অচেনা আমি ! পর্বঃ- ৫
লেখাঃ শারমিন আক্তার
তনয়াকে আয়াত হাত মুখ মুছিয়ে ঘরে নিয়ে আসলো। তারপর বিছানায় বসিয়ে বললো কি হয়েছে তনয়া হঠাৎ এমন বমি করে দিলে কেন? শরীর ঠিক আছে তো তোমার?
তনয়াঃ ঠিক বুঝতে পারছি না। কদিন ধরেই হঠাৎ করে মাথা ঘুরায়, বমি ভাব হয়, কেমন যেনো অসস্তি ভাব হয়।
আয়াতঃ তনয়া তুমি কি এ মাসে—– মানে বুঝতে পারছো কি বলতে চাইছি?
তনয়াঃ হুমমম। হতে পারে তুমি যা ভাবছো!
আয়াতঃ তনয়া আমার স্টেথোস্কোপ টা নিয়ে আসো তো?
তনয়াঃ সেটা দিয়ে কি হবে!
আয়াতঃ যা বলছি করো না প্লিজ!
তনয়া গিয়ে স্টেথোস্কোপ নিয়ে আসলো। আয়াত তনয়ার হাতের পালস চেক করে তারপর ভালো করে পরীক্ষা করে বললো। তনয়া তুমি প্রেগনেন্ট! খবরটা শুনে তনয়া খুশিতে আয়াতের উপর জমে থাকা সব অভিমান ভুলে আয়াতকে জড়িয়ে ধরে বললো কনগ্রেচুলেশন মাই ডিয়ার হ্যাজবেন্ড! ইউ উইল বি ফাদার সুন।
আয়াত তনয়াকে বুক থেকে সরিয়ে বললো।
আয়াতঃ তনয়া তুমি এ খবরে কি ভাবে খুশি হয়েছো!
তনয়াঃ আরে এত খুশির খবরে খুশি না হয়ে কি থাকা যায়?
আয়াতঃ বাট তনয়া আমার এখন বেবি চাই না! এখন এ সময় বেবি নেবার মত কোন মানুষিক প্রস্তুতি আমার নেই। আমি আরো কিছুটা সময় তোমার সাথে কাটাতে চাইছিলাম। তারপর বেবির কথা চিন্তা করতে চাইছিলাম , দেখো আমাদের বিয়ের মাত্র তিন বছর হলো, এত তারাতারি বেবির কি দরকার। আয়াতের কথা গুলো শুনে তনয়ার মুখের খুশিটা উড়ে গেলো।
তনয়াঃ কি বলছো আয়াত এসব? দেখো আমরা বেবি নেবার মত যথেষ্ঠ মেচিওর, বিয়ের তিন বছর হয়ে গেছে, আমার গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট, তুমি তোমার পেশায় সাকসেসফুল, তুমি ইস্টাবিলিস, বাড়ির সব কিছু ঠিক আছে তাহলে বেবি আসলে প্রবলেম কোথায়? ইনফ্যাক্ট এখন আমাদের বেবি নেবার পারফেক্ট সময়, আর এমন তো নয় যে, বেবি আমি একা একা তৈরী করেছি, বাচ্চাটা যতটা আমার ততটা তোমারও।
আয়াতঃ আমার তো মনে হচ্ছে তুমি ইচ্ছা করেই বেবি নিছো, কারন আমি তোমাকে আগেও বলছি আমি বেবির জন্য মানুষিক ভাবে প্রস্তুত না, তাহলে কিভাবে কি?
তনয়াঃ হ্যা আমি ইচ্ছা করেই বেবি নিছি, কারন আমি অনেক মেয়েকে দেখেছি বিয়ের পর অনেক দিন পরিকল্পনায় কাটিয়ে দিয়ে পরে মা না হতে পেরে সারা জীবন কাঁদে আমি চাইনা আমার সাথে এমন কিছু হোক! আর তাছাড়া আমাদের ঘরে একটা বেবির খুব প্রয়োজন এখন। আমি ভাবছিলাম আমি প্রেগনেন্ট হলে তুমি বিষয়টা মেনে নিবে, হয়তো বেবি আগমনে ওর অনুভুতি অনুভব করে খুশি হবে। আর আয়াত তুমি না ডাক্তার? আমার থেকে এসব বিষয় তুমি ভালো জানো। তাহলে অশিক্ষিতের মত বিহেব কেন করছো?
আয়াতঃ জাস্ট সেটাপ তনয়া, বেবি নেবার সিদ্ধান্তটা স্বামী স্ত্রী দুজনার হতে হয়। একজনের ইচ্ছায় হয় না।তুমি কেনো বুঝতে পারছো না আমি মানুষিক ভাবে প্রস্তুত না।
তনয়াঃ এতে মানুষিক প্রস্তুতির কি আছে আয়াত! এখনো সাত আট মাসের মত বাকি আছে, মানুষিক প্রস্তুতির জন্য এ সময় কি যথেষ্ট নয়? দেখো আয়াত একবার ভাবো, যে আসতে চলেছে সে আমাদের দুজনার অংশ তাহলে কেন ওকে মানতে চাইছো না? বোঝার চেষ্টা করো প্লিজ!
