ও আমায় ভালোবাসেনি

ও আমায় ভালোবাসেনি !! Part- 03

সন্ধ্যেবেলা ড্রয়িং রুমে বসে গল্প করছেন আম্মু আর ফুপ্পি । শুনলাম ভাইয়া আসবেন আজকে রাতে ।
বলা হয়নি আমরা দুই ভাই বোন । এত্তো এত্তো অবহেলার মাঝে আমাকে ভালোবাসার মানুষ দু’টো , এক আমার বাবা আরেকজন আমার বড় ভাই তানভীর ।
ছোটবেলার সেই ঘটনার পর ভাইয়ার কাছেই আমার শত আবদার আর ভালোবাসা পাওয়া কিন্তু এটাও আম্মুর সহ্য হয়নি ।
এইচএস শেষ করেই উনি ভাইয়াকে ইউএসএ মামুর কাছে পড়তে পাঠিয়ে দিলেন ।
ভাইয়ার সাথে প্রায় প্রতিদিনই আমার ফোনে কথা হয় কিন্তু গত এক সপ্তাহ থেকে কোনো এক কারণে কথা বলা হয়নি ।
আমি ভেবেছিলাম আম্মু কিছু করলো কি না! কিন্তু এখন বুঝতে পারছি সে আমাকে সারপ্রাইজ দিবে বলে এমন করছে!
ভাইয়ার আসবে শুনে প্রচন্ড খুশি লাগলো আমার ।
হালকা চা নাশতা নিয়ে ড্রয়িংরুমে গেলাম ।
সেন্টার টেবিলে ওগুলো রাখতেই ফুপ্পি বললেন_
— কি রে মা তুই ও বস? আর কত কাজ করবি?
কোমর লেগে গেছিলো তাই আমিও ওদের অপজিট সোফাতে বসে পড়লাম ।
আম্মুর সাথে গল্প বাদ দিয়ে ফুপ্পি এখন আমার দিকে ফিরলেন ।
— পড়াশোনা কেমন চলছে? ভার্সিটি যাচ্ছিস নিয়মিত?
— জ্বী যাচ্ছি ।
— শুনলাম তোদের বন্ধুরা নাকি পিএইচডি করবার জন্য আ্যাপ্লিকেশন করেছিল তা তুই করিস নি?
আমি কিছু বলবো তার আগেই মা টেনে বললেন_
— যা পড়াশোনার বহর! সে আবার আ্যাপ্লিকেশন করবে!

কথাটা প্রচন্ড খারাপ লাগলো । চোখে পানি এসে যাচ্ছিলো আমার । তবুও নিজেকে সামলে বললাম_ আমার জীবন কেমন চলছে এগুলোর খোঁজ তো কখনো নেয়ার প্রয়োজন মনে করোনি আম্মু তাহলে না জেনেই এতবড় কথা বললে কি করে?
কথাটা বলা মাত্র!
শুরু হয়ে গেলো আম্মুর ধমকানো । আমি ওখানে বসলাম না আর । উঠে চলে আসছিলাম , ডাইনিংয়ে রাইদ ভাইয়া বসে ফল খাচ্ছিলেন ।
আমাকে দেখে গুনগুনিয়ে উঠলেন_ ও আমায় ভালোবাসেনি , হৃদয়ের ভালোবাসা ও বোঝেনি..
আমি হালকা হাসলাম । মানুষগুলো আমাকে নির্লজ্জ বানিয়ে ছাড়লো!
আমি চেয়ারের হাতলে একটা হাত রেখে আস্তে করে রাইদ ভাইয়াকে বললাম_ ভালোই তো গাচ্ছেন । গানটা কান্টিনিউ করলেই তো পারেন?
,
রাইদ ভাইয়া চোখ পাকিয়ে তাকালেন আমার দিকে , আমি দাঁত বের করে হাসলাম ।
উনি বললেন_ বেহায়া ।
আমিও জবাব দিলাম_ আপনারাই তো বানালেন..
কথাটা বলে সোজা রুমে চলে আসলাম , পেছনে ঘুরে দেখার সাহস আর হলোনা আমার ।
রুমে এসে বান্ধবী সিমির সাথে কথা হলো । সিমি আর আমি একই ইউনিভার্সিটিতে হায়ার ডিগ্রীর জন্য চান্স পেয়েছি ।
ওর বাসায় সবাই খুব খুশি হয়েছে খবরটা শুনে ।
ওর কথাগুলি শুনে খুব ভালো লাগলো সাথে ইমোশনালও হয়ে পড়লাম । আমার ফ্যামিলি ঠিক থাকলে কি তারাও খুশি হতো?
সিমির সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে আমার খুব কান্না পেয়ে গেলো ।
আমি কেঁদে কেঁদে ওকে আজকের সব ঘটনা খুলে বললাম ।
ও একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমাকে বললো_শক্ত হ মিথি , আসলেই এই মানুষগুলো এই দেশ তোর যোগ্য না । কয়েকদিন ধৈর্য্য ধর ইনশাআল্লাহ তোর সুখের দিন তোকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে ।
আমি আছি তোর পাশে চিন্তা করিস না ।
ওর কথায় একটু শান্তনা পেলাম ।
রাতে আমি আর খেতে যাইনি , অসহ্য লাগছিল সবকিছু ।
আমার প্রায়ই এমন হয় , অকারণে অসহ্য লাগে অসহায় লাগে ।
সময়টা এমন যে আশেপাশে তো মানুষ নেই ই তারউপর দেখা যায় ফেইসবুক , হোয়াটস এপ্প সহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া গুলিতেও কেউ ভুল করেও খোঁজ নিতে আসেনা ।

