আলোছায়া

আলোছায়া !! Part- 17

সাতসকালেই ছেলেকে উঠিয়ে হাতমুখ পরিষ্কার করে দিয়ে তাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে দিল চৈতালি। তারপর তার হাতে ধরিয়ে দিল খেলনা গাড়ি। ছেলেটি সারারাতে একদম ঘুমোয়নি। কিছুক্ষণ পরপরই কেঁদে কেঁদে উঠেছে। মুখে তোলেনি একটি দানাও। শরীরের তাপমাত্রাও অস্বাভাবিক গরম। জ্বর করেছে বোধহয়। তবে এনিয়ে কোনো উদ্বেগ নেই এবাড়ির মানুষদের মাঝে। তারা দিব্যি খাচ্ছেদাচ্ছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাতে অবশ্য একবার তার ঘরে এসেছিলেন সেঁতারা বেগম। চোখমুখ কুঁচকে বলেছিলেন, কান্দে কেন পোলায়? তবে জবাবে তার কথা শুনে তিনি দেখাননি কোনো সহমর্মিতা। ভেবেই বুকটা ভার হয়ে এল চৈতালির। ছেলের কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে সে এগুলো নিচতলায় টুটুলের ঘরের দিকে। ছেলেটির জ্বর বাড়ছে। দ্রুত কিছু একটা করা দরকার তার।
টুটুলের ঘরের দরজায় কড়া নেড়ে দাঁড়িয়ে রইলো চৈতালি। ছেলেটার জ্বর মেপে জোর করে হলেও কিছু খাইয়ে দিয়ে ঔষধ দিতে হবে। তারপর ব্যবস্থা করতে হবে ডাক্তারের। ছেলেটির এমন অবহেলিত জীবন যাপন দেখে কোনোভাবেই স্বস্তি পায়না সে। বুকের ভেতরটা কষ্টে ভারী হয়ে আসে। মনে ডাকে কু।
“কে?”
ভেতর থেকে টুটুল চেঁচিয়ে উঠতেই চৈতালি বললো,
“আমি.. থার্মোমিটারটা দাও তো একটু।”
ঘুমঘুম চোখে দরজা খুলে আবারও বিছানার দিকে এগুলো টুটুল।
“কার আবার জ্বর হলো?”
“চমকের গা গরম লাগছে..”
“অহ.. নিয়ে যাও।”
ঘরে ঢুকে ওয়ার্ডরোবের দিকে এগুলো চৈতালি। ঘরটির জানালাগুলো বন্ধ থাকায় সবটা তার নজরে না এলেও সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে থার্মোমিটার খোঁজার চেষ্টা করে বললো,
“কাল রাতে চমক ঘুমোয়নি.. তুমি কি একবার সুরুজ চাচার কাছে ওকে নিয়ে যাবে?”
“জ্বরটা দেখো.. যদি বেশ মনে হয় নিয়ে যাবো।”
“ঠিকাছে.. কোথায় রেখেছো থার্মোমিটার?”
“উপরেই আছে কোথাও। মোড়ায় দাঁড়িয়ে খুঁজে দেখো..”
পাশ থেকে মোড়া নিয়ে তাতে দাঁড়িয়ে অজস্র জিনিসের স্তুপের মাঝে হাত দিল চৈতালি। তবে থার্মোমিটারের কোনো চিহ্ন সেখানটায় না দেখতে পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে টুটুলের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রয়েছে তার বুকের দিকে। সাথেসাথেই মোড়া থেকে নেমে পড়লো চৈতালি। পরনের ওড়না ঠিক করে প্রথম ড্রয়ার খুলতেই ওপাশ থেকে ঘরের আলো জ্বেলে দিল টুটুল।
“তুমি জানো বাবা আমাদের নিয়ে কী ভাবছে?”
কয়েক কদম এগিয়ে এসে টুটুল প্রশ্নখানা করলেও সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চৈতালি বললো,
“কোথায় রেখেছো থার্মোমিটার? মনে করে আমায় বলো।”
“মনে করে বলছি.. তার আগে তুমি আমায় এটা বলো তুমি আমাদের বিয়ের ব্যাপারে কিছু জানো?”
“জানতাম না.. এখন জানলাম।”
“মিথ্যা বলছো.. তুমি জানতে।”
ঢোক গিললো চৈতালি। অস্বস্তিকর এক পরিস্থিতির হাত থেকে বাঁচতে সে থার্মোমিটার খোঁজা বন্ধ করে দরজার দিকে চেয়ে বললো,
“আমি যাচ্ছি.. তুমি থার্মোমিটার খুঁজে আম্মার কাছে পাঠিয়ে দিও।”
তড়িঘড়ি করে দরজার দিকে এগুলেও মাঝপথেই হঠাৎ নিজের হাতে টান অনুভব করলো চৈতালি। পিছন ফিরে বিস্মিত ভঙ্গিতে টুটুলের দিকে চাইতেই সে মৃদু হেসে বললো,
“তোমার হাসিটা সুন্দর ভাবি।”
“কী করছো এসব? হাত ছাড়ো।”
“আমি তোমাকে নিয়ে ভাবছি ভাবি..”
