শালুক ফুলের লাজ নাই !! Part- 30
পরের মাসেই ছোট এক বেডরুম, একটা কিচেন,একটা ওয়াশরুমের একটা বাসায় উঠলো ধ্রুব আর শালুক। এখানে ভাড়া ৮ হাজার টাকা।
ধ্রুবর জন্য ব্যাপারটা স্বস্তিদায়ক। প্রায় ৯ হাজার টাকার ব্যবধান। তবে সমস্যা হচ্ছে বাসাটা একটু বেশি ভেতরের দিকে।
শালুকের সেসব নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।বরং শালুক ভীষণ আনন্দিত।
কেননা এখানে এরকম অনেকগুলো ফ্ল্যাট আছে একই ফ্লোরে, সবাই তাদের মতো করে থাকছে।জীবন যুদ্ধের লড়ে যাচ্ছে সবাই।
সকাল হতেই শুরু হয় সব ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের কথাবার্তার শব্দ ভেসে আসে,বাচ্চাদের কান্নার শব্দ ভেসে আসে।
কর্মমুখর মানুষ সাত সকালে বের হয়ে যায় নিজের জীবিকার তাগিদে।
শালুকের পরীক্ষা সামনের মাসে শুরু হবে।শালুক সারাদিন মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করে, বিকেলে রাতের জন্য রান্না করে। সন্ধ্যায় শালুকের কাছে আশেপাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা আসে।সবাই মিলে গল্প করে যখন শালুকের মনে হয় এরা সবাই যেনো তার কতো চেনা।
এই এক অন্য জীবন যেনো,অন্য রকম অনুভূতি।
একজন এক জেলা থেকে এসেছে, সবার কথাবার্তা আলাদা,রান্নাবান্নার নিয়ম আলাদা,চলাফেরার নিয়ম আলাদা।
একটাই মিল সবার মধ্যে, সবার একই রকম আর্থিক অবস্থা। সবাই খেয়ে পরে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে।কেউ বিলাসিতা করতে যায় না এখানে।
শালুক দেখলো এখানের মানুষগুলো কি নির্দ্বিধায় প্রতিদিন মাছ মাংস না খেয়ে ও স্বামী, সন্তান নিয়ে হাসিখুশি থাকছে।
এক পদ তরকারি দিয়ে,একটা ভর্তা একটা ডাল দিয়ে খেয়ে খুশিমনে একে অন্যের কাছে তা বলছে।বলতে তাদের মধ্যে কোনো জড়তা নেই।লজ্জা পায় না কেউ নিজের দৈন্যতা স্বীকার করতে। কেউ কাউকে বড় করতে চায় না।কার কি আছে সেসব নিয়ে প্রতিযোগিতা হয় না।
এরা সবাই যেনো সবার ভীষণ আপন।
শালুকের মনে পড়লো আগের বাসার কথা। তার টাইফয়েড হবার পর বাড়িওয়ালার বউ প্রতিদিন বিকেলেই তাদের বাসায় আসতো গল্প করতে।
যেহেতু তার বাসায় কাজ করা মহিলাটি যার নাম দিলারা, শালুকের দেখাশোনা করছে সেই সুবাদে আসতেন তিনি।
এলেই জিজ্ঞেস করতেন,কি রান্না করেছে আজকে, কি দিয়ে খেয়েছে শালুকরা।
তারপর শুনে নাক কুঁচকে বলতেন আজ তারা বড় কাতলা মাছ এনেছেন, কোনোদিন গরুর মাংসের বিভিন্ন আইটেম,কখনো বড় ইলিশ মাছ।
আফসোস করে দিলারাকে বলতেন,”আহারে দিলারা,বাসায় থাকলে তো খেতে পারতি।আজকে আমরা এই রান্না করেছি,সেই রান্না করেছি। ”
দিলারা মলিন মুখে হেসে বলতো,”বড় লোকের বাসার খাওন দাওন আর এই গরীবের বাসার খাওন কি এক রকম হয় আপা?কিসের লগে আপনি কি তুলনা করেন।”
লজ্জায় তখন শালুকের চেহারা বিবর্ণ হয়ে যেতো।
নতুন শাড়ি,জুয়েলারি পরে বাড়িয়ালি এলে শালুক তখন এক মনে আল্লাহকে ডেকে যেতো।
শাড়ির দাম কতো,কোন ব্র্যান্ডের শাড়ি,জুয়েলারি কই থেকে নেওয়া এসবের ফিরিস্তি শুনিয়ে বলতেন,”তোমার তো এসব নেই মনে হয় শালুক।তোমার কানের এই ছোট দুল ছাড়া আর তো কিছুই দেখি নি কখনো পরতে।তোমার বরকে বলো না না-কি? তোমাকে টাকাপয়সা দেয় না সে?
