পাথরের বুকে ফুল

পাথরের বুকে ফুল ! সিজেন 2 !! Part- 22

সকাল ৯টা বাজে।ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে ওয়াসেনাত।মাথায় সূর্য প্রকট হয়ে উঠছে।এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার কারণ একটাই রিক্সা।কিন্তু এই রিক্সা খুব একটা পাওয়া যায় না এদিকে।অনেক খুঁজে,দাঁড়িয়ে, অপেক্ষা করে তবেই ভাগ্য সহায় হলে পাওয়া গেলেও যেতে পারে।ভার্সিটি এখান থেকে ৪০মিনিটের রাস্তা।রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ওয়াসেনাত।চোখেমুখে বিরক্তি। রিক্সার জন্য অপেক্ষা করা একদম পছন্দ না তার।তবুও করতে হয়।অন্যদিকে এই রিক্সা তার খুবই প্রিয়।এটা ছাড়া চলাফেরা তার ভালো লাগে না।একদম না।চারদেয়ালের মত গাড়িতে দমবন্ধ হয়ে আসে তার।তাই তো নিজের বাবাকেও গাড়ি কিনতে দেয় না সে।গাড়ি হলেই বাবা তাকে গাড়ি ছাড়া কোথাও যেতে দিবে না।আর এটা সে চায় না।একদম কিছুতেই না।খোলামেলা হলেই ভালো লাগে।তাহলে আর নিয়েকে বন্ধনী বন্ধনী মনে হয় না।ওয়াসেনাত ব্যাগটা আর একটু তুলে নেয়। মাথার কাছে আড়াআড়ি ভাবে বাম হাত রাখে।সূর্যের হঠাৎ তাকে পছন্দ হয়েছে তাই একদম চোখের সামনে এসে পড়ছে।হঠাৎ কেউ দৌড়ে এসে জাপ্টে নিয়েছে তাকে।বিস্মিত হয়ে ওয়াসেনাত চোখ বড় বড় করে।প্রথমে চিন্তে অনেক কষ্ট হলেও পরে বুঝতে পেরেছে জড়িয়ে নেওয়া ব্যক্তিটি কে।ওয়াসেনাত ভারী অবাক গলায় বললো,
—” নোড়া তুই???”
নোড়া ওয়াসেনাতকে ছেড়ে সামনাসামনি দাঁড়িয়ে বললো,
—” না নোড়ার ভূত!!”
দু’জনেই হেসে দেয়।নোড়া ওয়াসেনাতের স্কুল, কলেজ লাইফের বান্ধবী। ভার্সিটিতে নোড়া চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটিতে চাঞ্চ পেয়েছে।আর তার বাবা মাও সেখানে থাকে তাই সে চট্টগ্রামে ছিলো এতো দিন।ওয়াসেনাত ভ্রু নাচিয়ে বললো,
—” তা কি মনে করে ঢাকায় আসা??”
নোড়া অভিমানের সূর তুলে বললো,
—” কেমন আছি প্রশ্ন না করেই কেনো এলাম প্রশ্ন করার মানে কি ওয়াসু??তুই কি তোর ঢাকা থেকে তাড়িয়ে দিতে চাস আমাকে??”
ওয়াসেনাত একগাল হেসে বললো,
—” আমার ঢাকা মনে কি??ঢাকা কি আমার বাপের!”
—” তোর কথা শুনে তো এটাই মনে হচ্ছে।”
—” আরে বাপ প্রশ্ন করেছি কারন আছে তো??এতদিনে একবারো আসলি না যেই অরূপ ভাইয়া কামিং কামিং সাথে তুইও ফ্রি।”
ওয়াসেনাত হাসলো।নোড়াও লজ্জিত ভঙিতে হেসে উঠে।কিন্তু তাদের অগোচরে দাঁড়িয়ে থাকা রিমির এটা মোটেও পছন্দ হচ্ছে না।সে নাকমুখ ফুলিয়ে এগিয়ে এসে বললো,
—” এত হাসার কি আছে??আজ ভার্সিটিতে গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে।তাই আমাদের যেতে হবে নোড়া।তুই বরং আমাদের বাসায় চলে যা।ড্রাইভার আঙ্কেল দিয়ে আসবে তোকে।”
ওয়াসেনাত থেমে থেমে বলে,
—” রিমি তুই ও এখানে??কখন এলি??”
