অচেনা আমি ! পর্বঃ- ৪
লেখাঃ শারমিন আক্তার
বিকাল বেলা আনিকা সাথে তার ছেলেরা এবং তনয়ার বাবা মা ও ছোট ভাই (তানভির) আসে। সবাই আয়াতের শরীরে অবস্থা জানতে চায়।
আয়াতের বাবার একটা কাজ পরায় পরে আসবে, নয়তো কাল সকালে।
রায়ানঃ মামা তোমার কি হয়েছে? এভাবে রোগীদের মত শুয়ে আছো কেন? বাড়ি যাবে কবে!
আনিকাঃ বাবা তোমার মামা ব্যাথা পেয়েছে তাই। সুস্থ হলেই বাড়ি যাবে।
রিয়ানঃ মা তুমি কি বোকা? মামাতো ডাক্তার, ডাক্তারদের কি অসুখ হয়?
আয়াতঃ ঠিক বলছো বাবাই, খুব তারাতারি আমি বাসায় গিয়ে তোমাদের সাথে জমিয়ে খেলবো। ঠিক আছে।
তানভিরঃ ভাইয়া আপনি ডাক্তার হয়েও নিজের খেয়াল রাখতে পারেন না!
আয়াতঃ শালা বাবু একসিডেন্ট আপনার বোনের মত না যে, আমায় ভালোবাসবে!
তনয়াঃ আয়াত! কি হচ্ছে কি?
সবাই আয়াতের সাথে বেশ কিছুক্ষন কথা বলে বাড়ি চলে গেলো। তারা যাবার কিছুক্ষন পর মাগরিবের আযান দিলো, তনয়া আয়াতকে ওযু করতে সাহায্য করলো, যেহেতু আয়াত নামাজের পাটিতে বসে নামাজ পড়তে পারবে না তাই তনয়া একটা চেয়ার পেতে তাতে নরম একটা তোয়ালে দিয়ে আয়াতকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বললো, নামাজ পড়তে হয়তো একটু কষ্ট হবে, কিন্তু তুমিই তো বলো কষ্টের ফল সুমিষ্ট হয়, নামাজ পড়ে আল্লাহকে বলো তিনি যেনো আমাদের সব বিপদ দূর করে দেয়। তারপর তনয়া নিজেও ওযু করে নামাজ পড়ে নিলো। নামাজ শেষে আয়াতকে হালকা নরম কিছু খাবার খাইয়ে দিলো, খাবারটা আনিকা বানিয়ে নিয়ে এসেছিলো। তারপর আয়াতকে বললো একটু ঘুমাবে কি? সারাদিন তো বকবক করে কাটালে?
আয়াতঃ নাহ পড়ে এখন বরং তুমি একটা গল্প শুনাও।
তনয়াঃ আয়াত কত দিন ধরে লিখছি না।
আয়াতঃ তাহলে পুরোনো গল্প শুনাও। নয়তো তোমার ব্যাগে সবসময় কোন না কোন বই থাকে, সেটা পড়ে শোনাও।
তনয়াঃ ঠিক আছে।
তনয়া ব্যাগ থেকে একটা বই বের করলো। বইটির নাম বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স) এর জীবনি। তনয়া বইটি খুলে পড়া শুরু করলো আর আয়াত চুপচাপ শুনছে। কয়েক পাতা পরার পর কে যেনো দড়জায় টোকা দেয়। তনয়া হিজাবটা ভালোভাবে পরে, দড়জা খুলে, খোলা মাত্র একজন লম্বা করে সালাম দিলো।
——আসসালামু আলাইকুম।
তনয়া নিচু স্বরে নিচের দিকে তাকিয়ে সালামের জবাব দিলো ওয়ালাইকুম আসসালাম।