আমার এসব দেখো,এগুলো আমি গত শুক্রবারে কিনে এনেছি নিজে গিয়ে। ”
শালুকের রাগ হতো ভীষণ। সে যেভাবে আছে সেভাবেই তো সে সুখী,সে তো উচ্চাশা করছে না।তবু কেনো উনি এসব কথা বলেন?
এই যে ধ্রুব বাসায় ফেরার সময় মনে করে শালুকের জন্য একটা পাঞ্চ ক্লিপ,একটা ফুলের মালা,একটা গোলাপ ফুল,এক মুঠো কাঁচের চুড়ি,এক জোড়া পায়েল এসব কিনে আনে নিজে থেকে,এসব পেয়ে শালুক যে পরিমাণ সুখ পায় তা কী ২ ভরি ওজনের কানের দুলের মধ্যে পাবে?
১৪-১৫ হাজার টাকা দিয়ে শাড়ি কিনে এনে পাবে?
প্রিয় মানুষটা ভালোবেসে যা এনে দেয় তার চাইতে কি নিজের কেনা হাজার টাকা দামের জিনিসটা বড় হয় কখনো?
এই শো অফে অতিষ্ঠ হয়ে শালুক একদিন জবাব দিলো, “আন্টি,আংকেল কি নিজ থেকে আপনার জন্য কিছু কিনে আনে না?নিজে পছন্দ করে? ”
বাড়িয়ালি ইতস্তত করে বলে, “আরে,ওর সময় কোথায়?আমার ওর পছন্দ ভালো লাগে না। ও এসব কেনাকাটা করতে পারে না ভালো করে। আমি নিজেই কিনি নিজের পছন্দে।”
শালুক হেসে বলে, “আমার বর আমাকে ভালোবেসে,আমার কথা মনে করে একটা গোলাপ এনে দেয় যখন, বিশ্বাস করেন আন্টি মনে হয় এই পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখী নারী আমি। আমাদের সংসারে হয়তো বিলাসিতা করার মতো কিছু নেই কিন্তু সুখী হওয়ার মতো অনেক কিছু আছে।
মাঝরাতে আমি আমার বরের সাথে বারান্দায় বসে চাঁদ দেখতে পারি।সেই সময় কামিনী ফুলের এতো মিষ্টি ঘ্রাণ ভেসে আসে আন্টি!
