আলোছায়া

আলোছায়া !! Part- 26

হাসপাতালের রাউন্ড শেষে চেম্বারে এসে বসলো মেসবাহ। চেয়ারে হেলান দিয়ে বুজলো চোখজোড়া। গতরাতের ধকলের রেশ এখনো কাটেনি৷ শরীরের ভেতরটা অস্বাভাবিক এক ব্যথায় ভরে আছে। ইচ্ছে হচ্ছে দ্রুত বাসায় গিয়ে গভীর এক ঘুম দিতে। তবে আরও ঘন্টাখানেক থাকতে হবে তার। জরুরী একটি রিপোর্ট দেখে তারপর বেরুতে হবে হাসপাতাল ছেড়ে। ভেবে লম্বা একটি দম ছাড়লো সে। সোজা হয়ে বসে রফিক মিঞার আনা খানিকক্ষণ আগের চায়ের কাপের দিকে দৃষ্টি দিতেই বেজে উঠলো ফোনের রিংটোন।
“আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া। আপনি কি ব্যস্ত ছিলেন? বিরক্ত করলাম?”
স্ক্রিনে পুষ্পর নাম দেখে ফোন রিসিভ করলেও কোথাও একটা খটকা লাগছিলো মেসবাহর। তবে পুষ্পর স্বাভাবিক গলার স্বরে তা কেটে গেলো নিমেষে। চায়ের কাপে একবার চুমুক দিয়ে সে বললো,
“ওয়ালাইকুম সালাম। না না.. ব্যস্ত ছিলাম না। কী খবর তোমার? ভালো আছো?”
“আছি ভালো.. আপনার শরীর ভালো?”
“আলহামদুলিল্লাহ। স্যারের শরীরের কী অবস্থা?”
“বাবাও ভালো আছেন। আচ্ছা ভাইয়া, আপনাদের মাঝে কি কিছু হয়েছে? কোনো ঝামেলা হয়েছে আমাদের বিয়ে নিয়ে?”
ভ্রু কোঁচকালো মেসবাহ। চায়ের কাপ হাত থেকে নামিয়ে রেখে উদ্বিগ্ন স্বরে বললো,
“না তো.. কেনো? কিছু হয়েছে?”
“আপনার বাবা গতরাতে ফোন দিয়ে হঠাৎ বিয়ের ডেইটটা এগিয়ে আনতে বললো। আর আজ মুবিন…”
থেমে গেলো পুষ্প। বুকের ভেতরের অস্থিরতা ঢাকার চেষ্টায় কিছুটা সময় নিয়ে অসহায় গলায় আবারও বললো,
“ভাইয়া উনি আমাকে কেনো একথা বললো? আমি বা আমার পরিবার কি ভুল কিছু করেছি? আপনি তো আমার বড় ভাইয়ের মতো। আমার বাবা আপনাকে নিজের ছেলের মতোই দেখে। আপনি অন্তত আমায় বলুন!”
“মুবিন কী বলেছে তোমায়?”
“উনি আমায় বিয়ে করবেন না..”
