আলোছায়া

আলোছায়া !! Part- 03

রাতে ঘুম না হওয়ায় মানসিক উত্তেজনা বৃদ্ধির পাশাপাশি শরীরের ভেতরটা ম্যাজম্যাজ করায় লাঞ্চ আওয়ারে বাসায় ফেরার সিদ্ধান্ত নিল মুবিন। তবে লেনদেনের হিসেবে খানিকটা ত্রুটি হওয়ায় সে সিদ্ধান্ত বাতিল করে চেয়ারে শরীর এলিয়ে চোখজোড়া বুজে রইলো খানিকক্ষণ। ইদানীং ব্যস্ত সময় কাটাতে কাটাতে বেশ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে সে। সাথে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে তার অনুভূতিহীন হৃদয়টাও। এখন আর কোনোকিছুতেই থেমে থাকতে ইচ্ছে হয়না তার। দু’দন্ড আরামের জন্য মিথ্যা অযুহাত খোঁজে না.. রাতের আধারে করে না ভালোবাসার জগতে বিচরণ। ব্যস্ত এই নগরীতে বা নির্জন কোনো পল্লীতে আর খোঁজে না ভালোবাসা..
ফোনে আসা কলের রিংটোনের শব্দ মস্তিষ্ক অব্দি পৌঁছাতেই হালকা মাথা নেড়ে চোখজোড়া মেললো মুবিন। হাত বাড়িয়ে ফোন উঠিয়ে কানে নিতেই ওপাশ থেকে এলো পুষ্পর গলার স্বর।
“ওয়েটিং রুমের দিকটায় একটু আসবেন?”
কপাল কোঁচকালো মুবিন।
“কেনো?”
“আসুন প্লিজ!”
দরজা ঠেলে মুবিন প্রবেশ করতেই মৃদু হেসে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো পুষ্প। কয়েক কদম এগিয়ে যাবার জন্য পা বাড়াতেই তাকে থামার ইশারা করে নিজেই অগ্রসর হলো মুবিন। চোখেমুখে একরাশ বিস্ময় নিয়ে বললো,
“আপনি এখানে?”
“আপনাদের ব্যাংক থেকে লোন নিতে এলাম..”
“লোন?”
“কেনো? নিতে পারিনা?”
জবাব দিল না মুবিন। একদন্ড ভেবে সে বললো,
“এই দুপুরে?”
“হ্যাঁ.. দুপুরের দিকটায় শুনেছিলাম ব্যাংকে ভিড়ভাট্টা কম থাকে। তাই ভেবে চিন্তে এই সময়টাকেই বেছে নিলাম। তা আপনার লাঞ্চ হয়েছে?”
“না..”
“তবে চলুন একসাথেই করি। আমিও কিছু না খেয়েই বেরিয়েছি।”
রায়হানকে বলে ব্যাংক থেকে বেরিয়ে পাশের একটি রেস্টুরেন্টে পুষ্পকে নিয়ে বসলো মুবিন। ওয়েটারকে ডেকে নিজের পছন্দসই খাবার অর্ডার করে ঘাড় উঁচিয়ে বসে কেশে উঠতেই পাশ থেকে পুষ্প বললো,
“মেসবাহ ভাইয়া আজ বাবাকে কল করেছিল।”
“কেনো?”
“আপনার বাবা কাল আমাকে আংটি পড়াতে আসতে চাচ্ছেন। সে নিয়ে কথা বলতে..”
“অহ..”
ঝিমিয়ে পড়লো মুবিন।
পুষ্প বললো,
“আপনি এব্যাপারে কিছু জানেন না?”
ভারী গলায় মুবিন বললো,
“জানি।”
“মিথ্যা বলছেন?”
“না..”
ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে নড়েচড়ে বসলো পুষ্প। হাত ঘড়িতে সময় দেখে স্বাভাবিক স্বরেই বললো,
“একটা প্রশ্ন করি?”
“করুন.. তবে বাচ্চাদের প্রশ্নগুলোই করুন।”
“সেইফ সাইডে থাকতে চাইছেন?”
ম্লান হাসলো মুবিন।
“আপনি মেসবাহ ভাইয়াদের সাথে না থেকে আলাদাভাবে কেনো থাকেন?”
“অন্যের সংসারে গিয়ে ঝামেলা বাড়াতে চাইনা বলে..”
উদ্বেগসূচক কন্ঠে পুষ্প বললো,
“ঝামেলা কেনো বলছেন?”
“নিজের কাছে ঝামেলা লাগলে তাকে ঝামেলার বিপরীত নাম দিতে পারি না!”
“নিজের কাছেই বা ঝামেলা কেনো লাগবে? ভাবি কিছু বলেছে?”
“না.. ছোট ভাবি ওমন মনের মানুষ নয়।”
“তবে?”
