শালুক ফুলের লাজ নাই !! Part- 31
শালুক ধ্রুবর এক বাহু শক্ত করে চেপে ধরে বসে আছে। সারা শরীর কাঁপছে তার। বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটা করছে।
কিছুতেই বুঝতে পারছে না শালুক ধ্রুব কেনো এলো আদনানের কাছে তাকে নিয়ে।
কষ্টে তার দুই চোখ টলমল করতে লাগলো। এই মানুষটাকে শালুক দ্বিতীয় বার দেখতে চায় নি আর। ধ্রুব তো জানতো,তবুও কেনো নিয়ে এলো!
মাথার উপর নানা রঙের আলো।এসি চলছে না,ফ্যান ও বন্ধ।শালুক টের পেলো সে যেনো ঘামছে।
আদনান মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো সামনে বসা দম্পতির দিকে।তারপর হেসে ধ্রুবকে বললো, “, কেমন আছিস তোরা?”
ধ্রুব বললো, “ভালো আছি।”
আদনান এর পর কি বলবে খুঁজে পেলো না।শালুকের দিকে লজ্জায়, ভয়ে তাকাতে পারছে না সে।কেমন গলা শুকিয়ে যাচ্ছে তার হঠাৎ করেই। টেবিলের উপর থেকে একটা পানির বোতল নিয়ে ঢকঢক করে আদনান পানি পান করলো।
শার্টের হাতায় মুখ মুছে বললো, “হঠাৎ করে নার্ভাস লাগছে কেনো জানি। ”
ধ্রুব হাসলো। ধ্রুবর সেই হাসি আদনানের কলিজায় গিয়ে লাগলো। কেমন তাচ্ছিল্যের হাসি ধ্রুবর।যেনো ধ্রুবর হাসি তাকে বলছে,”তোমার মতো নির্লজ্জ মানুষ আবার নার্ভাস হয় না-কি! ”
নিজেকে ধাতস্থ করে আদনান বললো, “শালুককে আমার ছোট বেলা থেকেই ভালো লাগতো। তবে তা শুধু ভালো লাগাই ছিলো। কেননা তখন নয়নার সাথে আমার প্রেম ছিলো। নয়নার সাথে প্রেম আমি কখনো সিরিয়াস ভাবে নিই নি।এমনি কথা বলতাম যাতে সময় কেটে যায়। এরই মধ্যে বাসায় বড়রা অনেকেই টের পেয়ে গেলো ব্যাপারটা।
কারো কোনো আপত্তি দেখলাম না।আমি ও নিশ্চিন্তে নয়নার সাথে প্রেম করতে লাগলাম।
কিন্তু নয়নাকে সত্যি বিয়ে করে সংসার করবো এই মনোভাব আমার ক্ষণিকের জন্য মনে এলেও তা আমি এতো গভীরভাবে পাত্তা দিই নি। মা মাঝেমাঝে বলতেম আমি বিরক্ত হতাম শুনে।
এরপর সুযোগ এলো আমেরিকা যাওয়ার। আমার তখন দুচোখ ভর্তি নতুন স্বপ্ন। আমেরিকা! স্বপ্নের দেশ আমার।
ওখানে যাওয়ার পর আশার সাথে সম্পর্ক হবার পর আমার কেনো জানি মনে হতে লাগলো আশা আমার জন্য পারফেক্ট না।কিন্তু আশাকে বিয়ে করতে পারলে আমি রাজত্ব, রাজকন্যা দুটোই পাবো।আমার খালা ও আমাকে খাতির করতে লাগলো। ও দেশের ছেলেদের চাইতে যে বাঙালি ছেলেদের চরিত্র যথেষ্ট ভালো, তা খালা বেশ বুঝতে পেরেছেন।
তাছাড়া ওখানে ডিভোর্স, লিভ টুগেদার এসব কোনো ব্যাপার না।
খালা বাঙালি মেয়ে তো,তাই চেয়েছে আশার বিয়ে আমার সাথে হোক তাতে অন্তত তার মেয়ের সংসার ভেঙে যাবে না।
কিন্তু আমার মাথায় তখন অন্য প্ল্যান। আশা অনেকের সাথেই ক্লোজ হয়েছে, হাগ,লিপ কিস এমনকি বিছানা অবদি ও গেছে। সেসব আশার নিজের স্বীকারোক্তি।
সেই মুহুর্তে আমার মনে হলো, এরকম একটা মেয়ের সাথে আমি আজীবন থাকতে পারবো না। আবার তাকে ফিরিয়ে দিলে সোনার ডিম পাড়া হাঁস সে,অনেক কিছুই হাতছাড়া হয়ে যাবে।
আমার কুটিল মন,লোভী মন,স্বার্থপর মন তো।
