তোকে চাই

তোকে চাই !! Part- 08

হঠাৎ কিছুর তীব্র আলো চোখে পড়ায় আমার ভাবনার ঘোর কাটলো,,,চোখ ধাঁধানো এই আলোর উৎস খুঁজে না পেয়ে চমকে উঠলাম,,আচ্ছা,,,নতুন কোনো বিপদের পূর্বাভাস নয় তো এই আলো???ভয়ে ভেতরে ভেতরে জমে যাচ্ছিলাম।।।তখনই দুজোড়া পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম,,,তারা যেনো দৌড়ে আসছে আমার দিকে,,,কিন্তু আলোর অপজিটে থাকায় চেহারাগুলো অন্ধকারে ঢাকা।।চোখের উপর চাপ প্রয়োগ করেও তাদের চেহারা দেখতে ব্যর্থ হয়ে চুপচাপ শেষ পরিনতির অপেক্ষায় চোখ খিঁচে বসে আছি।।হঠাৎ কোনো পরিচিত কন্ঠে চোখ মেলে তাকালাম,,,

রিদু,,,বোন,,,কাদঁছিস কেন বোকা মেয়ে???(দুই গালে হাত রেখে)

সামনে ভাইয়াকে হাঁটু গেড়ে বসতে দেখে নিজেকে সামলাতে পারলাম না,,,এতোক্ষণের আটকে থাকা ভয়,,,জ্বালা ধরানো অতীত সবকিছু থেকে মুক্তি পেতেই যেনো ভাইয়ার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।।।আমি জানি এখানে আমার ভয় নেই,,,ভাই নামের এই মানুষটি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে পুরো পৃথিবীর সাথে লড়ে যেতে পারে অবলীলায়।।। আমার বিয়েটা আটকাতে,,বাবা-মার বাধ্য ছেলেটাও অবাধ্য হয়ে উঠেছিলো।।।আমাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো কেঁদেছিলো,,,,শেষ রক্ষা না হওয়াই বেরিয়ে গিয়েছিলো বাড়ি থেকে।।

রিদু,,,এই রিদু,,,কাঁদিস না বোন,,,দেখ আমি এসে গেছি,,সব ঠিক হয়ে যাবে।।কোথাও ব্যাথা পেয়েছিস বোন??

ভাইয়া??(ঠোঁট ফুলিয়ে)

কি হলো??ব্যাথা পেয়েছিস কোথাও?? সরি রে,,আমি আসতে দেরি করে ফেলেছি,,সরি,,,,

তুমি কাঁদো কেন??কিছুই হয়নি আমার,,,কিন্তু উনার হয়েছে,,, সেন্সলেস হয়ে গেছেন,,,আমাকে ছেড়ে উনাকে ধরো,,,

উপপপস্,,,, সরি,,,অভ্র ভাইয়া??আমি একা পারবোনা আপনিও ধরেন,,আপনার ভাইয়ের স্বাস্থ্য ভয়ানক,,,

রাহাত?তুমি এই পরিস্থিতিতে ও মজা করছো??

মজা কই করলাম?আম সিরিয়াস ভাই,,উনাকে একা তোলা আমার কর্ম নয়,,,

ভাইয়ার কথা শুনে এমন একটা পরিস্থিতিতেও আমার হাসি পাচ্ছে।।ভাইয়াটা যে কি?যখন দেখছে বোন ঠিক আছে,,,তার মানে জগৎ-সংসারের সব ঠিক আছে।।


শুভ্র বিছানায় শুয়ে আছে,,,কি নিষ্পাপ লাগছে মুখটা,,,ডাক্তার আংকেল বলে গেছেন টেনশনের কিছু নেই,,অতিরিক্ত মানসিক চাপে এমনটা হয়েছে।।নিজেকে বড্ড দোষী মনে হচ্ছে,, সেই দিন ওভাবে কথাগুলো বলাটা ঠিক হয়নি।।উনি অসুস্থ তবু কেমন একটা ভালোলাগা কাজ করছে সারা শরীর জোড়ে।।সেই বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত,, ইভেন গাড়িতেও উনি আমার কোলে মাথা রেখে শোয়ে ছিলেন।।।এই প্রথম তাকে কাছে পাওয়া,,,উনার এই ক্লান্ত -নিষ্পাপ মুখ আমায় বড্ড টানছে,,,ইচ্ছা করছে খুব করে আদর করে দেই।।।কিন্তু একটা সংকুচ ভিতরে কড়া নেড়ে চলেছে অনবরত,,,উনি তো আমার নন,,উনি নীলিমা আপুর ভালোবাসা।।উনাকে ছোঁয়া বা ভালোবাসার অধিকার কি আমার আছে??কেনো থাকবে না??উনি যে আমার স্বামী,,,অধিকার আমার,,,কিন্তু………নিজের সাথে নিজেরই করা হাজারো তর্ককে থামিয়ে দেয় একটি মাত্র কিন্তু।।।এই কিন্তুর ভেতর কতো হাজার প্রশ্ন,,যে প্রশ্নগুলো বেঁধে রেখেছে,,,হাজারো চাওয়া-পাওয়ার স্বপ্নগুলো থেকে।।রাত ১২ঃ২০ বাজে উনার ঘুম এখনো ভাঙে নি,,,হয়তো ভাঙবেও না।।।এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না,,উনার কপালে আলতো একটা ভালোবাসার পরশ দিয়ে দিলাম,,,


