সে কি জানে

সে কি জানে Season 2 ! Part- 46

৬৫.
মাথা নিচু করে রাহুল আহমেদের মুখোমুখি বসে আছেন রেয়ান। তার পাশেই বসে আছি আমি, নীলা রাহমান আর নুহান। একটু আগের কান্ড মনে করে সবাই-ই মিটিমিটি হাসছি। তবে দু’জন বাদে! রাহুল আহমেদ প্রখর রাগ নিয়ে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন রেয়ানের দিকে। আর রেয়ান! উনি মাথা নিচু করে মুখ ফুলিয়ে রেখেছেন। কারো দিকে তাকাচ্ছেন না মোটেও। কিছুক্ষন নিরব থেকে এবার রাহুল আহমেদ গর্জে ওঠেন,
— “নীলা! তোনার ছেলে যে নোংরামি করে আমার গাল তার থুতু দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে সেটা পরিষ্কার কে করবে হ্যাঁ? তাছাড়া ওমন নোংরামির কারন কি ওকে জিজ্ঞেস করো।”
এবার আড়চোখে রাহুল আহমেদের দিকে তাকালেন রেয়ান। আমতা আমতা করে বললেন,
— “মা আছে সেটা পরিষ্কার করতে! এবার বলো তুমি আমাকে মাফ করেছ কি-না?”
— “অবশ্যই না। তোমাকে মাফ করার প্রশ্নই আসে না।”
রেয়ান এবার চিল্লিয়ে বলে উঠেন,
— “আয়ায়ায়াব্বব্বব্বব্বা জান!”
রাহুল আহমেদ রেগে বলে উঠেন,
— “তোমার এই বেস্বুরা আওয়াজ বন্ধ করো রেয়ান। তোমাকে মাফ করব না আমি।”
— “কি করলে মাফ করবে?”
— “সবসময় না হলেও বিজনেসের কিছু কিছু কাজ তোমাকে করতে হবে। রাজী?”
রেয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ইহকালে যে তার বাপকে সে বোঝাতে পারবে না, তা সে বুঝে গেছে ইতিমধ্যে। তাছাড়া এখন রাজী হয়ে যাওয়াই শ্রেয় মনে করছেন রেয়ান। কেননা বিজনেসের সব ভাড় নিজের কাঁধে নেওয়ার চেয়ে একটু ভাড় নেওয়াই ডের গুণ ভালো। আরও কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রেয়ান বলে উঠেন,
— “ঠিকাছে আমি রাজী।”
চোখ মুখ চকচক করে ওঠে রাহুল আহমেদের। পরক্ষনেই তিনি গম্ভীর হয়ে নুহানকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠেন,
— “প্রস্তুতি নিয়ে ফেলো নুহান। পরবর্তী বছর থেকে তুমি বিজনেসের সকল কাজ হ্যান্ডেল করবে।”
বলেই তড়িৎ গতিতে বাড়ির বাইরের বাগানে চলে যান উনি। এদিকে নুহান নিজের বাবার এমন কথায় চমকে গেছে অনেকটাই। হাত থেকে ফোনটা সোফায় পরে গেছে তার। উফফ! এসব কেন তারই ঘাড়ে আসে? এত্ত ছোট্ট বয়সে সে কি বিজনেস হ্যান্ডেল করবে? বিরক্ত চোখে-মুখে ছেঁয়ে গেল তার। রেয়ান পৈসাচিক আনন্দ নিয়ে নুহানের মাথায় একটা টোকা দিয়ে বললেন,
— “এবার বুঝবি- কত ধানে কত চাল! খুব তো মজা নিয়েছিলি আমাকে নিয়ে তাই না? এবার আমার পালা।”
নুহানের মুখটা মলিন হয়ে গেল মুহুর্তেই। তার বড় ভাইটা এমন কেন? মন খারাপ করে নিজ রুমে চলে গেল সে। নীলা রাহমানও চলে গেলেন রান্না করতে। বাকি রইলাম আমি আর রেয়ান। রেয়ান আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে আমার কাছে এসে হাত টেনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। রুমের দিকে যেতে যেতে বলে উঠলেল,
— “চলো ঘুমাবো।”
— “কিন্তু রেয়ান! একটু পরে সন্ধ্যা নামবে।”
— “তো?”
— “সন্ধ্যার সময় কেও ঘুমায়? আমার হাত ছাড়ুন, আমি বরং আম্মুকে সাহায্য করতে যাই।”
— “পরে করবে। এখন হাসবেন্ডের সেবা করো।”
বলতে বলতেই রুমে ঢুকে গেলেন উনি। দরজা লাগাতে লেগেই উনার হাত ধরে ফেললাম আমি। শান্ত স্বরে বললাম,
— “যেতে দিন প্লিজ! আপনি না আমার কিউট হাসবেন্ড।”
রেয়ান কোমড় জড়িয়ে ধরলেন আমার। কিছুটা কেঁপে উঠলাম আমি। সেদিকে পাত্তা দিলেন না রেয়ান। কপালে কপাল ঠেকিয়ে আদুরে কণ্ঠে বলে উঠলেন,
— “তুমি সত্যিই অনেক পঁচা মরুভূমি। আমাকে একটুও ভালোবাসো না। সবসময় ব্লেকমেইল করো।”
তার কথায় শুধু হাসলাম আমি। উনি চোখ বন্ধ করে আমার কোমড় জড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষন।

