বদনাম—– পর্বঃ ৬
শারমিন আক্তার
-একাকি রাস্তায় তনয়া হাঁটছে। কতক্ষন ধরে ধরে হাঁটছে তার ঠিক নাই। শহরের রাস্তায় গাড়ির চাপ খুবই কম। আঁকা বাঁকা রাস্তায় কোন গলিতে যাচ্ছে তার খেয়াল নাই। বোরকা পরা মুখ ঢাকা অবস্থায় নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো। কিন্তু তারপরও হাঁটছিলো। কোথায় যাবে তার কোন ঠিক নাই ভেবে কোন গাড়িতে উঠছে না। দু একটা চায়ের দোকান খোলা সেখানে কয়েকজন ছেলে আড্ডা দিচ্ছে। ছেলেগুলোকে দেখে তনয়ার বুক ভয়ে কেঁপে উঠলো। কারন এত রাতে একা একটা মেয়েকে দেখলে শিয়াল কুকুরের অভাব হয়না। ভয়ে তনয়া দ্রুত পা চালাচ্ছে। পিছন থেকে কে যেনো বলে ওঠলো
—–আসসালামু আলাইকুম বোন!
তনয়া চমকে গিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখে। সাদা পাঞ্জাবি পরা একটা অল্পবয়সি ছেলে। কতই বা বয়স হবে আঠারো কি উনিশ। তনয়া ভয়ে ভয়ে সালামের উত্তর দিলো।
তনয়াঃ ওয়লাইকুম আসসালাম।
—–কিছু মনে করবেন না। এত রাতে আপনাকে একা দেখে ভাবলাম হয়তো কোন বিপদে পড়ছেন। আপনাকে দেখে বেশ ধার্মিক মনে হলো তাই সালাম দিলাম। এত রাতে এখানে কি করছেন বোন? দেখুন ভয় পাবেন না! আমাকে আপনার ছোট ভাইয়ের মত ভাবতে পারেন।
তনয়াঃ আসলে আমি থাকার জন্য কোন হোটেল খুঁজতেছিলাম কিন্তু পাচ্ছি না। আমি এ শহরে নতুন তাই।
——হোটেল তো অন্যদিকে বোন। তাও যেতে অনেকক্ষন লাগবে। এত রাতে খোলা পাবেন কিনা সন্দেহ! আপনার আপত্তি না থাকলে বা আপনি চাইলে আমার বাসায় যেতে পারেন। আমার বাসা ঐ সামনে। দেখুন খারাপ কিছু ভাববেন না বাসায় আমার মা আছে।
তনয়াঃ আমিও তো খারাপ হতে পাড়ি?
——সেটা হতেই পারেন। আর আপনাকে দেখে আমার তেমন মনে হয়নি। আর বাকি যদি খারাপ কিছু করার থাকে মেনে নিবো সেটা আল্লাহর ইচ্ছা।
তনয়াঃ আপনার নাম? (ছেলেটার কথা শুনে তনয়ার মনে হলো ছেলেটা খুব ভদ্র ও ধার্মিক।)
——মোঃ এমদাদ ইসলাম। এবার চলুন বোন। রাতে এ মোড়ে খারাপ ছেলেদের আড্ডা বাড়ে। আপনার কপাল ভালো যে এখনো কোন সমস্যা হয়নি।
তনয়া ছেলেটার সাথে হাঁটছিলো আর বলছিলো। আপনি এত রাতে বাইরে কেনো?
এমদাদঃ আসলে বোন আমি দিনে একটা অটো চালাই আর রাতে নাইট কলেজে পড়ি। আজ ক্লাস শেষ হবার পর এক বন্ধুর বাসায় গিয়েছিলাম ওর নোট নিতে। নোট কপি করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেছিলো। ও থাকতে বলেছিলো, কিন্তু বাসায় মা একা, হয়তো অনেক চিন্তাও করছে। তাই অটো নিয়ে বাড়ি চলে আসছিলাম কিন্তু আসার পথে দেখলাম তিন চার জন লোক একজন গর্ভবতী মহিলাকে নিয়ে রাস্তায় দাড়িয়ে আছে। কোন গাড়ি পাচ্ছিলো না। তাদের হসপিটালে নামিয়ে দিয়ে অটো গ্যারাজে রেখে আসলাম। তখন দেখলাম আপনি একা হাটছেন।
তনয়াঃ কিসে পড়েন?
এমদাদঃ জ্বি এবার বি এ প্রথম বর্ষে।
তনয়াঃ আপনি আমার থেকে অনেক ছোট। আর এত ছোট বয়সে এত কষ্ট করছেন?
এমদাদঃ কি করবো বোন? বাবা মারা গেছে দু বছর আগে। ঘরে আয় করার মত কেউ নাই। আমার মা খুব ধার্মিক মহিলা। আজ পর্যন্ত কোন পরপুরুষ আমার মাকে দেখেনি। বাবা মারা যাবার পর মা কাজ করতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমি চাইনি আমার মা তার পর্দা থেকে বের হোক। তাই নিজেই কাজে নেমে পরলাম কিন্তু মাকে ওয়াদা করেছি লেখা পড়া চালিয়ে যাবো। তাই দিনে কাজ করি রাতে পড়াশুনা।
তনয়াঃ বাহ্ ! আপনার মত ছেলে থাকলে সে মায়ের কহিনুরের দরকার হয়না।
কথা বলতে বলতে একটা বাড়ির সামনে এসে দাড়ালো তনয়ারা। টিনের দোতলা ঘর কিন্তু ফ্লোর করা। দেখে বেশ পুড়ানো মনে হলো। ঘরটা মোটামুটি বড়ই বলা যায়।
এমদাদঃ বোন জানেন এ বাড়িটা আমার মরহুম দাদাজান করেছিলেন তিনি বাড়িটা আমার নামে করে গেছেন কারন তিনি আমাকে খুব ভালোবাসতেন।
তনয়াঃ ওহ।
ছেলেটা দড়জা ধাক্কা দিলে ভিতর থেকে আওয়াজ আসলো কে?
এমদাদঃ মা আমি। দড়জা খুলে দিলেন এক ভদ্র মহিলা। মহিলাকে দেখে তনয়া নিজের অজান্তেই বলে ফেললো মাশাআল্লাহ্। কারন মধ্য বয়সি মহিলারা চেহারা যে এত সুন্দর হতে পারে তনয়ার জানা ছিলো না। চেহার কিঞ্চিত পরিমানও বয়সের ছাপ নাই। একেই বুঝি নূরের চেহারা বলে। ভদ্র মহিলা বললেন।
মাঃ আজ এত দেরি করলি যে বাবা?
এমদাদঃ মা কিছু কাজ ছিলো। মা এই বোনটির আজ রাত আশ্রয়ের দরকার আমি আপনার অনুমোতি না নিয়েই চলে এসেছি। ক্ষমা করবেন।
মাঃ আরে না বাবা! ভিতরে চলো। তনয়াকে নিয়ে মহিলা ভিতরে গেলেন। ঘরটা খুব সাদাসিদা কিন্তু তারপরও যেনো ঘরের ভিতর ভালো লাগা আর শান্তি কাজ করছে। তনয়াকে তিনি একটা রুমে নিয়ে বললেন আপনি এই রুমে থাকবেন।
তনয়াঃ আন্টি আমাকে নাম ধরে আর তুমি করে ডাকবেন, আমি আপনার মেয়ের মত। আমার নাম তনয়া।
মাঃ ঠিক আছে। তুমি কাপড় বদলে নাও। আমি খাবার দিচ্ছি।
রাতে তেমন কোন কথা হলো না। কারন প্রায় শেষ শেষ। তাই যে যার মত ঘুমিয়ে পরলো।
সকাল বেলা তুলি ঘুম থেকে উঠে দেখে আয়াত ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসছে।
তুলিঃ এভাবে তাকিয়ে হাসছো কেন?
আয়াতঃ ভাবতেই হাসি পাচ্ছে সেদিনের পিচ্চি তুলি যে কিনা এখনো ছেলে মানুষি ছাড়তে পারেনি সে নিজে মা হবে! আর যে আয়াত বাচ্চাদের ভয়ে কোলে নেয় না পড়ে যাবে বলে, কয়েকমাস পর একটা ছোট্ট সোনা তার কোলে খেলবে। সেটা ভেবে অদ্ভুদ ভালোলাগার হাসি পাচ্ছে। ধন্যবাদ তুলি!
তুলিঃ কেনো?
আয়াতঃ কারন তোমার কারনে আমি পৃথিবীর সব থেকে বেশি খুশির খবরটা পেলাম। ভালোবাসি তোমায়! আচ্ছা বাসায় কেউ জানে?
তুলিঃ নাহ! আমি নিজেই তো কাল সকালে জানলাম। তারপর এত ঝামেলা হলো যে বলার মত সুযোগই পেলাম না।
আয়াতঃ বাদ দেও তো। ওসব কথা শুনতে ভালো লাগছে না। তারচেয়ে চলো ফ্রেস হয়ে সবাইকে খুশির খবরটা দি।
তুলিঃ হুমমমম।
তুলি আয়াতের মুখ থেকে সকাল সকাল এমন খুশির খবর শুনে সবার মন খুশিতে মনটা ভরে গেলো। তখন তুলি বললো—-
তুলিঃ তনয়া এখনো উঠেনি? কাল রাতেও খেতে এলো না। শরীর ঠিক আছে তো?
নীরাঃ প্লিজ তুলি তুই এখন নিজের চিন্তা কর। এ সময় অন্যের টেনশন নিস না।
তুলিঃ ভাবি যেটা হয়েছে ভুলে যাও না প্লিজ। চলো তনয়াকে খুশির খবরটা দি!
নীরাঃ তুই এত ভালো কেন তুলি! চল
তনয়ার রুমে গিয়ে দেখে পুরো রুম ফাঁকা। কেউ নাই, বিছানার উপর ফুলদানি দিয়ে চাপা রাখা একটা কাগজ। তুলি কাগজটা উঠিয়ে পড়া শুরু করলো—-
তুলি—
এ বাড়ি থেকে আমি যে, ভালোবাসা আর স্নেহ পেয়েছি তা সারা জীবনে ভোলার নয়। তোমার মত বোন পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু বিশ্বাস করো আমার অনাগত সন্তানকে ছুয়ে বলছি আয়াতকে আমি কখনো খারাপ চোখে দেখিনি। আমি চাইনা আমার কারনে তোমাদের আর কোন #বদনাম হোক! তাই চলে যাচ্ছি। আমাকে খোঁজার বৃথা চেষ্টা করো না। হয়তো কোন দিন নিজে থেকে তোমাদের সাথে দেখা করতে আসবো, নয়তো উপর ওয়ালা ব্যাবস্থা করে দিবে। আর হ্যা কখনো যদি আমার বাবা মা, আর অভি আমার সাথে দেখা করতে আসে তাহলে ড্রয়ারে দুটো চিঠি আছে সেদুটো তাদের দিও। নিজের খেয়াল রেখো। ভালো থেকো এই দোয়া সবসময়ই করি।
____ইতি____
তনয়া
তুলি চিঠিটা পড়ে আয়াতকে জড়িয়ে ধরে কতক্ষন ভিষন কাঁদলো। বাড়ির সবারও খুব খারাপ লাগছিলো।
এদিকে তনয়া এমদাদের মাকে সব খুলে বললো। তিনি তনয়ার কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলো। এমদাদের কাছে জানতে চাইলো এখানে কোন চাকরি আর একটা ছোট ভাড়া ঘরের ব্যাবস্থা করে দিতে পাড়বে কিনা?
এমদাদের মাঃ ভাড়া ঘরের কোন দরকার নাই। তুমি আমাদের সাথে থাকবে।
তনয়াঃ কিন্তু আমি চাইনা আমার কারনে আপনারা বিপদে পড়ুন।
এমদাদের মাঃ বিপদ আসলে সেটা থেকে আল্লাহই মুক্তি করবে। আজ থেকে তুমি আমার বড় মেয়ে। এখন থেকে তুমি এখানেই থাকবে। কেউ জিগেস করলে বলবে আমার বোনের মেয়ে ঠিক আছে?
তনয়া শতচেষ্টা করেও তাকে মানাতে পারলো না শেষমেশ তনয়া তার কথা মেনে নিলো। কয়েকদিন পর এমদাদ ওখানের একটা কোচিংএ তনয়াকে পড়ানোর ব্যাবস্থা করে দিলো।
আর এদিকে সেদিনের সে ঘটনার পর অভিকে তার বাবা মা বাড়ি থেকে বেড় করে দিলো। কারন অভির এ জঘন্য কাজটার কথা তারাও জানতো না। অভির বাবা অভিকে কয়েকটা চড় দিয়ে বললো কেনো করিছিস অভি বল। অভি তখন সবটা ওর বাবা মাকে খুলে বললো।
অভিঃ আসলে বাবা বিয়ের এক সপ্তাহ পরই আমার জবটা চলে যায়। বসকে কারন জিগেস করায় সে বললো আমাদের বিয়ের দিন তনয়াকে দেখে নাকি তার খুব ভালো লাগে সে তনয়ার সাথে এক রাত—-। তখন আমি রাগ করে নিজেই জব ছেড়ে দিয়ে ওখান থেকে চলে আসি। অনেক খোঁজার পরও কোন জব পাচ্ছিলাম না।
এদিকে বস ফাইলে গন্ডগোল দেখিয়ে প্রায় বিশ লক্ষ টাকার গড়বড় দেখায় যার পুরো দায়টা আমার কাঁধে পড়ে, পুলিশ কেস হয়! আমাকে বলা হয় পনেরো দিনের মধ্যে যেনো সব টাকা বুঝিয়ে দেই নয়তো আমাকে জেলে নেয়া হবে। এদিকে বস আমার উপর আরো একটি মিথ্যা মামলা করে আমি নাকি অফিসের এক নারী কর্মীকে ধর্ষনের চেষ্টা করেছি। তারপর বস বললো যদি আমি তার কথা মেনে নি তাহলে সব সমস্যার সমাধান তিনি করে দিবে। বললো টাকার ঘাটতির তো সে দেখবেই, সব মামলা তুলে নিবে সাথে সাথে কম্পানির সবচেয়ে বড় পোষ্টে আমায় বসাবে। সব কিছু মিলিয়ে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। চিন্তা করার মত হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলাম। কাউকে বলতেও পারছিলাম না। এক বন্ধুকে সব কথা খুলে বলায় সে আমাকে বুঝিয়ে বললো আমি যাতে বসের কথা মেনে নি। তাহলে নাকি আমারই লাভ। সব কিছু এভাবে শেষ হয়ে যাওয়া দেখতে না পেরে বসের কথা মেনে নিয়েছিলাম। ভাবলাম বিষয়টা আমাদের মাঝেই থাকবে। কিন্তু লোভ করতে গিয়ে সব হারালাম।
চলবে–