কারন ও আয়াতকে প্রমিস করেছিলো। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর তনয়া অধির আগ্রহে আয়াতের ফোনের অপেক্ষা করতে লাগলো। কিন্তু প্রায় একমাস হয়ে গেছে কিন্তু আয়াত ওকে দেখা করতে বলছে না! ফোনে তনয়ার সাথে কথা হলেও এ বিষয়টা আয়াত সবসময় এড়িয়ে যায়।
এড়িয়ে যাবে নাতো কি করবে? আয়াতের তো তনয়ার মুখোমুখি হতেই ভয় করে। ঠিক কি বলবে ওকে? কিন্তু তনয়া আর অপেক্ষা করতে পারছে না। তাই সরাসরি আয়াতকে ফোন দিয়ে বললো আপনি দেখা করবেন নাকি আমি আপনার বাসায় আসবো?
আয়াতঃ না না তার দরকার নাই। আসলে আমিতো এখন কিছু কাজে ঢাকা এসেছি দু সপ্তাহ পর আসতেছি। যেদিন আসবো তার পরের দিনই তোমার সাথে দেখা করবো।
দু সপ্তাহ পর
তনয়া একটা রেস্টুরেন্টে বসে আয়াতের জন্য অপেক্ষা করছে। এই দু সপ্তাহ যে তনয়া ঠিক কি ভাবে কাটিয়েছে তা শুধু তনয়াই জানে? কিছুক্ষন পর আয়াত আসলো। তনয়ার বুকটা দুরু দুরু করছে আয়াত ঠিক কি বলবে এটা ভেবে?
আয়াতঃ কেমন আছো?
তনয়াঃ হুমম ভালো। আপনি?
আয়াতঃ ভালো। কিছু খাবে?
তনয়াঃ না না স্যার। স্যার———
তারপর দুজন অনেক্ষন নীরবতা পালন করলো। ।
কিন্তু তনয়া আর অপেক্ষা করতে পারছে না। গত চার বছরের বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করছে। তাই মুখ ফসকে বলে ফেললো—-
তনয়াঃ স্যার আপনি যেনো কি বলতে চাইছিলেন?
আয়াতঃ হ্যা। কিন্তু ঠিক কিভাবে বলবো সেটা ভাবছি?
তনয়াঃ এত ভাবাভাবির দরকার নাই। সরাসরি বলে দেন। আমি শোনার জন্য রেডি। (তনয়া মনে মনে বলছে প্লিজ আল্লাহ ভালো কিছু যেনো বলে!)
আয়াত কিছুক্ষন ভেবে বললো
আয়াতঃ তনয়া আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।
তনয়া অবাক চোখে আয়াতের দিকে তাকালো।
তারপর আয়াত ওর বাবার ওর ভাইয়ার সব কথা বললো। এও বললো সামনের মাসের শেষের দিকে আমার বিয়ে। আর সেই মেয়েটি কিছুক্ষন পর এখানে আমার সাথে দেখা করতে আসবে।
আয়াতের কথা গুলো শোনার পর তনয়ার পুরো পৃথিবীটা যেনো গোলক ধাঁধাঁর মত ঘুরছে। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। নিজের ওপর যেনো কোন নিয়ন্ত্রন রাখতে পারছে না। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু শত কষ্টে তনয়া নিজেকে আটকাচ্ছে।
আয়াতঃ প্লিজ তনয়া আমাকে মাফ করে দেও। আর প্লিজ নিজের ওর নিয়ন্ত্রন রাখার চেষ্টা করো। আসলে আমি——
তনয়াঃ থাক স্যার। আপনার আমাকে কোন এক্সপ্লেনেসন দেয়ার দরকার নাই। আমি আপনাকে জানি!
আর আয়াতকে অবাক করে দিয়ে তনয়া বললো মেয়েটির নাম কি স্যার?
আয়াতঃ আমি জানি না?
তনয়াঃ কি বলেন? যার সাথে বিয়ে হবে তার নাম জানেন না? দিস ইজ নট ফেয়ার স্যার? আচ্ছা ভাবি কি এখন আসবে?
আয়াতঃ তনয়ার কথায় হতবাগ হয়ে গেলো তারপর বললো হুমম।
তনয়াঃ আমি কি তাকে একবার দেখতে পারি? ভয় নাই আমি আমার বিষয়ে কিছু বলবো না।
আয়াতঃ তনয়া! আর ইউ ওকে?
তনয়াঃ কেন? ইয়েস স্যার আই অ্যাম এবসোলেটলি ওকে। আরে আপনি আবার এটা ভাবছেন নাতো যে আমি উল্টা পাল্টা কিছু করে ফেলবো? পাগল নাকি! স্যার আমি তনয়া! আর আমি এতটা সাহসি নই যে নিজের জাহান্নামের টিকিট নিজে কাটবো।
তনয়ার এমন কথা শুনে আয়াতের মুখের ভাষা যেনো হারিয়ে গেছে। কিছু বলতে পারছে না।
কিছুক্ষনের মধ্যে সেই মেয়েটা আসলো। এসে আয়াতকে বললো—–
——আর ইউ আয়াত? আই অ্যাম অবনী।
আয়াতঃ খুব শুষ্ক ভাবে ইয়েস! বসুন।
অবনীঃ ওনি? তনয়াকে উদ্দেশ্য করে?
তনয়াঃ বেশ হাসি মুখে বললো হাই আই অ্যাম তনয়া? আয়াত স্যারের—— স্টুডেন্ট।
অবনীঃ ওহ! হাই।
তনয়াঃ তো আপনি আমাদের ভাবি হবেন?