________________
এভাবে কেটে গেল অনেকগুলো দিন। রাহুল আহমেদের সাথে রেয়ানের সম্পর্কটা আগের মতো বেশ বন্ধুত্বপূর্ন হয়ে উঠেছে। যা দেখে হাসার উপক্রম হয় আমাদের প্রতিবার। এদিকে দীঘি আর আবদ্ধের সম্পর্কটা আগের থেকে আরও ভালোবাসা পূর্ণ হয়ে উঠেছে। আজ কামরুল আর শারমিন দেখা করতে যাবেন দীঘির সাথে। এ উপলক্ষ্যে অনেক আয়োজন করছেন মামী আর দীঘি। কামরুলরা কিছু কাজ থাকায় সন্ধ্যায় আসবেন বাসায়। সে হিসেবে আবদ্ধও অফিসে চলে গেছে কিছু ঘন্টার জন্য। দীঘি বলে গেছে সে দুপুরে চলে আসবে বাসায়। কিন্তু দুপুর থেকে বিকাল গড়িয়ে গেছে কিন্তু আবদ্ধের আসার নাম নেই। এমনি তো একদিন দেড়ি করে বাসায় আসলে আগেই ফোন করে জানিয়ে দেয় তাকে। সারাদিনে কত শত বার ফোন দেয়। অথচ আজকে একবারও ফোন করল না। দীঘি ফোন করেছিল! কিন্তু ফোন সুইচড অফ। যতবারই আবদ্ধের ফোনে ফোন দিয়েছে সে প্রতিবারই অপাশ থেকে মহিলা একটার কণ্ঠ ভেসে ওঠেছে কানে। মহিলার কণ্ঠটা নিত্যান্তই সুন্দর। কিন্তু এ মুহুর্তে পৃথিবীর খুবই কর্কশ আর বিশ্রী কণ্ঠ মনে হচ্ছে তার কাছে। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো দীঘির। সোফায় বসে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলো আবদ্ধর আসার! প্রায় কয়েক ঘন্টা পর কলিংবেল বেজে উঠল বাসার। দীঘি তড়িৎ গতিতে গিয়ে দরজা খুলে দিল। সাথে সাথে বুক ছ্যাৎ করে উঠল তার। আবদ্ধ ওয়াল ধরে কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। পায়ে, হাতে আর মাথায় ব্যান্ডেজ করা তার। চোখে মুখে ক্লান্তি। এসব দেখে দীঘির চোখ পানিতে ভরে এলো। আবদ্ধ কিছু সময় সেদিকে তাকিয়ে রইল। শান্ত সরে বলল,
— “সর সামনে থেকে। আমি ভীতরে ঢুকবো তো।”

বিনা বাক্যে তাড়াতাড়ি সামনে থেকে সরে এল দীঘি। আবদ্ধ খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছে। তা দেখে আবদ্ধকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে নিলো দীঘি। আস্তে আস্তে নিয়ে গেল সোফার দিকে। আবদ্ধ সেখানে বসতে না বসতেই তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো দীঘি। আবদ্ধ ক্ষাণিকটা ব্যাথা পায়। তবে শব্দ করে না। এদিকে মামী রান্নাঘর থেকে মাত্রই ড্রইংরুমে এসেছিলেন। আবদ্ধকে এভাবে দেখে বিচলিত হয়ে পরেন তিনি। পরক্ষনেই দীঘিকে তাকে জড়িয়ে ধরতে দেখে সেখান থেকে সরে আবার রান্নাঘরে চলে এলেন। কেননা এ মুহুর্তটা নিত্যান্তই তাদের একান্ত মুহুর্ত। মাঝে মাঝে দীঘি মেয়েটার প্রতি মামীর অনেক ভালোবাসা উতলে উঠে। মেয়েটা যেমন মার্জিত তেমন সবার খেয়াল রাখে। তাদের দেখলে যে কেও বলবে, তারা একদম আপন মা-মেয়ে! মুখে হাসি ফুটে উঠল মামীর। একটু পরেই তার কানে কান্নার শব্দ ভেসে উঠল। দীঘি আবদ্ধকে জড়িয়ে ধরে এখনও কাঁদছে। আবদ্ধ দীঘিকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। ভালো হাত দিয়ে তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে সে বলল,
— “এভাবে মরার মতো কান্না করছিস কেন? আমি ব্যাথা পেয়েছি নাকি তুই? কান্না কার করা উচিত?”
আবদ্ধ থেকে সরে এলো দীঘি। নাক টেনে অভিমান নিয়ে বলে উঠল,
— “আপনি আসলেই পঁচা। এমন পরিস্থিতেও আমাকে বকছেন আপনি।”
আবদ্ধ ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,
— “তো কখন বলব? গোসল করার সময়? আমি গোসল করে আসবো আর আমার গায়ে পানি লেগে না থেকে তোর গায়ে লেগে থাকবে। আর আমি অবাক হয়ে বলব- আল্লাহ! তোর গায়ে পানি কেন? পানি তো আমার গায়ে লেগে থাকার কথা। গোসল তো আমি করেছি।”
— “চুপ থাকুন অসভ্য কোথাকার! কোন কথার মাঝে কোন কথা ঢুকাচ্ছেন?”
আবদ্ধ হাসলো। দীঘি নাক টেনে আবারও বলল,
— “ব্যথা কিভাবে পেয়েছেন?”
— “গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছি।”
— “কিভাবে?”
— “নাচতে নাচতে।”
— “উফফ! সঠিকভাবে বলুন।”
— “তাড়াতাড়ি আসতে চেয়েছিলাম তোর কাছে। তাই গাড়ি ফুল স্প্রীডে চালাচ্ছিলাম। তখন বেখেয়ালী ভাবে গাছের সাথে বারি খেয়ে যায় গাড়ি।”
দীঘির চোখ আবারও পানি ভরে আসে। কিছু বলতে যাবে তার আগেই নিজের ভালো হাত দিয়ে বুকে টেনে নেয় তাকে আবদ্ধ। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
— “এত প্রেসার মাথায় দিস না পিচ্চি। আমি ঠিক আছি।”

