সে কি জানে Season 2 ! Part- 13
সয়ং যমরাজ এসে যদি আপনাকে জিজ্ঞেস করে…”কেমন আছো?” তখন আপনার কেমন লাগবে?আমার তো রিতিমতো হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে।চেহারা শক্ত রেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে কোনো মানুষ যে শান্ত সরে কথা বলেও অপর জনকে ভয় পাইয়ে দিতে পারে তা রেয়ানকে না দেখলে জানাই হতো না। উনার ঠোঁটে স্পষ্ট হাসি, কিন্তু চোখে অসীম রাগ! তবে আমি তার রাগে ভয় পাবো কেন? সে কে আমার? ডক্টর! হলে হবে কিন্তু তাই বলে তার রাগ দেখে আমার ভয় পেতে হবে সেটার তো কোনো কারন নেই।আমি ভয় পাবো না তাকে। ভেবেই একটা বড় শ্বাস নিলাম। রেয়ানের চোখে চোখ রেখে বললাম….
— ভালো! আপনি?
জবাব দিলেন না রেয়ান। মুচকি হেসে সোফায় বসে পড়লেন উনি।এদিকে দিহানের চোখ আটকে গেছে রেয়ানের দিকে। কিঞ্চিত হেসে সে আমাকে জিজ্ঞেস করে….
— উনি কে মিরু?
আড়চোখে একবার তাকালাম রেয়ানের দিকে।সে আবদ্ধের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত। চোখ ফিরিয়ে নিলাম আবার। বললাম….
— আমার নতুন ডক্টর।উনিই ঠিক করেছেন আমায়।
— তাই নাকি? তাহলে তো উনাকে আমার কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত।আফটার অল আমার পৃথিবীকে বাঁচিয়েছেন উনি।
— পৃথিবী মানে?
— ওটা তুমি বুঝবে না।
আমার থেকে চোখ সরিয়ে রেয়ানের দিকে এবার তাকালো দিহান। মুখে বিরাট বড় হাসি ফুটিয়ে বলল….
— থ্যাংক ইউ ডক্টর!আমার পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য। অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
পৃথিবী শব্দটা কেমন যেন শোনালো। এক জনের কথার উপর ভিত্তি করে সে কি শব্দ ব্যবহার করে কি অর্থ বুঝাতে চাচ্ছে। পৃথিবী অর্থ আমরা বুঝি ধরণী। এখানে আমরা মানুষ জাতি, পশুপাখি,জ্বীন-পরী থাকি।সাথে বেঁচে থাকার বিভিন্ন উপাদানও রয়েছে।যার ফলে আমরা বেঁচে রয়েছি। পৃথিবী দ্বারা কিন্তু এটাই বুঝায়। সাথে এটাও যে পৃথিবী ছাঁড়া আমরা বাঁচতে পারবো না। কারন পৃথিবীই আমাদের সব। এ-ই কথাটা যদি মানুষ অন্য মানুষকে তার পৃথিবী হিসেবে বিবেচনা করে বলে তাহলে তার ইঙ্গিত-টা কিন্তু অন্য দিকে দ্বারায়। ফলে দিহান পৃথিবী দ্বারা কি বুঝাতে চাচ্ছে তা বেশ ভাবে বুঝতে পারছি উপস্থিত আমরা সবাই। আবদ্ধ তো কেমন যেন রাগি ভাব নিয়ে তাকিয়ে আছে দিহানের দিকে। তার দিহানের প্রতি যে সম্মানটা সৃষ্টি হয়েছিলো তা নিমিষেই শেষ।তবে রেয়ান শান্ত! উনার মাথায় কি চলছে তা শুধু উনিই জানেন। কিচ্ছুক্ষন চুপ থেকে মুচকি হাসলেন রেয়ান। দিহানের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন….
— ডক্টরদের কাজই তো রোগীদের সুস্থ করা। পৃথিবীর সব মানুষকে সুস্থ রাখা। তবে একটা কথা জানেন কি মিস্টার, অন্যের পৃথিবীতে হাত দিলে কিন্তু হাত কাঁটা পরে যায়। তাই একটু সাবধানে থাকবেন।
কথাটা শুনে জোড়ে জোড়ে হেসে দিলো আবদ্ধ। রেয়ানের কথার অর্থ বুঝতে পেরেছে সে। তবে দিহান মোটেও তা পারে নি। রেয়ানের কথাগুলো কিভাবে যে তার মাথার উপর দিয়ে চলে গেছে। সে টেরই পায় নি! তাই না বুঝে আবদ্ধের মতো সেও হাসলো। দিহানের বোকামো দেখে এবার আমারও হাসি চলে এলো। তবে হাসলাম না। আড়চোখে আবার তাকালাম রেয়ানের দিকে। সাথে সাথে চোখ টিপ দিলেন রেয়ান। চোখ সরিয়ে নিলাম আমি। মনে মনে বললাম “অসভ্য”।
রেয়ান আবদ্ধের সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে দীঘিকে উদ্দেশ্য করে আবদ্ধকে বলল….
— উনি কে আবদ্ধ?এনি ওয়ান স্পেসাল?
— হুম! দুধ ভাত বউ আমার।
কথাটা শুনে তিন জন ছেলেই “হো হো” হেসে দিলো। ঘর কাপানো হাসি যাকে বলে। এতে বেশ লজ্জা পেল দীঘি। লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে সে।মাথা নিচু করে বিড়বিড় করে শুধু বলল….
— সব ছেলেই একই রকম।অসভ্য!
গল্প করার মাঝে মামী এসে গেলেন নাস্তা নিয়ে। তখন বাজে প্রায় সাড়ে নয়’টা। বসে গল্প করা দেখছি আর মামীর হাতে নাস্তা খাচ্ছি মাত্র। হঠাৎ দিহান আমাকে বলে উঠে….
— তোমাকে তো বলেছি আমি আজকে ভার্সিটি যাবো না। সারাদিন ঘরেই থাকবো। একটা কাজ করি আজকে বিকেলে আমরা দু’জন মিলে পার্কে ঘুরতে যাই।কি বলো?
চোখ-মুখ শক্ত করে ফেললেন রেয়ান। আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই মামী বলে উঠলেন….
— তাহলে তো ভালোই হবে। মেয়েটার মনটা একটু ফ্রেস হবে। তুই আর মানা করিস না মিরা। দিহানের সাথে ঘুরে আসিস পার্কে।আবদ্ধ তুই আর দীঘিও যাইস ওদের সাথে।
সাথে সাথে আবদ্ধের উত্তর….
— না মা।আসলে দীঘির স্কুল আছে।তাছাড়া স্কুল ছুটির পর ওকে একটু ওর বাসায় নিয়ে যাবো।
মুখ একটু মলিন হলো মামীর। পরক্ষনেই কিছু বলবেন তখনই দিহান দাঁড়িতে যায়।আর বলে….
— সমস্যা নেই আন্টি। আমি আর মিরু যেতে পারবো।আপনি চিন্তা করবেন না। আচ্ছা আন্টি এখন আমি যাই। আমার একটু কাজ আছে।
সবাইকে বিদায় জানিয়ে দিহান দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যায় বাসা থেকে। দিহান যেতেই এবার রেয়ানও উঠে দাঁড়ান।মুখে হাসি নিয়ে বলে উঠেন…..
— তাহলে আমিও আসি আন্টি। পরে দেখা হবে।
— এ কি? তুমি না এখন এলে, এখনই চলে যাবে?
— আসলে হাসপাতালে কাজ আছে। আমি তো শুধু মিরাকে দেখতে আসলাম৷ ঠিক আছে নাকি তাই। দেখা শেষ এখন চলে যাচ্ছি।
— কিন্তু…
— আন্টি আমি কালকে আসবো তো।
— আচ্ছা। কিন্তু কালকে বেশি সময়ের জন্য আসবে ঠিকাছে।
রেয়ান শুধু হাসলেন।তারপর চলে গেলেন নিজ গন্তব্যে। রেয়ান যাওয়ার প্রায় ৫মিনিট পর ফোনের টুংটাং বেজে উঠে। ফোন হাতে নিয়ে দেখি রেয়ানের মেসেজ।যাতে লিখা…..
.
.
“আমাকে দেখতে যতটা ভালো মনে হয়, আমি কিন্তু তার চেয়েও দ্বীগুণ খারাপ। খবরদার ছেলেটার সাথে বাইরে বের হবে না। নাহলে বুঝোই তো তোমাকে মেরে ফেলতে যেখানে আমার হাত কাঁপবে না সেখানে তোমার পা ভেঙ্গে তোমাকে বাসায় বসিয়ে রাখতেও আমার সমস্যা হবে না নিশ্চয়ই। এন্ড ওয়ান মর থিংক, ছেলেটা তোমাকে মিরু মিরু ডাকছিল তাই না? এখন এটার শাস্তি তো ছেলেটার পেতেই হয়। বাট এখন না। সময় আসলে সুদে আসলে সব ফেরত নিবো ওই ছেলেটার থেকে। জাস্ট ওয়েট মরুভূমি!”
.
.
মেসেজটা পড়তেই কয়েকটা শুকনো ঢোক গিললাম আমি। মনে মনে বললাম…”এটা কি ধরণের থ্রেট??”
৩.
দীঘিকে স্কুলে দিয়ে এসেই আবদ্ধ আমার রুমে আসে। উদ্দেশ্য গল্প করবে! রুমে ঢুকে বিছানায় আমার পাশে বসে পরে সে। হাসি হাসি মুখে বলে উঠে….
— মিরাপু! আবার ভার্সিটি যাওয়ার সিধান্ত নিয়ে অনেক ভালো করেছো।
হাসলাম আমি আর বললাম….
— তোর পড়ালেখার খবর কি।
সাথে সাথে মুখ মলিন হয়ে গেল আবদ্ধের। ধীর কণ্ঠে বলল….
— আসলে আমি পড়ালেখা ছেঁড়ে দিয়েছি আপু!
হতবাক আমি!ছেলে বলে কি? রাগ হলো আমার।কঠিন কণ্ঠে তাকে বললাম….
— পড়ালেখা ছেঁড়ে দিয়েছিস মানে?কেন?
আবদ্ধ কিছুক্ষন চুপ রইল।বড় একটা নিশ্বাস নিয়ে বলে উঠল….
— তুমি তো জানো আমাদের বিজিনেস অনেক বড়।বাবা যাওয়ার পর তো খালুই সেটা সামলাতেন।আমরা দু’জন তো শুধু তাকে টুকটাক সাহায্য করতাম মাত্র।কিন্তু যখন তোমাদের এক্সিডেন্ট হয় তখন খালা খালু মারা যান।তুমিও মানোসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পরো। বিজনেস সামলানোর কেউ ছিল না। আমি সিধান্ত নিলাম পড়াশোনার পাশাপাশি বিজনেসও হেন্ডেল করব।কিন্তু সব এত সহজ ছিল না। বিজনেসের দিন দিন লসই হচ্ছিল।তার উপর লোন ছিল অনেক।কিভাবে কি করব বুঝতে পারছিলাম না।একটা চাকরির খুব প্রয়োজন ছিল। খালুর পরিচিত একজন আমাকে বলে সে আমাকে চাকরি দিবে।ভালো সেলারি পাবো!আমিও রাজি হয়ে গেলাম।কিন্তু এসবের মধ্যে পড়ালেখা কন্টিনিউ করা সম্ভব ছিল না।এমনও দিন ছিল যে লজ্জায় আমি বলতে পারতাম না ওই কোম্পানিটা আমার।আমি ওখানের মালিক।বুঝতেই পারছো কতটা বাজে অবস্থা ছিল বিজিনেসের।এমন কি দীঘিকে যখন আমি আমার সম্পর্কে বলেছিলাম তখন এটা বলতে পারিনি যে আমি একজন বিজনেস ম্যান।বরং বলতে হয়েছিল ভালো চাকরি করি।কারন টা ছিল এটা যে, আমাদের কোম্পানিটা আর কয়েকদিন পরই নিলাম হয়ে যেত। আমি তো ভালো ভাবে বিজনেস চালাতে পারি না।তারওপর আমার সাথে অন্য কেউও নেই যে বিজনেসটা সামলাবে। তাহলে আমাদের কাছে শুধু শুধু কেন কোম্পানিটা রাখা হবে।আমি তো ভেবেছিলাম কোম্পানিটা নিলাম হয়েই যাবে।কিন্তু হয়েছে কি জানো মিরাপু, কোম্পানির হঠাৎ-ই প্রফেট হওয়া শুরু হয়।অনেকগুলো প্রোজেক্ট এর অফার আসে।এখন ভালোই আছি।কাজের চাপ থাকলেও খুশি আছি।তবে একটা কিছুর জন্য আমি এখনও অনুতপ্ত।আমি দীঘিকে অনেক মিথ্যা কথা বলেছি আপু। প্রথমে চাকরির কথা আর পরে পড়ালেখার কথা।আমি মাত্র ইন্টার পাশ।অনার্সে উঠার পরও ঠিকাঠাক ভাবে ক্লাস করি নি।এখন তো পড়ালেখাও করি না।আমার ভয় হয় ও যদি আমার পড়ালেখার যোগ্যতা দেখে আমাকে রেখে চলে যায়।তাই মিথ্যা বলেছি, যে আমি হায়ার এযুকেডেট।মিথ্যা বলে আমি অনেক খারাপ করেছি তাই না মিরাপু?
বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো আবদ্ধ।তার চোখে পানি স্পষ্ট। হঠাৎ করে মনে হলো ছেলেটা বড় হয়ে গেছে।আবদ্ধ আর আমার বয়সের পার্থক্য বেশি না।আমি যখন অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে, তখন আবদ্ধ মাত্র ইন্টার থেকে অনার্সে উঠেছে।হাতে গোনা কয়েকদিন ক্লাস করেছে সে।এর মধ্যে কতই না ঝড়ের সম্মুখীন হতে হয়েছে ছেলেটাকে।রেয়ান ঠিকই বলেছেন, এভাবে বন্দী থেকে আমি নিজেকে কষ্ট দেওয়ার পাশাপাশি আপনজনদেরও কষ্ট দিয়েছি।বাবা-মা মারা যাওয়ার পর যদি নিজেকে একটু সামলে নিতাম।আবদ্ধের সাথে যদি বিজনেসটা একটু দেখতাম, তাহলে হয়তো ছেলেটার পড়ালেখা বন্ধ করতে হতো না।ভাবতেই বুকের ভেতর একটা কষ্ট অনুভব হলো। কিন্তু এখন কষ্ট পেলে হবে না।আবদ্ধকে ভরসা দিতে হবে।আলতো করে আবদ্ধের হাতে হাত রাখলাম।ভরসা ভরা কণ্ঠে বললাম….
— চিন্তা করিস না ভাই সব ঠিক হয়ে যাবে।দু’জনে মিলে বিজমেসটা দেখবো।তুই চাকরিটা ছেঁড়ে দে।পড়ালেখা আবার শুরু কর।দীঘিকেও সব খুলে বল।দেখিস ও ফিরিয়ে দিবে না তোকে।পিচ্চিটার চোখে তোর জন্য ভালোবাসা দেখেছি আমি।
চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আবদ্ধর।আমার দিকে তাকিয়ে মনে মনে হাজার বার বলতে লাগলো…”সব ঠিক হয়ে যাবে!”
ভাই-বোন দু’জনে অনেক গল্প করলাম।গল্প করতে করতে প্রায় বিকেল হয়ে গেল। আবদ্ধ চলে গেল দীঘির স্কুলে। এদিকে আমাকে দিহান পাগল করে দিচ্ছে সে নাকি এখন পার্কে। আমাকে রেডি হয়ে আসতে বলছে।সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে আমিও রেডি হয়ে পড়ি।রেয়ানের থ্রেটের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম।কিন্তু তা আমাকে মনে করিয়ে দেয় রেয়ানের মেসেজ! রেডি হয়ে বাইরে আসতেই রেয়ানের মেসেজ আসে আমার কাছে। যেথায় লিখা…”ইউ আর গোন মাই লেডি!”
লিখাটা বারবার পড়লাম।কিন্তু এর সঠিক অর্থ বুঝতে পারলাম না।কি বুঝাতে চাচ্ছেন রেয়ান?
.
.
#চলবে🍁