রিমি গোমড়া মুখে বলে,
—” একসাথেই এসেছি।কিন্তু তুই নোড়াতে ব্যস্ত। আমার দিকে নজর দেওয়ার মত সময় কই??”
ওয়াসেনাত আবার হাসে।বলে,
—” ফালতু কথা রাখ।তোর দিকে বেশি নজর দিলে নজর লেগে যাবে।এখন চল।আর নোড়া তুই যা। তোর সাথে পরে কথা হবে।
ওয়াসেনাত নোড়ার আরো কাছ ঘেঁষে কানে কানে বললো,
—” অরূপ ভাইয়া বাসায় আছে।উনি এখনো অফিসের জয়েনিং লেটার পায় নি।মানে আঙ্কেল এখনো দেয় নি।কিছুদিন পরে যাবে শুনেছি।সে হিসেবে আজ বাসায় তিনি।”
নোড়া লাজুক হাসে।রিমি ওয়াসেনাতের হাত টেনে বললো,
—” চল তো।নোড়া বাই।আর হে ভাইয়ার কাছে বেশি ঘেঁষা ঘেঁষি করিস না।রেগে যাবে।
একটা রিক্সা এগিয়ে আসতেই ওয়াসেনাত রিমিকে টেনে রিক্সায় বসতে বসতে বললো,
—” এভাবে বলার মানে কি রিমি??ওর খারাপ লাগতে পারে।”
—” দেখ ও বেশি ঘেঁষাঘেঁষি করে যেটা আমার ভাইয়ার খারাপ লাগে।এত দিন পরে ভাইয়া এসেছে।আমি চাই না এসবের কারনে ওর মন খারাপ হক।”
ওয়াসেনাত চুপ করে যায়।রিমি তার ভাইকে খুব ভালোবাসে এটা সে জানে।নোড়াকে একদম অপছন্দের তালিকায় ফেলে রেখেছে অরূপ।শুধু নোড়া কেনো সব মেয়েকেই অরূপ অপছন্দের তালিকায় রাখে।এটা ওয়াসেনাত জানে।বিশেষ করে ঘেঁষাঘেঁষি টাইপের মেয়েদের। নোড়া কিন্তু সত্যি খুব ভালোবাসে অরূপকে এটাও ওয়াসেনাত জানে।তাই তার নোড়ার জন্য খারাপ লাগছে।

_______________
আজকের মত সব ক্লাস শেষ করে ওয়াসেনাত খুব টায়ার্ড।আজ তাদের ঘুরতে যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু এত টায়ার্ড যে ওয়াসেনাত যাবে না বলে দেয়।ওয়াসেনাতের হাতের প্লাস্টার খোলা হবে কাল।তাই কালই যাবে।ওয়াসেনাত রিমিকে নিয়ে ওয়াসরুমে যায়।চুলটা খুলে যাচ্ছে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। তাই দ্রুত ওয়াসরুমে চলে যায় ওয়াসেনাত আর রিমি।রিমি চুলগুলো ভালো করে ক্লিপের সাথে আটকে দিয়ে চোখেমুখে পানি দেয়।ওয়াসেনাতের গায়ে ইচ্ছে করে পানি মারে।ওয়াসেনাতের আজ আর প্রতিক্রিয়া হচ্ছে না।অন্যদিন হলে ঠিক রেগে যেত।ওয়াসরুমে মেয়েদের দল আছে কিছু।মেয়েদের আবার ওয়াসরুমটা ভালোই লাগে।তার মূল কারন আয়না।আয়না দেখা এদের জাতিগত অভ্যাস। কারনে অকারনে ওয়াসরুমে এসে আয়নার সামনে রং ঢং করা, ঘুরা ঘুরি করা এদের দৈনিক রুটিনবাঁধা কাজ। ওয়াসেনাত বেশ বিরক্ত এসবে।ওয়াসরুমে প্রয়োজন ছাড়া আসাও তার পছন্দ না।সেও এক হাতে চোখেমুখে পানি দিয়ে বেড়িয়ে আসবে এমন সময় একটা গুশুরপুশুর শব্দ কানে এলো।খুবই অদ্ভুত কিছু আলাপ চলছে।মাদৌলি নামের একজন সিনিয়ার আপু আছে ভার্সিটিতে।মেয়েটা বেশিই স্মার্ট।ছেলেরা উঠতে বসতে ক্রাশ খায়।সেও তাল মিলিয়ে প্রেম করে।একদম বাজে টাইপের মেয়ে মনে হয় ওয়াসেনাতের।এখন যে অদ্ভুত গুশুরপুশুর হচ্ছে সেটা তার নতুন বয়ফ্রেন্ড নিয়ে।ওয়াসেনাত না চাইতেও একটু কান খাড়া করে।রিমি তো মনোযোগী স্রোতার মত শুনছে।মেয়েরা চুপ হয়ে গেছে।হয় তো কথা শেষ।রিমি আগ্রহ প্রকাশ করে বললো,
—” মাদৌলি আপুর নতুন বয়ফ্রেন্ড কে গো??”