নিজেরটাই খুঁজে গেছে সে তাই।নিজের সুবিধা, নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে লাগলো সে তাই।
বারবার মনে হতো বউ হিসেবে দরকার আমার শালুকের মতো দুষ্ট, মিষ্টি একটা মেয়ে।এর পর থেকেই মনের পর্দায় শালুকের আনাগোনা বাড়তে লাগলো।
সিদ্ধান্ত নিলাম আশাকে বিয়ে করে একেবারে আমেরিকায় সেটেল্ড হবার পর তাকে ছেড়ে দিবো।এরপর শালুককে বিয়ে করবো এতে আমার সাপ ও মরবে লাঠি ও ভাঙ্গবে না।
আশাকে ছাড়ার জন্য উপযুক্ত কারণের অভাব হতো না আমার। দুজনের দেশ,কালচার যেহেতু আলাদা, আশা আমার সাথে এডজাস্ট করতে পারতো না আমি জানতাম।
আশার কাছে ভালো হবার জন্য আমি আশার হ্যাঁ তে হ্যাঁ, আশার না তে না মেলাতে থাকি।
আমি বোকা ছিলাম।আশা যে ভীষণ চালাক মেয়ে তা আমি ধরতে পারি নি। আশা আমাকে নিয়ে খেলছিলো। তার এই খেলা শেষ হবার আগ পর্যন্ত আমি কিছুতেই বুঝতে পারি নি।
ফোনে শালুকের সাথে মাঝেমাঝে কথা বলতাম।শালুকের বয়স কম,আমার কথা শুনে শালুক হয়তো আমাকে নিয়ে ভাবতো কখনো। আমি সেটা জানি না।শালুক কখনো আমাকে ফিডব্যাক দেয় নি। আমি বলতাম ও চুপ করে শুনতো।
এরপর আশা গোঁ ধরে বাংলাদেশে আসবে বলে। ওর আসা হয় নি এই দেশে।
আমি ভাবলাম এই সুযোগ। দেশে গেলে মা’কে বলে বিয়ের ব্যবস্থা করে নিবো।
সব ঠিক ছিলো, আশা যাতে শালুকের প্রতি আমার দুর্বলতা টের না পায় তাই আশার সামনে সবসময় শালুককে ছোট করে কথা বলতাম,হাসাহাসি করতাম শালুককে নিয়ে। কিন্তু মনে মনে শালুককে সরি বলতাম।মাঝেমাঝে ইচ্ছে হতো শালুককে বলে দিই এসব ভান শালুক,অভিনয়। শুধু তোর আর আমার ভবিষ্যৎ সুন্দর করার জন্য।
এরই মধ্যে তুই ও বাড়িতে গেলি।কিছুদিন পর টের পেলাম আশা তোর প্রতি ইন্টারেস্টেড হয়ে পড়েছে। আমার মনে হতে লাগলো এতো বছর ধরে যে মাছ আমি খেলিয়ে খেলিয়ে বঁড়শিতে গাঁথার চেষ্টা করছি সেই মাছ কিনা তুই খালি হাতেই শিকার করতে যাচ্ছিস!
তুই বল আমার কষ্ট হবে না?
আশা তোর সবকিছুতে মুগ্ধ হয়,তোর সাথে সবসময় আমাকে তুলনা শুনতে হয়।
আমার সারা শরীর জ্বলে যেতো এসব শুনে।ভীষণ রাগ হতো তোর উপর।কেনো বাড়তে এলি তুই এই ক্ষোভে তোকে মাঝেমাঝে কি যে করতে ইচ্ছে করতো বলে বুঝাতে পারবো না ।
এরপর যখন দেখলাম আশা তোর সাথে ঘুরে বেড়ায়,হাসাহাসি করে তখন আমার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলো। আমার তখন মনে হলো কিছু একটা করতেই হবে এবার।
আমি তখন প্ল্যান করলাম।আফিফার বিয়ের আগের রাতে ঠিক করলাম তোকে ভীষণ বদনাম করে দিবো যাতে আশার মোহ কেটে যায়।
এবার ও আমার ভাগ্য আমার সহায় ছিলো না। শালুককে নিয়ে আমি এই প্ল্যান করি নি। আমি পাঠিয়েছিলাম শাপলাকে।কিন্তু কেনো জানি শাপলার বদলে শালুক চলে গেলো তোর রুমে।
এরপর আমি নিজেই হতভম্ব হয়ে গেলাম।
আমার মুখে রা ছিলো না শাপলার জায়গায় শালুককে দেখার পর। সেই মুহুর্তে আমার কি পরিমাণ কষ্ট হচ্ছিলো তা আমি কাউকে বুঝাতে পারি নি।
এরপর আশা ও আমাকে ছেড়ে চলে গেলো। তখন আমার হতাশা আরো বেড়ে গেলো। আশা যদি যাবারই ছিলো তবে কেনো এতো দেরিতে গেলো?
