পাথরের বুকে ফুল

পাথরের বুকে ফুল ! সিজেন 2 !! Part- 19

ঘরের দরজা খোলা।ওয়াসেনাত খানিকটা চমকে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে।রূপালি আর মজিদ এই বাড়িতে থাকে।তিনতলা বাড়ি।নিচের তলা আর তিন তলা ভাড়া।দ্বিতীয় ফ্লোরে তারা থাকে।রূপালি এখানেই থাকে।নিজে নিজে রান্না করে খায়,বাড়িঘর দেখাশুনা করে।আর মজিদ তার স্বামী। তারা দুজনে মিলেই বাড়িময় থাকে।মাসে মাসে তৌফিক বেতন দিয়ে দেয়।বাড়ি দেখা শুনা করা এদের কাজ।মজিদ বাড়ির দারোয়ানের কাজ করে।আর রূপালি ঘরের।ওয়াসেনাত ভীতু হয়ে দু’পা এগিয়ে যেতে যেতে উঁচু গলায় ডাকে,
—” রূপালী??মজিদ??দরজা খোলা কেনো??রূপালী??? ”
ওয়াসেনাত বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করতেই তার বাবার কন্ঠ কানে ভেসে আসে।খুশিতে লাফিয়ে সে তাকে জড়িয়ে ধরতে যায়।কিন্তু কিছু কথা কানে আসতেই সে থেমে যায়।তৌফিক আহমেদ ফোনে কাউকে বলছে,
—” তাকে নিজ হাতে মারতে পারলে আমার শান্তি হতো।কখন ছাড়া পাবে সে??”
ওপাশ থেকে কি বলছে তা আর ওয়াসেনাতের কানে এলো না।সে আর একটু এগিয়ে শুনতে চাইলো।তৌফিক বললো,
—” মনে থাকবে আমার।আর পাপ বাপকেও ছাড়ে না।আমার স্ত্রীকে সে খুন করেছে।তাকে ছেড়ে দেওয়ার মানুষ আমি না।জীবনে পাপ অনেক করেছে।একটা একটা করে হিসাব নিবো।নিজ হাতে না নিতে পারলেও আইনের মাধ্যমে নিবো।মাত্র তো ৩বছর জেলে ছিলো।সব প্রমাণ জোগাড় করে সারা জীবনের জন্য জেলে পাঠিয়ে ছাড়বো।”
কথাটা বলেই তিনি কারো আগমনের আভাষ পেয়ে পিছনে ঘুরে তাকালো।ওয়াসেনাতকে দেখেই চুপসে গেলো।ওয়াসেনাত স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে বাবার দিকে।তার বাবা এই মাত্র বলেছে তার মাকে খুন করা হয়েছে।যেখানে সবাই জানে তার এক্সিডেন্ট হয়েছে।আর সেখানেই মারা গেছে।তাহলে বাবা কেনো বললো তার মা খুন হয়েছে?এই কেনোর উত্তর জানে নেই ওয়াসেনাতের।সে উৎসুক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে।তৌফিক মেয়ের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে কল কেটে দিলো। এক হাতে জড়িয়ে বললো,
—” মাই লিটেল প্রিন্সেস! কেমন আছ??ইশশ্ শুকিয়ে গেছো খুব।আর হাতের কি অবস্থা!!”
ওয়াসেনাত নিজেকে সামলে নিয়ে তৌফিক আহমেদের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে বললো,

—” বাবা মা কি খুন হয়েছে??”