ঢোক চেপে উঠে দাঁড়ালো মেসবাহ। অনুভব করলো তার চিপের কোণা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ঘামের ধারা।
“কী হয়েছে ভাইয়া? এই স্টেজে আসার পর উনি আমায় এই কথা কেনো বললো? আমি কি ব্যাংকে একবার যাবো? ভাইয়া কোনো ঝামেলা হলে আমায় খুলে বলুন।”
উৎকন্ঠা নিয়ে বললো পুষ্প।
জবাবে মেসবাহ স্বাভাবিক সুরে বললো,
“কোনো ঝামেলাই হয়নি.. আমার মনে হচ্ছে কোথাও একটা মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে। তুমি কোনো টেনশন করো না। বিয়েশাদিতে এমন খুটিনাটি ঝামেলা হয়।”
“এটা খুটিনাটি ঝামেলা নয়.. আমি যে কী পরিমাণের অস্থিরতার মাঝে আছি তা বলে বোঝাতে পারবো না আপনাকে।”
“আমি দেখছি। আমি বাবা মুবিন দু’জনের সাথে কথা বলেই দেখছি। তুমি একটু অপেক্ষা করো। আর স্যারকে এব্যাপারে কিছু জানিয়ো না।”
গলার স্বর বেশ ভারী হয়ে উঠলো পুষ্পর। মেসবাহর কথার পিঠে সে বললো,
“উনি ফোনটাও বন্ধ করে রেখেছেন। নিজের দুই লাইনের কথা শুনিয়ে আমার কাছ থেকে কিছুই শোনার প্রয়োজন বোধ করলেন না উনি। উনি এর আগেও আমাকে এতটা হয়রানির উপরে রেখেছিল। তবে তখনও আমি কিছু বলিনি। কেনো যেনো উনার সামনে ঠিকভুল বিবেচনা করে একদম কথা বলতে পারিনা আমি…”
ফোনের লাইন কেটে হাত ঘড়ির দিকে তাকালো মেসবাহ। একটা বেজে কুড়ি মিনিট। আর মিনিট তিরিশেক রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করবে সে। এর মাঝে রিপোর্টটি না এলে রওনা হবে মুবিনের খোঁজে। ফোন যেহেতু তার বন্ধ সেহেতু ফোনে চেষ্টা করে লাভ নেই। এবার যা কথা হবে সবটাই হবে মুখোমুখি৷
ব্যাংকে ঢুকে রিসিপশনিষ্টের কাছে নিজের পরিচয় দেয়ায় মুবিনের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তার রুম দেখিয়ে দিতেই সেদিকে এগুলো মেসবাহ। দরজা ঠেলে গম্ভীরমুখে ভেতরে ঢুকতেই ওপাশ থেকে মুবিন বললো,
“হঠাৎ? তোমার শরীর ভালো?”
সেপ্রশ্নের জবাব দেবার প্রয়োজন বোধ করলো না মেসবাহ। মুবিনের সম্মুখে বসে রাশভারী কন্ঠে বললো,
“তুই সত্যিই পুষ্পকে বিয়ে করবি না?”
ছোট্ট একটি শ্বাস ছেড়ে মুবিন ক্ষীণ স্বরে বললো,
“আমি আমার সিদ্ধান্ত তোমায় আগেই জানিয়ে দিয়েছিলাম।”
“তুই মনে করিস একটা মেয়ের অভিশাপ নিয়ে তুই চৈতালির সাথে খুব সুখে সংসার করতে পারবি?”
“মনে করি না। তবে আমার একসময় না একসময় ওকে ছাড়তেই হতো।”
“কেনো ছাড়তে হতো? পরিবার, সমাজ কারো পরোয়া নেই তোর? কী করতে চাইছিসটা কী তুই? তুই মনে করিস বাবা-মা, ভাই-বোন সবাইকে কষ্ট দিয়ে জীবনে সুখী হওয়া যায়?”
মেসবাহর প্রশ্নে একদন্ড থেমে মুবিন বললো,
“চৈতালি কি আমার জন্য এতটাই অযোগ্য যে তোমরা কষ্ট পাবে?”
“যোগ্য অযোগ্য বিচার করার আমি কেউ নই। তবে চৈতালি তোর জন্য সঠিক নয়। এই পরিস্থিতিতে তো নয়ই।”
বুকের ভেতরটা টিপটিপ করে উঠলো মুবিনের। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মেসবাহর পাশের চেয়ারে এসে বসে পড়লো সে। কাঁপা হাতে ভাইয়ের হাতটা ধরে বললো,
“চৈতালি খুব অসহায় ভাইয়া.. আর ওর এই পরিস্থিতির জন্য কোনো না কোনোভাবে আমিই দায়ী।”
মুবিনের হাত শক্ত করে চেপে ধরলো মেসবাহ।
“তুই কেনো নিজেকে শুধুশুধু অপরাধী ভাবছিস?”
“আমি তখন ওর উপর আস্থা রাখলে আজ ওকে এত কষ্টের মুখোমুখি হতে হতো না।”
“কে বলেছে এসব তোকে? ওর কপালে দুঃখ-কষ্ট লেখা থাকলে তোর সাথে বিয়ে হলেও ও কষ্ট পেত। তাছাড়া সময়টা তোর প্রতিকূলে ছিল। তুই চাইলেই ওই অবস্থায় ওকে বিয়ে করতে পারতি না।”
“কিন্তু আস্থাটা তো রাখতে পারতাম!”