আয়াত লোকটাকে দেখে চিনতে পারলো। আসলে লোকটা আয়াতের সেই এ সি পি বন্ধু জয়। আয়াত জয়ের সাথে কতক্ষন কথা বলে মানে কুশল বিনিময় করে তনয়াকে দেয়া মেসেস গুলোর কথা আর হাসপাতালে হওয়া দূর্ঘটনার কথা বললো। জয় সব কিছু শুনে তনয়ার মোবাইলের মেসেস দেখতে চায়, মেসেস দেখে এবং মেসেস এর স্ক্রিন শর্ট নিয়ে তা নিজের মোবাইলে নিয়ে নেয়। দুটো আইডি থেকে মেসেস আসে, কিন্তু আইডি দুটো ডিএকটিভ থাকায় আইডি দুটো সম্পর্কে কিছুই জানতে পারলো না। তারপর আরো কিছু কথা বলে জয় আয়াত আর তনয়ার কাছ থেকে বিদায় নিলো আর বলে গেলো বিষয়টা ও নিজে হ্যান্ডেল করবে।
দুদিন পর আয়াতকে হসপিটাল থেকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। আয়াতের বাড়ি এসে নিজেকে ভিষন হালকা লাগছে। দুদিন হাসপাতালে থাকতে ভিষন বিরক্ত লাগছে, তখনই আয়াত ভাবলো মাত্র দুদিন হাসপাতালে থেকে আমি হাপিয়ে উঠেছিলাম অথচ আমার কত রোগী দিনের পর দিন হাসপাতালের বিছানায় কাটিয়ে দেয়। আল্লাহ্ তাদের হেদায়েত করুক। আয়াতের হাঁটতে বেশ কষ্ট হয়, কারন হাঁটতে নিলে পোড়া স্থানে টান লাগে, যা প্রচন্ড যন্ত্রনাময়। তনয়া আয়াতকে একটুও জন্যও নিজের চোখের আড়াল করে না। আয়াতের তনয়ার এ ভালোবাসা দেখে অনেক ভালো লাগলেও ভাবে তনয়ার উপর দিয়ে খুব প্রেশার যাচ্ছে। কারন ঘর সংসার সামলাতে হয় , এখন সাথে সাথে আবার আয়াতকেও সামলাতে হয়।
আয়াতঃ তনয়া!
তনয়াঃ হুমমমম
আয়াতঃ তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না?
তনয়াঃ কেন?
আয়াতঃ এই যে বাড়তি ঝামেলা বাড়লো।
তনয়াঃ কেমন?
আয়াতঃ সারাদিন ঘর সামলাও এখন আবার আমাকে নিয়ে ঝামেলা।
তনয়াঃ চুপ করো আয়াত, এ ধরনের বাজে কথা কেন বলো তুমি? মানুষ তার জন্যই সব করে যাকে সে ভালোবাসে। আর আমি আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার জন্য সামান্য কদিন একটু কষ্ট করতে পারবো। কথা গুলো বলতে বলতে তনয়ার গলা ভার হয়ে গেলো।
আয়াতঃ স্যরি তনয়া প্লিজ এমন করো না। আমি তোমাকে কাঁদাতে এমনটা বলিনি।
তনয়াঃ তুমি কি বুঝবে তোমার এমন কথায় আমার কেমন লাগে আয়াত! তোমার জন্য করবো নাতো কার জন্য করবো। তুমিই তো আমার সব। তুমি, আর আমাদের পরিবার তোমাদের জন্য করবো নাতো কাদের জন্য করবো?