তৌফিক জানতো এই প্রশ্নটা করবে।তার খুব রাগ লাগছে নিজের প্রতি। দরজা কেনো যে খোলা রেখেছে??তিনি কিছুসময় চুপ থেকে ভাবে।কয়েক সেকেন্ড ভেবে তৌফিক আহমেদ বললো,
—” ওয়াসিকা একজন জার্নালিস্ট ছিলো মা।সে হিসেবে তার মৃত্যু স্বাভাবিক হলেও সেটা আমাদের কাছে একটু ভিন্ন মনে হচ্ছে। তাই আমি একটু এই ব্যাপারে ভাবছি।এর বেশি কিছু না।তুমি ফ্রেশ হয়ে নেও।এগুলো তোমার চিন্তা করার বিষয়বস্তু না।”
ওয়াসেনাতের মন যেনো মানলো না।মন বার বার বলছে বাবা জানে তার মায়ের খুনি কে।বাবার দিকে তার চোখ কৌতুহলী হয়ে তাকিয়ে আছে।তৌফিক জানে তার মেয়ে সন্দেহ করছে।বাবা মা জার্নালিস্ট হলে মেয়েও যে একটু আকটু তার ভাগিদারী হয় না, তা তো নয়।মেয়ের চোখেও সব সময় ইনভেস্টিগেশন ইনভেস্টিগেশন ভাব থাকে।যেটা তিনি জানে।তবুও মেয়েকে এই পেশা থেকে বহু দূরে রাগে তিনি।ভয়টা তীব্র।ওয়াসেকা তার স্ত্রী। তাকে তিনি কথা দিয়েছে মেয়েকে আগলে রাখবে।জীবনকে তার ঝুঁকি বিহিন করবে।কোনো ঝুঁকিতে পরতে দিবে না।তাই তো এত আয়োজন। জীবনময় যেনো তাদের রহস্য।ওয়াসেনাত কিছু বলতে যাবে তার আগেই তৌফিক বললো,
—” মাত্র এসেছি।খুব টায়ার্ড। ক্ষুধাও লেগেছে।যাও ফ্রেশ হও!!”
—” বাবা আমি খেয়ে এসেছি।আন্টি জোড় করে খাইয়ে দিয়েছে।”
তৌফিক হাসলো।সে জানে আনোয়ারা বেগম তার মেয়ের খুব খেয়াল রাখে একদম মায়ের মত।তৌফিক শার্টের হাতার কব্জির দিকে বুতাম গুলো খুলতে খুলতে বললো,
—” তুমি খেয়ে এসেছো ভালো কথা।তাই বলে কি বাবার সাথে টেবিলেও বসা যাবে না??”
ওয়াসেনাত দ্রুত নিজের সব চিন্তা ঠেলে বললো,
—” অবশ্যই। আমি আসছি তুমি বসো।”
তৌফিক হাতা গুটিয়ে হাতে মুখে পানি দেয়।আয়নায় নিজের হালকা হালকা বয়সের ছাপের দিকে কিছুসময় নির্লিপ্ত ভঙিতে তাকিয়ে থাকে।আজ সে বড্ড খুশি।তার একটা বিশেষ কারন আছে।খাবারের টেবিলে মেয়েকে বলবে বলেই ঠিক করেছে।তৌফিক আহমেদ নিজের হাতের, মুখের পানি ঝেড়ে হাক দিয়ে ডাকলো,
—” রূপালী!রূপালী!
রূপালী রান্নাঘর থেকে একপ্রকার দৌড়ে বেড়িয়ে আসলো।সেই ছোট থেকে এই বাড়িতে কাজ করে সে।তৌফিক আহমেদ ওয়াসেনাতের জন্মের আগে গ্রাম থেকে ৮ বছরের রূপালীকে নিয়ে এসেছিল।অসহায় রূপালীকে আশ্রয় দিয়েছে।রূপালীর বাবা তার মাকে মেরে একজনের কাছে বিক্রি করে দিতে চেয়েছিল।তখন তৌফিকের মা তাকে আশ্রয় দেয়েছিলো।মরার সময় তিনি তখন করুনার সুরে তৌফিকে বলেছিলো,
—” ভাই মাইয়া ডারে ল্যাইয়া যান।ন্যাইলে ওই ব্যাডা ওরেও ব্যাইচ্চা দিবো।”
তৌফিকের দয়া হলো।কালো একটা ছিমছাম মহিলার গাঢ় রঙের সাদা মেয়ে রূপালী।কুনজর পড়বে নিশ্চিত তাই নিয়ে এসেছে।কাজের মেয়ে কখনোই মনে করে না তৌফিক। ছোট বোনের মেয়ের মত তাকে আদর করে।ওয়াসেনাত আপু ডাকে।রূপালী প্রথম থেকেই তৌফিককে খুবই ভয় পায়।তৌফিক কখনো তাকে বকে নি।তবুও পায়।কিছুকিছু মানুষের চেহারার গম্ভীরতাই ভয় পাওয়ার মতো।তৌফিক তেমন গম্ভীর মানুষ না।তবে এই তিন বছরে সে বেশ গম্ভীর হয়ে উঠেছে।প্রিয়তমাকে হারিয়ে।মেয়ের কাছ থেকে দূরে থেকে।পরিবেশপরিস্থিতির কারনে।তৌফিক তোয়ালিয়া দিয়ে হাত মুখ মুছে বললো,
—” খাবার লাগা।আজ রান্না করেছিস তো আমার জন্য??মানে খাবার দাবার কিছু কি আছে??”
রূপালী দাঁত বের করে বেক্কেলের মত হাসে।মাথা দুলায়।তৌফিক হেসে বলে,
—” মুখে বলা যায় না??তোর মামি তো এটা বলতে বলতেই হয়রান হয়ে উঠত।সে চলেগেলো কিন্তু আজও তোর মাথা দুলানি গেলো না।”
মামির কথা মনে পড়তেই চোখে পানি চলে আসে রূপালীর।কাঁদো স্বরে বলে,
—” হ মামু।তয় মামিরে খুব মনে পরে আমার।আমনেরা তো থাকেন না।আপামনিও থাকে না।একলা ঘরে শুধু হ্যাতেনের কথাই মনে উঠে।”
—” হইছে আর মনে করতে হবে না এখন।যা খাবার লাগা টেবিলে।আর হ্যা মজিদ খেয়েছে??”
রূপালী লাজুক হেসে বললো,
—” হো হ্যাতেনে খাইছে।”
—” আচ্ছা যা।”
রূপালীর আর মজিদের বিয়ে হয়েছে আজ একবছর। মজিদেকে কাজে রাখার সময়ই বিয়ের কথা বলেছিলো তৌফিক। রূপালীর বয়স হয়েছিলো অনেক।মজিদও গ্রামের।সুঠাম দেহের পুরুষ,গায়ের রং কালো।তবে রূপালীর সাথে দারুণ মানায়।বয়সও রূপালীর থেকে বেশি না।দু’জনে মিলে এই বাড়িতেই সংসার করে সুখে।

____________________
অরিত্রান রাস্তার আশেপাশে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র সব জায়গায় খুঁজে ফেলেছে।কিন্তু মোবাইলটা পাচ্ছে না।রাগে শরীর গিজগিজ করছে তার।এখন ইচ্ছে করছে সব তছনছ করে ফেলতে।ওয়াসেনাত যাওয়ার পরেই তার খুব অনুশোচনা হয়।ওয়াসেনাত কেঁদেছে??কেঁদে চোখ,গাল সব লাল করেছে!ওভাবে কথা বলাতেই কেঁদেছে?কথাগুলো নিজের মনে মিলিয়ে নিতে কয়েক মিনিট লেগে যায় অরিত্রানের।তারপরই সে খুঁজে ওয়াসেনাতকে কিন্তু ওয়াসেনাতকে খুঁজে পায় না।ভাবে একবার বাড়ি গিয়ে সরি বলবে।কিন্তু তাও যেতে পারে না।ইগোর জন্য।অরিত্রান খানের ইগো যে বড্ড বেশি।ইগো দূরত্ব বাড়িয়ে দিচ্ছে। আজকের কয়েক ঘন্টায় সে কি করে ফেলেছে নিজেই বুঝতে পারলো না।ওয়াসেনাতের বাড়ি,রিমির বাড়ি সব খুঁজে নিয়েছে সে।শুধুই কাঁধে হাত রাখার জন্য??অরিত্রান আজ থেমে নেই।এই মোবাইল সে খুঁজে বের করবেই।খুব লেগেছে আজ মেয়েটার।মাকে তো সেও ভালোবাসতো।খুনখারাবির চক্করে সব ভুলতে বসেছে।মনটায় যেনো কিছুই ফিল হয় না।কিন্তু ইদানীং খুব খোঁচায়।মনে করায়।সেই দিন গুলোর কথা।অনেক খুঁজে অরিত্রান অবশেষে রাস্তার পাশে ঝোপের মাঝে মোবাইলটা পেয়েছে।