ও আমায় ভালোবাসেনি

ও আমায় ভালোবাসেনি !! Part- 04

ভাইয়া আসলো বিকেলের দিকে । কিন্তু সে একা আসেনি নতুন মেম্বার নিয়ে এসেছে । সেই নতুন মেম্বার আর কেউ না মামুর ছোট মেয়ে আফসানা রিহায়াত ।
সে অবশ্যি এমনি এমনি আসেনি একটার ওপর আরেকটা সম্পর্কের নাম এবং অধিকার নিয়ে এসেছে ।
আমার ভাই তানভীর রিহায়াতকে বিয়ে করে বউ বানিয়ে ঘরে তুলেছে ।
সদর দরজায় ভাইয়ের সাথে রিহায়াতকে দেখে মা যতটা না খুশি হয়েছিল ঠিক ততখানি, নাহ না তার চাইতে হাজার গুণ বেশী রেগে আছে সম্পর্কের নতুন নাম শুনে ।
ভাই যে একা একাই বিয়ে করবে এটা মা কেনো আমরা কেউ কখনো ভাবতেই পারিনি ।
আপাতত ড্রয়িংরুমে সবাই বসে আছি । ভাই-ভাবী মাথা নিচু করে মায়ের সামনের সোফায় বসে আছেন ।
মায়ের পাশে ফুপ্পি মায়ের মাথায় আইসপ্যাক ধরে আছেন আর আস্তে আস্তে বলছেন_ভাবী শান্ত হও যা হবার তা তো হয়েছেই..
কিন্তু মা’র রাগ কমছে না । উনি মাথা নিচু করে ফুঁসছেন শুধু ।
আমি বুঝতে পারছি না এতে এতোটা রাগ করার কি আছে? ভাই এডাল্ট , রিহা এডাল্ট ।
ভাই জব করে অনেক ভালো , রিহা মামুর বিজনেসে হাত দিয়েছে , মামুর সয় সম্পত্তির অভাব নেই এবং ছোটবেলা থেকে বিদেশে বড় হওয়া সত্বেও রিহা কি সুন্দর বোরখা পরে এসেছে ।
আবার বোরখার নিচে শাড়িও , কি সুন্দর মাথায় আঁচল টেনে বসে আছে মেয়েটা!
সব দিক দিয়েই পারফেক্ট ম্যাচ তাহলে মায়ের এখানে রাগ করবার কারণ কি?
,
আমাকে আর বেশি ভাবতে হলো না , তার আগে মা ই চিল্লিয়ে উঠলেন । দাঁতে দাঁত চেপে বললেন_
— ফ্যামিলির ভেতর বিয়ে আমার একদমই পছন্দ নয় । রক্তের মিল থাকলে বাচ্চা হয়না তাছাড়াও ছোটখাট ব্যাপার নিয়ে মনমালিন্য হলে ভাইবোনের মধ্যে সম্পর্কও নষ্ট হয় । তানভীর আমি কি তোমাকে প্রথমেই বলিনি যে এই সম্পর্ক আমি মেনে নিবো না?
তাহলে কেনো তুমি ওকেই বিয়ে করে নিয়ে আসলে?
সম্পর্ক চালিয়ে গিয়ে তো আমার কথার অবাধ্য হয়েছো ই এখন বিয়ে করে ঘরে অবধি তুলেছো?
কি আমাকে তোমাদের মানুষ মনে হয়না? আমার কথা কেউ ধরোনা কেনো তোমরা?

ওহ্ হোওও তারমানে এই সমস্যা?
এই সিরিয়াস ব্যাপারে মায়ের মান্ধাতা আমলের কথা শুনে আমার হাসি পেয়ে গেলো কিন্তু কি মনে করে সাথেসাথেই রাইদ ভাইয়ের দিকে তাকালাম ।
রাইদ ভাই এতক্ষণ ছাগলের মতো আপেল গিলছিলেন কিন্তু এখন তার দৃষ্টি আমাতে নিবদ্ধ , এই দৃষ্টিতে স্পষ্ট কিছু আনওয়ানটেড প্রশ্ন যার উত্তর আমি মরে গেলেও তাকে দিতে পারবো না ।
আমি তার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম ।
ভাই আস্তে করে এগিয়ে এসে মায়ের পায়ের কাছে বসলেন ।
নরম গলায় বলতে শুরু করলেন_
— আম্মু আমি জানি আমি ভুল করেছি কিন্তু কি করতাম বলো? ভালোবাসা জিনিসটাই এমন , আমি রিহাকে খুব বেশীই ভালোবাসি । এখন ওকে ছেড়ে আসা আমার পসিবল ছিলোই না । ও সুইসাইড আ্যাটেম্পট করেছিল জানো?
আমি চলে আসার দু’দিন আগে অনেক গুলি স্লিপিং পিলস খেয়ে ফেলেছিল মেয়েটা ।
মামু আমার পায়ে পড়েছিলেন ওকে আপন করে নেবার জন্য ।
নিজের চোখের সামনে ভালোবাসার মানুষটার এই অবস্থা আর মামুর আর্তনাদ আমি সহ্য করতে পারিনি মা ।
তুমি আমাকে মাফ করো আম্মু , আমি আশা করেছিলাম তুমি আমাকে ভুল বুঝবে না ।
রিহাকে তুমি প্রচন্ড ভালোবাস এটা আমি জানি ।
আমি ভেবেছিলাম বিয়ে করে আনলে তুমি ওকে মেনে নিবেই ।
কিন্তু..
আম্মু একটা সুযোগ অন্তত ওকে দিয়ে দেখো? প্লিইজ!
রিহাও মায়ের কাছে এসে কেঁদে ফেললো ।
আমারই তো মায়া হচ্ছে এদের জন্য!
,
মা অনেক কঠিন মানুষ , ওনার মনের বরফ গললো না ।
মুখ ফিরিয়ে চলে গেলেন , আমি জানি মায়ের একটাই ভয় পরিবারের ভেতরে বিয়ে হলে যদি সন্তান নিতে সমস্যা হয়?
তবে মায়ের মুখভঙ্গি দেখে আমার মনে হলো তার মনের বরফ খুব জলদিই গলতে শুরু করবে শুধু রিহাকে মায়ের মন মতো চলতে হবে তাহলেই হবে ।
হাহ্ সব্বাইকে মা মেনে নিচ্ছেন শুধু আমার ক্ষেত্রেই তার অনীহা!