লম্বা একটি দম ছাড়লো মুবিন।
“আমার মতে উনি উনার দায়দায়িত্বর তুলনায় বেশ ছোট। তাই আর তার ঘাড়ে নিজেকে চাপিয়ে দায়িত্ব বাড়াতে চাই না।”
ভ্রু কোঁচকালো পুষ্প। ক্ষীণ স্বরে বললো,
“বিয়ের পর? বন্ধুদের সাথে মিলে সেই ফ্ল্যাটেই থাকবেন? নাকি নতুন বাসা নেবেন?”
“ভাবিনি..”
“তবে কি ওয়াইফকে গ্রামে রাখার চিন্তা আপনার?”
“তার ইচ্ছে.. সে থাকতে চাইলে থাকবে। না চাইলে নয়। আমার দিক থেকে কোনো প্রকারের চাপ নেই।”
“কিন্তু আপনার একটা মতামত থাকা উচিৎ। কারণ বিয়ের পর আপনি আর সে তো আলাদা নন। কিছুটা দুই দেহ এক মন টাইপের.. শোনেনটি কথাটি?
“দুটি মনের সংযোগ ঘটানো কি খুব সহজ?”
বিরবির করে আওড়ালো মুবিন।
ভ্রু কুঁচকে পুষ্প বললো,
“কিছু বললেন?”
মাথা ঝাকালো মুবিন।
প্রসঙ্গ টানতে পুষ্প বললো,
“প্রেম করেছেন কখনো?”
“না..”
“সত্যিই? আমি কিন্তু করেছি.. ছেলেটা ছিল আমার মামাতো ভাই। ভেবেছি আমাদের বিয়ে ঠিকঠাক হলে আমি ওকে ওর বউসহ ইনভাইট করবো। আপনার কোনো সমস্যা হবে না তো?”
“না..”
চোখমুখে হাসির ঢেউ ছড়িয়ে পড়তেই উচ্ছাসিত কণ্ঠে পুষ্প বললো,
“শালাটা বড্ড জ্বালিয়েছে আমায়। জ্বালাতে জ্বালাতে বুকের ভেতরটা ছাইছাই করে দিয়েছে। আমি কী ভেবেছি জানেন? ও আমায় যতগুলো বই গিফট করেছে সবগুলো বই আমাদের বাসর রাতে জ্বালিয়ে ফেলবো।”
বুকের ভেতরটা হঠাৎ কেঁপে উঠলো মুবিনের। ঢোক চেপে সে ক্ষীণ স্বরে বললো,
“বই পড়তে ভালোবাসেন আপনি?”
“খুব.. এই আপনি বললেন না তো! আপনি কেনো প্রেম করেননি? কাওকে ভালোলাগেনি কখনো?”
বুকচিরে গভীর এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে থেমে থেমে মুবিন বললো,
“ভালোবাসাটা একধরনের প্রতিজ্ঞা। আর আমি তোমায় ভালোবাসি হচ্ছে প্রতিজ্ঞাবাক্য। হয়তো আমার মেরুদণ্ড নেই, প্রতিজ্ঞা রক্ষার মতো নেই সেই সাহস।”
দুটো ক্লাস শেষে রুমাকে নিয়ে বেরিয়েছিল উল্লাসী। তবে কোচিংয়ের সামনের দিকটায় ভিড় থাকায় আবারও ক্লাসে ফেরার উদ্দেশ্যে করিডোরে আসতেই জাভেদ থামিয়ে দিল তাদের। খানিকটা দুরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে সে উল্লাসীর উদ্দেশ্যে বললো,
“চুল বেঁধে এসেছো কেনো?”
রুমার দিকে চেয়ে ঢোক গিললো উল্লাসী। ক্ষীণ স্বরে তাকে বললো,
“তুমি ক্লাসে যাও.. আমি আসছি।”
রুমা স্থান ত্যাগ করতেই ভ্রু কোঁচকালো উল্লাসী। গলার স্বরে খানিকটা বিরক্তি ফুটিয়ে বললো,
“আপনি এমন কথা প্লিজ বলবেন না.. শুনতে বাজে লাগে।”
“বাজে লাগে? সত্যিই বলো বাজে লাগে?”
“লাগে..”
“মিথ্যা বলছো..”
“মিথ্যা কেনো বলবো বলুন! তাছাড়া..”
উল্লাসীকে থামিয়ে ম্লান হেসে জাভেদ বললো,
“তাছাড়া কী?”
“আপনি আইয়ুব ভাইয়ার কাছ থেকে অবশ্যই শুনেছেন আমি ম্যারিড। আমার একটা বাচ্চাও আছে।”
“তো? তাই বলে কি আমি তোমার সাথে কথা বলতেও পারবো না?”