নীরব হয়ে পড়লো মেসবাহ। মুবিনের হাত ছেড়ে গাল চুলকোতে শুরু করতেই ওপাশ থেকে মুবিন বললো,
“চৈতালীর প্রতি আমার আগের সেই ভালোবাসাটা আছে কিনা জানা নেই তবে সময় অনেক কিছু পাল্টে দিয়েছে। আমাকে, আমার বিষণ্ণ হৃদয়কে, আমার আশপাশের পরিবেশ পরিস্থিতিকে। সেখানে ভালোবাসাতেও পরিবর্তন আসা কি খুব বড় পাপ ভাইয়া?”
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মুবিনের দিকে চাইলো মেসবাহ। তার কথার গভীরতা বুঝতে খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলো কথাগুলো।
“আমার মাঝে আজ জড়তা কাজ করে, আমি চাইলেও পারি না চৈতালীকে আগের মতো করে কাছে টানতে, আগের মতো করে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে। এসব আমার সাথে কেনো হচ্ছে ভাইয়া?”
“এক্সাক্টলি! তুই যাকে ভালোবাসতি সে ছিল এক যুবতী মেয়ে। তার ছিল না কোনো পিছুটান ছিল না কোনো দায়িত্ব.. তবে এখন সে একজনের স্ত্রী এবং এক সন্তানের মা। তাকে ঘিরে রয়েছে পিছুটান.. দায়দায়িত্বর পাহাড়। এতগুলো বছর পর যখন তুই নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছিস, নিজেকে নিজের হালে মানিয়ে নিয়েছিস, পুষ্পকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিস তখন হঠাৎ করেই চৈতালী তোর জীবনে এলেও সবকিছু আগের মতো স্বাভাবিক হবে না। তুই আমার প্রশ্নের একটা সোজাসাপটা উত্তর দে..”
“কী প্রশ্ন?”
“পুষ্প কি তোর মনে কোথাও জায়গা তৈরি করতে পারেনি?”
মেসবাহর দিকে মুখ তুলে তাকালো মুবিন। বুকচিরে বেরিয়ে আসা গভীর এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মৃদু স্বরে বললো,
“জানি না.. তবে পুষ্পর জন্য খারাপ লাগছে।”
“খারাপ লাগবে। ধীরেধীরে দেখবি এই খারাপ লাগাটাও আরও তীব্র হবে। সহ্য করতে পারবি তো তখন?”
“পারবো.. তবুও এতটা অপরাধবোধ নিয়ে চলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
ভ্রু কোঁচকালো মেসবাহ।
“অপরাধবোধ দিয়ে আর যাইহোক জীবন কাটে না। তুই এখন ভাবছিস আজ যদি তুই পুষ্পকে বিয়ে করে সংসার শুরু করিস তাহলে তা চৈতালির প্রতি অন্যায় হবে। তবে এটা কেনো ভাবছিস না এই অপরাধবোধ নিয়ে চৈতালির পাশে থেকে তুই ওকে আবারও ঠকাবি?”
“শুধু অপরাধবোধ নিয়ে নয়..”
“তবে? তুই বলতে চাইছিস তুই চৈতালিকে এখনো ভালোবাসিস?”
মেসবাহর করা প্রশ্নের জবাবে মুবিনের দিক থেকে কোনো সাঁড়া না পেয়ে হতাশ হলো মেসবাহ। ক্ষুদ্ধ কণ্ঠে সে বললো,
“তোকে আমি এতটা বোকা, দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাবিনি। তোর আর উল্লাসীর চিন্তাধারার মাঝে পার্থক্য কোথায়? ও যেভাবে ভাবছে তুইও সেভাবে ভাবছিস! ও যেমন বাস্তবতা বুঝতে চাচ্ছে না তুইও তেমন চাইছিস না! তাহলে শুধুশুধু বয়সে বড় হয়ে লেখাপড়া শিখে লাভটা কী?”
