আলোছায়া

আলোছায়া !! Part- 18

এমন এক পড়ন্ত বিকেলেই আপনার আঙ্গুল ধরে হাটবো আমি। সূর্যের কিরণের সাথে লুকোচুরি খেলতে দাঁড়াবো আপনা আঁড়ালে। আপনি হাসবেন। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখবেন আমায়। আমি লজ্জায় দু’হাতের আঁড়ালে নিজের মুখ লুকিয়ে বলবো, আল্লাহর দোহাই লাগে এভাবে আমার দিকে তাকাবেন না আপনি… পড়ন্ত বিকেলে নগরীর ব্যস্ততম এক স্থান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পুষ্পর বলা কথাগুলো স্মরণ হলো মুবিনের। হাঁটার গতি বাড়িয়ে সে মনকে অন্যদিকে ঘোরাতে উল্টো দিক থেকে গুনতে শুরু করলো গাণিতিক সংখ্যা। ব্যাংকের একটি কাজেই নিউমার্কেটে আসতে হয়েছে তাকে। বেলা ফুরোনোর আগে কাজটা শেষ করে আবারও ফিরতে হবে অফিসে। তবে তা নিয়ে মোটেও উদ্বেগ কাজ করছেনা তার মাঝে। গত রাতে আনিসের আগমনের পর থেকেই জীবন যেন তার থমকে দাঁড়িয়েছে। ঠিক ভুল বিবেচনা করে সঠিক পথের সন্ধান করতে পারছেনা কোনোভাবে। কেনো এত দোটানায় ভুগছে সে? পুষ্পকে নিয়ে কেনো ভাবছে তার অস্থির মন। পুষ্প তার জীবনের কোনো সাবজেক্ট নয়। না আগে ছিল আর না এখন.. তারপরও কেনো তা বারেবারে মনকে বোঝাতে অক্ষম হচ্ছে সে?
পুরো শার্ট ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে উঠায় থেমে দাঁড়ালো মুবিন। পকেট থেকে দ্রুত সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটি সিগারেট মুখে নিয়ে গ্যাস লাইটে চাপ দিল সে। আশেপাশে লোকজনের উপস্থিতি দেখতে ঘাড় ঘুরিয়ে নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লো বাতাসে। চৈতালির সাথে রাতে খুব বেশি সময় কথা হয়নি তার। নিম্নে দুই মিনিট কিংবা উর্ধ্বে মিনিট তিনেক। তবে এই স্বল্প সময়ের মাঝেও চৈতালির ভেতরের যন্ত্রণা অনুভব করতে পেরেছে সে। বুঝতে সক্ষম হয়েছে তার সকল না বলা কথা। এটাই কি ভালোবাসা নয়? পুরো পরিবারের বিপক্ষে গিয়ে এই ভালোবাসা নিয়ে এক জীবন কি কাটিয়ে দেয়া যায় না? গভীর এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো মুবিন। এনিয়ে রাতে ভেবেছে সে। পুরো রাত নির্ঘুমে কাটিয়ে ভেবেছে তার পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে। আর তাতে যা উঠে এসেছে তা করার জন্য তার প্রয়োজন দৃঢ় মনবলের।
চৈতালি-পুষ্পকে নিয়ে মুবিনের গভীর সেই চিন্তার অবসান ঘটলো তার আসা ফোন কলে। কপাল কুঁচকে পকেট থেকে ফোন বের করতেই পুষ্পর কল দেখেই তা কেটে দিল মুবিন। তার সিদ্ধান্ত জানাতে কল করলো মেসবাহর নাম্বারে।
“সকালেও দেখলাম একবার কল করেছিলি। তখন একটু ব্যস্ত ছিলাম বলে রিসিভ করতে পারিনি। জরুরী কিছু বলবি?”
ফোন ধরে ওপাশ থেকে মেসবাহ স্বাভাবিক সুরে কথা বলতেই হাত থেকে অবশিষ্ট সিগারেট ফেলে দিল মুবিন। কন্ঠে একরাশ উদ্বেগ নিয়ে সে বললো,
“এখন ফ্রি তুমি?”
“হ্যাঁ। বাসায় যাচ্ছি। বল তুই। শরীর ঠিক আছে তোর?”
“আছে..”