উপরের স্ক্রিন ভেঙে গেছে।তবে ফোন অক্ষত আছে।অরিত্রান ফোনটা অন করলো একটা মহিলার কোলে মাথা দিয়ে ওয়াসেনাত।আর নিচে ঘাসের উপর বসে তার চুল আছড়ে দিচ্ছে একজন পুরুষ।অরিত্রান ভয়ংকর রকমের চমকে তাকিয়ে আছে ওয়াসেনাতের লম্বা চুলের দিকে।এত লম্বা চুল হয়??কথাটা হুট করেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে তার।বিশাল লম্বা চুল উপর থেকে ঝুলে কাঁধ পিঠ শরীর বেয়ে একদম ফ্লোর ছোড়িয়ে আরো লম্বা।অরিত্রানের চোখ আকাশে।আশ্চর্য! এটা বাস্তবে সম্ভব না বলেই তার মনে হচ্ছে। এত লম্বা চুল হলে মেয়েটা সবসময় ডেকে রাখে কেনো?অরিত্রান বিড়বিড় করে বলে,
—” মেয়েটার মনে হয় চুল নেই।তাই Slack চুল লাগিয়েছে।তাই তো ডেকে রাখে।”
অরিত্রান গাড়ি চালনোর ফাঁকে ফাঁকে ওয়াসেনাতের ছবি দেখছে।হঠাৎ করেই তার মনে হয়।ওয়াসেনাত সুন্দর!
কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেমে হুট করে তার মনে হলো,না আশ্চর্য সৌন্দর্যের অধিকারী ওয়াসেনাত!অরিত্রান হোটেলের সামনে এসে গাড়ি থামায়।থামিয়ে আবার একবার ওয়াসেনাতকে দেখে।অরিত্রান স্ক্রিনে চোখ রেখে বলে,
—” তোমার চুল যদি সত্যি হয় তাহলে তা ভয়ংকর সুন্দর!”
_____________________
ডাইনিং টেবিলে বসে আছে ওয়াসেনাত গালে হাত দিয়ে তার বাবার দিকে তাকিয়ে আছে।তৌফিক খাবারে মনোযোগী।সে জানে তার মেয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।এমনটা তিন বছর আগে আরো একজনের স্বভাব ছিলো।চেহারার দিক দিয়ে মেয়ে তার কার্বনকপি হলেও স্বভাবের দিকে সে মায়ের মত।তৌফিক আহমেদ খাবার শেষ করে মুখ মুছে পানি খেতে খেতে বললো,
—” একটা খবর আছে।খুশি হবে বলেই মনে হচ্ছে। তবে আমি জানি খুশি হবে।”
ওয়াসেনাত গাল থেকে হাত সরিয়ে উত্তেজিত হয়ে বললো,
—” বলো বাবা।জলধি!”
—” এখন থেকে বাবা এখানেই থাকবো।”
ওয়াসেনাতের যেনো ঈদ লেগেছে।লাফিয়ে সে খুশিতে পাগলের মত অবস্থা। আজ অনেক বছর পরে বাবার সাথে থাকবে আগের মত।ওয়াসেনাত তৌফিক আহমেদের গলা জড়িয়ে বললো,
—” ওয়াওওওও বাবা আমরা একসাথে থাকবো??”