অবনীঃ লজ্জা পেয়ে হুমমম।
তনয়াঃ আপনি জানেন আপনি অনেক লাকি! কারন আপনি আয়াত স্যারকে নিজের জীবন সঙ্গী হিসাবে পাচ্ছেন! স্যার অনেক ভালো মানুষ। এখানে এসেছিলাম কিছু কাজের জন্য কিন্তু স্যারকে দেখে তার সাথে একটু কথা বললাম। আই হোপ ইউ ডোন্ট মাইন্ড।
অবনীঃ নো নো।
তনয়াঃ আচ্ছা আমি তাহলে আসি। কিছু কাজ আছে। বাই ভা——বি। বাই স্যার।
তনয়া একটিবারও আয়াতের দিকে তাকালো না। শুধু সামনের দিকে তাকিয়ে হাটছে। আজ তনয়া পা দুটো যেনো চলছে না। মনে হচ্ছে পিছন থেকে কোন অদৃশ্য শক্তি ওর পা দুটোকে আটকে রেখেছে।।
কিন্তু তনয়ার এমন আচারনে আয়াত অনেক অবাক হলো। তনয়া চলে যাচ্ছে। আয়াত হা হয়ে ওর যাবার পানে তাকিয়ে আছে। তনয়া নিজের অবাধ্য চোখের জলগুলোকে মোছার বৃথা চেষ্টা করছে। আয়াত বুঝতে পারছে তনয়ার মনের অবস্থা। কারন আয়াতের মনের অবস্থাওতো একই রকম।
তনয়া চলে যাবার পর আয়াত নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারছে না। তাই অবনীকে বললো আমার খুব মাথা ব্যাথা করছে। আমরা কি পরে একদিন কথা বলতে পারি?
অবনী বললো ঠিক আছে।
আয়াত বাড়ি এসে বার বার তনয়াকে ফোন করছে। কিন্তু কেউ ফোন ধরছে না। তারপর বাধ্য হয়ে তনয়ার বাবার ফোনে ফোন করে বললো আঙ্কেল তনয়া কি করছে?
তনয়ার বাবা বললো তনয়া নাকি টিভি দেখছে। কাটুর্ন দেখছে আর পাগলের মত হাসছে। এই মেয়েটানা পুরো পাগল। আয়াত বললো আঙ্কেল ফোনটা একটু তনয়াকে দিবেন? তনয়ার বাবা ফোনটা তনয়াকে দিয়ে বললো আয়াত ফোন করেছে।
তনয়াঃ হ্যালো স্যার কেমন আছেন? ভাবি কেমন আছে? স্যার শোনেন বিয়ে করছেন আমাদের কিন্তু বড় করে একটা ট্রিট দিতে হবে! ঠিক আছে?
আয়াত তনয়ার এরূপ কথা শুনে পুরো থ হয়ে গেলো।
তারপর প্রায় রোজ আয়াত তনয়াকে ফোন করতো কারন আয়াত তনয়াকে নিয়ে খুব ভয়ে থাকতো। কিন্তু রোজ তনয়া এমন ভাবে কথা বলতো যেনো কিছুই হয়নি। যেনো তনয়ার স্মৃতি থেকে আয়াত নামটা সম্পূর্ন মুছে গেছে। আয়াত তনয়ার এমন আচরনে দ্বিধার মধ্যে পড়ে যেতো। খুব ভয় হতো আয়াতের করতো তনয়াকে নিয়ে।
আয়াতের যেদিন বিয়ে হবার কথা তার কিছুদিন আগে তনয়ার রেজাল্ট দেয়। তনয়া এবারও A+ পায়। সবাই খুব খুশি হয় আয়াতও। কিন্তু এত খুশির মাঝেও আয়াত আর তনয়ার বুকের ভিতরটা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।
আর আজ আয়াতের গায়ে হলুদ।
আর মজার ব্যাপার কি জানেন আয়াতের গায়ে প্রথম হলুদটা তনয়াই ছুয়েছে। আর গিফ্ট হিসেবে আয়াতের দেয়া ওরনাটা আয়াতকে দিয়ে বলেছে—-
তনয়াঃ এটা অবনী ভাবির জন্য। কারো শখের জিনিস নিজের কাছে রাখতে নেই।
আয়াত কোন কথা না বলে চুপচাপ ওড়নাটা হাতে নিলো।
সবার সাথে খুব হাসি হাসি মুখ করে কথা বলছে তনয়া। কিন্তু ওর মনের ভিতরটা হয়তো আয়াত ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারছে না। গায়ে হলুদ পর্ব শেষে আয়াত তনয়াকে বললো তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে? আমার সাথে এসো। তনয়া আয়াতের সাথে সাথে গেলো।
তনয়াঃ হ্যা বলুন স্যার?
আয়াতঃ তনয়া তুমি কি করে এতটা স্বাভাবিক আছো? বলো?
তনয়াঃ কেন স্যার অস্বাভাবিক হওয়ার মত কিছু হয়েছে কি?
আয়াত এবার নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারলো না। ঠাস করে তনয়ার গালে কষিয়ে একটা চড় মেরে দিয়ে বললো——-
আয়াতঃ এই মেয়ে তুমি কি কিছু বোঝো না নাকি? নাকি তোমার বোধগাম্য শক্তি সব শেষ হয়ে গেছে?
তনয়াঃ (তনয়া নিজের গালে হাত দিয়ে) আবার মারলেন? এবার কোন অধিকারে মারলেন?
আর হ্যা ইউ আর টুু লেট স্যার!
আর ————-
চলবে———