একমুহূর্ত সময় নিয়ে গলার স্বর ভারী করলো মুবিন। ফোনের ওপাশে থাকা মেসবাহর উদ্দেশ্যে বললো,
“আমি পুষ্পকে বিয়েটা করতে পারবো না। তুমি পুষ্পর বাবাকে এবিষয়টি জানিয়ে দাও।”
কন্ঠে উৎকন্ঠা ফুটিয়ে মেসবাহ বললো,
“মানে?”
“আমি পুষ্পকে বিয়েটা করতে পারবো না।”
“কেন? কী হলো হঠাৎ?”
“আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি.. নিজের ভুলগুলোকে শুধরে নেবার এর চেয়ে বড় সুযোগ আর কখনোই পাবো না আমি।”
“হয়েছে কী? আমাকে খুলে বল। পুষ্পর সাথে ঝগড়া হয়েছে?”
“পুষ্পর সাথে ঝগড়া হবার মতো সম্পর্ক আমাদের এখনো তৈরি হয়নি।”
একদন্ড ভেবে মেসবাহ বললো,
“তুই বাসায় আয়.. নয়তো তুই ব্যাংকে থাক। আমি আসছি।”
“তুমি এসো না। আমি ব্যাংকে নেই।”
“কোথায় আছিস তাহলে?”
“বাইরে কাজে এসেছি.. তুমি শুধু দ্রুত এই ঝামেলা মিটমাট করে ফেলো।”
মুবিনের প্রতিটি কথায় বিস্ময় কাটতে না কাটতেই নতুন করে একরাশ বিস্ময় চেপে ধরায় নিজেকে শক্ত করলো মেসবাহ। গলার স্বরে একরাশ ক্ষোভ প্রকাশ করে বললো,
“তোর কি মনে হয় বিয়েটা কোনো পুতুল খেলা?”
“তোমাদের কি মনে হয় চৈতালির ব্যাপারটা তোমরা আমাকে না জানালে আমি কখনোই জানতে পারবো না?”
উত্তেজিত কন্ঠে বললো মুবিন।
মেসবাহর পুরো বিষয় বোধগম্য না হলেও যা নিয়ে তাদের মাঝে একটি উদ্বেগ কাজ করছিল সপ্তাহ দুয়েক হলো, তা ভেবেই আঁতকে উঠলো সে। ভাইকে বোঝানোর চেষ্টা করে বললো,
“তুই যা ভাবছিস ওসব করবি না। ওসব হবার না। বি প্রাক্টিকাল মুবিন। তোকে নিয়ে, চৈতালিকে নিয়ে অনেক বাজে কথা উঠবে।”
“উঠুক.. আমি রাখছি।”
বাতাসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে কল কেটে ফোন বন্ধ করে দিল মুবিন। উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা করে আবারও চৈতালিকে কষ্ট দিলে নিজেকে আর কোনোভাবেই মাফ কর‍তে পারবে না সে..
বিচলিত হয়ে বাসায় ফিরলো মেসবাহ। চোখমুখে দুশ্চিন্তা নিয়ে বিছানায় এসে বসতেই উল্লাসী এগিয়ে এল তার দিকে। মেঝেতে বসে তার পায়ের মোজা খোলার জন্য হাত বাড়িয়ে বললো,
“শরীর কেমন এখন?”
সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে লম্বা একটি দম ছাড়লো মেসবাহ। উল্লাসীকে সরিয়ে নিজেই মোজা খুলতে খুলতে বললো,
“কোচিংয়ে কেনো যাওনি?”
“আপনার সাথে সময় কাটাবো বলে। তাছাড়া আপনি অসুস্থ না?”
“কোথায় অসুস্থ? আর অসুস্থ থাকলেই বা কী? এত টাকা খরচ করে পড়াচ্ছি কি তোমার নিত্য নতুন বাহানা শোনার জন্য?”
মেসবাহর কথায় উঠে দাঁড়ালো উল্লাসী। চোখমুখ কুঁচকে তার মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করতেই ওপাশ থেকে মেসবাহ আবারও অদ্ভুত কন্ঠে করে বললো,
“অথচ কখনোই তোমাকে আমি মনোযোগ দিয়ে পড়তে দেখি না। ইচ্ছা হয় পড়তে বসো, ইচ্ছা হয় বসো না। ইচ্ছা হয় কোচিংয়ে যাও.. ইচ্ছা হয় যাও না। কোচিং কি তোমার বাবার বাড়ি মনে হয়? নিজের মন মোতাবেক যখন খুশি যাও.. যাও না!”
