খুব যতনে ভালোবাসি তারে ! Part- 04
এবার আমি জানালার কাচ নামিয়ে বললাম,
-তোমাদের মধ্যে লিডার কে?
আমার কথা শুনে একজন হিজরা এগিয়ে এসে বললো,
-কেন রে? কেন রে? তুই কি আমাদের লিডারকে বিয়ে করবি রে?
এই বলে ওরা সবাই হেসে উঠলো এবং নিজেদের ভঙ্গিমায় হাত তালি দেয়ার মাধ্যমে উল্লাস করতে লাগলো। এদিকে আমাদেরও দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি এবার আবারো বললাম,
-তোমাদের লিডারকে আসতে বলো। আমি তার হাতেই টাকা দিব।
এবার ওদের লিডার এলো। আমি তার হাতে পাঁচ হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়ে বললাম,
-নাও, এটা রাখো। আর আগামী পরশুদিন আমার সাথে দেখা করো।
জানিনা কেন ওরা আমার সাথে আর কোন বাজে আচরণ করেনি। এরপর ওরা আমাদের রাস্তা থেকে সরে দাঁড়ায়। আমাদের বহনকারী গাড়িগুলো আবার ছুটে চলতে শুরু করে আপন গন্তব্যের পথে।
হিজরারা যখন আমাদের বরযাত্রার গাড়িগুলোকে ঘেরাও করে ফেলেছিলো তখন আশেপাশে আরো প্রায় অর্ধশত লোক জড়ো হয়ে গিয়েছিলো। তারা সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছিলো। আমাদের দেশে এই চিত্রটা খুবই পরিচিত। যদি কোথাও আগুন লাগে তবুও বহুলোক সেটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপভোগ করে। ছবি তুলে, ভিডিও ধারণ করে। কাউকে দিনেদুপুরে পিটিয়ে-কুপিয়ে মেরে ফেলতে থাকলেও লোকজন দাঁড়িয়ে থেকে সেই একই কাজ করে! এই সংস্কৃতির পরিবর্তনের দরকার। তখন হিজরাদের প্রতি আমার মোটেও কোন বিরক্তি আসেনি। আসেনি কোন ঘৃণা। যেটুকু বিরক্তি আর ঘৃণা জন্মেছিলো মনে তার পুরোটাই ছিলো আশেপাশে এসে জড়ো হয়ে মজা দেখতে থাকা মানুষগুলোর প্রতি। বরং আমার কাছে প্রকৃতার্থে ওদেরকেই হিজরা বলে মনে হয়েছিলো।
আমি একদম চুপচাপ বসে আছি। এমন সময় আতিক বলে উঠলো,
-ভাই, মানুষ হিজরা হয় কেন? এর কি কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে?
আমি ওর দিকে তাকাতেই ও বলে উঠলো,
-আমি জানি এখন তোমার মোড অফ। তবুও, বলোনা যদি তেমন কোন ব্যাখ্যা থাকে। কথা বলতে বলতে গেলে দেখবে মন ভালো হয়ে যাবে।
ওকে আমি খুব ভালো করেই চিনি। যেভাবেই হোক ও আমার থেকে ঠিক কথা বের করে নিবে। আমি এবার বলতে লাগলাম,
– হুম, মানুষ কেন হিজরা হয় এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে। ‘মানুষ হিজরা হওয়ার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হলো, “XX প্যাটার্ন ক্রোমোজমে কন্যা শিশু আর XY প্যাটার্ন ক্রোমোজমে সৃষ্ট হয় ছেলে শিশু। অর্থাৎ, X এর সঙ্গে X এর মিলনে মেয়ে এবং X এর সঙ্গে Y এর মিলনে ছেলে সন্তান জন্ম নেয়। এবং নারীরা XX ও ছেলেরা XY ক্রোমোজম ধারণ করে। ভ্রুনের পূর্ণতার স্তরগুলোতে ক্রোমোজোম প্যাটার্নের প্রভাবে ছেলে শিশুর মধ্যে অন্ডকোষ আর কন্যা শিশুর মধ্য ডিম্ব কোষ জন্ম নেয়। অন্ডকোষ থেকে নিসৃত হয় পুরুষ হরমোন এন্ড্রোজেন এবং ডিম্ব কোষ থেকে নিসৃত হয় এস্ট্রোজেন। এক্ষেত্রে ভ্রুনের বিকাশকালে নিষিক্তকরণ ও বিভাজনের ফলে বেশকিছু অস্বাভাবিক প্যাটার্নের সৃষ্টি হয় যেমন XXY অথবা XYY। এর ফলে বিভিন্ন গঠনের হিজড়া শিশুর জন্ম হয়।