যখন আসে তখন উপচে পড়ে সব আর যখন নেই তখন কেউ নেই , প্রিয় বান্ধবীটিও নেই ।
আর একজন ছিলো সে একদিন নেশা ধরিয়ে দিতো কথা বলার কিন্তু সকাল হতেই সে মেসেজ অবধি সিন করতো না । কতখানি ভালোবাসতাম তাকে সে বুঝেও অবুঝ ছিলো!
তাতেও আমার অভিযোগ ছিলো না , অভিমান হতো খুব । কিন্তু সেই অভিমানও নিজে নিজেই প্রশমিত হয়ে যেত একসময় , যে অভিমান বোঝেনা তার উপর অভিমান করে লাভ কি?
আমি খুব খুব সুখী ছিলাম নিজে নিজেই ভালোবেসে । নিজেই ভালোবাসতাম , নিজেই রাগ করতাম , নিজেই অভিমান করতাম আবার নিজে নিজেই ঠিক হয়ে যেতাম ।
কিন্তু সবসময় এমনটা চলে না , তবুও মর্জির বিরুদ্ধে চালিয়েছি আমি ।
যেখানে ভালোবাসা আমার , অভিমান আমার , রাগ একারই আমার অপর মানুষটার কোনো ভূমিকাই নেই সেখানে আবার এক্সপেকটেশন আসে কোথা থেকে?
এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যে চোখ দু’টো লেগে এসেছে বুঝতেই পারিনি ।
ঘুমটা ভাঙ্গে মাঝরাতের দিকে ।
নিজেকে কারো বাহুডোরে আবিষ্কার করি , মানুষটা খুব শক্ত করে জাপটে ধরে আছে আমাকে ।
প্রথমে ভয় পেয়ে যাই , একটু নড়াচড়া করি কিন্তু চিল্লাই না ।
চিল্লাফাল্লা করলে সমস্যা হতে পারে তাই বাম হাত দিতে হাতড়ে ফোনটা খুঁজতে থাকি ।
তখন একটা ঘুম জড়ানো গলা ভেসে আসে_আহ্ মিথি এতো নড়াচড়া কিসের? ঘুমাতে দে ভালোমতো ।
কন্ঠটা শুনে আমার চোখ বেরিয়ে আসবার উপক্রম!
রাইদ ভাইয়া? আমার ঘরে আমার বিছানায় এভাবে আমাকে জাপটে ধরে শুয়ে আছে?
ছিঃ ছিঃ খুব লজ্জার ব্যাপার এটা!
আমি ব্যস্ত হয়ে সরে গেলাম তার থেকে , একপ্রকার জোর করেই ছাড়িয়ে নিয়ে বিছানা থেকে নেমে কয়েক কদম সরে দাঁড়িয়েছি ।
রাইদ ভাইয়ার ঘুমটাও ভেঙে যায় এতে , সেও উঠে বসে ।
আমি শক্ত গলায় বলি_ কি হচ্ছে এসব আপনি আমার ঘরে কেনো?
— কেনো মিথি তোর ঘরে আসা কি বারণ?
নরম স্বরে জবাব দেন রাইদ ভাইয়া । আমি একটু দমে যাই এতে । আবার বলি_
— নাহ বারণ না । কিন্তু রাত্রিবেলা সবার অগোচরে আসা বারণ । আপনি দিনের বেলা বা সন্ধ্যাবেলা যখন তখন আসতেই পারেন কিন্তু এই মাঝরাতে , আমার বিছানায় শুয়ে থাকা..