“আমি কি আবারও কিছু করেছি?”
চোখমুখ কুঁচকে জানতে চাইলো উল্লাসী।
জবাবে মেসবাহ মোজা মেঝেতে রেখে উল্লাসীর দিকে চেয়ে বললো,
“মুবিনকে চৈতালির ব্যাপারে জানিয়েছো তুমি?”
বিস্ময় নিয়ে উল্লাসী মাথা নাড়াতেই উঠে দাঁড়ালো মেসবাহ।
“মুখে উত্তর দাও। কেনো মুবিনকে চৈতালির ব্যাপারে জানালে তুমি? এখন আমি স্যারকে কী জবাব দেবো? আপনার মেয়েকে আমার ভাই বিয়ে করতে পারবে না?”
“মুবিন ভাই বিয়ে করবে না? কিন্তু কেনো?”
উল্লাসীর ভোলানো কথা আর আমলে নিল না মেসবাহ। কঠিন স্বরে সে বললো,
“আমার সামনে একদম বাচ্চা সাজার অভিনয় করবে না। তোমার এই বাচ্চামো দেখতে দেখতে আমি আজ বিরক্ত। কেনো তোমার সাথে আমি কিছু শেয়ার করতে চাইনা এবার বুঝলে? বুঝলে বলো?”
আঁতকে উঠে কয়েক কদম পিছিয়ে পড়লো উল্লাসী। কাঁপা স্বরে সে ধীর গলায় বললো,
“আমি মুবিন ভাইকে কিছু বলিনি।”
“বলোনি? তাহলে তো এবার তুমি এটাও বলবে ইভানার ম্যাসেজটাও তুমি ডিলিট করোনি।”
ঢোক চেপে মাথা নাড়ালো উল্লাসী। দৃষ্টি মেঝেতে আবদ্ধ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো আসামী বেশে। মেসবাহর এই রূপটি তার কাছে অপরিচিত এবং বেশ ভয়ংকর৷
“ইভানার ম্যাসেজ কেন ডিলিট করেছিলে তুমি? তুমি জানো ওইসময় আমার ইভানার পাশে থাকা কতটা জরুরি ছিল!”
“ইভানা আপুর ম্যাসেজ আমি ডিলিট করিনি।”
“করোনি ডিলেট? উল্লাসী সত্যি করে বলো..”
অস্থির চিত্তে প্রশ্নখানা করেই উল্লাসীর দিকে এগিয়ে গেল মেসবাহ। তার হাত শক্ত করে চেপে ধরে উচ্চস্বরে বললো,
“তুমি ওকে যেভাবে বাসা থেকে বের করেছো তাতে বিকৃত মস্তিষ্ক থাকলেও বাচ্চামো নেই। আর একজন বাচ্চার সাথে সংসার করা গেলেও বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষের সাথে করা যায়না।”
মুখ তুলে মেসবাহ দিকে তাকালো উল্লাসী। চোখমুখে একরাশ বিস্ময় নিয়ে বললো,
“কী বলতে চাইছেন আপনি? আমি বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ? অথচ অন্যের স্বামীর গায়ে হাত বোলানো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের কাজ?”
“শাট আপ.. জাস্ট শাট আপ। তোমার চিন্তাভাবনা এত জঘন্য কী করে হয়? পবিত্র একটি সম্পর্কের মাঝে অপবিত্রতা খুঁজে নিজেকে আমার নজরে আর ছোট করো না উল্লাসী।”
“আপনার নজরে বড় ছিলামই বা কবে আমি? আপনি আমার বাবাকে তুলে কথা বলেছেন। আমার ফ্যামিলি তুলে কথা বলেছেন। যখন দেখেছেন মেয়েটা তো এতিম। ওর হয়ে বলার মতো কেউ নেই তখন থেকে কথা বলায় আপনি আমাকে কোনো ছাড় দিয়েছেন?”
মেসবাহর দিক থেকে কোনো জবাব না পেয়ে তার হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো উল্লাসী।
“আপনি আপনার জীবনের সবকিছু আপনার বান্ধবীর সাথে শেয়ার করতে পারবেন অথচ আমি কিছু ভাবতে পারবো না। আমার সংসারে এসে কর্তৃত্ব ফলানোর অধিকার আপনি আপনার বান্ধবীকে দিতে পারবেন, অথচ আমি কিছু ভাবতে পারবো না। আমার অনুপস্থিতিতে আপনার সাথে তাকে আপত্তিকর অবস্থায় আমি দেখতে পারবো, তারপরও আমি কিছু ভাবতে পারবো না?”
