শালুক ফুলের লাজ নাই !! Part- 27
শালুকের সব পরীক্ষা শেষ হতে ১৫ দিন সময় লাগলো। পরীক্ষা যেদিন শেষ হলো সেদিন শো রুম থেকে বের হয়েই ধ্রুব গাড়িতে উঠলো। শালুককে আগেই বলে রেখেছে রেডি হয়ে থাকতে।
শালুকের কেমন শূন্য শূন্য লাগছে চলে যাবার কথা শুনেই।আবার কবে আসবে কে জানে!
কতোদিন হয়ে যাবে কারো সাথে আর দেখা হবে না।বাবা মা’কে দেখবে না।
স্কুল থেকে ফিরেই শালুক উদাস হয়ে বসে রইলো। আনমনা হয়ে ভাবতে লাগলো সবার কথা। আজ চলে গেলে আবার কবে সবার সাথে দেখা হবে কে জানে!
আর এসএসসি পরীক্ষা যখন শেষ হয়ে যাবে তখন!তখন তো আর আসা হবে না বাড়িতে।
এভাবে কি আর পারবে সবার সাথে সময় কাটাতে?
কিছু সময় জীবন থেকে একবার চলে যাবার পর হাজারো সময়, সুযোগ এলেও আগের সেই মধুর সময়টা আর আসে না।
কোনো একদিন শালুকের ও সময় হবে,বৃদ্ধ বয়সে অফুরন্ত সময় থাকবে তখন এভাবে বিপদে ফেলার মতো কেউ থাকবে না। কাউকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না।কিন্তু এই যে এখন বাবা মা চাচা চাচী দাদা দাদী আছে এরা সবাই কি থাকবে?
তখন কি মানসিকতা এখনকার মতো থাকবে?
এসব ভাবতে ভাবতে শালুকের চোখের কোন ভিজে গেলো।
শাপলা কলেজ থেকে এসে শালুকের পাশে বসে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে তোর?”
শালুক বোনকে ধরে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো, “আজকে চলে যাবো আপা।ধ্রুব ভাই আসতেছে আমাকে নিতে।”
শাপলার ভীষণ মন খারাপ হলো শুনে।বোনের চোখের জল মুছে দিয়ে বললো, “আমাদের ভাগ্যটা এরকম কেনো বল তো!কতো হাসিখুশি ছিলাম আমরা, কতো সুখী ছিলাম আমরা সবাই।অথচ একটা ঝড়ে আমাদের সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। সবার মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গেছে।
নয়না আপা ও আসে না,আফিফা আপার বর ও আপাকে আসতে দেয় না।তুই চলে গেলি কতো দূরে।আমি একেবারে একা হয়ে গেছি রে।নিজেকে বড় নিঃসঙ্গ লাগে এখন।
মনে হয় এক মরুভূমিতে একা বেঁচে আছি।মা চাচীরা সবাই সবার কাজে ব্যস্ত। দিবা ছোট মানুষ, ও ওর মতো থাকে।নিজেকে মনে হয় একা নিঃসঙ্গ তাল গাছের মতো।
ডানা থাকলে আমি ও উড়ে যেতাম।এখন ডানার অভাবে একা দাঁড়িয়ে আছি।
আমাকে ছেড়ে তোরা সবাই চলে গেলি নিজ নিজ ঠিকানায়। ”
শালুকের মন খারাপ হলো আরো বেশি বোনের কথা শুনে। আসলেই তো!
ধ্রুবর সাথে তো তার দিন কেটে যায়।শাপলা একা বাড়িতে থাকে কিভাবে!
ওর কেমন লাগে জানি।
শাপলা বললো, “আয় তোর ব্যাগ গুছিয়ে দিই।”
দুবোন মিলে ব্যাগ গুছাতে লাগলো।
রান্নাঘরে হাসনা বেগম ভীষণ ব্যস্ত। ধ্রুবর পছন্দের খাবার রান্না করছেন তিনি।বক্সে করে সব দিয়ে দিবেন।ধ্রুব যে বাড়িতে এক গ্লাস পানি ও খাবে না তা তিনি জানেন।
তাই তড়িঘড়ি করছেন।তার সাথে হাতে হাত লাগিয়ে সবাই কাজ করছে। আদিবা বেগম দুধ পুলি পিঠা বানাচ্ছেন।
সবাই ভীষণ ব্যস্ত।ধ্রুব এলো রাত ১০ টার দিকে।এসে দেরি করলো না আর। সবার সাথে দেখা করে, কথা বলে শালুকের হাত ধরে বের হয়ে এলো।
শালুক নিরবে অশ্রুপাত করছে তাও দেখলো ধ্রুব।কিন্তু কিছু বললো না।
প্রতিটি মেয়ের জন্যই এই মুহুর্ত ভীষণ বেদনাদায়ক। এই সময়ে তাকে যদি বলা হয় এতো কান্নার কি আছে তবে তা হলো চরম অমানবিকতা।
এই সময়টা প্রতিটি মেয়ের জন্য খুবই নাজুক সময়। তাদের মন তখন অল্পতেই আঘাত পায়।
রিকশায় বসে ধ্রুব শালুকের মাথা নিজের বুকে নিয়ে বললো, “আমি বুঝতে পারছি তোমার খুবই খারাপ লাগছে শালুক। আমি এ ও জানি তোমাকে আরো কয়েকটা দিন থাকতে দেওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু আমার দিকটা তুমি একবার ভেবে দেখো শালুক। আদনান যেকোনো সময় বের হয়ে আসতে পারে, তারপর তোমার যদি কোনো ক্ষতি করে ও?আমার জায়গায় তুমি নিজেকে দাঁড় করিয়ে একবার ভেবে দেখো আমি কি ভুল করেছি না-কি ঠিক করেছি।আমি তোমাকে নিয়ে কোনো রিস্ক নিতে চাই না শালুক।.১% রিস্কও আমি তোমাকে নিয়ে নিতে পারবো না। তবুও যদি তোমার মনে হয় আমার কাজটা ভুল হয়েছে তবে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত শালুক। ”
শালুক এর বিপরীতে কিছু বলতে পারলো না। ধ্রুব ভুল কিছু করে নি।রিকশা থেকে নেমে দু’জনে বাসে উঠলো। ধ্রুব শালুককে সীটে বসিয়ে দিয়ে নেমে গিয়ে বার্মিজ আচার,তেঁতুলের আচার,চিপস,জুস,কেক কিনে আনলো।
চলন্ত গাড়িতে শালুক ঘুমিয়ে পড়লো ধ্রুবর কাঁধে মাথা রেখে।ধ্রুবর মনে হলো কতো লক্ষ,কোটি বছর যেনো পার হয়ে গেছে এর মধ্যে। শালুক তার থেকে দূরে ছিলো।
আজ বহুদিন পর ধ্রুবর মনে হলো প্রাণপাখি তার খাঁচায় ফিরে এসেছে। শালুকের কপালে একটা আলতো করে চুমু খেলো ধ্রুব।
শীতে শালুক ধ্রুবকে জড়িয়ে ধরলো। হুডির জিপার খুলে ধ্রুব শালুককে ভেতরে টেনে নিয়ে হুডি দিয়ে ঢেকে দিলো।
ভোর রাতে নিজেদের বাসায় এসে পৌছালো দুজনে।শালুক বিছানায় শুতেই ঘুমিয়ে গেলো। বাকিটা সময় ধ্রুব আর ঘুমাতে পারলো না।
বাড়ি থেকে দেওয়া খাবারের বক্সগুলো বের করে সব গরম করে রাখলো।
একটা ফ্রিজের যে ভীষণ প্রয়োজন তা আবারও অনুভব করলো ধ্রুব।
একাউন্টে প্রায় ৪২ হাজার টাকার মতো আছে।ধ্রুব ঠিক করলো আজকে দিনেই একটা ছোট ফ্রিজ কিনে আনবে বলে।
