আলোছায়া !! Part- 02
লাইটারের আগুনে সিগারেট জ্বালিয়ে চেয়ারে বসলো মেসবাহ। নীরব দৃষ্টিতে স্ফুলিঙ্গের মতো লাল আগুনের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর তাতে কয়েকবার টান দিয়ে আবারও উঠে দাঁড়িয়ে ব্যালকনির আলো জ্বেলে দিল। চারিপাশে অসহনীয় গরম পড়লেও খানিকক্ষণ পরপর মৃদু বাতাস বইছে। যা পুরো শরীরে আলতো করে ছুঁয়ে দেয়ায় গরমের আভাস কমে যাচ্ছে। পরিবেশ শীতল হয়ে উঠছে ধীরেধীরে। এমন এক ক্ষণেই উল্লাসী এসেছিল তার জীবনে। তার বুকের ভেতরটায় অদ্ভুত এক তুফানের সূচনা করে বলেছিল, আমার বাবা মাকে যতটা ভালোবাসে আপনিও কি আমায় ততটাই ভালোবাসেন? সেপ্রশ্নের জবাবে দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছিল মেসবাহ। বলেছিলো, ভালোবাসা মানে বোঝো তুমি? উল্লাসী বলেছিলো, উহু.. তবে এটুকু জানি বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীর দুজন দুজনকে ভালোবাসতে হয়।
“বসবো?”
পাশ থেকে আসা উল্লাসীর গলার স্বরে স্মৃতিচারণ ছেড়ে বাস্তবে ফিরে এল মেসবাহ। এশট্রেতে সিগারেট ফেলে গম্ভীরমুখে বললো,
“বসো..”
হাতে থাকা আমের থালা নিয়েই বসে পড়লো উল্লাসী। পরিবেশ স্বাভাবিক করতে বললো,
“মৈত্রীর স্কুল কেমন চলে?”
“ভালো..”
“টিচারদের তো ওকে নিয়ে কোনো কমপ্লেইন নেই?”
“না..”
মেসবাহর স্বল্প বাক্যে অন্যসময় উল্লাসীর রাগ লাগলেও এমুহূর্তে মায়া হলো। লম্বা একটি দম ছেড়ে মেসবাহর দিকে তাকিয়ে সে নরম সুরে বললো,
“মুবিন ভাইকে কিন্তু নাম্বার দিয়ে দিয়েছি।”
তবে বিপরীত দিক থেকে মেসবাহর কোনো সাড়া না পেয়ে সে হতাশ হয়ে আবারও মুখ খুললো সে।
“মন খারাপ?”
“না।”
“তবে আমার দিকে তাকান।”
পাশ ফিরে তাকালো মেসবাহ।
উল্লাসী কাটা চামুচে আমের এক টুকরো মেসবাহর দিকে তুলে ধরে বললো,
“হা করুন..”
“আমি খেয়ে নিতে পারবো।”
“আমিও খাইয়ে দিতে পারবো..”
ঠোঁটে হাসি ফুটলো মেসবাহর। বাতাসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে সে মুখে নিল আমের টুকরোটি।
“মেয়ে কই?”
“মুন্নি ভাবিদের ওখানে। আল্লাহ যে কেনো ভাবিদের কোনো সন্তান দিচ্ছেন না! আর আপনিও যে কোন আধপাগলকে সাজেস্ট করলেন! কিচ্ছু হলো না.. ওদিকে ইন্ডিয়া থেকেও ঘুরে আসলো। তবে কাজের কাজ শূন্য!”
“হবে.. আল্লাহ চাইলেই হবে।”
আম খেতে খেতে জবাব দিল মেসবাহ।
উল্লাসী বললো,
“আর ওদের চাওয়া?”
“হবে.. সব হবে।”
“কচু হবে! একটা কথা বলুন তো.. ”
“কী?”
“উনারা বাচ্চা পালক নিলেও তো পারে। তা কেনো নিচ্ছে না?”
“তা আমি কী করে বলি!”
“আপনি সারাদিন যেভাবে হাসান ভাইয়ের সাথে লেগে থাকেন! আর এখন বলছেন কীভাবে বলি! হাসান ভাই কী এসব নিয়ে আলোচনা করেনা?”
ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললো মেসবাহ। প্রসঙ্গ পালটে বললো,
“উনাদের নিয়ে কথোপকথন আপাতত বাদ। আমাদের নিয়ে কিছু বলি..”
“বলবেন? বলুন..”
“চলো রোযার আগেই একদিন বের হই। সারাদিনের উদ্দেশ্যে.. ঘোরাঘুরি করে বাইরে খাওয়াদাওয়া করে একদম রাতে বাড়ি ফিরলে কেমন হয়?”
উচ্ছাসিত কন্ঠে উল্লাসী বললো,
“যাওয়া যায়.. কবে যাবেন বলুন?”
“এই শুক্রবার?”
“পরীক্ষা আছে কোচিংয়ে।”
“তবে মঙ্গলবার?”
“উহু.. হবে না। কাল চলুন না!”