মা যাওয়ার পর ফুপ্পি রিহা আর ভাইকে উঠে বসালেন , চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন_ চিন্তা করিস না বাবা সব ঠিক হয়ে যাবে ।
তারপর আমাকে ইশারায় খাবারের ব্যবস্থা করতে বললেন ।
আমিও খুশি মনে উঠে গিয়ে ফ্রীজ থেকে মিষ্টি আর পানি নিয়ে আসলাম জলদি জলদি ।
রিহার পাশে বসে চামিচে করে মিষ্টি নিয়ে ওর মুখের সামনে ধরে হেসে বললাম_ বিয়ের মিষ্টি তো তোরা আনলি না আমার হাতেই খা!
রিহা আমার দিকে ছলছল চোখে তাকালো , আমি জোর করে ওর মুখে মিষ্টি পুরে দিতেই ও আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো ।
আমারও চোখ ছলছল করছিলো , পরিস্থিতিকে হালকা করতে ভাইকে বললাম_ দেখেছো তোমার বউ আমাকে বেশি ভালোবাসে । কেমন জোরসে জড়িয়ে ধরেছে দেখো?
আমার কথা শুনে সবাই হেসে ফেললো ।
রিহাকে বললাম ফ্রেশ হয়ে নিবি চল?
ভাইয়ার রুমটা আগেই পরিস্কার করে রাখা হয়েছিল ।
ওদের রুমটা আমার রুমের পাশেই ।
রিহাকে ফ্রেশ হতে বলে যখন আমি চলে আসবো তখন ভাইয়া ডেকে ওঠে_ বুড়ি কেমন আছিস?
আমি এই ডাকটার অপেক্ষা করছিলাম । ছুটে ভাইয়ার বুকে গিয়ে হু হু করে কেঁদে দেই ।
ভাইয়া মাথায় হাত বুলিয়ে বলে_ স্যরি বাচ্চা এই ক’দিন ঝামেলায় তোর খোঁজ নেয়া হয়নি ।
লান্ডান যাবার ব্যাপারে বাবাকে কিছু বলেছিস?
আমি ভাইয়ার দিকে অবাক চোখে তাকাই।
ভাইয়া হেসে বলে_ আমি আমার একমাত্র বোনটার সব খবরই রাখি!
বলে আমার মাথায় একটা চুমু খায় ।
আমি ভাইয়াকে বলি_ তোমাকে অনেক মিস করেছি ভাইয়া!
— আমিও করেছি পাগলী , এখন তো এসে গেছি । আর একদম কাঁদিস না ।
— হু ।
আচ্ছা তুমিও ফ্রেশ হও এখন আমি তোমাদের খাবারের ব্যবস্থা করছি ।
— আচ্ছা যা ।