দু’জন মেয়ে দাঁড়িয়ে এসব বলছিলো।তারা কিছুটা পাশ ঘেঁষে ফিসফিস করে রিমিকে বলতে শুরু করলো,
—” সে এক ভয়ংকর ব্যাপার বুঝলা!নতুন দুইটা ছেলে আছে না একদম ভিন্ন!
রিমি বললো,
—” কোন নতুন?”
—” আরে চুপচাপ থাকে সবসময়।কারো সাথে কথা বলে না।ওরা!তাদের মধ্যে লম্বা চৌড়া বলিষ্ঠ দেহের যে ছেলেটা আছে না, শ্যামলা হলে কি হবে বডিসডি মাশআল্লাহ্।দেখতেও দারুণ। কারো সাথেই কথা বলে না।চুপচাপ থাকে।তার সাথে আমাদের ক্লাসমেট মাদৌলির চক্কর চলে বুঝলা।”
রিমি কৌতুহলী হয়ে বললো,
—” কিভাবে বুঝলেন??”
—” এটা বুঝা কি কঠিন কিছু।আর মাদৌলি যা সুন্দর ছেলেরা এমনেই মরে।কিন্তু এই ছেলের সাথে রিলেশনশিপে যাওয়ার মত মেয়ে তো ওরে মনে হয় না ।তবুও চলে। এবং গভীর ভাবে।”
ওয়াসেনাত চমকে তাকালো।পিছন থেকে সামনে তাকিয়ে বললো,
—” এক্সকিউজ মি আপু আপনি সিউর??”
—” সিউর হওয়ার চান্স তোমাকেও দি ওই যে ওয়াসরুমে আসার সময় একটা বন্ধ রুম আছে না সেখানেই আছে মনে হয় এখনো।রোম্যান্টিক সিন ফ্রিতে দেখতে পাবে।একদম ফ্রি বিনোদন। আমি মাত্র আসার সময় দেখেছি।”
কথার মাঝে দ্বিতীয় মেয়েটা কেঁদে কেঁদে চোখ মুছে বললো,
—” না এ হতে পারে না।বিশ্বাস করি না।ও এমন না দোস্ত। ওই মাদৌলি মেয়েটাই চিপকু টাইপের।একদম ছেলেদের সাথে লেগে থাকে।জামাকাপড় ও তওবা তওবা স্টাইলের পরে।এমন মেয়ে দেখলে সবাই একটু ভড়কে যা।তবে ও এমন না।আমার ক্রাশ আইকন ও।আমার জান।”
ওয়াসেনাত বিস্মিত হয়ে চোখ বড় বড় করে।মেয়েটা ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদছে। একে দেখে ওয়াসেনাতের সত্যি খুবই কষ্ট লাগছে।নিজের চিন্তা ভয় ধুকপুকানি সব এই মেয়েকে ঘিরে শুরু হয়েছে।ওয়াসেনাত মৃদু কন্ঠে বললো,
—” কে সে??মানে ছেলেটা কে??”
মেয়েটা কান্না জড়িত গলায় বললো,
—” আমার নুহাশ বাবু!!”