—” হুম।এখন হাতে ব্যথা পাবে।দূরে যাও।”
ওয়াসেনাত সরে এলো।খুশি দেখার মত।সবাই খুশি।মজিদ আর রূপালীও।
ওয়াসেনাত বারান্দায় বসে আছে।চাঁদটা দেখা যাচ্ছে না।মেঘের ঘন আবরণ ঠেলে মাঝে মাঝে উঁকিঝিঁকি দিলেও সে লুকিয়ে আছে।আকাশ বিষন্ন।ওয়াসেনাতের মনে হচ্ছে আকাশেরও আজ মন খারাপ।হয় তো তার কাছের কেউ তাকে দুঃখ দিয়েছে তাই।আসলে মানুষের মন খারাপ থাকলে, মনে হয় আশেপাশের সব কিছুরই মন খারাপ।ওয়াসেনাতের বেলাও তাই হচ্ছে।নুহাশ নামের ছেলেটাকে সে মনে করতে চাচ্ছে না।আবার ভুলতেও পাড়ছে না।এত কেনো মনে পড়ছে?ভালোবাসে তাই?সে কিভাবে এতটা গভীর ভাবে জড়িয়ে গেলো?দেখা তো খুব কম হয়েছে।কথা তো আরো কম।ছেলেটা তো কথা তেমন বলেই না।সব সময় রহস্যময় ভঙিতে মুখটা গুমোট করে রাখে।আর আজ যা করলো এতে ওয়াসেনাতের খুব কষ্ট হয়েছে।সে ভুলতে চায় নুহাশ কে?আর ভাববে না তার কথা।ওয়াসেনাত পরক্ষনেই ভাবে নুহাশের কি গার্লফ্রেন্ড আছে?না কি ভালোবাসার মানুষ?ওয়াসেনাতের বুক বিষন্নতায় আবার ভার হয়ে আশে।ভালোবেসে বলতে না পারার কষ্টটা মারাত্মক। যা মানুষকে কুড়ে কুড়ে খায়।
—” তোমার ফোন কোথায় ওয়াসেনাত??”
তৌফিকের গলা পেয়ে ওয়াসেনাত চমকে পিছনে ঘুরে তাকায়।তৌফিক উত্তরের কথা না ভেবে বললো,
—” রিমি কল করেছে। তোমার ফোনে কল করছে আর তুমি রিসিভ করছো না কেনো??”
ওয়াসেনাত ভাবে তার ফোন তো শেষ।এখন কি হবে?বাবাকে বলবে ওই নুহাশের কথা?ধপ করে আবার ভাবে বাবা তো জানলেই পুলিশে দিয়ে দিবে।থাক বলার মত তেমন কিছু হয় নি।বাদ দিয়ে সে তৌফিকের হাত থেকে ফোন নিয়ে বললো,
—” ফোনটা চুরি হয়েগেছে বাবা।”
—” সে কি? কবে??আমাকে বললে না কেনো?আর একটা নিয়ে আসতাম।”
ওয়াসেনাত দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো,
—” এই তো এখন বললাম।আচ্ছা বাবা আমি রিমির সাথে একটু কথা বলি।”
—” আচ্ছা।

বলেই তৌফিক বেড়িয়ে গেলো।ওয়াসেনাত ফোন কানে ধরতেই অরূপের গলা ভেসে এলো।ওয়াসেনাত চমকে বললো,
—” আরে ভাইয়া আপনি??”
অরূপের উৎসাহ সরে গিয়ে বিরক্তি ফুটে উঠে মুখে।সে বেশ কঠোর হয়ে বলে,
—” কোন জন্মের ভাই আমি তোমার??”
ওয়াসেনাত হালকা হেসে বললো,
—” জন্ম তো একটাই।আর সে জন্মেরই।তা বাবার ফোনে রিমি সেজে কল করা হয়েছে কেনো??”
—” রিমি সাজতে যাবো কেনো?রিমি আগে কথা বলেছে তার পরেই আমি।আর তোমার ফোন কোথায়??”
—” সেটা চুরি হয়েছে।আচ্ছা কল কেনো করেছেন।কোনো কিছু দরকার??”
অরূপ গলার কন্ঠ নরম করে বললো,
—” তোমার গলার স্বর ভাণ্ডার শুনতে ইচ্ছে হলো তাই।এর চেয়ে বড় দরকার আর কিছু নেই আমার।”
ওয়াসেনাতের কেমন যেন ঠেকলো। সে ইতস্তত হয়ে বলে,
—” মজা করার আর সময় পেলেন না?ঘুমাবো এখন।কিছু প্রয়োজন হলে বলেন?আসলে হাত ব্যথা তো?”