“না.. কাল আমার সময় হবে না।”
হতাশ হলো উল্লাসী। চোখমুখ ছোট করে মেঝের দিকে তাকাতেই হাতে হালকা চাপ অনুভব করলো। মেসবাহ প্রায়ই এমনটা করে। তার এই কাজের অর্থ হতাশ হবার কিছু নেই। আমি তোমার পাশে আছি। মাঝেমাঝে তার এই কাজের দ্বারা বিরক্ত হলেও মাঝেমাঝে লোকটির উপর প্রচুর ভালোবাসা পায়। ছোট বাচ্চাদের মতো বসতে ইচ্ছে হয় তার কোলের ভেতরটায়। ধীরেধীরে তার শার্টের বোতামগুলো খুলে বুকের মাঝে নাক ঘষতে ঘষতে বলতে ইচ্ছে হয়, ছোট আদর চাই। অবশ্য বড় আদর দিলেও কিছু মনে করবো না। ভাবামাত্রই চারপাশটায় চোখ বুলিয়ে উঠে মেসবাহর কোলের মাঝে বসে তার চুলে হাত বুলিয়ে দিল উল্লাসী। আহ্লাদী গলায় বললো,
“মাঝেমাঝে হঠাৎ আপনার প্রতি আমার এত আদর পায়! মনে হয় আপনাকে কামড়ে কামড়ে খেয়ে ফেলি।”
হাসলো মেসবাহ। উল্লাসীর গালে বৃদ্ধাঙ্গুল ছুঁইয়ে দিয়ে বললো,
“মেয়েটাকে আজ একটু তুমি খাইয়ে দিও।”
“কেনো? ও কিছু বলেছে?”
“হু..”
কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠতেই উঠে দাঁড়ালো উল্লাসী। ক্ষীণ স্বরে বললো,
“কী বলেছে?”
“চিন্তিত হবার মতো কিছু নয়.. রিল্যাক্স!”
“তবে আপনি থাকুন.. আমি ওকে ডেকে আনি।”
উল্লাসী দরজার দিকে পা বাড়াতেই তাকে থামিয়ে দিল মেসবাহ। নিজেও উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“হাসান ভাই একবার যেতে বলেছিল। চলো, একসাথেই যাই।”
দুইবার কলিংবেল টিপতেই ভেতর থেকে দরজা খুললো শীতল। সাথেসাথেই কাঁধ প্রসস্থ হয়ে এল মেসবাহর। চোখমুখ কুঁচকে সে উল্লাসীর দিকে চাইতেই মৃদু হাসলো সে। তরতর করে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
“আমার ছানাটা কই? নাওয়াখাওয়া ভুলে সারাদিন এবাড়িতে পড়ে থাকলেই চলবে?”
পাশ থেকে চেঁচিয়ে উঠলো মৈত্রী। দৌড়ে মায়ের কাছে আসতে আসতে বললো,
“হাট্টিমাটিম টিম, হাসান চাচ্চু একটা ভীতুর ডিম!”
মেয়েকে একধমক মেরে সোফায় বসে পড়লো উল্লাসী। সম্মুখে খিলখিল করে হাসা মুন্নি সরকারের দিকে তাকিয়ে বললো,
“শীতল ভাই কখন এলো?”
“এইতো কিছুক্ষণ.. তোরা বয়। আমি চায়ের পানি বসিয়ে দিয়ে আসি।”
পাশ থেকে পেপার থেকে মুখ তুলে হাসান সরকার বললেন,
“তোমরা এসেছো ভালোই করেছো। আমিই যেতাম তোমাদের ওখানে।”
শীতল ভেতরের ঘরে ঢুকে পড়ায় স্বস্তির সাথে সোফায় বসলো মেসবাহ। প্রশ্নসূচক চোখে হাসান সরকারের দিকে চেয়ে বললো,
“বিশেষ কোনো দরকার ছিল?”
“হ্যাঁ.. কাল শীতলের জন্য মেয়ে দেখতে যাচ্ছে তোমাদের ভাবি। এনিয়ে তোমাদের মন্তব্য কী?”
“এ আর নতুন কী! মাসে তো দশবারোটা দেখা হয়ই!”
পাশ থেকে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো উল্লাসী। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাসান সরকার বললেন,
“সহমত! এ আর নতুন কী!”
রান্নাঘরের দিকে যেতে চাইলেও সোফা ছেড়ে উঠলেন না মুন্নি সরকার। গম্ভীরমুখে তিনি হাসান সরকারের উদ্দ্যেশ্যে বললেন,
“তুমি এমনভাবে কথা কেনো বললে?
“কেমন ভাবে বলেছি?”
“মুখের দশা প্যাঁচার মতো করে। সমস্যা কী তোমার? আমার ভাইকে কেনো দেখতে পারোনা তুমি?”
হতভম্ব হয়ে পড়ার মতো করে হাসান সরকার বললেন,
“দেখতে পারিনা কে বলে!”
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে মাঝ থেকে মেসবাহ বললো,
“আচ্ছা আমরা টপিকে ফিরে আসি। তা মেয়ে কী করে ভাবি?”