“হাত ছাড়ো টুটুল..”
টুটুলের শক্ত হাতের বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে অপর হাত দিয়ে তার গালে কষিয়ে একটা চড় বসিয়ে দিল চৈতালি। পুরো শরীর তার থরথরিয়ে কেঁপে উঠলেও নিজেকে শক্ত রেখে দৃঢ় গলায় বললো,
“ভাবিও বলছো আবার হাত ধরে টানাটানিও করছো। লজ্জা করছে না তোমার? আজ তোমার ভাই বেঁচে থাকলে এই ধরনের কাজ করার সাহস পেতে তুমি?”
চৈতালির চড় খেয়ে তার হাত ছেড়ে দিতেই টুটুলের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল সে। দ্রুত পায়ে এগুলো নিজের ঘরের দিকে। ঠিক-ভুল, শুদ্ধ-অশুদ্ধ, ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে জানে না সে। করেনা কারো মতামতের তোয়াক্কাও। শুধু এটুকুই জানে আর মানে মুবিন তাকে আর ঠকাবে না। ছলছলে নয়নে ঘরে ফিরে এসেই ছেলে বুকে চেপে ধরলো চৈতালি। চোখজোড়া বুজে অঝোর ধারায় কেঁদে ডেকে উঠলো উপরওয়ালাকে। হে আল্লাহ, মুবিনকে আর সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগিয়ো না। ওকে দ্রুত আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।
“চুল কেটে বাসায় আসবেন.. আসবেন না বলুন?”
“হ্যাঁ আসবো। ছেটেই আসবো।”
“বললাম নাড়ু করুন। কেন যে করছেন না বুঝি না!”
উল্লাসীর কথায় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মেসবাহ বললো,
“আপাতত ওসব বাদ দাও।”
“আচ্ছা, ঠিকাছে.. এখন কেমন লাগছে আপনার?”
“ভালো..”
“সত্যিই তো?”
“হ্যাঁ.. ”
“জানেন আপনার কিছু হলে আমার বুকের ভেতরটায় কেমন লাগে? আপনার যখন কোনো রোগীর কারণে ঝামেলা পোহাতে হয় তখন আমি ঠিক কতটা কষ্ট পাই তা আপনাকে বলে বুঝানো যাবেনা। মনে মনে ওই রোগীকে একশবার অভিশাপ করে দেই আমি।”
ফোনের ওপাশ থেকে উল্লাসীর কথা শুনে ম্লান হাসলো মেসবাহ। চেয়ারে আরাম করে বসে ক্ষীণ স্বরে বললো,
“জানি.. তবে যখন রাগ উঠে তখন তো তোমার সেই কষ্টটা আর থাকেনা।”
“কে বলেছে থাকেনা? অবশ্যই থাকে.. তবে তখন আমি আমার মনকে বোঝাই। মনকে শক্ত করি।”
“শক্ত করাটা যদিও অপ্রয়োজনীয়!”
“অপ্রয়োজনীয় বলছেন? আচ্ছা একটা কথা বলুন তো?”
“কী কথা?”
“আমার কাজে আপনি কি খুব বেশি বিরক্ত হন?”
“মোটেও না..”
“আমি জানতাম.. এখন রাখছি কেমন? মৈত্রীকে স্কুল থেকে আনার সময় হয়ে গেছে।”
মেসবাহর উত্তর শুনে মনের সকল প্রশ্ন মুছে গেল উল্লাসীর। গলার স্বরে বেশ উৎফুল্লতা ফুটিয়ে সে কথা শেষ করে ফোন কেটে দিতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো মেসবাহ। আজ তার কাজের বেশি একটা চাপ নেই। মৈত্রীকে স্কুল থেকেও আনতে যাবে উল্লাসী। যাবেনা সে বিকেলে ল্যাবএইডেও। ভেবে খুশি মনে চোখজোড়া বুজতেই তার কানে এল ইভানার গলার স্বর।
“আসবো?”
উঠে সোজা হয়ে বসলো মেসবাহ। মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
“আরে তুই! আয়.. তুই কবে এলি কবে কী হলো কিছুই কেন জানাসনি বলতো?”
মেসবাহর মুখোমুখি বসলো ইভানা। গম্ভীরমুখে বললো,
“জানি না কিছু। আমার তোকে কিছু বলার আছে।”
“কী ব্যাপারে?”
“আগে বল তোর শরীর ঠিক আছে?”
“আছে বেশ। কাল তুই যা যা করলি! রাতে ভেবে রেখেছিলাম সকালে তোকে একবার কল করবো। কিন্তু নানান চাপে মাথা থেকে যে কখন বেরিয়ে গেল!”
