তারা দুজন !! Part- 03
সন্ধ্যা ৭টার দিকে বৌভাতের অনুষ্ঠান, পুরো বাড়ি যেন একেবারে বউ এর মতো সাজানো হয়েছে। অর্কদের বাড়িটা পুরোনো ডুপ্লেক্স বাড়ি, অর্কের দাদা বাড়িটিকে বানিয়েছিলেন। পুরোনো দিনের ছাপ বাড়িটিতে খুব সুন্দর করে ফুটে উঠে। আফসারার কিছু ভালো লাগুক না লাগুক বাড়িটা বেশ লেগেছে। বাড়ির দোতালার একেবারে পশ্চিমের ঘরটা অর্কের, ঘরের সাথে লাগানো বারান্দাটা আফসারার বেশ মনে ধরেছে। এখনো সে ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে। ছোটবেলায় একবার বারান্দার গ্রিল ধরে ঝুলতে ঝুলতে পড়ে যেতে নিয়েছিলো সে, যার শাস্তি স্বরুপ তার রুমের বারান্দাটা তালা মেরে দেন আফসারার বাবা ইমন সাহেব। তাই বারান্দার প্রতি একটা আকর্ষণ আফসারার বরাবরই। দুপুরে খাবার পরে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে থাকতে তার বেশ লাগছে। বাসার সামনে একটা ফুলের বাগান আছে, এটা অর্কের মা সালমা বেগমের হাতে করা। বাগানে গোলাপ ফুলগুলো দেখতে খুব ভালো লাগছে আফসারার। বাবার সাথে জিদ না হলে হয়তো এই বাড়িতে তার থাকতে আপত্তি ছিলো না। ঘড়িতে তখন ৩.৪০ বাজে, অর্ক নিচে আড্ডায় ব্যাস্ত; আফসারার মোবাইলটা বেজে উঠে। ফোনের স্ক্রিনের নাম্বারটি আফসারার খুব পরিচিত। ফোনটি ধরতেই অপর পাশ হতে পুরুষালি কন্ঠে বলতে লাগলো,
– বিয়ে হবার পরতো দেখছি আমার কথা গুলে মেরে দিয়েছিস। তোর কারণে হসপিটালের বেডে পড়ে আছি।
– আরো কিছুদিন থাকতে হবে, মালটা চালু আছে। আমার কথা গিলেছে বলে মনে হয় নি। বাবা দেখে দেখে পিছের সাথে বিয়ে দিয়েছে। বলে কিনা আজকের মধ্যে ডিসিশন দিতে।
– তো দিয়ে দে, তুই ওই ক্যাবলার সাথে দুই বছরের বেশি থাকবি না।
– বা* ডিসিশন দিবো আমি, শালা যদি ওর লগে না থাকি দুই ফ্যামিলির গোল মিটিং বসাবে। আর ওকে ক্যাবলা বলবি না, হ্যান্ডসাম আছে লোকটা।
– হ্যান্ডসাম… উম্মম্ম, মামা তুমি তো দেখি ডুবে ডুবে জল খাচ্ছো। মাঝখান দিয়ে গণপিটুনি আমার খাইতে হইলো।
– কান্দিস না, হরলিক্স কিনে দিবানি।
– আমার ২ টা হাড় ভাঙ্গছে, চেহারার নকশা পাল্টে দিছে তোর খোদার খাসি ভাইগুলো, আর তুই আছোস হরলিক্স নিয়ে।
– তোর মরা কান্দুনি শুনাইতে ফোন দিছোস তুই??
– আরে না না, বলতেছিলাম আর কতদিন হসপিটালে থাকতে হবে আমার??
– আর সপ্তাহ খানিক থাক, একবার বেটা টোপটা গিললেই কল্লাফতে। দেখতে দেখতে দুই বছর চলে যাবে। একবার বাইরের ভিসা পাইলে আমাকে আর পায় কে?
– আচ্ছা সরাসরি বেটাকে সব খুলে বললে হয় না?? অহেতুক এই নাটক করার কোনো দরকার আছে?