আমার ছোট্ট বাসাটাকে আমার কাছে স্বর্গ মনে হয়।
আমার বর যখন আমাকে কাঁচের চুড়ি পরিয়ে দেয় পরম যত্নে,যাতে চুড়ি ভেঙে হাত কে/টে না যায়, সেই সময় আমার ইচ্ছে করে সময়টাকে এখানেই থামিয়ে রাখি।এই মধুর সময় যেনো কিছুতেই না কাটে।
আমাদের অনেকগুলো মিষ্টি মুহূর্ত আছে যেগুলো আপনার টাকা দিয়ে কেনা যাবে না আন্টি।আপনার সুখের মাপকাঠি হতে পারে দামী শাড়ি,গহনা আমার কাছে তা ভিন্ন। আমার সুখের মাপকাঠি হচ্ছে স্বামীর ভালোবাসা ।
সবার দৃষ্টিভঙ্গি তো এক না।আপনার কাছে যেটা সুখী হবার কারণ আমার কাছে সেটা মনে হয় লোক দেখানো, ফুটানি করা,নিজেকে সবার সামনে অযথাই জাহির করার প্রচেষ্টা।যার অন্তঃসার আসলে শূন্য, পুরোটাই মেকি। ”
তার পরের মাসেই বাড়িয়ালা ভাড়া বাড়িয়ে দিলো। শালুক আপনমনে হাসতে লাগলো এসব মনে করে।
আদনানের সৌদির ভিসা হলো। টিকিট ও কাটা হলো ১৫ দিন পরের। হুট করে আদনান বাড়ি থেকে উদাও হয়ে গেলো।
বাড়িতে কেউ আদনানের খোঁজ জানে না।আদনান কাউকে কিছু না জানিয়ে ঢাকায় চলে এলো শালুকের সাথে শেষ একবার দেখা করতে।
আদনান প্রথমে এলো ধ্রুবর হলে।ধ্রুবর বন্ধুদের ফেসবুক আইডি থেকে তাদের সাথে যোগাযোগ করলো। বন্ধুদের থেকে ধ্রুবর ফোন নাম্বার যোগাড় করে আদনান কল দিলো ধ্রুবকে।
আদনানের নাম্বার ধ্রুবর ফোনে সেভ করা ছিলো। আদনানের কল পেয়ে ধ্রুব ভীষণ অবাক হলো। তার ফোন নাম্বার তো আদনানের জানার কথা না।
বাড়িতে যেই নাম্বার দিয়ে ধ্রুব কথা বলে সেটা শুধু কথা বলার সময় একটিভ করে ধ্রুব। তাহলে এই নাম্বার কিভাবে পেলো সে!
ভাবনা চিন্তা করে ধ্রুব কল রিসিভ করলো। ভাঙা ভাঙা স্বরে আদনান জিজ্ঞেস করলো, “কেমন আছিস ধ্রুব?”
ধ্রুবর চোখ ভিজে উঠতে চাইলো,সামলে নিলো ধ্রুব নিজেকে।নিরুত্তাপ কণ্ঠে জবাব দিলো, “ভালো আছি।”
আদনান বললো, “আমি ঢাকায় এসেছি, একবার শালুককে নিয়ে আমার সাথে দেখা করতে পারবি?ভয় নেই,তোর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিবো না শালুককে। আমি জানি, নিজের জিনিসের যত্ন তুই কতো ভালো করে নিতে জানিস”
ধ্রুব বললো, “আল্লাহ ছাড়া এই পৃথিবীতে এরকম কেউ নেই আমার থেকে শালুককে আলাদা করতে পারবে।এই ভয় ধ্রুব করে না। ”
আদনান বললে, “কোথায় আসতে পারবি আমাকে টেক্সট করে জানিয়ে দিস,আমি হাজির হয়ে যাবো।”
ধ্রুব কিছু বললো না।
আদনান বললো, “আমি দেশ থেকে চলে যাবো ধ্রব।১৫ দিন পরে আমার ফ্লাইট চট্টগ্রাম এয়ারপোর্ট হয়ে। শেষ বার তোদের সাথে দেখা করে যেতে চাই।তোদের কাছে ক্ষমা না চাইতে পারলে আজীবনের জন্য নিজের কাছে নিজে অপরাধী হয়ে থাকবো।”
রাতে শালুক ধ্রুবর সাথে একটা রেস্টুরেন্টে এলো। কেনো আসছে সেটা ধ্রুব শালুককে আগে বলে নি। চেয়ারে আদনানকে দেখে শালুক ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো। খামচে ধরে রাখলো ধ্রুবর হাত।ধ্রুব শালুকের হাত আলতো করে চেপে ধরে বললো, “আমি আছি তো।ভয়ের কিছু নেই।”
চলবে……