সে কি জানে

সে কি জানে Season 2 ! Part- 47

ছেলেগুলোকে আধমরা অবস্থা করেও শান্তি পাননি রেয়ান। একেবারে জেলে ঢুকিয়ে দিয়েই তবে তার শান্তি! সেখান থেকে বাড়ি অব্দী আসা পর্যন্ত একটা কথাও উনি আমার সাথে বলেন নি। বাড়ির মুখ্য দরজা দিয়ে ঢুকেই গাড়িটা থামান উনি। এত সময়বাদ গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠেন,
— “তুমি আগেই বাসার ভেতর ঢুকবে না। সাইড করে দাঁড়াও! আমি গাড়ি পার্ক করে আসছি।”
আমি মাথা নাড়িয়ে নেমে গেলান গাড়ি থেকে৷ আর রেয়ান চলে গেলেন গাড়ি পার্ক করতে। কিছুক্ষন পরই আবার আমার সামনে এসে হাজির হলেন রেয়ান। কিছু না বলে আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বাড়ির ভেতরে এগিয়ে গেলেন উনি। ড্রইংরুমে ঢুকতেই আমি আর রেয়ান দু’জনেই থমকে দাঁড়ালাম। সোফায় বসে আছেন কিছু অচেনা মানুষ। একটা মহিলা আর পুরুষ৷ হয়তো স্বামী-স্ত্রী। তাদের পাশেই বসে আছে আমার সমবয়সী কিংবা আমার থেকে কয়েক বছরের ছোট একটা মেয়ে। তাদের মেয়ে সম্ভবত! আমাদের ড্রইংরুমে প্রবেশ করতে দেখেই নীলা রাহমান সোফায় বসতে বলেন আমাদের। আমরা নির্বাক তাই-ই করলাম। তবে একটা জিনিস খেয়াল করলাম, সবার মুখেই কেমন গম্ভীর ভাব একেঁ রয়েছে। রেয়ানেরও তাই! নিরবতা ভেঙ্গে অচেনা লোকটি আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠেন,
— “তুমি কে? তোমাকে ঠিক চিনলাম তো। রেয়ানের কোনো বোন নাকি?”
কথাটা শুনে আমি আর নুহান “খুক,খুক” করে কেশে উঠলাম। রাহুল আহমেদ, নীলা রাহমান আর রেয়ান মিটিমিটি হাসছেন। নীলা রাহমান কিছু বলতে যাবেন তার আগেই রেয়ান ইশারা করলেন যেন কিছু না বলে। তবে সে ইশারা উপেক্ষা করে রাহুল আহমেদ বলে উঠলেন,
— “বোন না অন্যকিছু। যাই হোক, তোরা হঠাৎ এখানে এলি কেন? অন্য কাউকে নিজের খেলার পাত্র হিসেবে পাস নি বুঝি?”
কথাটা অনেকটাই অপমানজনক লাগলো লোকটির। আমতা আমতা করতে লাগলো সে। তখনই তার পাশে বসে থাকা মেয়েটি বলে উঠল,
— “মানে? কিসের খেলার পাত্র আংকেল?”
রাহুল আহমেদ হেসে বললেন,

— “তুমি বরং তোমার বাবার থেকেই সেটা জেনে নিও।”
মেয়েটা তার বাবার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। তবে জবাব এলো না ওপাশ থেকে। সে এবার লোকটির পেটে হাতের কুনুয়ের সাহায্যে গুতো দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
— “ড্যাডা চুপ করে আছো কেন? আচ্ছা থাক আংকেলের কথার উত্তর এখন দিতে হবে না। যে কাজের জন্য এসেছি সেটা আগে বলো। তাড়াতাড়ি!”
লোকটা মাথা নাড়ালো। মাথা নিচু করেই রাহুল আহমেদকে বললেন,
— “আসলে ভাই আমরা যে কাজে এসেছি তা হলো__!”
— “এমন বনিতা না করে তাড়াতাড়ি বল। ফাউ কাজের জন্য আমার কাছে সময় নেই।”
লোকটা আরেকবার অপমানিত হলো। তবে এবার দমে গেল না। জোড় গলায় বলল,
— “আমার মেয়ের সাথে রেয়ানের বিয়ে দিতে চাই ভাই। আপনার মতামত চাচ্ছি।”
কথাটা শুনে আমার শ্বাসরোধ হওয়ার অবস্থা। চোখ বড় বড় করে রেয়ানের দিকে তাকাতেই দেখলাম উনি হাসছেন। কত্তবড় ফাজিল! এসব কথায় কেউ হাসে? নির্লজ্জ পোলা! রেয়ানের থেকে চোখ সরিয়ে এবার রাহুল আহমেদের দিকে তাকালাম আমি। আজব ব্যাপার! উনিও হাসছেন। মানে কি এসবের! রাগে জ্বলে উঠলাম আমি। রাহুল আহমেদ লোকটাকে হাসতে হাসতেই বললেন,
— “আমি কি বলব এতে? তুই রেয়ানকেই জিজ্ঞেস কর।”
লোকটি এবার রেয়ানকে জিজ্ঞেস করতেই রেয়ান মুচকি হেসে বললেন,
— “আমার কোনো আপত্তি নেই।”
এটা শুনে লোকটির মেয়েটা লাফিয়ে উঠল। খুশিতে গদগিদ করতে বলল,
— “আমি জানতাম রেয়ান তুমি এটাই বলবে। তো কখন বিয়ে করবে আমাকে?”
রেয়ানের প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে সেখানে মনোযোগ দিলেন। হাসি মুখেই বললেন,
— “তুমি যখন চাও নিথি।”
মেয়েটা আরও খুশি হয়ে বলল,
— “ড্যাডা তুমি কিছু বলো। ও তো বিয়ে করবে আমাকে। বিয়ের ডেট ফিক্স করো।”
প্রতিউত্তরে কিছু বলল না লোকটি। রেয়ান আবারও বলে উঠলেন,
— “ইউ নো ওয়াট নিথি! চলো এখনই বিয়ে করি। বুঝো-ইতো দ্বিতীয় বিয়ে করতে তর সইছে না আমার।”
এবার লোকটির পুরো ফ্যামেলি অবাক হয়ে তাকাল রেয়ানের দিকে। মেয়েটা মৃদু চিৎকার করে বলে উঠল,
— “দ্বিতীয় বিয়ে মানে?”
রেয়ান বাঁকা হাসলেন এবার। ফোনটা সাইডে রেখে আমার কাঁধে হাত রেখে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বললেন,
— “মিট মাই ওয়াই, মীরা।”
লোকটা ক্ষাণিকটা ভ্রুঁ কুঁচিকে বলল,
— “তোমার বিয়ে হয়েছে কবে?”
— “আরও তিন মাস আগে। কেন আপনারা জানেন না? অবশ্যক না জানারই কথা। কোনো ঠকবাজ মানুষদের তো আর আমার বিয়েতে ইনফাইট দি নি। সে হিসেবে আপনার না জানারই কথা।”
এত অপমান আর সহ্য করতে পারলো না লোকটা। কোনোমতে রাহুল আহমেদকে ক্ষীণ স্বরে “আসি” বলে স্ব-পরিবার নিয়ে চলে গেল সে। এদিকে রাহুল আহমেদ হাসতে হাসতে টেবিল থেকে পত্রিকা পড়তে শুরু করলেন। নীলা রাহমান চলে গেলেন রান্নাঘরে। নুহান আর রেয়ান ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ফোন চালাতে। আমি নির্বাক তাকিয়ে আছি তাদের দিকে। একটু আগের ঘটনা মোটেও বুঝতে পারি নি আমি।
_______________°
রাতে কোনোমতে খাবার খেয়ে সব গুছিয়ে রাখলাম। শরীরটা দিনদিন খারাপ লাগছে আমার। খাবারের একটা দানা পেটে যেতেই মনে হয় এখনই বমি করে দেব। পানি খাওয়াটাও যেন দায় হয়ে গেছে। হাঁটা চলার শক্তিও নেই তেমন। কোনোমতে ধীর পায়ে চলে এলাম রুমে। রেয়ান তখন সোফায় বসে বসে ল্যাপটপে কি যেন করছিলেন। আমাকে বিছানায় শুতে দেখে লাইট অফ করে উনিও চলে এলেন বিছানায়। আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে গলায় মুখ গুঁজলেন। সাথে সাথে নিশ্বাস ভাড়ি হয়ে এলো আমার। ক্ষাণিকটা কেঁপে উঠে ক্ষীণ সরে বললাম,
— “আজকে যে লোকটা আসলেন, সেটা কে রেয়ান?”