আমাকে কথা শেষ করতে দিলেন না উনি । আড়মোড়া ভেঙ্গে বললেন_ ঠিকাছে এখন থেকে বেশি করে আসবো । এই রুমেই শুবো আমি , দেখি তুই কি করতে পারিস!
ওনার কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম ।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম_ আমি কি আর করতে পারি? করবেন তো আপনি , আমার শেষ অবলম্বন এই মাথা গোঁজার ঠাই টাও হারাতে সাহায্য করবেন ।
এটা বলেই আমি লাইট জ্বালাতে গেলাম ।
সুইচ বোর্ডের কাছাকাছি যেতেই হঠাৎ উনি এসে পেছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন ।
কিছু বুঝে ওঠবার আগেই কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন_ আমি তো দিতে চেয়েছিলাম তোকে ঠাই , একটু ভালোবাসা চেয়েছিলাম-অধিকার চেয়েছিলাম তবে দিলিনা কেনো?
আমি কি উত্তর দিবো খুঁজে পেলাম না ।
ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতেই রাইদ ভাইয়া করুণ সুরে জিজ্ঞেস করলেন_
— বল না মিথি সেদিন কেনো বিয়ের আসর থেকে পালিয়েছিলি? আমি এতই খারাপ ছিলাম কি? ফয়সালের মাঝে কি আছে যা আমার মাঝে নেই? ঠিক কি কারণে তুই ওকে ভালোবাসিস আর আমাকে না?
কাঁধের দিকের কাপড় টা আমার ভিজতে শুরু করেছে , রাইদ ভাইয়া কাঁদছেন!
ওনার প্রশ্নের জবাব আমি কি করে দেবো?
আমি যে কারো কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সেদিনের সেই ঘটনার কারণ বেঁচে থাকতে কাউকে জানতে দেবো না!
বেশ কিছুক্ষণ আমার জবাব না পেয়ে রাইদ ভাইয়া হাল ছেড়ে দিলেন কিন্তু আমাকে না ছেড়ে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় বসালেন তারপর আমাকে ইশারায় জামু ফেলে বসতে বললেন ।
আমি যেন কাঠের পুতুল! তার নির্দেশনা ফলো করছি ।
পা ভাঁজ করে বসতেই উনি ফট করে আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন , কোমর দু’হাতে পেঁচিয়ে উবু হয়ে শুয়ে পড়লেন ।
আমাকে কিছু বলতে না দিয়ে আবার নিজেই বললেন_
— আমার মাথা খুব যন্ত্রণা করছে প্লিজ চুলগুলো টেনে দে আমি ঘুমোবো আর খবরদার নড়াচড়া করেছিস তো!
— কিন্তু এভাবে কীভাবে?
— এভাবেই করতে হবে , নইলে রাগের মাথায় কি করে ফেলবো ঠিক নেই । খবরদার আমাকে রাগাবি নাহ্!
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে ওনার মাথার চুল টেনে দিতে লাগলাম৷
আমি এক সময় অজান্তেই তার সাথে অন্যায় করেছি , আবার কিছুদিন পরই তার থেকে ফের বহুদূর চলে যাচ্ছি । এ যাবৎ তো তার অবাধ্য হয়েই এলাম , আজ নাহয় একটুখানি…
ফয়সালের ব্যাপারটা যেন তখন আমি ভুলেই বসেছি!
আমার চিন্তা তখন আমার সামনে থাকা ঐ রাগী মানুষটার মাঝে সীমাবদ্ধ ।