অরূপের খারাপ লাগে তবুও সে বলে,
—” আচ্ছা ঠিক আছে।তুমি বাসায় পৌঁছেছ কি না তা জানতেই ফোন করেছি।তাহলে তুমি ঘুমিয়ে পরো।”
—” আচ্ছা।”
ওয়াসেনাত কল কাটতে যাবে অরূপ আবার বলে উঠে,
—” হ্যালো হ্যালো!!”
ওয়াসেনাত কল কানে ধরে।অরূপ মিষ্টি গলায় বলে,
—” শুভরাত্রি।”
ওয়াসেনাত হাসে।হাসি ঝুঁলিয়েই বলে,
—” আপনাকে ও।আর সাথে আমার চুল্লি বান্ধবীকেও।”
অরূপ কল রাখতেই তার কাঁধে আনোয়ারা বেগম হাত দেয়।অরূপ কিঞ্চিৎ বিচলিত হয়ে পাশ ফিরে তাকায়।ছেলের পাশে বসে আনোয়ারা বললো,
—” ওয়াসেনাতের কল না??”
অরূপ হাতের ফোনের দিকে তাকিয়ে মন খারাপের ভঙিতে বললো,
—” হুম!”
আনোয়ারা বেগম হাসে।ছেলেটা বড্ড ভালোবাসে মেয়েটাকে।রিমি আড়চোখে ভাইয়ের দিকে তাকায়।ওয়াসেনাতকে তার ভাই শুধু পছন্দ না ভালোবাসে।এটা সে জানে।আর ওয়াসেনাতের সাথে তার মিল করাতে সে বহুবার চেয়েছে।তার এত সুদর্শন ভাইয়ের পিছনে মেয়েরা পাগল হয়ে পরে আছে।কিন্তু যাকে সে চায় তার তো তার দিকে মনোযোগই নেই।একদম পাত্তা দেয় না মেয়েটা।প্রিয় বান্ধবী বলেই সে কিছু জোড় দিয়ে বলতে পারে না।আর অন্যদিকে নোড়া আসবে।মেয়েটাকে সে পছন্দ করে।সেও তার প্রিয় বান্ধবী। কিন্তু ওয়াসেনাতের চাইতে বেশি না।নোড়া অরূপ বলতে পাগল।কালেই আসবে সে।এই নোড়া আসা মানে নতুন বিপদ।
____________________
মদের নেশায় বুদ হয়ে আছে অরিত্রান।একটার পর একটা বোতল শেষ করছে সে।কিন্তু কি আশ্চর্য! নেশা ধরছে না কেনো?রিমন অরিত্রানের ঠিক সামনে বসে আছে।আজ সে অরিত্রানের সবচেয়ে অদ্ভুত একটা রূপের সাথে পরিচিত হয়েছে।অরিত্রানের পিছা করেছে সে।কোথায় কোথায় গিয়েছে, কি কি করেছে সব দেখেছে সে।সে আর আশ্চর্য হতে পারলো না।তার বড্ড ইচ্ছে করছিলো সেন্সলেস হয়ে কয়েক ঘন্টা পরে থাকতে।তবে তা সম্ভব না।অনেক ইচ্ছে অপূর্ণ থাকে।আর সেন্সলেস হওয়ার ব্যাপারটা এতটাই ফালতু যা বলার মত না।মানুষ যখন হতে চায় তখন আর সেন্সলেস ভাবটাই আসে না।ফালতু!তবে আজ রিমন বেশ অবাক হলেও সে এটার আভাষ সবার আগে পেয়েছে।শত হক প্রেমিক তো প্রেমিককেই চিনবে এটা তো স্বাভাবিক। অরিত্রান ওয়াসেনাতের ফোনটা ঠিক করেছে।নিজে দোকানে গিয়ে গ্লাস চেঞ্জ করেছে।টি-টেবিলের উপরে সেই ফোন পড়ে আছে।অরিত্রান মদের বোতলে চুমু দেয় আর সেই ফোনের দিকে তাকায়।অরিত্রান চশমা লেন্স সব খুলে বসেছে।তাই অরিত্রানের চোখ দু’টির মুগ্ধতা রিমনের চোখে স্পষ্ট হয়ে ধরা দিচ্ছে। রিমন সে কখন থেকে হাসছে।মিটমিটে সে হাসির শব্দ অরিত্রানের কান অব্ধি যায় না।অরিত্রান মুগ্ধতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আছে।এত মুগ্ধ সে আগে কখনো হয়েছে কি না সে জানে না।মনে হচ্ছে জীবনে প্রথম সে এতটা মুগ্ধতায় ভাসছে।রিমন অরিত্রানের সামনে চেয়ার টেনে বসে।মৃদু হাসি দিয়ে আবার অরিত্রানের দিকে তাকায়।মাথা উঁচিয়ে ফোন দেখতে চায়।অরিত্রান নিচ থেকে মাথা উঠিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে বলে,
—” সমস্যা কি?এত ঢং করে এখানে বসে বসে হাসার মানে কি??কি চাই?”