শালুক ঘুম থেকে উঠে দেখে ধ্রুব নেই।চলে গেছে নিজের কাজে।খাবার রেডি করা।বাড়ি থেকে গরুর মাংস রান্না করে দিয়েছে হাসনা বেগম, ধ্রুব রুটি বানিয়ে রেখেছে।
হাত মুখ ধুয়ে শালুক খেয়ে নিলো।
খাওয়ার পর আপনাতেই আজ বই নিয়ে বসে গেলো পড়তে।ধ্রুবর এতো কাজ করা দেখে শালুকের মনে হলো ধ্রুবর এতো পরিশ্রমের প্রতিদান হিসেবে হলেও তার ভালো রেজাল্ট করতে হবে।
সারাদিন কাজ করার পরেও যে মানুষটা তাকে এতো যত্ন করে পড়ায় তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য এর চাইতে উত্তম বিকল্প আর কিছু নেই শালুকের।
ধ্রুব বাসায় ফিরলো রাতে।নিশার মা এরমধ্যে অনেকবার কল দিয়েছে। কিন্তু ধ্রুব রিসিভ করে নি।
শালুক অবাক হলো ধ্রুবকে আজ তাড়াতাড়ি ফিরতে দেখে।
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আপনার আরেকটা টিউশনি আছে না?”
ধ্রুব হেসে বললো, “ওটা ছেড়ে দিয়েছি।”
শালুক বুঝতে পারলো না কেনো ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু আর কিছু জিজ্ঞেস ও করলো না। ধ্রুব শো-রুমের ইউনিফর্ম চেঞ্জ করে বললো, “তুমি একটু বাজারের ব্যাগগুলো খুলে রাখো।আমি গোসলটা সেরে নিই।ফ্রিজ কিনেছি একটা, আমার ফোনে কল আসলে রিসিভ করিও।বাসার সামনে এসে ওনারা কল দিবেন।”
শালুক চোখ বড় করে তাকালো।তারপর বললো, “এই শীতের মধ্যে গোসল করবেন?”
ধ্রুব হাসলো। ধ্রুবর লাজুক হাসি দেখে শালুক ভ্রু কুঁচকে তাকালো।শালুককে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ধ্রুব বললো, “কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো বোকা ফুল, তোমাকে যে খুব সকালে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করার কষ্ট দিচ্ছি না।আমার অভ্যাস আছে।”
শালুক বুঝতে পারলো না ধ্রুবর কথা। ধ্রুব বাথরুমে ঢুকে যাওয়ার পর শালুক বুঝলো ধ্রুব কি বলেছে।এমনিতে আগে থেকেই শালুক একটু আধটু জানতো কিন্তু এবার বাড়ি যাবার পর দাদী তাকে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক নিয়ে অনেক কথা বলেছে।সেসব শুনে শালুক লজ্জায় রক্তিম হয়ে গেছে।
আজ ধ্রুবর মুখে এই কথা শোনার পর শালুকের নিজেকে ভীষণ বোকা মনে হলো।
আসলেই সে বোকা,ধ্রুব তাকে এমনি এমনি বোকা ফুল বলে না।
লজ্জায় শালুকের কান গরম হয়ে উঠলো। ধ্রুবর কল এলো সেই সময়। ধ্রুব জিজ্ঞেস করলো বাথরুম থেকে, কে কল দিয়েছে।
শালুক বললো, “নাম সেইভ নেই,আননোন নাম্বার। ”
ধ্রুব গায়ে সাবান মাখতে মাখতে বললো, “রিসিভ করে কথা বলো।আমাদের ফ্ল্যাটের নাম্বার বলে দাও।আমি বের হচ্ছি।”
শালুক রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে নিশা কান্না করতে করতে বললো, “স্যার,কেনো চলে গেলেন এভাবে? আমি কী অপরাধ করেছি স্যার?আমি থাকতে পারবো না আপনাকে না দেখে।প্রমিস করছি স্যার,আর কখনো আপনার কথার অবাধ্য হবো না।আপনার যেভাবে পছন্দ আমি সেভাবে চলবো।আম্মু আমাকে খুব বকেছে আপনি আর আসবেন না শুনে।আর এরকম হবে না স্যার।প্লিজ আপনি আসুন।”