“বাস্তবতায় কি বিধবা এক মেয়েকে বিয়ে করার বিরুদ্ধে?”
“না.. তবে বাস্তবতা উঠে দাঁড়িয়ে সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার পক্ষে। পিছুটান নিয়ে পড়ে থাকা নয়.. যেখানে তোর চৈতালির প্রতি সামান্য ভালোবাসা আছে কিনা তাতেও আমার বেশ সন্দেহ রয়েছে!”
মেসবাহর কথাগুলো মস্তিষ্কে পৌঁছুনোর আগেই ঘাড় নাড়ালো মুবিন। উঠে দাঁড়িয়ে নিজের চেয়ারের দিকে এগুতে এগুতে অস্থির চিত্তে বললো,
“বিয়ে করলে আমি চৈতালিকেই করবো। এখানে তুমি যাই বলো আর না বলো!”
“এই তোর শেষ কথা?”
“হ্যাঁ..”
ব্যাংক থেকে সরাসরি বাসায় ফিরলো মেসবাহ। মুবিনের বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত মুখে ঘরে ঢুকে অসময়ে উল্লাসীকে কাথা গায়ে শুয়ে থাকতে দেখে কপাল কুঁচকে বললো,
“এখনো গ্যাস গ্যাস ভাব কমেনি?”
“কমেছে.. কিন্তু জ্বরজ্বর লাগছে।”
উল্লাসীর পাশে বসে কপালে হাত রাখলো মেসবাহ। গায়ের তাপমাত্রা বোঝার চেষ্টায় বললো,
“স্বাভাবিক তো..”
“হ্যাঁ.. তবে আমার মনে হচ্ছে প্রেগন্যান্সি টেস্টটা করানো উচিৎ।”
ম্লান হেসে উঠে দাঁড়ালো মেসবাহ। পরনের শার্ট খুলতে খুলতে বললো,
“আগাম মেডিকেল স্টুডেন্টের ভাবনা যদি এই হয়, তাহলে সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়?”
চোখমুখ কুঁচকে ফেললো উল্লাসী।
মেসবাহ সেদিকে তাকিয়ে বললো,
“পিরিয়ড মিস গেছে?”
“উহু..”
“তাহলে? এসব ভাবনা বাদ দাও। আমি দেখি গোসল সেরে আসি। আব্বার সাথে কথা বলবো।”
“কী কথা?”
“মুবিনের বিষয়ে।”
উঠে বসলো উল্লাসী।
“আবার কী করেছে মুবিন ভাই?”
“যা করার তাই করেছে। তবে আমি ওর সাথে কথা বলে যতটা বুঝলাম তাতে এটা নিশ্চিত চৈতালি এখন ওর সাথেই রয়েছে।”
চোখেমুখে হাসি ফুটলো উল্লাসীর। চোখের সামনে ভেসে উঠলো মুষলধারে নামা সেই বৃষ্টির রাতের জবজবে ভেজা চৈতালিকে। সেসময় তার দৃষ্টি বুঝতে ব্যর্থ হলেও পরবর্তীতে সে বুঝেছিল ঠিক কতটা বুকভরা কষ্ট নিয়ে সে এসেছিল মুবিনের কাছে। একবুক তৃষ্ণা নিয়ে কীভাবে সে তাকিয়ে থাকতো তার দিকে। মেয়েটি কি তবে এবার সুখের দেখা পাবে? হবে তার সকল দুঃখকষ্টের অবসান?
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হতেই হাসপাতালে এল মুবিন। হাতে থাকা আইসক্রিমের বাটি দুটো নিচে এককোনায় নামিয়ে রেখে চমকের মাথার পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই ফোকলা দাঁত বের করে হেসে উঠলো চমক।
“কী? এখন শরীর ভালো?”
বলে উঠলো মুবিন।
জবাবে পূর্বের ন্যায় হাসি মুখ করে চমক বললো,
“হু..”
“ক্ষুধা পাচ্ছে? কিছু খেতে ইচ্ছে করছে?”
“উহু..”