রিমন আবার হাসে।আর একবার তাকিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে হাসে।ভাবে,বন্ধু তার প্রেমে উম্মাদ হয়ে আছে তাহলে!এটাই কি পাথরের বুকে ফুল ফুটা!তা নায় তো কি, যে ছেলে মেয়ে ছেলে কিছু মানে না খুন করার সময়,হাতের নখ তুলে ফেলে, হাত পা খণ্ড খণ্ড করে,মাথা কাঁটে, যতই আকুতি করে,পা ধরে,কাঁদে না কেনো, দয়া দেখিয়ে কখনো ছেড়ে দেয় না।তার মনে হঠাৎ বৃষ্টি নামার মত ঝড় তুলে দিয়েছে সামান্য একটা মেয়ে!অরিত্রান আবার বললো,
—” রুম থেকে যাবি?না কি কিছু চাই?কি চাই বল?”
রিমন দাঁত কেলিয়ে বললো,
—” প্রেম!!”

অরিত্রান বিস্ময়ের সাথে তাকিয়ে আছে রিমনের দিকে।তারপর নিজেকে ঠিক করে বলে,
—” শেটআপ রিমন!ডাক্তার দেখা।ছেলে হয়ে ছেলের কাছে প্রেম চাই?ছিঃ গে হয়ে গেলি নাকি?তোর গার্লফ্রেন্ড এটা জানে?”
রিমন চোখ বড় ছোট করে চেঁচিয়ে বললো,
—” ছিঃ আমি কি ওই ভাবে বলেছি না কি?”
হাতের বোতল রাখতে রাখতে অরিত্রান বললো,
—” তো কিভাবে বলেছিস?প্রেম চাই মানে কি?”
—” মানে তোকে প্রেমের কথা বুঝাতে চাই।”
অরিত্রান চোখ গরম করে বললো,
—” ফালতু জিনিস নিয়ে আমি কিছুই শুনতে চাই না।আর এটা বুঝে আমি কি করবো?”
—” প্রেম করবি??”
অরিত্রান আজ আর শান্ত থাকতে পারলো না।সে রেগে কটমট করে বললো,
—” হোয়াট রাবিশ!প্রেম আর অরিত্রান খান?প্রেম ভালোবাসা অরিত্রান খানের জন্য ইম্পসিবল।যা রুম থেকে।”
রিমন আবার একটা হাসি দিয়ে বললো,
—” আর ইম্পসিবলকে পসিবল করাই হচ্ছে প্রেম ভালোবাসার কাজে।”
অরিত্রান একটু রোয়ে সয়ে নড়েচড়ে বসলো।বললো,
—” যেমন?”
—” তোর পাথরের মত কলিজার ফুলটা কে আগে বল?একটু তো শুনি?”
অরিত্রান রেগে বললো,
—” রুম থেকে বাহিরে যা।গেটলস্ট!
রিমন গেলো না।অরিত্রানের কোনো হুমকি ধামকিকে সে ভয় পাচ্ছে না এখন।সে নিজেই বুঝতে পাড়ছে না এত সাহস এলো কোথা থেকে।রিমন চেয়ারে হেলান দিয়ে বললো,
—” ওওওও এই পাথরের বুকের ফুল কি ওয়াসেনাত বিনতে তৌফিক!!”
.
.
#চলবে____