একটা ব্যাপার হল, একটি হিজরা শিশুকে পরিণত বয়সে যাওয়ার আগে যদি যথযথ মেডিকেল ট্রিটমেন্ট করা হয় তাহলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাকে সুস্থ করা সম্ভব। কিন্তু যখন বোঝা যায় সে সাধারণ আর দশজনের থেকে আলাদা তখন আসলে অনেক দেরি হয়ে যায়। একইভাবে কোন পুরুষ বা নারীও হিজরা হতে পারেন।’
আতিক আমার মুখে কথাগুলো শুনে একেবারে অবাক হয়ে গেলো। এবার আরো কৌতুহলী হয়ে বললো,
-আর ইসলাম কি বলে এটা সম্বন্ধে?
আমি,
-আর ইসলামের দৃষ্টিতে এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, ‘হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন : হিজরারা জীনদের সন্তান। কোনো এক বাক্তি আব্বাস (রাঃ) কে প্রশ্ন করেছিলেন এটা কেমন করে হতে পারে। জবাবে তিনি বলেছিলেন “আল্লাহ্ ও রাসুল (সাঃ) নিষেধ করেছেন যে মানুষ যেন তার স্ত্রীর মাসিক স্রাব চলাকালে যৌন সংগম না করে”, সুতরাং কোনো মহিলার সঙ্গে তার ঋতুস্রাব হলে শয়তান তার আগে থাকে এবং সেই শয়তান দ্বারা ঐ মহিলা গর্ববতী হয় ও হিজড়া সন্তান প্রসব করে। (মানুষ ও জিন এর যৌথ মিলনজাত সন্তানকে ইসলাম এ বলা হয় “খুন্নাস”)। (প্রামাণসূত্রঃ সূরা বাণী ইসরাইল- আর রাহমান -৫৪, ইবনে আবি হাতিম, হাকিম তিরমিজি।)’
আসলে কি জানিস আতিক, কেউ তার নিজের দোষে হিজরা হয়না। হিজরার হিজরা হওয়ার পেছনে তার নিজের কোন হাত থাকেনা। বর্তমানে বিশ্বের বহু দেশেই হিজরাদের স্বীকৃতি রয়েছে। বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তৃতীয় লিঙ্গের বা হিজড়াদের অবস্থান ধীরে ধীরে আরোও দৃঢ় হচ্ছে। বাংলাদেশ তাদেরকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ২০১৪ সালে। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড ২০১১-১২ সালে তৃতীয় লিঙ্গের জন্য নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে জার্মানি সর্বপ্রথম হিজড়া জনগোষ্ঠীকে অনির্ধারিত লিঙ্গ হিসেবে জন্ম সনদ নিবন্ধনের মাধ্যমে স্বীকৃতি দেয়। ভারত ২০১৪ সালের এপ্রিলে তৃতীয় লিঙ্গকে স্বীকৃতি দেয় এবং পাকিস্তান সরকারও ২০০৯ সালে হিজড়াদের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র প্রণয়ন করে। যদিও মালদ্বীপসহ আরো ৫৪ টি দেশ জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত লিঙ্গ পরিচিতির বিরোধিতা করে আসছে।
আতিক আমার কথাগুলো শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো,
-হুম ভাই বুঝলাম এবার।