চোখজোড়া স্বাভাবিক করে মুন্নি সরকার বললেন,
“মেয়ে প্রাইমারী স্কুলের মাস্টার। বেশ দেখতে। আমি এর মাঝেই ওর পুরো ফেইসবুক আইডি চেক করে ফেলেছি।”
“মাস্টারী করিস ভালো কথা। আবার এই গাধাকে বিয়ে করে লাইফটার টুয়েলভ বাজানোর দরকার ছিল না!”
বললেন হাসান সরকার। সাথেসাথেই তাতিয়ে উঠলেন মুন্নি সরকার। দাঁতে দাঁত চেপে সে বললো,
“তুমি কিন্তু বড্ড বাজে বকছো!”
“আমার মতে ঠিক বকছি। শোনো আগে ভাইকে মানুষ বানাও।”
“তোমার কী ধারণা? আমার ভাই কোনো পশু?”
“পশু নয়, তবে মানুষও নয়। তা বিয়ে দিচ্ছো ভালো কথা! তবে বউকে খাওয়াবে কী?”
কড়মড়ে সুরে মুন্নি সরকার বললেন,
“ও যা খায় তাই খাওয়াবে।”
“ও তো খায় মদ গাঞ্জা, বউকেও কি তাই খাওয়াবে?”
পরিস্থিতি ক্রমশ বিগড়ে যাচ্ছে বুঝে দ্রুত স্থানত্যাগ করাটাই শ্রেয় মনে হলো মেসবাহর। ইশারায় উল্লাসীকে উঠার নির্দেশনা দিতেই বাড়িতে যাবার জন্য চেঁচামেচি শুরু করলো মৈত্রীও।
“মাগো মা.. আই লাভ ইউ মা।”
মৈত্রীর কথায় হাসলো উল্লাসী। বইয়ের পাতা থেকে মুখ তুলে দেয়াল ঘড়ির দিকে দিয়ে বললো,
“মা, মাথার এই পাশটা টেনে দাও। হু.. এপাশটায়।”
মায়ের চুলে হাত বোলাতে বোলাতে মৈত্রী বললো,
“রশ্নি কী বলে জানো?”
“কী?”
“বলে তোর মা তো আমার বোনেও থেকেও ছোট! এত ছোট কি কারো মা হয়? তখন আমি কী বলি জানো? মাই মা ইজ ওয়ার্ল্ড’স বেস্ট মা। এন্ড আই লাভ মাই মা ভেরি মাচ।”
“আর বাবা?”
“বাবাকে নিয়েও বলে..”
“কী বলে?”
“বলে ওর মা নাকি লাবিবের মাকে বলছিলো বাবা বুড়ো। বুড়োর মনে রঙ ধরেছিলো বলে তামাশা করেছে। আর তুমি বাবার টাকা নিয়ে সেই তামাশার শেষে আমাদের ফেলে নাকি চলে যাবে।”
চোয়াল শক্ত হয়ে এলো উল্লাসীর। পিছন ফিরে মেয়েকে সামনে বসিয়ে কঠিন স্বরে বললো,
“তুমি আর রশ্নির সাথে মিশবে না।”
“বাট আই লাইক রশ্নি মা।”
“কিন্তু ও তোমার জন্য সঠিক নয়।”
“কে কার জন্য সঠিক নয়? আর ফোন নিজের কাছে রাখো না কেনো বলতো? বাজছিল কতক্ষণ হলো!”
চোখমুখ কুঁচকে ঘরে ঢুকলো মেসবাহ। উল্লাসীর ফোন বিছানায় রাখতেই উল্লাসী বললো,
“কে কল করেছিলো?”
“জাভেদ ভাইয়া লেখা ছিল। কে উনি?”
“আমাদের কোচিংয়ে ক্যামেস্ট্রি ক্লাস…”
কথা শেষ না হতেই আবারও কল বেজে উঠাতে কল রিসিভ করতে ফোন কানে নিল উল্লাসী। ভারী কন্ঠে বললো,
“হ্যালো.. বলুন?”
“উল্লাসী বলছো?”
“জ্বী..”
“ব্যস্ত ছিলে? পড়ছিলে নাকি?”
“হ্যাঁ..”
“একটা শিট করছিলাম.. ভাবলাম তোমায় কল করি।”
“আচ্ছা..”
“কাল আসছো না ক্লাসে?”
“হ্যাঁ।”
“ঠিকাছে এসো.. আর একটা কথা!”
“হ্যাঁ..”
“খোলা চুলে তোমায় অপূর্ব সুন্দর লাগে।”
বুকের ভেতরটা ধুকপুক করে উঠতেই লাইন কেটে দিল উল্লাসী। ফোন নামিয়ে রেখে ঢোক গিলতেই ওপাশ থেকে মেসবাহ বললো,
“কী বললেন উনি?”
একমুহূর্ত থেমে উল্লাসী ভাঙ্গা গলায় বললো,
“কিছু না.. চলুন। খেতে দেই।”
-চলবে