পরদিন বেলা ১১/১২ টার দিকে
ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হতেই সিমির সাথে দেখা হলো ফয়সালের ।
ফয়সাল সিমিকে দেখে বেশ খানিকটাই চমকে গেছে তেমন সিমিও।
ফয়সালই আগে আমতা আমতা করে বলে_ আ..আরেহ্ ছোট আপু তুমি এখানে?
— জ্বী ঐতো মা কে নিয়ে এসেছিলাম ডাক্তার দেখাতে । কিন্তু আপনি এখানে কেনো ফয়সাল ভাই? ডক্টর কিবরিয়ার চেম্বারে আপনি কেনো? এনিথিং সিরিয়াস?
— আমি? আমি তো এসেছিলাম.. আমি তো এখানে আমার বন্ধুর রিপোর্ট দেখাতে এসেছিলাম ডাক্তার কে । আরেহ্ সিরিয়াস কিছু না ওর মাইগ্রেইন এর প্রবলেম তো এটা ও জানতো নাহ । পরে ডাক্তারের কাছে এসে বলায় কিছু টেস্ট করালো ঐ রিপোর্টই আমি দেখাতে এসেছিলাম ।
আমতা আমতা করে বললো ফয়সাল ।
— ওহ্ আচ্ছা! তো আপনি ভালো আছেন?
— হ্যাঁ ঐতো..
কথা বাড়াবার আগে ফয়সালের একটা কল আসলো ।
ফোনটা বের করে এক্সকিউজ মি বলে সে সাইডে কথা বলতে গেলো ।
সিমি ডাক্তারের চেম্বার টাতে আরেকবার চোখ বুলালো ।
আরেহ্ এখানে তো লেখা আছে ডক্টর আদিত্য কিবরিয়া কার্ডিওলজিস্ট , তাহলে ফয়সাল মিথ্যে বললো কেনো?
ফয়সাল ফোনে কথা শেষ করে বেশ দূর থেকে সিমিকে বললো_ ছোট আপু আমার খুব জরুরি কাজ পড়ে গেছে । তুমি প্লিজ কিছু মনে করো না আমি আসলাম , ভালো থেকো!
সিমি ডাকার সুযোগ পেলো না তার আগেই ও চলে গেলো ।
সিমি ওখানে দাঁড়িয়েই ভাবতে লাগলো আচ্ছা ফয়সালের কি কিছু হয়েছে? এই ঘটনাটা কি মিথিকে জানানো উচিৎ নাকি না??
কি করবে না করবে ভাবতে ভাবতেই রামিমকে ফোন দিলো সে ।
রামিমই হয়তো কিছুটা জানতে পারবে আবার সাজেশনও দিতে পারবে ।
রামিম সিমির বয়ফ্রেন্ড আর ফয়সালের খুব ভালো বন্ধু ।
সিমি সরাসরি রামিমকে ফোন করলো , কিন্তু রামিম কলটা আ্যাটেন্ড করতে পারলো না । কেটে দিয়ে টেক্সট করে দিলো “মিটিংয়ে আছি । পরে ফোন করছি”
কি আর করার! ফোনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে সিমি তার মায়ের কাছে চলে গেলো ।

মিথিদের বাসায়_
ফজরের আজানের কিছুক্ষণ পরই রাইদ ভাইয়া উঠে গেস্ট রুমে চলে গেছেন ।
আমিও ফ্রেশ হয়ে এসে নামাজ পড়ে বাগানের সাইডটায় গেছিলাম ।
বেশকিছুক্ষণ ওখানে হাঁটাহাঁটি করে সোজা কিচেন তারপর প্রতিদিনের অভ্যেস মতো ব্রেকফাস্ট তৈরি ।
এতদিন একটু বিরক্ত লাগলেও আজ লাগেনি উল্টো অন্যরকম মায়ার সৃষ্টি হয়েছিল ।
কিছুদিন পর আমি অন্য কোথাও চলে যাচ্ছি জানিনা আর ফিরবো কি না!
তখন বুঝি খুব বেশীই মিস করবো এই বাড়িটাকে ।
আমার পছন্দের জায়গা এগুলো , বেশির ভাগ সময় যেন এইসব জড় বস্তুর সাথেই আমার কথা ।
এদের ছেড়ে যেতে বড্ড মায়া লাগবে ।
মনটা অদ্ভুত আমাদের , একটা জড়বস্তুর ওপরেও মায়া তৈরী হয়ে যায় ।
আচ্ছা আমি যে এতবছর থেকে মায়ের সামনে থাকি মায়ের কি এক ফোঁটাও মায়া জন্মেনি আমার ওপর?
মায়েরা কি কখনো এরকম কঠিন হতে পারে?
,
সকালের নাশতার পর মোটামোটি ঘর গুছানো শেষে বসে গল্পের বই পড়ছিলাম তখনি বাইরে থেকে মায়ের উচ্ছ্বাসিত গলা শোনা যাচ্ছিলো । ফুপ্পিকে বলছিলো_ কতদিন পর আমার ছেলেটাকে দেখবো আপা! আমার কলিজার টুকরা টা কতদিন আমাকে ছেড়ে ভীনদেশে থাকলো!
কথাটা শুনে আপন মনেই আমি বললাম_ আমি চলে গেলে আমার জন্য অপেক্ষা করবেনা মা?
,
চলবে,