আয়াতঃ আমি কিছু বুঝতে চাই না, জাস্ট লেট মি এলোন।
আয়াতের কথাগুলো তনয়ার বুকে ছুড়ির মত বিধলো, কারন আয়াত কখনো তনয়ার সাথে এমন আচরন করে না, কিন্তু আজ বিকাল থেকে কি হয়েছে আয়াতের? কেন এমন ব্যবহার করছে, তনয়া কথা গুলো ভাবতে ভাবতে ছাঁদের গিয়ে এক কোনে বসে পরলো। রাত প্রায় নয়টার বেশি বাজে তনয়া ছাঁদে বসে কাঁদছে, তনয়ার শ্বশুড় বা আস্ফি কেউ বাড়িতে নেই , তারা আনিকার বাসায় গেছে আজ রাতে আসবে না। তনয়া ছাদের কোনে চুপটি করে বসে কান্না করছে গত তিন বছরে এত কষ্ট তনয়ার কখনো হয়নি। তনয়া কাঁদছে আর আল্লাহর কাছে বলছে কেন এমন হচ্ছে খোদা? কি অন্যায় করেছি আমরা? কেন আমাদের মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি ঢুকিয়ে দিলে? নয়তো আজকের দিনটা আমার আর আয়াতের জীবনের শ্রেষ্ঠতম দিন হতো। তনয়া এসব ভাবছে তখনই তনয়ার ফোনটা বেঁজে উঠলো, তনয়ার ফোনের দিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই কিন্তু বেশ কয়েকবার রিং হবার পর ফোনের স্ক্রিনের দিকে না তাকিয়েই তনয়া ফোনটা রিসিভ করে সালাম দিলো।
—–ওয়ালাইকুম আসসালাম। তা লেখিকা কি করছে? কন্ঠ স্বরটা শুনেই তনয়া চমকে উঠলো, কারন বিকালে এই কন্ঠ স্বরটাই শুনেছে। তনয়া কোন কথা বলছে না দেখে সে আবার বললো কি হলো কিছু বলছো না যে? নিশ্চয়ই আয়াত কাছে আছে! নো প্রবলেম আমি থাকতে আয়াত তোমাকে কিছু বলতে পারবে না।
তনয়াঃ কি চান কি আপনি হ্যা বলুন!
——আমি তো শুধু তোমাকে একবার সামনে থেকে দেখতে চাই। আর কোন উদ্দেশ্য নাই।
তনয়াঃ উদ্দেশ্য! আপনি তো আজ আপনার উদ্দেশ্যে সফল হয়েছেন। কারন যে আয়াত গত তিন বছরে আমার সাথে সামান্য উঁচু গলায় পর্যন্ত কথা বলেনি সে আজ আমাকে কত গুলো কথা শুনিয়েছে শুধু মাত্র আপনার জন্য। যে, আয়াত ঘরে থাকা কালীন সময় আধা ঘন্টাও আমার থেকে দূরে থাকতো না, আমার সাথে কথা না বলে থাকতো না সে আজ গত প্রায় পাঁচ ঘন্টা যাবত আমার সাথে ঠিক ভাবে কথা বলছে না। আপনি আজ সফল। কিন্তু একটা কথা শুনে রাখুন আপনি যতই চেষ্টা করুন আমার আয়াতকে আমার কাছ দূর করতে পারবেন না। আমাদের সম্পর্কের সামান্য পরিমানও ক্ষতি করতে পারবেন না। কারন আমাদের সম্পর্কটা যখন আল্লাহ্ বানিয়েছে তাই তাকে রক্ষা করার দায়িত্বও তিনি নিয়েছেন।
তারপর তনয়া অপর পাশের লোকটার উত্তরের অপেক্ষা না করে ফোনটা কেটে দিয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখে রাত দশটা বাজে। তনয়া ভাবছে এত রাত হয়ে গেছে,ছাঁদে উঠেছি প্রায় তিন ঘন্টা হলো অথচ আয়াত একবারও আমার খোঁজ করলো না, এতটা রাগ করেছে ও আমার উপর? এতটা অন্যায় করেছি আমি? শুধু নিজের বেবিটাকে পৃথিবীর আলো দেখাতে চাই এটা কি অন্যায়? জানি না তবে আমি কেন যেনো আয়াতের উপর রাগ করতে পারি না, খুব ভালোবাসি তো ওকে।