– দরকার তো আছে, আমি বাবার কাছে হার মানবো না। এটা আমার জিদ বল, ছেলেমানুষী বল। আমি জানি না এটা কি তবে আমি হার মানবো না।
কারোর পায়ের আওয়াজ পেলে “রাখি আমি” বলে ফোনটা কেটে দেয় আফসারা। রুমে এসে দেখলো অর্ক ল্যাপটপ খুলে সোফায় বসেছে। সকালের ঘটনার পর থেকে অর্কের সামনে যেতেই লজ্জা পাচ্ছে আফসারা। যথেষ্ট এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছিলো কিন্তু এখন একই রুমে মুখোমুখি দুজন। আফসারার ইচ্ছে করছে দৌড়ে বাইরে চলে যেতে, কিন্তু তাতেও অপারগ সে। অর্ক বেশ কিছুক্ষণ খেয়াল করছে আফসারা একবার রুমের ভেতর পা রাখছে একবার বাইরে। তার এই কর্মকান্ড বেশকিছুক্ষন ধরে চলছে। তাই বাধ্য হয়ে অর্ক বলে উঠলো,
– হয় ভেতরে আসো, নয় বারান্দায় থাকো। ভেতর বাহির করার কি মানে তো বুঝলাম না।
অর্কের কথায় গটগট করে ভেতরে চলে আসলো আফসারা। ঘরে পিনপতন নীরবতা, শুধু ল্যাপটপের টকটক আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কাজ করতে করতেই অর্ক বলে উঠে,
– কিছু চিন্তা করলে তোমার হাতে কিন্তু ( ঘড়ি দেখে) সাড়ে ষোল ঘন্টা আছে। কাল ৯ টায় আমাকে তোমার ডিশিসন জানাবা। আজ রাতে যেহেতু আমরা তোমার বাসায় যাচ্ছি তাই তোমার বাবা ভাইদের সাথে কথা বলা ইজি হবে।
– আপনি বাবাকে জানাবেন? আচ্ছা এটা আমাদের মধ্যে থাকলে হয় না?
– না হয় না, কারণ বিয়েটা ছেলেমানুষী না। এখানে দুইটা মানুষের সাথে দুটো ফ্যামিলি জড়িত।
– কিন্তু আপনি আমাকে জোর করে নিজের সাথে রাখতে পারেন না, আর আমি চাই না বাবা এই ব্যাপারটায় জড়িত থাকুক।
– তোমার চাওয়ায় আমার কিছুই যায় আসে না, বয়স ই বা কতো তোমার? এই বয়সে এক দুইটা ভুল মানুষের দ্বারা হয়। আমি এগুলোকে ইগনোর করছি। আর অরিন্দম নামক ছেলেটি ওর সাথে কাল একবার দেখা করবো। তুমি তোমার ডিশিসন ওর সামনেই বলবে।
আফসারার মেজাজ তুঙে উঠে আছে, লোকটা তো পুরো আদা জল খেয়ে লেগেছে ওর সাথে সংসার করার জন্য। এমনটা হওয়ার কথা ছিলো না, তাহসানের নাটকে তাহসান কি সুন্দর সব স্যাক্রিফাইস করে। এতো উল্টো হয়ে গেলো। আফসারার খুব ভালো করেই জানা আছে যদি বাবার কানে একবার যায় অর্ক তাকে ডিভোর্স দিবে আফসারার প্লানে পানি তো পরবেই, উপর থেকে অরিন্দমকে আবার উত্তম মধ্যম দেওয়া হবে। আড় চোখে আফসারাকে ছটপট করতে দেখে অর্কের খুব ভালো লাগছে, একে বলে “যেমন কুকুর তার তেমন মুগুর”। এখন শুধু কালকের দিনের অপেক্ষা।
পরদিন সকাল ৮.২০, আফসারাদের বাসার ডাইনিং টেবিলে আফসারা ব্যতীত সবাই জড়ো হয়েছে একসাথে নাস্তা করার জন্য। কাল বৌভাতের অনুষ্ঠানের পর আফসারাদের বাসায় চলে আসে তারা। আফসারার বাসায় মেয়ে বলতে শুধুই আফসারা। খুব ছোটবেলায় মাকে হারায় সে। ঠিক একারণে ইমন সাহেব কোনোদিন মেয়েকে শাসন করেন নি। আফসারার বড় তিন ভাই আকাশ, আবির, আবরারের চোখের মনি আফসারা। এতো বয়স হবার পরো একজন ও বিয়ে করে নি। তাদের বিয়ের পর যদি আফসারার প্রতি তাদের ভালোবাসা কমে যায় এর জন্য তিনটি মধ্যবয়সী ছেলে এখনো অবিবাহিত রয়ে গেছে। অর্কের সাথে আবীর আর আবরারের খুব বনেছে। আকাশ একটু কম কথা বলে তাই অর্কের সাথে ভালো মন্দ বাদে কোনো কথা হয় নি তার। নাস্তার টেবিলে ইমন সাহেব আসার পর খেয়াল করলেন তার গুনধারী কন্যা এখনো দর্শন দেয় নি। মেয়েকে নিয়ে সত্যি খুব চিন্তিত তিনি, যথেষ্ট বড় হবার পর ও এতো কেয়ারলেস কেউ কিভাবে হতে পারে যেখানে তার জামাই অনটাইম এসে বসে আছে।
– আফসারা কি এখনো ঘুম থেকে উঠে নি নাকি?