রিমি হেসে বললো,
—” বাবু হবে না মাদৌলির বাচ্চার বাপ হবে আপনার নুহাশ।”
মেয়েটা রাগে কটমট করে তাকায়।ওয়াসেনাত রিমির হাত টেনে ওয়াসরুম থেকে বেরিয়ে আসে।রিমি কিছুই বুঝতে পারছে না।ওয়াসেনাত উত্তেজিত ভঙ্গিতে পাশের রুম গুলোর দরজা ঠাস ঠাস করে খুলে দেখছে।কই কেউ তো নেই??ওয়াসেনাতের যেনো জান ফিরে এলো। দীর্ঘশ্বাস নিলো সে।সামনের একটা রুম থেকে নিজের শার্টের হাতা ঠিক করতে করতে এগিয়ে আসছে অরিত্রান। চোখেমুখে রাগ আর রাগ।রাগে লাল হয়ে আছে চোখজোড়া। ভয়ংকর তেজে নাকটা ফুঁলছে।যেন সব ভেঙে গুঁড়িয়ে দিবে।সামনে তাকিয়ে হাঁটছে না সে।নিচের দিকে তাকিয়ে পথ চলছে।ওয়াসেনাত কিছুসময় তাকিয়ে থাকে, তারপর সামনে হাঁটা দেয়।কই থেকে মাদৌলি দৌরে এসে অরিত্রানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।দু’হাতে জড়িয়ে ধরে।হাউমাউ করে কান্না শুরু করে।আকর্ষীক ধাক্কায় অরিত্রান পড়ে যেতো একটুর জন্য।নিজেকে সামলে পাশের দেয়ালে হাত ঠেকায় সে।ওয়াসেনাত, রিমি বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে হা করে তাকিয়ে আছে।রিমি চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়।না এদিকে কেউ নেই।ওয়াসেনাত হা হয়ে তাকিয়ে আছে!রিমি তো বিস্ময় কাটিয়ে উঠতেই পারছে না।একদম খোল্লাম খোলাই প্রেম!বাপ করে!কিন্তু কান্দে কা?রিমি ওয়াসেনাতেের দিকে না তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে,
—” বাপরে বাপ কি যুগ আসছে দোস্ত এরা তো ভার্সিটিরে প্রেমময় করে তুলতাছে।তবে এত কান্দে কা?”
ওয়াসেনাত চুপ করে তাকিয়ে আছে।কিছু বলছে না।রিমি আবার বললো,
—” তয় দোস্ত এই নুহাশরে দেখলে মনে হয় না এতটা প্রেমিক বান্দা সে।কোথাও যেনো কিছু মিসিং মিসিং মনে হচ্ছে।সাথে রহস্য রহস্য গন্ধ।তবে আমি শুনেছি এমন চুপচাপ গম্ভীর মানুষ প্রেমিক হিসেবে মারাত্মক হয়।”
ওয়াসেনাত তিক্ত মেজাজে বললো,

—” চুপ করবি রিমি!!আর চল।কারো পার্সোনাল মুহূর্ত দেখা উচিঁত না।”
—” যা ভাগ এমন ফ্রিতে বিনোদন মিস করা যায় বুঝি!তুই যা দরকার হলে।আমি যামু না।”
ওয়াসেনাতের চোখ জ্বলজ্বল করছে।রিমি কথা থামিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।ওয়াসেনাত রিমির হাত টেনে পিছনে ঘুরে হাটা শুরু করে।ওয়াসেনাতের বুক পুড়ছে।হচ্ছে অসহনীয় যন্ত্রণা।মনে হচ্ছে বুকের বাঁ পাশটায় আগুন লেগেছে।ধাউধাউ করছে সে আগুনের উত্তাপে।কলিজা পুড়ছে।ওয়াসেনাত দ্রুত হাঁটছে। রিমি অবাক।মহা অবাকতায় সে চুপ করে আছে।ওয়াসেনাত মোটেও দুর্বল চিত্তের মেয়ে না।তবুও হঠাৎ করেই জ্বালা করছে বুক।প্রথম প্রেম তার।প্রথম আবেগে সে আটকা পরেছে।এটাই তো প্রথম ভালোবাসা ছিলো।১৮বছরের জীবনে প্রথম সে মন থেকে কারো প্রতি দূর্বলা অনুভব করেছে।কিন্তু আজ!বড্ড খারাপ লাগছে তার! খারাপ লাগায় দুনিয়াটা এলোমেলো লাগছে তার।তিক্ত, বিরক্ত, যন্ত্রণাদায়ক মনে হচ্ছে সব।ওয়াসেনাত হাঁটতে হাঁটতে হোঁচট খায়।রিমনের গায়ের সাথে বাড়ি খেয়েছে।রিমন কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওয়াসেনাত তাকে পাশ কাটিয়ে হাঁটছে।রিমন থমকে দাঁড়িয়ে ডাকলো,
—” রিমি??”