রাত অনেক হয়েছে আয়াতকে খাবার দিতে হবে, তারপর ওর মেডিসিন দিতে হবে, দিন দিন ওর শরীরটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তনয়া ছাঁদ থেকে ছাঁদের দড়জার কাছে আসতেই চমকে উঠলো, দূরের নিয়ন আলোয় মুখটি চিনতে অসুবিধা হলো না, কারন এর গায়ের গন্ধও তনয়ার চেনা, বসে আছে যে মানুষটা, চোখে মুখে বিষন্নতার ছায়া, কান্না করে চোখ দুটো লাল বানিয়ে ফেলছে? তনয়াকে দেখে ছাঁদে বসা থেকে দাড়িয়ে মাথা নিচু করে বললো এতক্ষন কেউ ছাঁদে বসে থাকে? তাও এত রাতে এই সময়? তোমাকে পাহাড়া দিতে আমাকেও কতক্ষন ধরে বসে থাকতে হয়েছে! প্রায় দু ঘন্টার বেশি সময় ধরে এখানে বসে আছি আর তুমি? তনয়া আর কোন কথা বলতে পারলো না, আয়াতকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠলো।
আয়াতঃ দুঃখিতো তনয়া, প্লিজ মাফ করে দাও, আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি আসলে তখন মাথাটা কাজ করছিলো না।
তনয়াঃ ইট’স ওকে আয়াত আমি জানি।
আয়াতঃ না তনয়া আমি সত্যিই অন্যায় করছি নয়তো নিজের সন্তানকে এভাবে বলতে পারতাম না। তুমি ঠিকই বলছো ও আল্লাহ্ তা’আলার রহমত ওকে এভাবে বলাটা পাঁপ হয়েছে, ও আমাদের ভালোবাসান ফসল ওকে অপমান করা মানে নিজেদের সম্পর্ককে অপমান করা। প্লিজ মাফ করে দাও তনয়া।
তনয়াঃ প্লিজ আয়াত এভাবে বলো না, আমি তোমার উপর রাগ করিনি।
আয়াতঃ না তনয়া আজ আমি সত্যিই তোমার সাথে খুব বাঁজে ব্যবহার করেছি। তুমি লিখবে, যখন ভালো লাগবে, যখন তোমার মন চাইবে তখন লিখবে দেখি কে তোমার কি ক্ষতি করে। আমি আছি তো তোমার পাশে। প্লিজ তনয়া মাফ করে দাও।
তনয়াঃ জাস্ট সেটাপ আয়াত, কতক্ষন ধরে বলছি আমি তোমার উপর রাগ করিনি, তারপরও এক কথা বারবার বলবে না। বলবে খবর আছে তোমার।
আয়াতঃ ওপস! স্যরি।
তনয়াঃ চলো নিচে চলো। আজ তুমি অসুস্থ বলে ছেড়ে দিলাম নয়তো ছাঁদ থেকে তোমার কোলে চরে নিচে নামতাম।
আয়াতঃ চাইলে এখনও পারি।
তনয়াঃ দরকার নাই তার। নিচে চলো প্রথমে দুজন একসাথে এশার নামাজ পড়বো তারপর দু’ রাকাত নফল নামাজ আদায় করবো আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করবো তিনি যেনো এভাবেই আমাদের সম্পর্কটাকে রক্ষা করেন। তার কৃপাদৃষ্টি না থাকলে আজ এত কিছুর হবার পরও এত সহজে আমাদের ভিতর মিল হতো না! আমাদের সব সময় উচিৎ আল্লাহর উপর ভরশা রাখা, বিপদে ধৈর্য্য রাখা, আর সবসময় তার প্রতি অনুগত্য থাকা, সকল কিছুর জন্য তার নিকট শুকরিয়া আদায় করা তাহলেই তো তিনি আমাদের ভালোবাসবেন।
আয়াতঃ ঠিক বলছো তনয়া, আল্লাহ্ মহান। তাই তো তিনি তার শ্রেষ্ঠ নেয়ামতের মধ্যে অন্যতম নেয়ামত আমাদের সন্তান রূপে দান করছেন। দেখো তনয়া এখন থেকে সব কিছু ভালো হবে। আমাদের সন্তান আমাদের জন্য খুশির অন্যতম নহড় নিয়ে আসবে।
তনয়াঃ আল্লাহ্ ভরশা। চলো নিচে।
আয়াত আর তনয়া নিচে গিয়ে, নামাজ পড়ে খাবার খেয়ে নিলো, তারপর তনয়ার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরেছে আয়াত।
তনয়াঃ আয়াত!
আয়াতঃ হুমমম।
তনয়াঃ এক ঘন্টায় কি এমন হলো যে তোমার মন বদলে গেলো?
আয়াতঃ হুমম বলছি তার আগে শোন, ডাক্তার ইমন আছেনা? সে নাকি তার ফ্যামিলি নিয়ে কাল দুপুরে আমাদের বাসায় আসবে।
তনয়াঃ ওহ! তার স্ত্রীও আসবে!
আয়াতঃ মনে তো হয়!
তনয়াঃ সেসব কথা পরে হবে আগে তুমি বলো কি এমন হলো যে, তুমি হঠাৎ এমন বদলে গেলে, আর ছাঁদে কখন গিয়েছিলে?
চলবে———
ভুলত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন।