সে কি জানে

সে কি জানে Season 2 ! Part- 34

৪০.
হাতে সিগারেট নিয়ে ছাদের এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে দিহান। তার দৃষ্টি রাতের আকাশের চকচক করা তারাগুলোর দিকে। চোখে পানি জমা হয়ে আছে। মিরুকে দেখতে ইচ্ছে করছে প্রবল ভাবে। কি হতো যদি তার মিরু শুধু তার-ই হতো? কি হতো যদি রেয়ান মিরার জীবনে না আসতো? তার মিরু তো শুধু তার-ই থাকতো তাই না? কিন্তু আফসোস! রেয়ান মিরার জীবনে এসেছে। দিহানের জীবন থেকে মিরাকে কেড়ে নিয়ে গেছে সে। কষ্টটা যেন আরও প্রবল হলো দিহানের। অপরদিকে কেমন অনুতপ্ততাও কাজ করছে তার মধ্যে। জেনির সাথে আসলেই অনেক খারাপ ব্যবহার করেছে সে। এতটা কঠিন না হলেও পারতো সে।চোখ বন্ধ করে ফেলল দিহান। সাথে সাথে ভেসে উঠল জেনির সেই অশ্রু মাখা মুখশ্রী। চোখ খুলে ফেলল দিহান। অবাক সে! এমন কেন হলো? সে চোখ বন্ধ করলে তো শুধু মিরার চেহারা ভেসে উঠে, তাহলে এখন জেনির চেহারা কেন ভেসে উঠল? তবে কি দিহান জেনিকে পছন্দ করতে শুরু করেছে? কিন্তু কিভাবে? এত তাড়াতাড়ি কিভাবে সম্ভব কাউকে ভালোবাসা কিংবা পছন্দ করা? নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগছে দিহানের। মস্তিষ্ক আর মনের দু’টানায় বাজেভাবে পিষে যাচ্ছে সে। সিগারেট মুখে দিয়ে একটা লম্বা টান দিলো দিহান। মুখ থেকে ধোঁয়া উড়িয়ে প্রায় সাথে সাথেই গান গাইতো লাগলো সে…
-” কেন মেঘ আসে, হৃদয় আকাশে “-
-” কেন মেঘ আসে, হৃদয় আকাশে “-
-” তোমারে দেখিতে দেয় না “-
-” মাঝে মাঝে তব দেখা পাই “-
-” চিরদিন কেন পাই না “-

________________
জেনির বাবা গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছেন। সেই বিকালে যে রুমে গিয়ে কান্না শুরু করেছে জেনি, এখনও থামার নাম নেই তার। তাও যেই সেই কান্না নয় একদম নিজের মার কোলে মাথা রেখে তাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে কান্না করছে জেনি। জেনির বাবার ভয় হচ্ছে অনেক। কালকে ইন্ডিয়া থেকে বাংলাদেশে আসার পরপরই রেয়ানের বাবা রাহুল আহমেদ ফোন করেছিলেন তাকে। তিনি নাকি জেনির সাথে রেয়ানের বিয়ে দিতে চান না। বিয়ে ভেঙ্গে দিতে চান। এতে অনেক ক্ষুণ্ণ হোন জেনির বাবা। এক প্রকার রেগেই তখন রাহুল আহমেদের সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছিল তার। শেষে তিনি রাহুল আহমেদকে বলেন যে তিনিও তার মেয়ের বিয়ে রেয়ানে সাথে দিতে চান না। তবে কি এ বিষয়ে জেনি কিছু জেনে গেছে? এজন্যই কি তার মেয়ে কাঁদছে? সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালেন জেনির বাবা। এভাবে বসে থাকলে হচ্ছে না। জেনিকে বোঝানো দরকার। ছেলেদের কি অভাব হয়েছে নাকি? অন্য কোনো ভালো ফ্যামিলির সাথে বিয়ে হবে তার মেয়ের। রেয়ানকে ভুলে যেতে বলবেন উনি। খুব করে বোঝাবেন জেনিকে। তাই-ই করলেন। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন জেনির রুমের দিকে।
জেনি মায়ের কোলে মাথা রেখে কাঁদছিল। তখন রুমে উপস্থিত হোন জেনির বাবা। মেয়ের পাশে এসে বসে নরম সরে বলে উঠেন…
— ” মাই প্রিন্সেস! কাঁদছ কেন তুমি?”
জেনি জবাব দিলো না। আশাহত হলেন জেনির বাবা। তার ধারণাই হয়তো ঠিক৷ জেনি বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার ব্যাপারে জেনে গেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন উনি। আবারও বললেন…
— “কান্না করো না জেনি। রেয়ানের সাথে বিয়ে ভেঙ্গে গেছে তো কি হয়েছে? ছেলেদের কি অভাব আছে নাকি? রেয়ানের থেকেও বড়লোক ঘরের ছেলের সাথে বিয়ে দিবো তোমার। দেখবে সে তোমাকে অনেক ভালো রাখবে।”
জেনি লম্বা নিশ্বাস ছেঁড়ে বলল…

— “ড্যাড! তোমাকে আমি আরও ৫মাস আগে বলেছিলাম রেয়ানের সাথে আমার বিয়ে দিতে। তাহলে তুমি এতদিন পর ওর সাথে আমার বিয়ে কেন ঠিক করেছিলে?”
জেনির বাবা চমকালেন ক্ষাণিকটা। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলে উঠলেন…
— “আসলে তুমি আমাকে বিয়ের কথা যখন বলেছিলে তখন আমি অনেকটাই ব্যস্ত ছিলাম। এসব বিষয়ে সময় ছিল না আমার। যখন কাজ একটু কম ছিল তখন একদিন তোমাকে ছাদে বসে কান্না করতে দেখেছিলাম আমি। বেশিদিন হবে না। এইতো কিছুদিন আগে। ভেবেছিলাম হয়তো রেয়ানকে নিয়ে কোনো কিছু হয়েছে৷ কান্না করার সময় তুমি ” বিয়ে ” শব্দটা উচ্চারণ করেছিলে। তাই ভাবলাম হয়তো রেয়ানকে বিয়ে করার জন্য কাঁদছো তুমি। এজন্য এতদিন পর রাহুল আহমেদকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলাম৷ কিন্তু এখন উনি বলছেন উনি রেয়ানের সাথে তোমার বিয়ে দিতে চান না। বাট চিন্তা করো না প্রিন্সেস। আরও ভালো ছেলের সাথে তোমার বিয়ে দিবো আমি।”
জেনি অবাক হলো। তার বাবা এজন্য এতদিন পর রেয়ানের বাবার কাছে তার বিয়ের কথা বলেছে। কিন্তু সে তো রেয়ানের জন্য কাঁদছিল না। কাঁদছিল দিহানের জন্য। ওইদিন আবদ্ধের বিয়ে ছিল। জেনির বেস্ট ফ্রেন্ডের পরিবার মিরার দূরসম্পর্কের আত্মীয়। সে দিহানের সম্পর্কে জানতো। জেনি বলেছিল দিহানের প্রতি তার একটা আলাদা অনুভূতি কাজ করে। সে হিসেবেই জেনির বেস্ট ফ্রেন্ড যখন দিহান মিরার সাথে কথা বলছিল, সেই সময়কার করেকটা ছবি জেনির কাছে পাঠিয়ে দেয়। সেই ছবিগুলোতে দিহানকে কাঁদতে দেখেছিল সে। জেনি আগে থেকেই জানতো দিহান মিরাকে ভালোবাসে। কিন্তু দিহান যে মিরাকে এখনও ভালোবাসে তা ভেবেই জেনি কেঁদেছিল তখন। মনে একটা ভয় জেঁকে বসেছিল তার। যা এখনও আছে জেনির মনে। দিহান কি তাকে মিরার জায়গায় বসাতে পারবে? তাকে ভালোবাসবে? বিয়ে করবে তো জেনিকে? বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো জেনির। ভাবনার জগৎ থেকে বের হয়ে কোল থেকে মাথা উঠিয়ে বসল সে। ধীর কণ্ঠে বলল…
— “আমি তখন রেয়ানের জন্য কাঁদছিলাম না ড্যাড।”
— “তাহলে?”
আরেকটু সোজা হয়ে বসল জেনি৷ কান্না চাপিয়ে বলে উঠল…
— “রেয়ান শুধু আমার আকর্ষণ ড্যাড। আমার ভালোবাসা অন্যজন।”
— “মানে? কে সে? ভালো ফ্যামিলির তো? বড়লোক?”
— “না মধ্যবিত্ত।”
ভ্রুঁ কুঁচকে এলো জেনির বাবার। মেয়েটা আর কোনো ছেলে পেল না নাকি? মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির ছেলেকেই ভালোবাসতে হলো? মুখটা মুহুর্তেউ অস্বাভাবিক হয়ে গেল তার। সে দিকে একবার তাকালো জেনি। ঝটপট বলে উঠল…
— “ও অনেক ভালো ছেলে ড্যাড। আমাকে সুখে রাখবে। তবে…”
আবারও ভ্রুঁ কুঁচকালেন জেনির বাবা৷ বললেন…
— “তবে কি?”
— “ও আমায় ভালোবাসে না ড্যাড। ও বুঝতে চাইছে না আমি সত্যিই ওকে ভালোবাসি৷ সত্যি ভালোবাসি! আমি ওকে ছাঁড়া বাঁচতে পারবো না ড্যাড।”
কেঁদে দিলো জেনি। জেনির বাবার মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে৷ মেয়েটার উপর অনেক রাগ লাগছে তার। মিডেল ক্লাস ফ্যামিলির ছেলের জন্য এত কাঁদতে হয় নাকি? দু-তিন লাখ টাকা মুখে মারলেই তো এরা পায়ের কাছে এসে পড়বে। জেনির বাবা বেজায় বিরক্তি নিয়ে বললেন…
— “আমি দেখছি কি করা যায়।”
কথাটা বলে আর এক মুহুর্তও দাঁড়ালেন না তিনি। নিজের মেয়ের প্রতি বিশেষ রাগ হচ্ছে তার। মাথা ব্যথা করছে খুব!

৪১.
অভিমানের পাল্লা ভাড়ি করে সোফায় গোমড়া মুখ করে বসে আছি আমি। রেয়ান বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় বসে আছেন। আড়মোড়া ভেঙ্গে উনি বলে উঠলেন…
— “এভাবে বসে না থেকে কিছু আনো। ক্ষুধা লেগেছে আমার।”
আমি এখানে অভিমান করে বসে আছি অথচ উনি আমার অভিমান না ভেঙ্গে এগুলো বলছেন। রেগে গেলাম আমি। প্রকট রাগ দেখিয়ে বললাম…
— “কেন? আপনার হাসপাতাল কি আপনাকে খাবার দেয় নি?”
— “না। হাসপাতালকে বলেছি আমার বউ আছে সে-ই আমাকে খাবার খাওয়াবে। এখন সময় নষ্ট না করে যাও কিছু নিয়ে আসো৷ ইতিমধ্যে পেটের ইঁদুরগুলো লুঙ্গিডান্স করা শুরু করে দিয়েছে আমার।”
আমি রাগ করে ঠায় বসে রইলাম। যা দেখে উনি হাসলেন। দুষ্টামি করে বলে উঠলেন…
— “জানো মরুভূমি। তুমি রাগলে তোমার ঠোঁট স্টবেরি আইস্ক্রিমের মতো হয়ে যায়। ইচ্ছে করে…।”
নিজের ঠোঁট কামড়ালেন রেয়ান। উনার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালাম আমি৷ সাথে সাথে চোখ টিপ দিয়ে হাসলেন উনি৷ রাগ যেন আরও বেড়ে গেল আমার। বললাম…
— “বেহায়া বেহায়াই থাকে। জীবনও সুধরায় না। আপনি একটা খুব খারাপ রেয়ান।”
বলেই দাঁড়িয়ে গেলাম আমি। দরজার দিকে যেতে নিবো তার আগেই রেয়ান এসে আমার হাত টেনে বসিয়ে দিলেন বিছানায়। আমার কোলে মাথা রেখে কোমড় জড়িয়ে ধরলেন উনি। ক্ষাণিকটা কেঁপে উঠলাম আমি। কাঁপা সরে বললাম…
— “ছাঁড়ুন রেয়ান। নিচে যাবো আমি। আপনার জন্য কিছু নিয়ে আসি। খাবেন না?”
বিনিময়ে উনি মাথা ডানে-বামে নাড়িয়ে বলে উঠলেন…
— “উহু! ঘুমাবো আমি।”
দমে গেলাম আমি। তার মাথায় আস্তে আস্তে করে হাত বুলাতে লাগলাম। কিছুক্ষন পর উনি আমাকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমু ঘুমু কন্ঠে বললেন…
— “আই মিসড ইউ মরুভূমি।”
.
.
চলবে…