– না বাবা, ও রেডি হচ্ছে। আসলে আমরা একটু বের হবো তাই একেবারে রেডি হয়ে খেতে আসবে।
ইমন সাহেবের কথা শেষ না হতে অর্ক তাকে উত্তর দেয়। জামাই যে তার খুব বুঝদার একটা ছেলে তা বুঝতে বেশি সময় লাগে নি ইমন সাহেবের। তার অবুঝ মেয়েটাকে পারলে ও ই ঠিক রাস্তায় আনতে পারবে। ঠিক সেই মূহুর্তে আফসারা এসে হাজির হয় ডাইনিং রুমে। পরনে তার একটা লং ফ্রক টাইপ কুর্তি আর লেগিন্স। ওড়নাটা মাফলারের মতো গলায় পেঁচিয়ে রেখেছে। ঠোঁটে গাড় লাল লিপস্টিক, চোখে মোটা কাজল, চুল গুলো হাফ পাঞ্চ করে রাখা। কেউ দেখলে বলবে না মেয়েটির পরশু বিয়ে হয়েছে। অর্কের প্রথমেই আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলো এখানে তার বড় মা নেই, থাকলে একটা লংকাকান্ড বেধে যেতো। বাড়ির বউ কিনা মডেলের মতো চলাফেরা করছে। ইমন সাহেব আফসারার পোশাকের অবস্থা দেখে তাকে প্রশ্ন করেই বসলেন,
– এটা কি পড়েছো তুমি? তোমার বিয়ে হয়েছে। এখন কি এমন বাচ্চাদের মতো পোশাক আশাক তোমায় মানায়??
– বাবা, আমিতো আগেও এমন পোশাক ই পড়তাম। বিয়ে হবার পর বুঝি মেয়েদের নতুন শিং গজায়? যে এখন থেকে আমার পুরো ড্রেশ-আপ চলাফেরা সব চেঞ্জ করতে হবে! আমি পারবো না। আমি যেমন, তেমন ই থাকবো। তাতে যদি উনাদের ইস্যু হয় এটা উনাদের প্রবলেম। সারাদিন শাড়ি পরে কতোটা আনকমফোর্টেবল লাগে, সেটা তোমরা বুঝবা না।
ইমন সাহেব আর কথা বাড়ালেন না, মেয়ের জিদের সামনে তাকে নত হতেই হবে। বলা তো যায় না বেশি টাইট দিতে যেয়ে আবার না ওই বাড়ি থেকেও পালানোর চেষ্টা করে। অর্ক মাথা নিচু করে খাবার নেড়ে যাচ্ছে। এ কোন মেয়ের পাল্লায় আল্লাহ তাকে ফেললো, এই মেয়ের মাথার স্ক্রু যে কয়েকটা ঢিলা সেটা বুঝতে আর বাকি রইলো না তার।
সকাল ৯ টা, মেহেরুন্নেসা হাসপাতালের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে অর্ক আর আফসারা। উদ্দেশ্য অরিন্দম নামক ছেলেটির সাথে দেখা করা। হাসপাতালের রিসিপশনে জিজ্ঞেসা করতেই জানিয়ে দিলো এই নামের পেশেন্ট সাত তলার ৭২০ নাম্বার রুমে আছে। লিফট উঠে অর্ক খেয়াল করলো আফাসারা প্রচুর ঘামছে, তার কপালে ঘামের বিন্দু সুস্পষ্ট। কারন না জানলেও অর্কের বুঝতে বাকি রইলো না মেয়েটি কোনো কারনে খুব ঘাবড়ে আছে।
– আর ইউ অলরাইট?
অর্কের প্রশ্নে হালকা কেঁপে উঠে আফসারা। অর্কের চোখে সন্দেহজনক দৃষ্টি দেখে নিজেকে সামলে নেয়, উত্তরে বলে,
– আসলে অনেকদিন পর ওকে দেখবো তো তাই খুব চিন্তা হচ্ছে। না জানি ও রিয়েক্ট করে আমাদের দেখে।
– ও, সমস্যা নেই। ও যাতে ওভার রিয়েক্ট না করে এর গ্যারান্টি আমি দিচ্ছি। ডোন্ট ওয়ারি।
– হুম
আফসারার চিন্তা অন্য জায়গায়, না জানি রুম নাম্বার ৭২০ এ যাবার পর সিচ্যুয়েশন কোন দিক মোড় নেয়। হয় এসপার নয় ওসপার, তবে যাই হোক আফসারার জন্য যে সেটা খুব ভালো হবে না সেটা ভালো করে সে বুঝতে পারছে।
চলবে