ঘুমের মধ্যেই মনে হচ্ছিলো কেউ হয়তো আমার দিকে তাকিয়ে আছে।।।আমার বয়সটা এমন একটা বয়স যখন মস্তিষ্ক ঘুমালেও শরীরটা জেগে থাকে সবসময়,,,হালকা স্পর্শেও কেঁপে ওঠে এই শরীর।।হাজারো কৌতূহল নিয়ে ঘুম মাখা চোখ মেলে তাকালাম,,শুভ্র আমার দিকে তাকিয়ে আছে,,,কিছু একটা ভাবছে সে,,,আমি নড়েচড়ে উঠতেই উনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন,,,

থেংক্স,,,আমায় সামলে নেওয়ার জন্য

আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না,,উনার মুখে প্রথম থেংক্স শুনে কি রিয়েকশন দেওয়া উচিত,, তাই যেনো ভুলে গেছি।।”আমার দায়িত্ব ছিলো” বলে কোনো রকম কাটিয়ে দিলাম কথাটাকে,,,,

রোদ??

হুমম কিছু বলবেন?

হ্যা,,তোমার সাথে ইম্পর্টেন্ট কথা ছিলো,,

জি বলুন,,,(অবাক হয়ে)

তুমি এখনো বাচ্চা একটা মেয়ে,,১৮ এর গন্ডিতে পা রাখতে পারো নি এখনো,,,আর আমার জন্য তোমার জীবনটাই নষ্ট হয়ে গেলো।।। বাবা খুব স্বার্থপরের মতো কাজ করেছে রোদ,,নিজের ছেলের খুশির ঝুলা ভরতে গিয়ে তোমার ঝুলিটা ফাঁকা করে দিয়েছেন একদম।।।কিন্তু আফসোস,,,না পারলাম আমি হ্যাপি হতে,,, না পারলে তুমি,,,, কিন্তু আপাতত একজনের তো ভালো থাকা উচিত তাই না??

কথাগুলো উনি খুব শান্ত কন্ঠে বলছিলেন,,,খুব গুছিয়ে।।মনে হচ্ছিলো হয়তো আগে থেকে ভেবে রাখা কথাগুলো আওড়ে চলেছেন,,,আর আমি নিস্তব্ধ হয়ে শুনছি,,,কি বলতে চান তিনি,???উনি একটু থেমে আবার বলতে লাগলেন,,,

তোমার ভালো থাকা উচিত রোদ,,,ইউ ডিজার্ভ ইট।।আমি জানি,,,যা হয়েছে,,তাতে তোমার লাইফে দাগ পড়েছে,,সাথে সাথে তোমার মনেও,,,আমি সেই দাগ মেটাতে পারবো না,,,কিন্তু আর কোনো দাগ যেনো না লাগে সেই চেষ্টা করতেই পারি।।আমি তোমাকে তোমার সবটুকুই ফিরিয়ে দিতি চাই রোদ।।তোমাকে আমি সম্পূর্ন মুক্তি দিতে পারবো না কারন বাবা সেটা মেনে নিবে না,,, কিন্তু আমি তোমাকে বলছি,,,,আমি কখনো স্বামীর অধিকার নিয়ে তোমার সামনে দাঁড়াবো না,,,,তোমার স্বাধীনতায় কখনো বাঁধা হয়ে দাড়াবো না।।।তুমি তোমার স্বপ্নের দিকে এগিয়ে যাও,,,আমাদের সম্পর্ক তাতে বাঁধা হবে না,,,,কখনো না,,,

বলেই উনি ওয়াশরুমে চলে গেলেন।।।আমি স্তব্ধ হয়ে বসে আছি,,,কতো ইজিলি কথাগুলো বলে গেলেন।।।সবটুকু আমাকে ভেবেই বলেছেন উনি কিন্তু সেই আমিই তো মেনে নিতে পারছি না।।যে পরিনাম জানাই ছিলো,,,সেই পরিণামটাকেই যে মেনে নিতে এতো কষ্ট কেনো হচ্ছে বুঝতে পারছি না।।।কাঁদতে ইচ্ছা করছে,,,চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে।।

দুদিন হলো আমাদের বাড়ি থেকে শুভ্রদের বাড়ি এসেছি,,এই দুইদিনে উনার সাথে খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় নি।।আগে তবু ঝগড়ার ছলে কথা হতো কিন্তু এখন সেই ঝগড়াটাও নেই,,,খুব ইচ্ছা করে উনার সাথে গল্প করতে,, হাসতে কিন্তু,,,,,আবার সেই কিন্তু।।।এই কিন্তুটাই আমার জীবনের বড্ড বড় বাঁধা,, যাকে আমি অতিক্রম করতে পারছি না।।আজ মামু আমাকে আর শুভ্রকে রুমে ডেকে পাঠিয়েছে,,জানি না কেন,,,জানার কোনো ইচ্ছাও নেই,,আজকাল কৌতূহল জিনিসটা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে মনে হয়,,,তবু যেতে হবে,, মামুর জরুরি তলব বলে কথা,,,শুভ্রর জন্য অপেক্ষা করছি,,সে এখন পড়াশুনার পাশাপাশি মামুর অফিসও সামলাচ্ছে,,,অভ্র ভাইয়ার দায়িত্বটা নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছে হয়তো কষ্ট ভুলার জন্যই নিজেকে এই ব্যস্ততায় আটকে রাখা।।বড্ড একা লাগে এখন,,আপুও অভ্র ভাইয়ার সাথে চট্টগ্রাম চলে গেছে,,,আপু চট্টগ্রাম ভার্সিটিতে পড়ে,,,পড়াশোনা শেষ হতে আরো দু’বছর তাই মামু ডিসিশন নিয়েছে আপুর পড়াশুনা চলাকালীন সময়ে অভ্র ভাইয়া, চট্টগ্রামের কোম্পানি সামলাবে আর আপুর সাথে ওখানেই থাকবে,,বাড়ির বউকে তো আর এতোদূর একা রাখা যায় না,,,,এটাই মামুর বক্তব্য।।।রুমে পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি,,হয়তো উনি এসেছেন,,তাই চটপট ব্যালকনি থেকে রুমে ঢুকলাম,,,,আমার দিকে একনজর তাকিয়েই ওয়াশরুমে ঢুকে গেলেন তিনি,,আমিও কফি আনতে চলে গেলাম নিচে।।নিচে নামতেই আরিফ চাচা জানালেন মামু রুমে যেতে বলেছে,,আমিও মাথা ঝাকিয়ে সম্মতি জানিয়ে কফি হাতে উপরে চলে এলাম,,,,সাধারনত বাড়ির কাজের লোকদের নাম হয়,,,রহিম, করিম,জদু,কদু কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হলো এই বাড়ির প্রায় সব কাজের লোকদের নামগুলোই সুন্দর,,,যেমন,,,,আরিফ,,,মাধবী,,রাহেলা।।মামু হয়তো নাম যাচাই করে সবাইকে কাজে নিয়েছে,,নিতেও পারে,, হো নোস??একদিন জিগ্যেস করে দেখতে হবে।।এসব ভাবতে ভাবতেই রুমে পা রাখলাম,,উনি এতোক্ষণে ফ্রেশ হয়ে লেপটপ নিয়ে বসে গেছেন।।আমি উনার সামনে কফির কাপটা এগিয়ে দিয়ে বললাম,,,
মামু ডেকেছে,,,

উনি ভ্রু কুচঁকে আমার দিকে তাকিয়ে কফি হাতে নিলেন।।আমি আবার বললাম,,,

মামু,,আমাকে আর আপনাকে উনার রুমে যেতে বলেছেন,,

কেনো??(অবাক হয়ে)

আমি কি করে বলবো??গেলেই না বুঝতে পারবো…

ওহ,,,আচ্ছা চলো,,এখনি যেতে হবে??

হুম।।আচ্ছা শুনুন?

হুম??কিছু বলবা??

হ্যা,, আচ্ছা আপনারা কি বাড়ির কাজের লোকদের নাম দেখে এপোয়েন্ট করেন??(কৌতূহলী দৃষ্টিতে)

কেনো??আর এমন অদ্ভূত কথা মনে হওয়ার কারন?(ভ্রু কু্চ্ঁকে আমার দিকে তাকিয়ে)

অদ্ভুত কেমনে হলো??কাজের লোকদের নাম সাধারনত হয় রহিম,,করিম,,কমলা,,,জমেলা,,জদু,,মদু,,কদু।।।কিন্তু আপনাদের বাড়ির কাজের লোকদের নাম যথেস্ট স্মার্ট,,লাইক,,আরিফ,,মাধবী,,,,(হাত উল্টে ঞ্জানী ঞ্জানী ভাব নিয়ে)

উনি আমার কথা নাকি বলার ভঙ্গী দেখে জানি না তবে দু’সেকেন্ড আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে রুম কাঁপিয়ে হুহু করে হেসে উঠলেন,,৷ আর আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম,,,,কতোদিন পর তিনি মন খোলে হাসছেন,,ড্রেসিং টেবিলের গ্লাসে দেখলাম দরজার পাশে মামানি এসে দাঁড়িয়েছে,,পাশে কাজের লোকগুলো আর মামু।।।মামু আর মামানির চোখে জল যেনো বহু প্রত্যাশিত কিছু পেয়ে গেছেন,,,,আর কাজের লোকদের চোখে বিস্ময়……


#চলবে……