পরিণয়ে পরিণতি

পরিণয়ে পরিণতি !! Part- 19

তারেক একটু রাগান্বিত চেহেরা নিয়ে রাহির কাছে এসে,,
— তুমি এখানে কি করছ??
— তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।
— আমি কি তোমাকে আসতে বলেছি।
— তুমি কেন এমন করছ তারেক?? আমি কি করেছি বলবা??
— দেখ রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিনক্রিয়েট করবা না আমার কলিগরা আসেপাশে আছে। শুনলে আমার মান সম্মান যাবে।
— আমার সম্মানের কথা তো ভাবছ না। তোমাকে আমার কিছু বলার আছে।
— যা বলার তাড়াতাড়ি বলো।
— আজ তোমার খুব তাড়া তাই না। ভুলে যেও না আমি তোমার বউ।
— এখন এসব শুনার টাইম নাই যা বলার দ্রুত বলো। বাসায় আমার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে।
— শুনার টাইম নাই বললে তো হলো না। কি অপরাধের শাস্তি দিচ্ছ আমায়?? কল দিলে ধর না। এভোয়েড করছ। কি করেছি আমি??
— রাহি অযাথাই কথা বাড়াইও না। আমার এখন আগের মত সময় নেই। আমি তো তোমার মত ফ্রি না। কি হয়েছে যে অফিসের সামনে চলে এসেছ??
— আমি তোমার সন্তানের মা হতে যাচ্ছি।
— কিইইইই!! তুমি কি পাগল!! আমি এখন সন্তান চাই না। আমার পরিবার জানে না আমি বিয়ে করেছি।
— জানেনা এখন জানাবা। আমাকে ঘরে তুলে নাও। আম্মুকে বল আমার বাসায় আসতে।।
— দেখো রাহি আমার পক্ষে সম্ভব না। তোমাকে টাকা দিয়ে দিব এবোরেশন করে নিও।
— তারেক কি বলছ তুমি। আমাদের সন্তান ও আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন!
— রাহি আবেগ দিয়ে জীবন চলে না। আমি এসবের জন্য প্রস্তুত না। তুমি এখন যাও আমি ভেবে দেখব।
— তারেক যেও না প্লিজ আমার কথা শুনো প্লিজ। আমি এখন কি করব। আমার সাথে এমন করিও না।
রাহি কান্না করে যাচ্ছে। এ মুহুর্তে কি করবে কিচ্ছু মাথায় ঢুকছেনা। সেদিন খুব ভুল হয় গেছে। বিয়ের কাবিননামার এক কপি নিজের কাছে রাখা দরকার ছিলো। আজ রাহির কাছে বিয়ের প্রমাণ বলতে কয়েক টা ছবি ছাড়া আর কিছুই নেই।
রাহি তারেকের আচরণে বুঝতে পারছে তারেক এ সম্পর্ক নিয়ে আর আগাতে চায় না। কিন্তু সমস্যা টা কোথায় সেটা ধরতে পারছে না। হঠাৎ কি এমন হলো যে তারেকের এতটা পরিবর্তন!!
তাহলে কি সম্পর্ক পুরান হয়ে গেলে ভালোবাসা ও পুরান হয়ে যায়৷ এইতো সেদিন খুব একান্তে সময় কাটিয়েছিলো । তারেক কত যত্নে আদর সোহাগে ভরিয়ে দিয়েছে। ওর প্রতিটি স্পর্শ আমার ভিতর ছুঁয়ে গেছে। এগুলো কি মিথ্যা ছিলো!! শুধু কি শারিরীক চাহিদা! আর কিচ্ছু না??
রাহি বাসায় গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে আছে। মুনতাহার শাশুড়ী ভিতরে ভিতরে পুড়ে যাচ্ছেন। লক্ষ্য করেছেন ইদানীং রাহির আচরণ কেমন জানি হয়ে গেছে। সারাক্ষণ আনমনা হয়ে থাকে। লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে।বুঝতে পারছে মেয়ের কিছু একটা হয়েছে। ভয়ে আছেন আবার নতুন কোন ধাক্কা অপেক্ষা করছে নাতো!!
সন্তানের কষ্ট হলে মা বোধয় সবার আগে বুঝে যায় এজন্য বলে নাড়ীর টান। মেয়ে বড় হলে সব মায়েদের ক্রমশ চিন্তা বাড়তে থাকে। রাহি যদি এ বয়সে কোন ভুল করে ফেলে তাহলে যে মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যাবে। মেয়েদের সম্মান একবার নষ্ট হলে সারাজীবন চেষ্টা করেও সেটা ফিরিয়ে আনা যায় না।
আমাদের সমাজে ছেলেরা হাজার ভুল করলেও তাদের গায়ে কোন দাগ পড়ে না। কিন্তু মেয়েদের গায়ে একবার দাগ লাগলে হাজার চেষ্টা করেও মুছা যায় না।
রাহির মাথায় হাত দিয়ে চোখের জল মুছে রাহির মা জিজ্ঞেস করছে,,
— মারে তোর কি হয়েছে সারাদিন মনমরা হয়ে থাকিস। তোর ভাই ও আমার সাথে কথা বলে না। তুই ও সারাক্ষণ রুমে পড়ে থাকিস আমাকে বল না তোর কি কোন সমস্যা হইছে??
মা কিছু বুঝে গেলো নাতো!! ভাইয়া কে নিয়ে এমনি অনেক কষ্টে আছে তার মধ্যে আমার কথা শুনলে মরে যাবে।
— কিছুই না মা, সামনে ফাইনাল পরীক্ষা তাই টেনশনে আছি। তুমি ভেবো না আমি ঠিক আছি।
— সত্যি বলছিস আমাকে??
আমি কি করে বলব মা আমি ভালো নেই। আমার যে সব শেষ হয়ে গেলো। আমি যে কাউকে মুখ দেখাতে পারব না।
রাহি মুখ ফিরিয়ে চোখ মুছে,,
— হুম মা সত্যি বলছি তুমি যাও আমাকে সকালে ভার্সিটি যেতে হবে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে হবে।
রাহি দরজা বন্ধ করে বালিশে মুখ চাপা দিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। চোখ মুছে কিছুক্ষণ পর পর মোবাইল হাতে নিয়ে তারেক কে কল করছে। না কল ধরছে না কেটে দিয়ে মোবাইল অফ করে দিয়েছে। রাহির ইচ্ছে করছে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করতে। রাগের মাথায় ওয়ালে কিছক্ষণ বাড়ি দিলো।
মাথার যন্ত্রণা বুকের চাপানো কষ্টের কাছে কিচ্ছু না। এ কষ্টের যে কোন ঔষধ নেই।।
.
.
অবন্তিকা বাসায় যাওয়ার পর সবাই এক এক করে এসে জিজ্ঞেস করছে অবন্তিকা একা কেন সাইমুন কোথায়!! বিয়ের পর সাধারণত মেয়েরা প্রথমবার জামাই নিয়ে বেড়াতে আসে। অবন্তিকা হাতে মস্ত বড়ো ব্যাগ দেখে অবন্তিকার ভাবি সামিহা বলে উঠলো,,
— অবন্তিকা সাইমুন ভাই আসেনি কেন?? কখন আসবে??
— আসবেনা।
— জামাই ছাড়া আমার ননদিনী এতদিন থাকবে কি করে।
অবন্তিকার বাবা চিৎকার করে,,
ওরা জানেনা কাকে ঠকিয়েছে। রেজাউল করিম কি জিনিস এবার ওরা বুঝবে। আমার মেয়ের জীবন নষ্ট করার মাশুল ওদের দিতেই হবে। এত বড় বেইমানী আমার সাথে !!
সামিহা রীতিমতো অবাক। মেয়েকে দেখতে গিয়ে কি এমন হলো এভাবে রেগে গেছে। মেয়ের শুশুর বাড়ি যাবে বলে কাল থেকে কত আয়োজন করেছে। সকালে হাসিখুশি গেলো কিন্তু দুপুর গড়ানোর আগে চলে এসেছে। সামিহা ভয়ে ভয়ে শুশুর কে জিজ্ঞেস করছে,,
— বাবা কি হয়েছে আপনি এভাবে রেগে আছেন কেন?? আপনি এভাবে রাগ করলে শরীর খারাপ হবে।
— রেগে থাকব না!! সাইমুনের আগের বউ পালিয়ে যায়নি বিয়ের সময় তখনও ঘরে ছিলো। ডিভোর্স ও হয়নি ওদের মাঝে আমাদের সবকথা লুকিয়েছে।
— তাহলে অবন্তিকা কে বিয়ে করেছে কেন??