— “আগে চুলে হাত বুলিয়ে দাও। তারপর বলছি।”
আমি দ্রুত গতিতে হাত নিয়ে উনার চুলে রাখলান। চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম,
— “এবার বলুন। লোকটা কি আপনাদের পূর্ব পরিচিত?”
রেয়ান লম্বা একটা নিশ্বাস টেনে বললেন,
— “হুমঃ! আমার দূরসম্পর্কের মামা হয়।”
— “অথচ আপনারা উনাকে আমাদের বিয়েতে দাওয়াত দেন নি। ওরা জানেও না আমাদের কথা। তাছাড়া ওদের সাথে এমন ব্যবহার করছিলেন কেন? ওরাই-বা আপনাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে কেন?”
কথাগুলো অনেকটা মন খারাপ করে বললাম। রেয়ান হেসে উঠলেন। নিজের সাথে আমাকে আরেকটু মিশিয়ে নিয়ে বললেন,
— “বাব্বাহ! এত প্রশ্ন? কয়টার উত্তর দিবো বলো তো?”
— “সবগুলোর।”
— “উম্ম! ওদের সাথে আমাদের এত ভালো সম্পর্ক নেই। আরও পাঁচ বছর আগে বাবার অফিসের ইমপ্লই ছিল মামা। বাবাকে ঠকিয়ে প্রায় ১৫লাখের মতো টাকা হাতিয়ে নিয়ে স্ব-পরিবারের সাথে মালেশিয়া চলে গিয়েছিল সে। শুনেছি ১মাস হলো আবার বাংলাদেশে এসেছে। মামার মেয়ে ছোট বেলা থেকেই আমাকে পছন্দ করত। বড় হয়ে বিয়ে করবে বলে কান ঝালা-পালা করে ফেলতো। হয়তো এতদিন পর তাদের টাকার সংকট দেখা দিয়েছে। তাই এখন তার মেয়ের সাথে আমার বিয়ে দেওয়ার সখ জেগেছে।”
— “কিন্তু মেয়েটার কথা শুনে তো মনে হয় সে জানে না তার বাবার কুকর্ম!”
— “হয়তো। তবে ওরা সবাই-ই এক! লোভী আর ঠকবাজ।”
থামলেন রেয়ান। বড় আরেকটা নিশ্বাস নিয়ে বললেন,
— “আচ্ছা মরুভূমি তোমার কি শরীর খারাপ।”
— “একটু! কেন?”
— “ইদানিং দেখছি তেমন কিছু খাও না তাই বললাম। সত্যি করে বলো তোমার কি হয়েছে?”
— “না এমনিই। খেতে ইচ্ছে করে না। আপনার ওসবে এত গুরত্ব দিতে হবে না। আমি ঠিক আছি।”
— “দিতে হবে না আবার! আমার একটা মাত্র বউ হলে কথা।”
— “হুম! তাই তো দ্বিতীয় বিয়ে করতে যাচ্ছিলেন।”
আরেকদফা হেসে উঠলেন রেয়ান। আদুরে কণ্ঠে বলে উঠলেন,
— “তোমায় লয়ে ধন্য আমি! তোমার লাগি তৈরি। তুমি থাকতে অন্য কাওকে কেন করিব সঙ্গী?”

________________
রাতে আকাশে চাঁদের জোছনায় বিছানা পেতে বারান্দায় বসে আছে দীঘি। আবদ্ধ তার পাশেই শুয়ে আছে। শরীরে যতগুলো আঘাত লেগেছে, বসে থাকতে অনেক কষ্ট হয় তার। কি মনে করে দীঘিও আবদ্ধের পাশে শুয়ে পড়ল। সাথে সাথে আবদ্ধ তার গালে চুমু দিয়ে দিলো। আবেগী স্বরে বলল,
— “আমার যত্নের বউটা, আমার ময়নাটা! যা তো আমার জন্য এক কাপ কফি করে আন।”
দীঘি চোখ কটমট করে তাকালো আবদ্ধের দিকে। আবদ্ধ আবার বলল,
— “যা না বাবুন টা।”
— “কয়টা বাজে?”
— “কেন?”
— “প্রশ্ন না। উত্তর দিন!”
— “১২টা।”
— “এত রাতে আপনি কফি খাবেন কেন? তাছাড়া কফি খেলে ঘুমাবেন কখন শুনি?”
— “ঘুমাবো না। সমস্যা আছে?”
— “অবশ্যই! আপনার এখন ঘুমানো প্রয়োজন।”
— “তো?”
দীঘি রেগে বলল,
— “আপনি একটা আস্ত খাটাশ।”
— “তুই একটা রাক্ষসী।”
— “নিজের বউকে রাক্ষসী ডাকেন। লজ্জা করে না?”
— “নিজের বরকে খাটাশ ডাকিস। লজ্জা করে না?”
দীঘি এবার কিছু বলল না। মুখ ফুলিয়ে ফেলল। শোয়া থেকে উঠতে যাবে তখনই আবদ্ধ তার হাত-পা সব দীঘির শরীরে এলিয়ে দিল। আবদ্ধের শরীরের ভাড়ে দীঘি চেঁচিয়ে ওঠে। আবদ্ধ হাসে মাত্র। দীঘির কানে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,
— “এত চিল্লাচিল্লি করে না বউ। মা শুনলে উল্টা পাল্টা ভাববে।”
দীঘি প্রকট রাগ নিয়ে বিড়বিড় করে ওঠে- “অসভ্য!”

________________
সকাল ৭টা বাজে! শুধু হাফপ্যান্ট পড়ে বিছানার মধ্যখানে দু’হাত দিয়ে মাথা চেপে বসে আছে দিহান। তার পাশেই বিছানার চাদর গায়ে জড়িয়ে কান্নারত অবস্থায় বসে আছে জেনি। একটু আগেই কত খুশি ছিল সে। সব স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছিল তার। অথচ এখন! দিহানের এই সামান্য ব্যাপারে এত ভঙ্গিমা দেখে সারা মুখ তিক্ততায় ভরে গেছে তার। চোখ দিয়ে না চাইতেও পানি পড়ছে। এদিকে দিহানের নিজের ওপর নিজেরই রাগ লাগছে। পারলো না সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে। ভুল করেই ফেললো এবার। এমন না যে সে জেনিকে ভালোবাসে না। এই কয়েকমাসে জেনির প্রতি একটু হলেও ভালোবাসা জন্মেছে তার। এই তো কালকেই সে জেনেছে তার একটা চাকরি হয়ে গেছে। পরশু থেকে জয়েনিং। মাসে ২০হাজারের মতো বেতন। জেনির সাথে সংসারের জন্য যথেষ্ট না হলেও কম না। আর তাছাড়া বছরে বছরে পদ বদলি করে বেতন বাড়ারও সুযোগ আছে। আর কি লাগে? ভেবেছিলো কয়েকদিন পর নিজের বাবা-মাকে গ্রাম থেকে শহরে নিয়ে আসবে সে। জেনির বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে। কিন্তু তার আগেই এসব হয়ে গেল!
কালকে যখন নিজের চাকরির কথা জেনিকে বলেছিল দিহান। জেনি খুশিতে লাফিয়ে ওঠে। উত্তেজনা দমিয়ে না রাখতে পেরে চলে আসে দিহানের ফ্যাটে। তখন রাত প্রায় ৯টা। বাবা মাকে বলে এসেছিল বান্ধবীর বাসায় যাচ্ছে। তাই তারাও আপত্তি করে। দিহানের সাথে কিছুক্ষন গল্প করে একেবারে রান্না করে নিজের বাসায় যাবে বলে ভেবেছিল জেনি। এমনটা সে প্রায়ই করে। রান্না করে দিহান আর সে একসাথে খেয়ে-দেয়ে ১০টার দিকে জেনিকে তার বাসায় পৌঁছে দেয় দিহান। তবে কালকে রাতে ১১ঃ৫৫ টার উপরে বেজে যায়। দেড়ি হয়ে যাওয়ায় জেনি বায়না ধরে আজকে সে দিহানের সাথেই থাকবে। দিহান শতবার মানা করে তাকে ঠেকাতে পারলো না। রাজী হয়ে গেল। আর বিপত্তি ঘটলো সেখানে। রাতের বেলা ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে ছিল তখন। জেনির সদ্য ফ্রেশ হওয়া মুখটিতে
বিন্দু বিন্দু পানি দেখে নিজেকে সামলাতে পারেনি দিহান। চরম থেকে চরম ভুলটি করে বসে সে! জেনিও মানা করে না এই ভেবে, দিহান তো তার স্বামীই। তারা যদি মিলিতও হয় তাহলে ক্ষতি কি?
.
.
-চলবে…