আমাদের গাড়ি যদি ওরা না আটকাতো তাহলে এতগুলো কথা হয়ত ওকে আমার বলতে হতোনা। বলে অবশ্য ভালোই হয়েছে, ওর মনে হিজরাদের সম্বন্ধে সঠিক ধারণাটা এসেছে। হিজরাদের জীবনমানের উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও তাতে ওদের যে ইনকাম হয় তার চেয়ে বরং রাস্তাঘাটে ভিক্ষাবৃত্তির নামে চাঁদাবাজি করে ওরা তার চেয়েও হাজারোগুণ বেশি টাকা ইনকাম করে ফেলে। তাই ওরা এসব বন্ধ করতে চায়না। কাজেই, জনসাধারণের ভোগান্তি নিরসনে বিষয়টিকে নিয়ে আরো গুরুত্বের সাথে সংশ্লিষ্টদের কাজ করা দরকার বলে আমি মনে করি।
এবার আতিকও চুপ আমিও চুপ। গাড়ি সামনের দিকে এগিয়ে চলছে আর আমি ভাবছি, আল্লাহর দুনিয়ায় কতরকমের মানুষের বসবাস! এই হিজরাদের উগ্র আচরণে আর কাজকর্মে গ্রামে-শহরে কতশত মানুষ অতিষ্ঠ। অথচ, আমাদের দম্পতিরা চাইলেই সচেতনতার মাধ্যমে হিজরা সন্তান জন্ম ঠেকানোর চেষ্টা করতে পারে।
নেত্রকোণা শহরে জুমার নামাজের আগে আগে গিয়ে পৌঁছুলাম আমরা। নামাজ পড়ে রওয়ানা হলাম তানহার ফুফুর বাসার উদ্দেশ্যে। সম্পূর্ণ ঘরোয়া পরিবেশে বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। আমি বলেছিলাম যেন এসব গেট বাঁধার ঝামেলায় না যান তারা। কথা শুনেছেন আমার। অনেক সময় দেখা যায় গেট পাসের টাকা নিয়ে কথা কাটাকাটিতে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটে। এমনকি তার জেরে বিয়ে পর্যন্তও ভেঙে যায়! আমাদের আগমনের খবর পেয়ে তাঁরা এসে সাদরে গ্রহণ করে নেয় আমাদের। বাসার ভেতরেই সকলের আপ্যায়নের সবধরনের ব্যবস্থা করা হয়।
যথাসময়ে কাজী সাহেব এলেন। দুই লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা দেনমোহর ধার্য করে বিয়ে সম্পন্ন করা হয় আমাদের। এতে তানহারও মত ছিলো। কারণ, দেনমোহর কত হবে না হবে এটা নিয়ে পাত্রী চাইলেই ডিমান্ড করার অধিকার রাখে। কেননা, এর উপর কেবলমাত্র তাঁরই হক বা অধিকার রয়েছে।
অবশেষে সন্ধা নামার আগেই আমরা রওয়ানা হলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। নিজের বাবা-মাকে হারানোর পর ফুফা-ফুফুর কাছেই ছিলো তানহা। তাঁদের মায়ার বাঁধন ছেড়ে চলে আসতে বড্ড কষ্ট হয়েছে ওর। খুব কান্নাকাটি করেছে। আর এতটাই কান্নাকাটি করেছে যে, সে এখন একেবারে গা ছেড়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পরেছে। আর যেখানে মাথা রেখে ও ঘুমিয়েছে সেই জায়গাটিকে তাদের সহধর্মিণীদের জন্য সুরক্ষিত রাখাটা প্রতিটি পুরুষ মানুষের জন্যই নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।
সন্ধার পরপর বাড়ি এসে পৌঁছুলাম আমরা। বউ এসেছে বউ এসেছে এমন একটা রব পড়ে গেছে গোটা পাড়ায়। চাচীরা সবাই এসে জড়ো হয়ে গেছে। সবাই যে শুধুমাত্র বউ দেখেতে এসেছে বিষয়টি আসলে ঠিক তা নয়, অনেকেই নানান খুঁত বের করতেও এসেছে। দেখতে এসেছে বউয়ের সাথে জিনিসপত্র কি কি দিলো বা না দিলো। বউয়ের গায়ে গহনা কি পরিমাণ। সেগুলোই বা আসল খাটি সোনার নাকি নকল। আমার একটা খারাপ গুণ হলো আমি যে কারোরই চোখের ভাষা খুব সহজেই পড়ে ফেলতে পারি। কে কোন মতলব নিয়ে হাটাচলা করছে সেটার আন্দাজ করতে পারি। এগুলো আবার সত্যও প্রমাণিত হয়!