উল্লাসীর একেকটি কথায় হতবিহ্বল হয়ে পড়লেও তাকে ছাড়লো না মেসবাহ। পুরো শরীরে তার অস্থিরতা অনুভব করতেই হাতের মুঠ চেপে ধরলো সে।
“আপত্তিকর অবস্থা বলতে কী বোঝাতে চাও তুমি? আমি চরিত্রহীন? নাকি ইভানা?”
“আপনারা দুজনেই চরিত্রহীন। আমাকে সরিয়ে দিয়ে আপনারা কী করছিলেন তা আমি বুঝি না মনে করেন?”
উল্লাসীর মুখ থেকে বিভ্রান্তিকর কথা বেরুনো মাত্র তার গালে একটি চড় বসিয়ে দিল মেসবাহ। দ্রুত তার হাত ছেড়ে উত্তেজিত হয়ে বিছানায় এসে বসতেই ওপাশ থেকে উচ্চ স্বরে কেঁদে উঠলো উল্লাসী।
“ওই মহিলা দেশের বাইরে থেকেও আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে নক করে কেনো জানায় আপনি অসুস্থ? আপনি রাতে বাসায় ফিরলে যেনো আমি আপনাকে প্রেশার না দেই? আমি আপনার স্ত্রী। উনি নন.. তাহলে উনি এসব দেখিয়ে কী প্রমাণ করতে চায়? আবার আমার বাড়িতে বয়ে এসে আমাকেই অপমান করার অধিকার উনাকে কে দিয়েছেন? আমার কারণে আপনি বিরক্ত হন, স্ট্রেস ফিল করেন তা আপনি নিজে আমায় না বলে উনাকে দিয়ে কেনো বলান?”
দিশেহারা বোধ করলেও নিজেকে সামলানোর চেষ্টায় মেসবাহ বললো,
“তুমি আমায় কখনোই বোঝোনি উল্লাসী। কখনো চেষ্টাও করোনি আমাকে বোঝার।”
“আর আপনি বুঝেছেন? বুঝে উদ্ধার করে মহাজ্ঞানী হয়ে গেছেন? যখন আমার করা প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মুখ আপনার নেই তখন আপনি আমার গায়ে হাত তুললেন। এই আপনার স্ত্রীর প্রতি জাস্টিস?”
আরও কিছু বলার ইচ্ছা থাকলেও কলিংবেল বেজে উঠায় থেমে গেল উল্লাসী। অশ্রুবিক্ষিপ্ত চোখে মেসবাহর দিকে চাইতেই তা উপেক্ষা করে মেসবাহ সদর দরজার দিকে এগুতেই চোখের পানি মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে মেঝেতে বসে পড়লো সে। তবে পরক্ষণেই তার নানাজানের গলার স্বর কানে আসায় আবারও কাঁপা হাতে চোখের পানি মুছে নিল উল্লাসী।
“শরীর কেমন এখন তোমার?”
“আছি আলহামদুলিল্লাহ। বসুন.. আমি উল্লাসীকে পাঠাচ্ছি।”
“তুমিও বসো। দুজনের সাথেই কথা বলতে এসেছি আমি। অবুঝ মেয়েটাকে তোমার ভরসায় রেখে গেলেও তাকে বুঝদার বানাতে তুমি ব্যর্থ।”
কেনো আপনি মেসবাহকে এত বিশ্বাস করেন আর বাবাকে করেন না? বাবা তো কখনোই মায়ের গায়ে হাত তোলেনি। তবুও তাকে কেনো দু’চোখে দেখতে পারেননা আপনি? মনে চলা প্রশ্নটি মনে রেখেই দুজনের কথোপকথনের মাঝে ড্রইংরুমে প্রবেশ করলো উল্লাসী। শব্দহীন পায়ে সিকান্দার মির্জার পাশে এসে বসে ছলছলে নয়নে তার দিকে চেয়ে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললো,
“আমি আসলেই খুব অবুঝ নানাজান। কীভাবে বুঝদার হবো বলবেন?”
(চলবে)