________________
শরীরটা আজকে খুব খারাপ লাগছে আমার। সকাল থেকেই মাথাটা ঘুরছে। বমি বমিও পাচ্ছে কেমন! এদিকে রেয়ান বায়না ধরেছেন কোথাও ঘুরতে যাবেন। প্রথমে মানা করলেও শেষে তার জেদের কাছে হার মেনে যেতে রাজী হলাম আমি। সকাল থেকে পুরো বিকাল পর্যন্ত ঘুড়েছি আমরা। বেশিরভাগ সময় বিভিন্ন পার্কে হাতে হাত রেখে পাশাপাশি হেঁটেছি আমরা। এখন পালা বাসায় ফেরার! পার্ক থেকে বের হয়ে ফুটপাতে হাঁটছিলাম দু’জন। একটু দূরেই গাড়ি দেখা যাচ্ছে। গাড়ির কাছে এসে গেছি দেখে রেয়ান আমার হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দেন আমাকে। তার দিকে ভ্রুঁ কুঁচকে এর কারন জিজ্ঞেস করতেই উনি বলে উঠলেন,
— “ধীরে ধীরে হাঁটো। তুমি অনেক দ্রুত হাঁটছো মরুভূমি। এত দ্রুত হাঁটলে গাড়ির কাছে তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবো আমরা। তারপর তাড়তাড়ি বাসায় যেতে হবে। আমি চাই না সেটা।”
রেয়ানের এমন বাচ্চামো কথায় হাসলাম আমি। অত:পর ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলাম পাশাপাশি। হঠাৎ রাস্তার অপাশে থাকা কিছু বখাটে আমাকে দেখে বাজে ইঙ্গিত করতে লাগলো। আমি রেয়ানের হাত শক্ত করে ধরে ফেললাম। ভেবেছিলাম রেয়ান এখন রেগে যাবেন। কিন্তু না! উনি শান্ত ভঙ্গিতে আমার হাত ছাড়িয়ে প্যান্টের পকেটে দু’হাত গুঁজে সামনে দাঁড়ালেন তাদের। মিষ্টি হেসে বললেন,
— “আই লাইক ইউ গাইস ভেরি মাচ! কেন আই কিস ইউ বোথ?”
বখাটেগুলো মনে হয় কিছুটা হলেও শিক্ষিত। রেয়ান এমন কথা বলার সাথে সাথে নিজেদের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে তারা। বুঝতে পারছে না একটা ছেলে তাদের এমন কেন বলছে! এদিকে রেয়ানের মুখে লেগে আছে এখনও সেই হাসি। তবে তা দীর্ঘস্থায়ী হলো না। পরমুহুর্তেই গম্ভীর হয়ে গেলেন উনি। পায়ের কাছে থাকা ইট দিয়ে জোড়ে জোড়ে মারতে লাগলেন ওদের পিঠে। আর রাগী কণ্ঠে বলে উঠলেন,
— “সাহস বেড়ে গেছে না তোদের? কাকে কি বলতে হয় শিখায় নি কেও? মেয়েদের অসম্মান করতে মজা লাগে তাই না? আর সম্মান করতে লজ্জা লাগে? আজকে তোদের এই লজ্জা ভাঙ্গবো আমি। একেবারে ইচ্ছে মতো কিস করব তোদের।”
আমি দূর থেকে দাঁড়িয়ে রেয়ানকে দেখছি মাত্র। কেন যেন ভয় লাগছে আমার। রেয়ানের এমন রুপ যে আমার চির অচেনা আমার!
.
.
চলনে…