তানহাকে মায়ের রুমে নিয়ে বসানো হয়েছে। সবাই খুব ভিড় করে আছে ওর চারপাশে। ভিড় করবে নাই বা কেন, রিয়াদের বউ বলে কথা! আমি রুমে যাব এমন সময় কানে ভেসে আসলো একটি কথা, ‘দেখেছি দেখেছি, শুধু সুন্দরী বউই এনেছে আর কিছু আনতে পারেনি।’ গলার স্বরটা আমার পরিচিত। হ্যা, বারান্দায় থেকে কথাটি বলেছে কেউ। গেলাম আমি। আমাকে এভাবে সামনে ওরা কেউ আশা করেনি তখন। আপনজন। বলতে, বাড়ির মানুষই। ভাবতে পারেনি কথটি আমি শুনে ফেলবো। চারজন ভদ্রমহিলা। তারা সম্পর্কে আমার চাচী হন। এবার তাদের উদ্দেশ্যে বললাম,
-আমার চাচারা যা আনতে পারেনি আমি তা এনেছি। তাঁরা কাগজের ফুল এনেছিলো আর আমি, আমি এনেছি বাগানের তরতাজা ফুল। আশা করি এর সুবাস আমাদের সংসারের আশেপাশে যারা থাকে তারাও পাবেন। কি বলেন আপনারা?
তারা খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছে যে আমি কথাটা ঠিক কোথায় বলেছি। আর কোন কথা বললেননা তারা। চুপচাপ চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে গেলেন। আমাদের সমাজের নারীদের হলো এই কিছু সমস্যা। তারা নিজেদের মেয়েদেরকে স্বামীর ঘরে সুখে দেখতে চাইবে। তারা চাইবে, মেয়ের জামাই যেন তাদের মেয়ের সব কথা মেনে চলে। চাইবে, মেয়ে যেন সেখানে রাজরাণীর হালতে থাকে। অথচ, ঘরে ছেলের বউকে দেখবে কাজের মেয়ের মতো। ছেলে যদি বউয়ের কথায় কোনকিছু করে বসে তবেই কেল্লাফতে! ‘না না, আমার ছেলে আর আমার ছেলে নেই, আমার ছেলেকে জাদু করে ফেলেছে। আমার ছেলেকে বস করে ফেলেছে।’ আরো কত কি! এসব বদলানো দরকার। চিন্তাভাবনা আর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করা দরকার। আমাদের সমাজের নারীরা বদলে গেলে নারী নির্যাতনের হার অর্ধেকে নেমে আসবে।
রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে মানুষের আনাগোনা কমে এলো। সবাই এবার যার যার ঘরে চলে গেছে। আমি সোফায় বসে আছি আর মনে মনে ভাবছি, ‘বিয়ে করে বউ তো নিয়ে এলাম কিন্ত তার কাছে যাব কখন?’ এমন সময় ফুফাতো বোন শান্তা এসে বললো,
-ভাইয়া, এবার যেতে পারো।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে মনে মনেই বললাম, ‘যাক বাবা, অবশেষে এই রাত সাড়ে এগারোটার দিকে বাসর ঘরে প্রবেশের অনুমতি মিললো তাহলে।’
——চলবে——