— ভেবেছে ছেলের বউ এর সমস্যার জন্য নাতি নাতনীর মুখ দেখছে না তাই। এখন শুনছি সাইমুনের সমস্যা বউয়ের কোন সমস্যা ছিলো না। সাইমুন কেনদিন বাবা হতে পারবে না। এরকম একটা ছেলের কাছে আমার মেয়েকে রেখে আসব৷ আমার মেয়ে কি পঁচে গেছে। এরকম ১০ টা বিয়ে ভেঙ্গে গেলেও রেজাউল করিমের মেয়ের জন্য ছেলের অভাব হবে না।
অবন্তিকার খুব রাগ হচ্ছে। নিজে যে মিথ্যা বলছে সেটার জন্য অনুতপ্ত না। ওরা মিথ্যা বলেছে সেটা নিয়ে যত মাথা ব্যাথা। বাবার সামনে গিয়ে,,
— আমি আগেও বলেছি তুমিও কিন্তু মিথ্যা বলেছিলে।আমার যে আগে বিয়ে হয়েছে সেটাও কিন্তু ওদের লুকিয়েছ। তুমি ওদের দোষ দেখছ নিজের টা কেন দেখছ না?? এখন ও বুঝতে পারছ না যে যেমন করে তার সাথে সেটাই হয়। যদি আমাকে ভালোবেসে থাকো এ ব্যাপার টা এখানে শেষ করবে।
— হুম আমার ভুল হয়েছে। তাড়াহুড়ো করে বিয়ে দেয়া ঠিক হয়নি। আরেকটু খবর নেয়ার দরকার ছিলো। মা তুই চিন্তা করিস না আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডিভোর্স এর ব্যাবস্থা করব।
সামিহা শুশুর কে আশ্বাস দিয়ে বলছে,,
— যা হয়েছে বাবা ভালোর জন্য হয়েছে। অবন্তিকার জন্য ভালো কিছু অপেক্ষা করছে।
অবন্তিকার রুমে গিয়ে ভীষণ খুশি লাগছে। মিথ্যা বন্ধন থেকে মুক্তি পেয়েছে। আহানাফ কে পেতে আর কোন বাঁধা রইলো না।
শুধু সুযোগ বুঝে বাবা কে বুঝাতে হবে আহানাফ ওর জন্য ঠিক ছিলো। আহানাফের সাথেই কেবল ওর সুখ লিখা আছে। আহানাফ ওকে সুখে রাখবে সারাজীবন।
আসার পরে আহানাফ কে কল দেয়া হয়নি। ওকে বলতে হবে আমি চলে এসেছিন উফফ আমি এত এক্সাইটেড ইচ্ছে করছে এখনি উড়ে চলে যেতে।
অবন্তিকা আহানাফ কল দিয়ে খুশিতে কথা বলতে পারছে না।
— আহানাফ আজ আমি….আজ আমি…
— বলনা অবন্তি কি হয়েছে।
— আমি বাবার বাসায় চলে এসেছি। আজ থেকে আমি মুক্ত। কোন মিথ্যে সম্পর্কে আমি আর নেই।
— সত্যি!!
— হুম সত্যি। আমরা দুজন খুব শীগ্রই নিজেদের আপন করে পাবো।
— আমি জানতাম অবন্তী আমার অপেক্ষা মিথ্যে হতে পারে না। বিশ্বাস ছিলো আমার হারানো ভালোবাসা, আমার অবন্তী কে ঠিক ফিরে পাব।
— খুব কষ্ট হয়েছে আমাকে ছাড়া থাকতে তাই না।
— হুম খুব… অক্সিজেনের অভাব হলে যেভাবে মানুষ ছটপট করে আমার অবস্থা সেটাই ছিলো।
— আমিও তোমাকে প্রতিটি মুহুর্তে মিস করেছি। শুধু দিন গুণেছি কখন তোমাকে কাছে পাওয়ার সময় আসবে।
অবন্তিকা আহানাফের কথা শেষ হবার নয়। দুজন যেন এতদিন খাঁচায় বন্দী ছিলো আজ তারা মুক্ত হয়ে নিজেদের আকাশে বিচরণ করছে…
.
.
মুনতাহা ডিভোর্স লেটার রেডি করে এসে মা কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে যাচ্ছে,,
— মাগো আমি তো এটা চাইনি । আমি তো ওর সাথে সুখে হতে চেয়েছি। কেন ভালোবাসার কাছে এভাবে হেরে গেলাম বলতে পারো মা। আমার যে বুক টা ছিড়ে যাচ্ছে আমি যে আর নিতে পারছিনা
— তুই কাঁদ যতখুশি কেঁদে নে। এ কান্না যেন তোর জীবনের শেষ কান্না হয়। আর যেন তোকে কোনদিন কাঁদতে না হয়।
— মা…….মা….
কেন ভালোবাসার এত কষ্ট!!
— তুই আবার সুখী হবি। মায়ের কথা মিলিয়ে নিস।
— আমি পারবো না মা আর কাউকে বিশ্বাস করতে। আমার ভিতর টা পুড়ে গেছেন আমি বেঁচে আছি ঠিকি আমার যে নিঃশ্বাস নিতে বড্ড কষ্ট হয়। এ দুনিয়ার মানুষ গুলো স্বার্থপর কারো মনের কথা বুঝার সময় নেই।
.
.
ভালোবাসার মানুষ কে সারাজীবনের মত পর করার কষ্ট ভয়াবহ। বিচ্ছেদ তো কাগজে কলমে হয় কিন্তু মনের বিচ্ছেদ সত্যি কি হয়!! চাইলে কি ভালোবাসার মানুষের স্মৃতি গুলো এত সহজে মুছে ফেলা যায়।
সত্যিকারের ভালোবাসায় কি মনের মাঝে অবশিষ্ট কিছু থাকে?? হয়ত থাকে হয়ত না। কারো কারো জীবনে হয়ত ভালোবাসার রং দ্বিতীয় বার আসে। জিবনের হিসাব মিলানো বড়ই জটিল।।
.
.
অনেকদিন পরে মায়ের কান্না দেখে সাইমুন অফিসে যেতে রাজি হয়েছে। নিজেকে ব্যাস্ত রাখলে কষ্ট যদি কিছুটা কম হয় সেটা ভেবে সাইমুন অফিসের জন্য রেডি হচ্ছে।
কলিং বেল এর আওয়াজ শুনে দরজা খুলে দেখে অপরিচিত কেউ একজন সাইমুন কে খুঁজছে। সাইমুনের নামে একটা খাম এসেছে….
….চলবে….