তাহলে তো আমি শালুককে হারাতাম না।এরপর শালুক যখন বাড়ি গেলো আমার মনে হলো শালুককে সব খুলে বলতে হবে।আমি চেষ্টা করেছি কিন্তু শালুক আমার সাথে কথা বলে নি। তখন আমি রাতে আবারও শালুকের রুমে গেলাম।শালুকের বিন্দুমাত্র ক্ষতি করার ও কোনো ইচ্ছে আমার ছিল না। আমি শুধু এই কথাগুলো শালুককে বলতে চেয়েছি।
সেদিন ও আমি পারি নি।আজ তাই ভাবলাম আজ যদি না বলে যেতে পারি তবে সারাজীবনের জন্য আমাকে অনুতপ্ত হয়ে থাকতে হবে। আমার সব কথা বলা শেষ। এবার আমার শান্তি।”
ধ্রুব শালুক দুজনেই চুপ করে রইলো। তারপর কফি খেয়ে ধ্রুব শালুককে নিয়ে বের হয়ে এলো।আদনান চলে গেলো বাড়ির উদ্দেশ্যে ।
বাড়িতে এসে আদনান শেষ বারের মতো ধ্রুবকে একটা মেসেজ পাঠালো একটা কবিতা থেকে।
“আমি কেবল একটি দিন তোমার পাশে তাকে
দেখেছিলাম আলোর নীচে; অপূর্ব সে আলো!
স্বীকার করি, দুজনকেই মানিয়েছিল ভালো
জুড়িয়ে দিলো চোখ আমার, পুড়িয়ে দিলো চেখ
বাড়িতে এসে বলেছিলাম, ওদের ভালো হোক।
ভালো থাকিস তোরা দু’জনে। ”
সব কিছু আবারও সুন্দর করে চলছে।জীবন কেটে যাচ্ছে আপন গতিতে।শালুকের এসএসসি পরীক্ষা শেষ হলো। শালুক তখন বাড়িতে গিয়ে নির্ভয়ে থাকতে পারলো আদনান দেশে না থাকায়।
ধ্রুবর চাকরি হলো একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে।
শালুকের রেজাল্ট হলো। এসএসসি পরীক্ষায় শালুক জিপিএ ৪.৮৯ পেলো।শালুকের এই সাফল্যে সবচেয়ে বেশি খুশি হলো ধ্রুব।
অফিসের কাছাকাছি একটা কলেজে শালুককে ভর্তি করিয়ে দিলো।নতুন কলেজে,নতুন নতুন বন্ধু হলো শালুকের। পড়ালেখা, বন্ধুবান্ধব, আড্ডাবাজি,সংসার সবকিছু শালুক সুন্দর করে সামলাতে লাগলো।
কিন্তু সুখ সবসময় মানুষের কপালে থাকে না।উত্থান পতন নিয়েই জীবন। তেমনি এক বিকেলে শালুক বইয়ের ভাঁজে একটা চিঠি পেলো।কোনো একজন একটা চিঠি পাঠিয়েছে শালুককে। ভালোবাসার চিঠি।
সেই চিঠি পড়ে শালুক থরথর করে কেঁপে উঠলো। ধ্রুবকে জানাবে জানাবে করে ভয়ে জানালো না যদি ধ্রুব তাকে ভুল বুঝে এই ভেবে।তাছাড়া অফিসের কাজে ধ্রুবকে ভীষণ ব্যস্ত থাকতে হয়।
রাতে শালুককে পড়াতে বসে ধ্রুব নিজের ফাইলপত্র নিয়ে বসে।কাজের ব্যাপারে ধ্রুব ভীষণ সিরিয়াস।
শালুককে একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ উপহার দেওয়ার জন্য ধ্রুব তখন মরিয়া।
এরই মধ্যে বাড়ি থেকে খবর এলো ধ্রুবর দাদী ভীষণ অসুস্থ। অফিস থেকে তিন দিনের ছুটি নিয়ে বাড়িতে ছুটলো দু’জনে।
সিতারা বেগম স্ট্রোক করেছেন।এক পাশ সম্পূর্ণ অচল হয়ে গেছে তার। ধ্রুবর হাত ধরে সিতারা বেগম বললেন, “আমার একটা কথা রাখবি ভাই?”
ধ্রুব দাদীর চামড়া কুঁচকে যাওয়া হাত শক্ত করে ধরে বললো, “রাখবো দাদী,কি কথা বলো তুমি?”
সিতারা বেগম দুই চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললেন,”একবার তোর মায়ের সাথে দেখা করে আয় শালুককে নিয়ে। কতোবার যে খবর পাঠিয়েছে তোকে একটা নজর দেখতে চায় বলে। যাবি?”
ধ্রুব জবাব দিতে পারলো না। কি বলবে সে?
চলবে…….
রাজিয়া রহমান