রিমি পছনে ফিরে একবার তাকিয়ে বললো,
—” পরে কথা বলবো মাহির মশায়।এখন আসি।”
রিমন বিস্ময়ে কিছুসময় তাকিয়ে সামনে হাঁটা দেয়।রিমি ওয়াসেনাতের হাত টেনে ধরে।প্রশ্ন করে,
—” কি হয়েছে ওয়াসু??”
ওয়াসেনাত জবাব দেয় না।চোখ ঝাপসা হয়ে আসে তার।ঠোঁটজোড়া কাঁপছে।রিমি তার এত বছরের বন্ধুত্বপূর্ণ সময়ে এই প্রথম ওয়াসেনাতকে এভাবে দেখছে।এতটা নিশপ্রান আগে কখনো দেখেনি সে।ওয়াসেনাত কান্না আটকে বললো,
—” আমার ভালো লাগছে না রিমি।চল বাসায় যাই।”
পাশে বিশাল গাছ।রিমি ওয়াসেনাতের হাত টেনে সেখানে বসিয়ে দেয়।ব্যাগ থেকে পানির বোতল নিয়ে ওয়াসেনাতের দিকে এগিয়ে দেয়।ওয়াসেনাতের দৃষ্টি স্থির। মনে হচ্ছে সব থমকে গেছে।
______________________
অরিত্রানের মেজাজ তুঙ্গে আছে।শুধু তুঙ্গে বললে ভুল হবে মহা তুঙ্গে আছে।রাগে তার শরীরের রগ টগবগ টগবগ করছে।রক্ত লাফাচ্ছে।বার কয়েক ঝাঁকিয়ে মাদৌলিকে নিজের থেকে ছাঁড়িয়ে নিয়েছে সে।তবুও বেহায়ার মত মেয়েটা লাফিয়ে গায়ে এসে পড়ছে।অরিত্রানের এই মুহূর্তে খুন করে হাত রাঙাতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু কিছু করতে পাড়ছে না।চেঁচিয়ে সবাইকে বলে দিবে সে অরিত্রান খান নুহাশ নয়।ব্যাপারটায় একটা হাঙ্গামা হবে এখন।সাংবাদিক, মিডিয়া বিশ্রী কান্ড হবে।অরিত্রান চেয়েও ছুঁড়ে দিতে পাড়ছে না মাদৌলিকে।কেমন মেজাজ দেখাবে বুঝতেই পারছে না।রিমন এই দৃশ্য দেখে উল্টা পথে হাঁটতে যাবে অরিত্রান চেঁচিয়ে ডাকলো,
—” রিমন এদিকে আয়।”
রিমন এগিয়ে এসে দাঁড়ায়।নাক মুক ছিটকে তাকিয়ে আছে সে।অরিত্রান মেয়েটাকে এভাবে জড়িয়ে কেনো আছে?ছিঃ ছিঃ।অরিত্রানের শার্ট ভিজিয়ে কাঁদছে মাদৌলি।রাগে শরীর ঘিনঘিন করছে অরিত্রানের।অরিত্রান ঝিটকে সরিয়ে দিতে চাইলেই মাদৌলি আরো শক্ত করে ধরছে তাকে।অরিত্রান এবার নিজের রাগ আর নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে ছিটিয়ে টেনে হেঁচড়ে সরিয়ে দেয়।থমথমে গম্ভীর গলায় বলে,
—” মিস মাদৌলি আপনার সাহস কিন্তু বড্ড বেশি।আপনি কি জানেন না আমি কে??অরিত্রান আপনাকে মারতেও দু’বার ভাবেনা।খুন করে দিবো।জাস্ট মার্ডার।”
রিমন হতভম্ভ হয়ে তাকিয়ে আছে। মাদৌলি কান্নাজড়িত কন্ঠে থেমে থেমে বললো,
—” অরিত্রান আই লাভ ইউ।আই লাভ ইউ সো মাচ!এতটা ভালো আমি কাউকে বাসতে পারিনি বিশ্বাস করো।”
অরিত্রানের চোখ লাল হয়ে আসে।ঝাঁঝালো গলায় বলে,
—” আবার তুমি!!”