আয়াতঃ জানি তনয়া। স্যরি।
তনয়াঃ ইট’স ওকে।
আয়াত হসপিটাল থেকে বাড়ি আসলো প্রায় পাঁচ দিন হলো। আয়াতের পোড়ার ক্ষতর স্থানটা এখন শুকানোর পর্যায়ে তাই প্রচন্ড ব্যাথা করে। আয়াত দাঁতে দাঁঁত চেপে ব্যাথা সহ্য করলেও তনয়ার চোখ এড়াতে পারে না। তনয়া যখন যখন আয়াতের এ অবস্থা দেখে, আয়াতের ঘাঁয়ে ঔষধ চা মলম লাগিয়ে দেয় তখন তখন অঝোরে কাঁদে। আর আয়াত তনয়াকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে সামলাতে চেষ্টা করে। গত কয়েকদিনে ছেলেটার কোন মেসেস আসেনি, আসবে কি করে তনয়া সেই হসপিটালে বসে আইডি ডিএকটিভ করে রেখেছে। না থাকবে আইডি না থাকবে ফালতু ঝামেলা।
বিকেল বেলা তনয়া আয়াতকে নিয়ে বাড়ির চারপাশে হাঁটছিলো। তনয়া আয়াতকে শক্ত করে থরে রেখেছে, তখন আয়াতের ফোনটা বেঁজে ওঠলো। আয়াত ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে প্রাইভেট নাম্বার লেখা একটা নাম্বার থেকে কল আসছে, এ ধরনের কলে ফোন নাম্বার ওঠে না, আয়াত ফোনটা রিসিভ করে সালাম দিয়ে জানতে চাইলো কে?
—–আজব লোক! সেদিন ওরকম দূর্ঘটনায়ও বেঁচে গেলেন? কঁপাল বলতে হবে আপনার! দিন ফোনটা তনয়াকে দিন।
আয়াতঃ কে আপনি? আর এরকম কথা কেন বলছেন?
—–আজব লোক তো আপনি! ফোনটা তনয়াকে দিতে বলছি তা না করে নিজে বকবক করছেন? আচ্ছা ফোন দিতে হবে না, ফোনটা লাউড স্পিকারে দিন, আমি জানি তনয়া আপনার কাছেই আছে।
আয়াতঃ মানে? আপনি কি করে জানলেন?
—–আরে ভাই কমনসেন্স, সুগার আর চিনি কি আলাদা জিনিস? তেমনি আপনারা দুজন মানুষ দুটো হলেও প্রানতো একটাই, তাই পাশাপাশি থাকাটাই স্বাভাবিক। বেশি কথা না বলে দিন ফোনটা লাউড স্পিকারে দিন।
আয়াত ফোনটা স্পিকারে দেয়ার সাথে সাথে, হাই তনয়া! হাউ আর ইউ? ডু ইউ নো মি? প্লিজ গেস! নো আইডিয়া? ওকে আই টেল ইউ, আই এ্যাম ইউর ডাই হার্ট ফ্যান #অচেনা_আমি। এখন চিনছো? তুমি কি ভাবছো ফেইসবুকে আইডি ডিএকটিভ করলেই তুমি আমার থেকে পার পেয়ে যাবে? নো চান্স ডিয়ার!
কাম অন তনয়া , বি স্মার্ট জাস্ট থিংক যে তোমার হাজবেন্ড এর উপর এমন হামলা করতে পারে সে কি চাইলে তোমার ফোন নাম্বার পেতে পারে না। আমি শুধু আয়াতের না, তোমার ফোন নাম্বারও জানি। তাই তুমি ফেইস বুকে আইডি একটিভ না করলেও আমার কিছু আসে যায় না।
তনয়া প্লিজ কিছু বলো আমি তোমায় দেখতে না পারি, কিন্তু তোমার আওয়াজটা একবার শুনতে চাই। প্লিজ তনয়া একবার কথা বলো।
এতক্ষন ছেলেটার কথা শুনে তনয়া যেনো বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। ঠিক কি বলবে ভেবে পাচ্ছে।
আয়াতঃ হেই ও রকম অসভ্যের মত লুকিয়ে লুকিয়ে কথা না বলে সামনে আয়, দেখে নিবো কত বড় মাপের সাইকো তুই! তোর মত অনেক পাগলকে ঠিক করছি, তোকে ঠিক করতেও সময় লাগবে বা। ফালতু ছেলে, লজ্জা করে না অন্যের স্ত্রীকে এভাবে বিরক্ত করতে? বাবা মা বুঝি ধর্ম শিক্ষা বা মানুষিক শিক্ষা দেয়নি?