“ডাস’ন্ট ম্যাটার.. তবে কথা অন্যখানে। রাতে যখন তোর বাসা থেকে ফিরছিলাম তখন আমি বেশ হাইপার ছিলাম.. অসুস্থ বোধ করছিলাম।”
ভ্র কোঁচকালো মেসবাহ।
ইভানা পূর্ব সুরেই বললো,
“কিন্তু যখন আমি পুরো ব্যপারটা বুঝতে পারলাম তখন আমি হাটতে হাটতে পেরিয়ে এসেছি অনেকটা পথ। বেশ শুনশান নীরবতায় ঢাকা ছিল গলিটা.. রাত ক’টা বাজছিল তখন জানা নেই! তবে আমি যখন অনুভব করলাম আমার পেছনে দুজন লোক বেশ খানিকক্ষণ ধরে আমায় ফলো করছে তখন আমি প্রচুর উত্তেজিত হয়ে পড়লাম। হাটার গতি বাড়িয়ে দিতেই টের পেলাম আমার স্কার্ফের টান।”
গলার স্কার্ফ হালকা সরানোর চেষ্টায় হাত উঠাতেই ইভানার হাতে ব্যান্ডেজ এবং গলার আঘাতটা দেখতে পেল মেসবাহ। উঠে দাঁড়িয়ে সে ইভানার কাছে এগিয়ে আসতেই ইভানা বললো,
“ধস্তাধস্তির পর যখন আমি পার্সটা ছেড়ে দিলাম তখন আমার হাতের মাঝদিয়ে গরগর করে রক্ত ঝড়ছিল। বিশ্বাস কর.. আমার তখন কিছুই মাথায় আসছিল না। না আমার বাবামার ফোন নাম্বার আর না ড্রাইভার কাকার। আমার শুধু মাথায় ছিল তোর নাম্বার।”
“তুই আমাকে কল দিসনি কেনো?”
“কল দেইনি তোর অসুস্থতার কথা ভেবে। তবে সামনের একটি টঙের দোকান থেকে ফোন চেয়ে তোকে এসএমএস করেছিলাম.. তোর অপেক্ষায় অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি।”
এসএমএস? সে সকালেও ফোন বেশ কয়েকবার চেক করেছে জরুরী একটি ম্যাসেজ আসার কথা ছিল বলে। তবে তখন তো আননোন নাম্বার থেকে কোনো নাম্বার নজরে আসেনি তার। কপালে ভাজ নিয়ে মেসবাহ ইভানার পাশে এসে দাঁড়াতেই ইভানা ভারী গলায় বললো,
“কষ্ট আমার ওখানেও না। কষ্ট আমার উল্লাসীর চিন্তাধারায়, ওর কাজকর্মে। আমাকে ওর ভালো না লাগলে ও আমায় একবার বলতে পারতো। তাছাড়া আমার তো কোনো দরকার ছিল না.. আমি তোর পাশে ছিলাম শুধু এই ভেবে যে তুই একা। উল্লাসী যদি সেই সময়টায় তোর পাশে থাকতো তাহলে আমি কোনো সময়ই তোর পাশে বসে তোকে নিয়ে এতটা ওয়ারিড হয়ে পড়তাম না।”
“তোকে কিছু বলেছিল উল্লাসী? খারাপ কিছু করেছিল?”
ঘটনার সুত্রপাত খুলে বলার ইচ্ছে না থাকলেও চকলেট ক্রিম থেকে শুরু করে তার বিষন্ন মনে বাসা থেকে বেরিয়ে আসা সবটাই মেসবাহকে খুলে বললো ইভানা। নিজের ভেতরের কষ্টটা লুকোনোর চেষ্টায় বুকচিরে বেরিয়ে আসা গভীর এক দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললো,
“আমি যখন বুঝলাম উল্লাসী আমায় নিয়ে এতটা জেলাস বিশ্বাস কর তখন আমার মনটা এতটা বিষন্নতায় ভরে উঠেছিল যে আশপাশটায় নজর বোলানোর মতো সাহস আমার ছিল না। নিজেকে প্রচুর ছোট লাগছিল। আমি আর যাই চাই তোর কখনোই খারাপ চাইনা। তুই কষ্ট পাবি এমন কিছু আমি কখনো ভাবতেও পারবো না। করা বেশ দূরের কথা..”
ইভানার গলার স্বর মেসবাহর বুকে এসে বিঁধলো তীরের মতো। ইভানা তার বন্ধু.. সবচেয়ে কাছের বন্ধু। যার সাথে সুখদুঃখ ভাগাভাগি করে নেয়া যায় খুব সহজে। যে তাকে সঠিক সময়ে সঠিক পরামর্শ দেয় আবার কখনো খারাপ পথে পা বাড়ানোর আগে তাকে থামিয়ে দেয়। অথচ তার সাথেই এমন অপ্রীতিকর ব্যবহার! তাও কিনা তার নিজের স্ত্রীর দ্বারা! মেনে নেয়া যায়? রাগেকষ্টে বুকের বামপাশটায় চিনচিনে ব্যথা অনুভব হতেই হাটু গেরে ইভানার পাশে বসে পড়লো মেসবাহ। তার ব্যান্ডেজে মোড়ানো হাতে আলতো করে চেপে ধরে বললো,
“তোকে কিছু বলতে হবে না। তোকে আমি নিজের থেকেও ভালো করে চিনি.. জানি।”
(চলবে)