ভাইয়ার রুম থেকে আমি সোজা কিচেনেই চলে আসি ।
আজ ভাইয়ার পছন্দের রান্না হবে সব ।
ফ্রীজ থেকে মাছ মাংস বের করে ভিজিয়ে রেখে শাক সবজি কাটছিলাম ।
আব্বু ফোন করে , জানায় আজ রাতে উনিও আসছেন । আমার কিছু লাগবে কি না?
ছোট বেলার মতোই আবদার করি আমার জন্যে চকলেট আর আইসক্রিম নিয়ে আসবে কিন্তু!
আব্বু হেসে বলেন নিয়ে আসবেন ।
ফোনটা রাখতেই কেউ একজন বলে ওঠে_এখনো চকলেট আইসক্রিম খাইতে হবে? তুই কি বাচ্চা?
আমি পেছন ঘুরে দেখি এই কেউ একজন টা আর কেউ নয় রাইদ ভাইয়া ।
ঐ সবজি কাটতে কাটতেই আমি বলি_ চকলেট আইসক্রিম কি শুধু বাচ্চাদের জন্যই নাকি?
সবাই ই খায় ।
— ওগুলো খাওয়ার জিনিস? সব অখাদ্য কুখাদ্য!
নাক সিটকিয়ে বলে রাইদ ভাইয়া ।
আমিও হেঁসে বলি_
— ক্যান হিংসে হয় কেউ এনে দেয়না জন্য?
— এহ্হ আসছে আমার নাকি হিংসে হবে এসব অখাদ্যের জন্য! রাইদের এতো ছোটখাট ব্যাপার নিয়ে হিংসে হয়না । হিংসুটে তো তুই বিরাট বড় হিংসুটে ..
— কিইহ্ আমি হিংসুটে? কে বলেছে আপনাকে?
— আচ্ছা তুই হিংসুটে না তাইনা? ভুলে গেছিস সব? আমি যখন সেকেন্ড স্ট্যান্ডারে তখন আমার ফ্রেন্ড কিছু নোটস দিতে বাসায় আসলো আর এসে আমায় প্রপোজ করলো তাও আবার রজনীগন্ধা দিয়ে? আর তুই কি করলি তখন? দৌড়ে এসে ওর হাত থেকে ফুল নিয়ে ছিঁড়ে ফেললি আর চুল ধরে টানাটানি করে কি কি বললি?
ওনার কথায় আমি অতীতে ফিরে গেলাম যেন , কোন তালে আমিও বলে ফেললাম_ আরেহ্ বেচারির নাকি ১৩৬ টা চুল ছিঁড়েছি সে গুণতে ছিলো তবে ভালোই করেছি । এহ্ শখ কত সে তোমায় প্রপোজ করতে এসেছিলো । আহা আমিও যেন ছেড়ে দিতাম ।
দু’জনেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম ।
— কি নিয়ে এতো হাসাহাসি হচ্ছে শুনি?
কিছুক্ষণ বাদেই ফুপ্পির গলা শুনে আমার হাসি থেমে যায় ।
আমাদের হাসাহাসির শব্দ শুনেই ফুপ্পি এসেছেন রান্নাঘর অবধি!
— আরেহ্ তেমন কিছু না । ছোটবেলার কথা মনে করছিলাম ফুপ্পি!
আমি বললাম ।
রাইদ ভাইয়েরও হাসি থেমে গেছে । উনি এবার সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন ।
ওনার চোখে একটাই প্রশ্ন_ আমাকে নিয়ে তোর পোজেসিভ চিন্তাভাবনা তবে ধরাছোঁয়ার বাইরে কেনো তুই?
আমিও মনে মনেই বললাম_একদিন সব জানতে পারবেন আপনি আর সেই দিনটা বেশী দূরে নয় ।

আজকে ফুপ্পি সব রান্না করেছেন , তাকে অবশ্যি আমি হেল্প করেছিলাম৷
দুপুরে খাওয়ার টেবিলে সবাই আসলেও রাইদ ভাই অনুপস্থিত ছিলেন ।
ভাইয়া ওনার খোঁজ করেছিল তখন ফুপ্পি বললেন কোন জানি কাজে তাকে বাইরে যেতে হলো!
এটা শুনে ভাইয়া একটু দুঃখ প্রকাশ করলেন , সবাই একসাথে কতদিন পর অথচ সে এখন না খেয়ে বাইরে ।
মা চুপচাপই খেয়ে চলে গেছেন , ভাইয়া-রিহা ওনার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলেও উনি পাত্তা দেননি ।
ফুপ্পি বললেন আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে , মন খারাপ না করতে । আমরাও আশাবাদী
আপাতত দরজা জানালা বন্ধ করে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছি । ভাবছি আমি আসলে কাকে ভালোবাসি বা বাসতাম?
এটা আমাকে স্বীকার করতে হবে আমার আকৈশোর স্বপ্নে পুরোটা জুড়ে ছিলো রাইদ ভাই ।
আমার আকাঙ্খার যুবক!
সে আমারই হতো কিন্তু একটা ঝড় এসে সব লন্ডভন্ড করে দিলো সেসময় ।
ভেঙে পড়েছিলাম আমি । ভাঙা হৃদয়ের একাংশে ঠাই নিলো ফয়সাল ।
তাকে যখন পুরোটা দিতে চাইলাম তখন সে অন্যকারো হয়ে গেলো ।
অন্যকারো মানুষকে নিয়ে আমি ভাবতে চাইনা কারণ এটা অন্যায় ।
আজ খুব বেশীই মনে পড়ছে এই সবকিছুর সূচনার দিনটা ।
যেটা এক নিমিষেই তিনটে জীবনের গতিপথ বদলে দিয়েছিল ভ্রান্তির অগোচরে…
না কেউ বুঝতে পেরেছি আর না..!
বাকি কথা থাক আজ।
চলবে,