—–বাবা মা শিক্ষা ঠিকিই দিয়েছে, কিন্তু আমি নেইনি। বাই দ্যা ওয়ে তনয়ার সাথে আমার দেখা হয়েছে কিন্তু তনয়া আমায় চিনতে পারেনি, আর হ্যা আপনার সাথেও দেখা হয়েছে কিন্তু। আপনার স্ত্রীকে একদিন চোখের সামনে বসিয়ে সারাদিন তাকিয়ে থাকার ইচ্ছা আছে । দেখবো যার লেখা এত সুন্দর সে দেখতে কত সুন্দর।
আয়াত রাগে গজগজ করতে করতে ফোনটা কেটে দিলো। তনয়া কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাড়িয়ে আছে।
আয়াতঃ তনয়া ঘরে চলো প্লিজ। তনয়া আয়াতকে নিয়ে ভিতরে গেলো। আয়াত রুমে গিয়ে রাগ করে মোবাইলটা ছুড়ে বিছানায় ফেলে দিয়ে তনয়াকে বলে?
কি দরকার ছিলো গল্প লেখার? এখন তোমার গল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ছেলেটা তোমার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। এখন যদি ছেলেটা তোমার কোন ক্ষতি করে তাহলে কি হবে ভেবে দেখছো একবার! আর লেখালেখির কোন দরকার নাই, আমি যদি বুঝতাম তোমার গল্পের কারনে এমন কিছু হবে তাহলে তোমাকে লেখার অনুমোতিই দিতাম না। আমারই ভুল হয়েছে অন্য সব হ্যাজবেন্ড এর মতো তোমাকে ফেইসবুক চালানোর অনুমোতি দেয়া উচিৎ হয়নি।
আজ যেনো তনয়া এ আয়াতকে চিনতে পারছে না। গত তিন বছরে যে, আয়াত উঁচু গলায় তনয়ার সাথে কথা পর্যন্ত বলেনি সে আজ তনয়াকে এতগুলো কথা অনায়াসে বলে দিলো। তনয়া কাঁদতে চেয়েও কাঁদতে পারছে না। তনয়া আয়াতের কাছে গিয়ে কিছু বলতে যাবে কিন্তু আয়াত তনয়ার কাছ থেকে চলে গেলো। ওদের রুমের সাথে থাকা বেলকানীতে গিয়ে বসলো আয়াত । তনয়া তবুও সাহস করে আয়াতের সামনে গিয়ে বললো
তনয়াঃ আ—- আ—– আয়াত!
আয়াতঃ তনয়া প্লিজ আমাকে একটু একা থাকতে দাও।
তনয়া আর কোন কথা না বলে রুম থেকে সোজা বাইরে চলে গেলো। তিন বছরে আয়াতের থেকে এমন ব্যবহার তনয়া পায়নি, তাই আয়াতের সামান্য কথাই তনয়ার ভিষন কষ্ট হচ্ছে। আর আয়াতের দোষও দেয়া যায় না কারন নিজের স্ত্রী সম্পর্কে অন্য কারো মুখে কথা শুনে আয়াত নিজেকে সামলাতে পারেনি। রাগের মাথায় শুধু শুধু তনয়াকে বকা দিয়েছে।
তনয়া অন্য রুমে গিয়ে কতক্ষন কান্না করে তারপর ওয়াশরুমে ডুকে আরো কতক্ষন কান্না করলো। তারপর চোখে মুখে পানি দিয়ে রুমে এসে দেখে আয়াত নিজের পিঠে একা একা ঔষধ লাগানোর চেষ্টা করছে। তনয়া কোন কথা না বলে আয়াতের হাত থেকে ঔষধটা নিয়ে ওর পিঠে ধীরে ধীরে লাগাতে শুরু করলো।
আয়াতঃ তনয়া।
তনয়া কোন কথা না বলে দৌড়ে ওয়াশরুমে গিয়ে গলগল করে বমি করতে লাগলো। আয়াত ওয়াশরুমে ডুকে দেখে তনয়া অনর্গল বমি করছে। আয়াত কেমন যেনো হতভম্ব হয়ে গেলো।
চলবে——-
ভুলত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন——–