মাদৌলি ঢোক গিলে।কান্নায় মুখের মেকাপ ঘঁষে পরছে।আবার বিলাপ দিয়ে কেঁদে উঠে সে।রিমন আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পাড়ছে না।মাদৌলি কাঁদতে কাঁদত আবার বলে,
—” আই লাভ ইউ অরিত্রান।”
রিমন কথাটা শুনে বিড়বিড় করে ভেঙ্গায়।ব্যাঙ্গ করে বলে,
—” আই লাভ ইউ অরিত্রান!! শালি তোর এই লাভ ইউ অরিত্রানের স্পেশাল রুমে নিয়েই চুকিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।”
অরিত্রানের মেজাজ তিতো হয়ে এসেছে।কিছুক্ষণ আগের কথা মনে করে সে আরো বিরক্ত। মাদৌলি অনেক খোঁজ নিয়ে অরিত্রানের বা নুহাশের খবর জোগাড় করতে পারলো না।অরিত্রানের চোখে সমস্যা হচ্ছে সকাল থেকে।ভার্সিটিতে আসার কারন ওয়াসেনাত!!আজ ওয়াসেনাত ভার্সিটিতে এসেছে সে খবর পেয়েছে।তাই এখানে আসা।তা না হলে ভার্সিটির কাজ শেষ।অরিত্রান বন্ধ রুমে লন্স খুলে চোখে ঔষুধ লাগাচ্ছিলো।মাদৌলি হুট করেই ভিতরে চলে আসে আর অরিত্রানকে ভালো ভাবে দেখে চিনতে পেরে যায়।তার কারন সে ওই দিন সরাসরি দেখেছে অরিত্রানকে।অরিত্রান শান্ত ভাবে ব্যাপারটা শেষ করতে চেয়েছিলো।কিন্তু মাদৌলি ভালোবাসার পাট নিয়ে বসেছে।ইনিয়েবিনিয়ে শুধু তার এক কথা।অরিত্রানকে তখন জড়িয়ে ধরতে চেয়েছে তাই সে হাত বাঁকিয়ে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরেছে।খোলা দরজার সামনে এসে এই দৃশ্য ওই দুই মেয়ে দেখে ফেলেছে।ব্যস। চোখের দেখা সত্য মনে করেই তারা বকবক করছে।অরিত্রান একবার ছুঁড়ে দিয়েছে মাদৌলিকে।হাত ছিঁড়ে গেছে তার।মেয়েটার চামড়া মোটা।তা না হলে এখনো অরিত্রানের পিছনে ঘুরে তাকে বিরক্ত করতো না।অরিত্রান তাড়ায় ছিলো।ওয়াসেনাতের ক্লাস প্রায় শেষ মনে হয়।সে দেখা করতে চায়।তাই বেড়িয়ে পরেছে।কিন্তু মাদৌলি পিছনে পিছনে ঘুরবে জানা ছিলো না।
মাদৌলিকে এভাবে রেখেই অরিত্রান শার্ট ঠিক করে সামনে এগিয়ে যায়।তার ইচ্ছে করছে শার্ট টা খুলে ফেলে দিতে।মাদৌলি হাত টেনে ধরে।রিমন মনে মনে আল্লাহ্‌কে ডাকে।আজ অরিত্রানের মেজাজ ভালো।এখন যদি এই মাদৌলির কর্মকাণ্ডে রেগে যায়।আজ একটা খুন হবেই।অরিত্রান নিজেকে শান্ত রাখতে চায়।এভাবে ভার্সিটিতে হুল্লোর করতে চায় না সে।চোখ বন্ধ করে আবার খুলে মাদৌলির দিকে তাকায় সে।মাদৌলির চোখে পানি।অরিত্রানের চোখে বিরক্তি। রিমনের চোখে রাগ।এক রাশ রাগ।অরিত্রান শান্ত গলায় বললো,

—” কি চাই তোমার??বিরক্ত করছ কেনো??”
অরিত্রানের মুখে তুমি ডাক শুনে মাদৌলি যেনো চাঁদ হাতে পেয়েছে।কান্নায় সে হেসে দেয়।অরিত্রান যে প্রচণ্ড রাগলে কাউকেই আপনি /তুমি ঠিক ভাবে ডাকে না এটা রিমন বুঝতে পেরেছে।মেয়েটার উপর তার ক্রোধ প্রচন্ড বেশি।মাদৌলি দ্রুত হাত ছেড়ে চোখ মুছে।মুখে হাসির রেখা টেনে বলে,
—” আমি শুধু তোমাকে চাই।আই লাভ ইউ।সেই প্রথম দেখা থেকে তোমাকে ভালোবাসি।বিশ্বাস করো আমি এতটা ভালো কাউকে বাসি নি।তুমি আমার প্রথম ভালোবাসা।তোমার মনে আছে..”
অরিত্রান ধমক দিয়ে বলে,
—” টাকা লাগলে রিমন একে টাকা দিয়ে দে।জাস্ট বিরক্তকর মেয়ে একটা।”
মাদৌলি দমে গেলো না।অনুনয়ের সুরে বললো,
—” লন্ডনে দেখেই তোমার প্রেমে পড়েছি।তিন বছর ধরে ভালোবাসি।প্লিজজজ এক্সেপ্ট মি।একবার সুযোগ দিয়েই দেখো আমি তোমাকে ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখবো।”
অরিত্রানের খুব হাসি পেলো।কেনো সে জানে না।খানিকটা সময় নিয়ে সে হাসে।মাদৌলি ভড়কে যায়।পাগল টাগল হয়েগেলো নাকি!অরিত্রান হাসতে হাসতেই বললো,
—” এত ভালোবাসা আমার লাগবে না।অরিত্রান খানের প্রয়োজন নেই তোমার মত মেয়ের ভালোবাসা।সো গেট লস্ট।”
মাদৌলিকে থেতা টাইপের বেহায়া মেয়ে মনে হচ্ছে রিমনের। কেমন নির্লজ্জ। শুধু আই লাভ ইউ আর ভালোবাসি।মন চাচ্ছে সাইনবোর্ড বানিয়ে গলায় ঝুঁলিয়ে দিতে।বেয়াদপ।মাদৌলি বললো,
—” তোমাকে ছাড়া আমি মরেই যাবো।বিশ্বাস করো।আর কিছু চাই না।টাকা কম নেই আমার বাবার।এটা তুমিও জানো।”
অরিত্রান চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস নেয়।বলে,
—” ওকে! আর কি কি বলার আছে বলো।রিমন একটা চেয়ার নিয়ে আয়।শুনি আর কি কি বলার আছে।”
অরিত্রান নিজের চোখের সামনে চলে আসা সিল্কি চুলগুলো ডান হাতের দু আঙ্গুল দিয়ে সরিয়ে দিলো।মাদৌলি এবার কিছুটা ভীতু হয়ে উঠে।মনে মনে ভাবে এত প্রস্তুতি করে বসবে কথা শুনতে! মেরে দিবে না তো!মাদৌলি আঁতকে উঠে।অরিত্রান রিমনের নিয়ে আশা চেয়ারে পা তুলে বসে।শান্ত তার ভঙি।খুবই কোমল গলায় বলে,
—” তা শুরু করা যাক।বলো কত প্রেম আর ভালোবাসা আছে সব ঢেলে বলো।আমি শুনছি।”
মাদৌলি ঢোক গিলে।ভয় লাগছে খুব।হঠাৎ এত শান্ত হয়ে যাবে সে ভাবে নি।অরিত্রান হাক লাগিয়ে বলে,
—” রিমন উনাকে একটা চেয়ার এনে দে।দাঁড়িয়ে বলতে হয় তো কষ্ট হচ্ছে।”
অরিত্রান ঠোঁটবাঁকিয়ে হাসে।রিমন তড়িঘড়ি করে একটা চেয়ার নিয়ে আসে পাশের রুম থেকে।অরিত্রান বিনয়ী কন্ঠে বলে,
—” বসুন।দেখি ভালোবাসা বাসি করা যায় কি না।”
তুমি, আপনি, আপনি, তুমি কথাগুলোতে মাদৌলি গুলিয়ে যাচ্ছে। তার এখন মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগের লোকটা আর এখনকার লোকটার মাঝে অনেক পার্থক্য রয়েছে।হঠাৎ এত ঠান্ডা কেনো?অচেনা অচেনা লাগছে খুব।ভারী অদ্ভুত টাইপের।অরিত্রান আবার রিমনকে বললো,
—” কোল্ডড্রিংক্স নিয়ে আয়।উনার গলা শুকিয়ে গেছে মনে হয়।”
রিমন হাসছে।এতক্ষণে প্রকৃত রূপে অরিত্রান এসে হাজির হয়েছে।বেশ জমে গেছে এবার।আরো বল ভালোবাসি ভালোবাসি!রিমন খিটমিট করে হেসে উঠে।অরিত্রান চোখ ঘুরিয়ে একবার তাকায়।এতেই রিমন দেয় এক দৌড়।

__________________
ওয়াসেনাত এখনো বসে আছে।হাত দিয়ে খামছে ধরেছে ঘাস।রিমি কোনো কারন বুঝতে পাড়ছে না।হঠাৎ এমন পরিবর্তনের কারন কি??রিমি ওয়াসেনাতের বাহু ঝাকায়।ওয়াসেনাতের হুশ হয়।কষ্ট মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।মনে মনে আউড়ায়, “ওই মাদৌলি তাহলে উনার অন্য কিছু!!”ওয়াসেনাতের বুকটা ভারী হয়ে উঠে।নিঃশ্বাস গলায় আটকে আসে বার বার।পানি মুখে দিতেই গলায় আটকায়।মুহূর্তেই চোখমুখ লাল হয়ে উঠে।শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম। ভালোবাসা কি এতটাই ভয়ংকর?? এতে কি এত কষ্ট?ইশশ্ আগে জানলে কখনো এতে পা দিত না ওয়াসেনাত।কিছু দিন আগেও যদি বুঝতে পারতো এর ব্যথা কত তীব্র তাহলে কখনো সে ভালোবাসা নামক অনুভুতি গায়ে মাখা তো না।কিন্তু কি করবে সে।হঠাৎ ঝড়ের মত এসে তার সব এলোমেলো করে দিয়েছে ভালোবাসা।নুহাশকে তো ওয়াসেনাত নিজের ভালোবাসার রঙে মিশিয়ে নিয়েছে।অনুভুতি দিয়ে তার গম্ভীরতাকে ঢেকে দিয়েছে।যা এখন তাকে খুব পুড়াচ্ছে।নুহাশ হয় তো মাদৌলিকে খুব ভালোবাসে।তাই তো এত প্রেমিক হয়ে কথা বলেছিলো কাল।ওয়াসেনাত আর বেশি ভাবে না।নুহাশের প্রতি হঠাৎ করেই তীব্র ক্ষোভ জাগে।কিন্তু কেনো সে জানে না।তাকে তো কখনো সে বলেনি ভালোবাসি!এমন কি কখনো তেমন প্রকাশও করেনি!শুধু শুধু একটু জড়িয়ে নেওয়ায় সে কিসব ভেবে ফেলেছে।জড়িয়ে গেছে ভালোবাসা নামক ভয়ংকর দহন জ্বালায়।ওয়াসেনাত আর পারেনা নিজের বোকামি মানতে তার খুব কষ্ট হচ্ছে।মনটা কুঁকড়ে গেছে তার কষ্টে।ওয়াসেনাত চোখ বুজে।কানে বাজে ওই মেয়েগুলোর কথা।চোখে ভাসে অরিত্রানের সাথে মাদৌলির জড়িয়ে থাকা দৃশ্য। ওয়াসেনাত এই দৃশ্য একদম সয্য করতে পারলো না।ঠাস করে চোখ খুলে ফেলে।প্রথম ভালোবাসায় সে ব্যর্থ!হ্যা ব্যর্থ!মানতে চায় না মন।তবুও মানতে হচ্ছে। ওয়াসেনাত আওয়াজ করে ডুকড়ে কেঁদে উঠে।রিমি চরম ভাবে চমকে তাকিয়ে আছে।ওয়াসেনাত রিমির দিকে একবার তাকিয়েই তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দেয়।রিমি হাতও বুলাতে ভুলে গেছে।ওয়াসেনাত কেঁদে চলেছে।তার বুকের দহন যন্ত্রণা যেন বেরিয়ে আসছে পানি হয়ে।রিমি বিড়বিড় করা গলায় বললো,
—” ওয়াসু তুই নুহাশ ভাইয়াকে ভালোবাসিস!!”
.
.
#চলবে____