শালুক হতভম্ব হয়ে শুনতে লাগলো সব।ধ্রুবর স্টুডেন্ট ছেলে না-কি মেয়ে তা শালুক কখনো জানতে চায় নি।ধ্রুব ও কখনো বলে নি। শালুক ভেবেছে ছেলে স্টুডেন্ট। কিন্তু মেয়ে স্টুডেন্ট জানতে পেরে শালুকের হাত পা কেমন কাঁপতে লাগলো।
ভয়ে শালুক কল কেটে দিলো। লুঙ্গি পরে ধ্রুব বের হয়ে এলো। চুল মুছতে মুছতে বললো, “কি বললো ওরা?এসেছে? ”
শালুক মাথা নিচু করে বললো, “আপনার স্টুডেন্ট কল দিয়েছে। আপনি তাকে পড়াতে যাচ্ছেন না বলে খুব কষ্ট পাচ্ছে সে।”
শালুকের কথায় ধ্রুব বিষাদের সুর শুনতে পেলো। মুচকি হেসে শালুককে জড়িয়ে ধরে বললো, “বিশ্বাস করো শালুক।তুমি ছাড়া আমার এই পৃথিবীতে আর কোনো পিছুটান নেই।আমার জন্য কে কষ্ট পেলো, কে মরে গেলো সেসবে আমার কিছু আসে যায় না।কিচ্ছু না।আমার মাথাব্যথা শুধু আমার বোকা ফুলকে নিয়ে, আমার জন্য সে কষ্ট না পেলেই হলো।
ওর নাম নিশা।তিন মাস পড়িয়েছি ওকে আমি। মেয়েটাকে আমি বলেছি ও আমি বিবাহিত। ওর সামনে বসেও তোমার সাথে কথা বলেছি।কিন্তু ও বিশ্বাস করতে চাইছে না।এজন্য ওকে পড়ানো বন্ধ করে দিয়েছি।
এজন্য তুমি যদি আমাকে ভুল বুঝে মন খারাপ করে থাকো তবে আমার চাইতে কষ্ট আর কেউ পাবে না।শুধুমাত্র তোমার আমার মধ্যখানে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে নিশা যাতে না ঢুকতে পারে তার জন্যই আমি ওর থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি।এরপর আমার আর কি করার আছে বলো?”
শালুক ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো ধ্রুবর দিকে। তারপর বললো, “আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে পারবো না। আমার খুব খারাপ লেগেছে। কেনো লেগেছে আমি জানি না।তবে আজ এটুকু অনুধাবন করতে পেরেছি আদনানের কথা শুনলে আপনার কাছে কেমন কষ্ট লাগতো। এতো দিন আপনার সেই কষ্ট আমি অনুভব করতে পারতাম না।কিন্তু আজকে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি সেই যন্ত্রণা। আমি ছাড়া যেমন আপনার আর কেউ নেই,আজ এই মুহূর্তে ভীষণভাবে অনুভব করছি আপনি ছাড়া আমার ও এই পৃথিবীতে একান্ত আপন বলে কেউ নেই।আমি আপনাকে হারাতে পারবো না। ”
শালুক নিজেই ধ্রুবকে জড়িয়ে ধরলো। শালুকের কান্না দেখে ধ্রুব ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিলো।তারপর শালুকের মুখ উপরের দিকে তুলে একটা চুমু খেলো।
সারা শরীর কেঁপে উঠলো শালুকের, মনে হলো বৈদ্যুতিক শক খেয়েছে সে।
শালুক নিজ আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ধ্রুবকে।সেই চরম রোমান্টিক মুহুর্তে নিষ্ঠুরের ন্যায় ধ্রুবর কল এলো।ফ্রিজ নিয়ে এসেছে।
লজ্জা পেয়ে শালুক বারান্দায় ছুটে গেলো।
চলবে……
রাজিয়া রহমান