চমকের দিক থেকে নজর সরিয়ে চৈতালির দিকে দিল মুবিন। তাকে চমকের পায়ের কাছে নিশ্চুপ ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখে ক্ষীণ স্বরে বললো,
“আইসক্রিমটা খেয়ে নাও.. পরে গরম হয়ে গেলে তো সমস্যা।”
“তুমি কাল এসময় মেয়েটির সাথে ছিলে.. তাই না?”
চৈতালির প্রশ্নে মিইয়ে পড়লো মুবিন। মাথা ঝুকে মেঝের দিকে চাইতেই চৈতালি আবারও বললো,
“মেয়েটি কি দেখতে খুব সুন্দরী? পড়াশোনা অনেকদূর করেছে? ঢাকাতেই থাকে? ওর বাবাও খুব বড়লোক তাইনা?”
“এসব প্রশ্ন করে কেনো আমায় বিব্রত করছো তুমি?”
তাচ্ছিল্যের সুরে চৈতালি বললো,
“বিব্রত? সেটা তুমি আমায় কম করেছো?”
“আমি তো আমার সিদ্ধান্ত তোমায় জানিয়ে দিয়েছি। তাহলে পুষ্পকে নিয়ে প্লিজ কোনো কথা উঠিয়ো না..”
“কেনো? কষ্ট হয়?”
বুকচিরে বেরিয়ে আসা গভীর এক দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো মুবিন। চৈতালির দিকে তাকিয়ে কণ্ঠে দৃঢ়তা ফুটিয়ে বললো,
“মেজভাইকে আমি জানিয়ে দিয়েছি। মেজভাই আমাদের নিয়ে আব্বার সাথে কথা বলবে।”
“সেদিন যদি এটুকু সাহসটা দেখাতে পারতে তবে..”
“তখন পরিস্থিতি আমাদের প্রতিকূলে ছিল।”
“পরিস্থিতি কখন অনুকূলে ছিল বলে তোমার মনে হয়?”
আফসোস প্রকাশ করে চৈতালি কথাখানা বলতেই ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে মুবিন বললো,
“থাক ওসব কথা.. আইসক্রিমটা খাও।”
“ইচ্ছে নেই।”
“ঠিকাছে.. ইচ্ছে না হলে দরকার নেই। আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলেই ভেতরে এলাম। বললো আর ২/৩ দিন পরই চমককে রিলিজ করে দেবে।”
সময়ের সাথেসাথে গভীর এক নীরবতায় কেবিনের পরিবেশ ক্রমেই ভারী হয়ে যাচ্ছে বুঝেও মুখ খুললো না মুবিন। বুকের ভেতরটায় চাপা এক কষ্টে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে তার। প্রতিটি নিঃশ্বাসের জোয়ারে ভেঙে গুড়িগুড়ি হয়ে যাচ্ছে হৃদয়ে বাস করা সুখ নামক পাখিটি।
“কী করে পারলে তুমি? আমি চমকের বাবার সাথে পাঁচটা বছর কাটানোর পরও আমি কেনো পারলাম না? অথচ দেখো! তুমি কত সহজেই না অন্য একটি মেয়েকে নিজের মনে জায়গা করে দিলে!”
পাশ থেকে চৈতালি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠতেই তার দিকে চাইলো মুবিন। ঢোক চেপে নরম গলায় বললো,
“ভালোবাসি নি। দূর্বল হয়ে পড়েছিলাম। যা সময়ের সাথেসাথে কেটে যাবে।”
“ওই দূর্বলটাও আমি কেনো হতে পারলাম না? তবে কি তোমার ভালোবাসাতেই ভেজাল ছিল?”
“সময়ের সাথেসাথে সবকিছু বদলে যায় চৈতালি।”
“তাহলে তোমার প্রতি আমার ভালোবাসাটা কেনো একবিন্দু বদলায় নি?”
আবারও নীরব হয়ে পড়লো মুবিন।
চৈতালি একদন্ড মুবিনের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে নাক টেনে সুপ্ত গলায় বললো,
“মেয়েটার জন্য তোমার কষ্ট হচ্ছে?”
“না..”
“মিথ্যে বলো না।”
“বললাম তো হচ্ছে না। এদিকটায় একবার এসো..”
বেড ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে চৈতালির হাত ধরে তাকে টেনে করিডোরে নিয়ে এক মুবিন। আকাশে জ্বলজ্বল করা চাঁদের দিকে চেয়ে বললো,
“চাঁদটা যেমন দিনে আকাশের বুক থেকে হারিয়ে গেলেও রাতে আবারো ফিরে আসে ঠিক তেমন তুমিও আবারো ফিরে এসেছো আমার জীবনে। তোমাকে আমি ছাড়বো না চৈতালি। হাজারো প্রতিকূলতা এলেও না..”
চোখের পানি মুছে আকাশপানে তাকালো চৈতালি। ক্ষীণ স্বরে বললো,
“আর সূর্য? ওটা কি পুষ্প? সেও কিন্তু দিন হলেই ফিরে আসে আকাশের বুকে… ”
মুশলধারে পড়ছে বৃষ্টি। খানিকক্ষণ আগের গরমের ভ্যাপসা ভাবটি এখন আর নেই। খোলা বারান্দা হওয়ায় বাতাসের তীব্রতা গায়ে এসে লাগায় খানিকক্ষণ পরপর কেঁপে কেঁপে উঠছে পুষ্পর শরীর। সাথে মেঘের গর্জনে বুকের ভেতরটায় ছড়িয়ে পড়ছে আতঙ্ক। সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে বেরুনোর সময় আকাশে চাঁদ জ্বলজ্বল করলেও মুবিনের খোঁজে তার বাড়িতে আসতে আসতে তা নিষ্প্রাণ হয়ে পড়েছে। তবে সে দেখা পায়নি মুবিনের।
দক্ষিণা হাওয়ায় বৃষ্টির ছেঁচা এসে পড়ছে পুষ্পর চোখেমুখে। ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে তার তৃষ্ণায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকা গলার ভাজগুলো। এ তৃষ্ণা পানির নয়.. তবুও তার সংস্পর্শে বুকের ভেতরটা শীতল হয়ে উঠছে। বুকের ভেতরের জমে থাকা কষ্টগুলো বেরিয়ে আসছে চোখ বেয়ে। মুবিন কি কোনোভাবে তাকে আর চাইছে না? কিন্তু কেনো? কেনো তাকে এক আকাশ স্বপ্ন দেখিয়ে কেড়ে নিতে চাইছে সেই স্বপ্নের কাছে পৌঁছানোর সিঁড়ি?
আশেপাশে আবারও বেশ জোরেসোরে বাজ পড়াতে চোখের পলক ফেলে কয়েক কদম পিছিয়ে এল পুষ্প। মুখে পড়া বৃষ্টির ফোঁটা এবং চোখের জলের পার্থক্য খোঁজার চেষ্টায় মুখে হাত দিতেই কানে এল মোটা এক গলার স্বর।
“আপা এতক্ষণ তো থাকা যাইবো না! স্যাররে কল দেন। স্যার না আইলে ফিরা যান।”
“যাচ্ছি.. বৃষ্টি আরেকটু কমলেই চলে যাবো।”
পুষ্পর উত্তরে সন্তুষ্ট না হলেও দারোয়ান সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতেই ফোনের স্ক্রিনে আলো জ্বেলে সময় দেখে নিল পুষ্প। এগারোটার উপরে বেজে গেছে। অথচ এখনো বাড়ি ফেরেনি মুবিন। তবে কি কোনো বড়সড় বিপদে পড়েছে সে? মনে চলা প্রশ্ন উপেক্ষা করেই ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে প্যাডসহ একটি কলম বের করলো পুষ্প। ফোনের টর্চে আলো জ্বালিয়ে দেয়ালে কাগজ বসিয়ে ছোট ছোট অক্ষরে লিখতে শুরু করলো বুক উপচে পড়া কষ্ট লাঘবের চেষ্টায় ক্ষুদ্র তিনটি চরণ।
‘আপনি কি আমার সাথে লুকোচুরি খেলছেন? তাহলে আমি হার স্বীকার করে নিলাম। আপনি প্লিজ আমার সাথে একটাবার যোগাযোগ করুন।
ইতি,
আপনার পুষ্প’
(চলবে)