অস্বস্তিতে পড়ে গেল উল্লাসী। লোকটি তাকে সরাসরি কিছু বলেনি। তবে যা বলেছে তাতে জবান স্পষ্ট না হলেও উদ্দেশ্য বেশ স্পষ্ট।
উল্লাসীকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খানিকটা এগিয়ে এল জাভেদ। গলার স্বরে কোমল ভাব এনে বললো,
“একটা প্রশ্নের উত্তর দেবে?”
মেঝের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে জাভেদের দিলে দিল উল্লাসী। চোখমুখে উদ্বেগ প্রকাশ করে বললো,
“কী প্রশ্ন?”
“তোমার বিয়েটা কি তোমার মতে হয়েছিল?”
“যেভাবেই হোক আমি আমার স্বামীকে ভালোবাসি।”
একমুহূর্ত থেমে জবাব দিল উল্লাসী।
জাভেদ মাথা নেড়ে বললো,
“উহু.. তুমি যাকে ভালোবাসা বলছো সেটি আসলে ভালোবাসা নয়। সেটা স্যাকরিফাইস, সেটা রিকোয়ারমেন্টস। তুমি মানো আর নাই মানো তুমি প্রয়োজনের তাগিদে উনার সাথে আছো। তেমনটি উনিও.. সে কখনো তোমায় ভালোবেসে দুটো কথা বলেছে? তার মনের ভেতরের দুঃখ বা আনন্দ তোমাকে পাশে বসিয়ে তোমার সাথে শেয়ার করেছে? কিংবা তোমার রূপের প্রসংশা করেছে? কখনো কি উনি বলেছেন উল্লাসী তোমায় সবুজ রঙে বেশ সুন্দর লাগে? বলেছে? কখনোই না.. তুমি আজ কোন রঙের জামা পরে বেরিয়েছো সেটিও তার জানা নেই। কারণ উনি হয়তো এসব জিনিস খেয়ালই করেনা। আর তুমি কিনা তাকেই ভালোবাসার নাম দিয়ে বেড়াচ্ছো! হাসালে উল্লাসী! আসলে তুমি মানো আর নাই মানো মনের মিল বলতেও তো একটা কথা আছে তাইনা?”
“মনের মিল নেই কে বলেছে আপনাকে?”
“হাহা.. যেখানে বয়সের মিল নেই সেখানে মনের মিল! দুধের শিশু পেয়েছো আমায়?”
জাভেদ খলখল করে হেসে উঠতেই দাঁতে দাঁত চেপে উল্লাসী বললো,
“আপনি আমার সাথে আর কথা বলার চেষ্টা করবেন না.. একদম নয়।”
দ্রুত পায়ে ক্লাসের দিকে এগুলেও সুমনের ডাকে আবারও করিডোরে থেমে দাঁড়ালো উল্লাসী। নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টায় ম্লান হেসে বললো,
“কালকের পরীক্ষাটা কেনো দাওনি?”
সুমন বললো,
“ওসব রাখো.. একটা কথা শুনলাম তোমায় নিয়ে। সেটা কি সত্যি?”
“কী কথা?”
“তুমি নাকি ম্যারিড?”
পুরো শরীরে কাটা দিয়ে উঠলো উল্লাসীর। মাথার ভেতরটা উঠলো চিনচিন করে। হালকা মাথা নেড়ে ধীর স্বরে সে বললো,
“না..”
“তাহলে যে আইয়ুব স্যার তোমায় ভাবি বলে ডাকে?”
সেপ্রশ্নের কোনো জবাব দিল না উল্লাসী। ক্লাসে ঢুকে নিজের ব্যাগ নিয়ে হন্য পায়ে বেরিয়ে পড়লো।
বাসে উঠে খানিকক্ষণ নীরবে বসে জাভেদের বলা কথাগুলো নিয়ে ভাবলো উল্লাসী। লোকটি কি তাকে কথার জালে ফেলতে চাইছে? নয়তো তার এবং মেসবাহর সম্পর্ক নিয়ে এত যুক্তি কেনো দেখাচ্ছে সে? এটা ভালোবাসা নয়, ওটা ভালোবাসা নয়। সে কি ভালোবাসাবিদ? ভাবনার গভীরে প্রবেশ করলো না উল্লাসী। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে মেসবাহর নাম্বারে ডায়েল করে বললো,
“আপনি কোথায়?”
“ল্যাবএইডে।”
“বাসায় কখন ফিরবেন?”
“নয়টা বাজবে..”
“অহ.. আমি বাসায় যাচ্ছি।”
“কেনো? কিছু হয়েছে? মৈত্রী ঠিক আছে? এই উল্লাসী?”
গভীর এক নিঃশ্বাস ফেলে বিষন্ন স্বরে উল্লাসী বললো,
“হ্যাঁ আছে.. মৈত্রীর কিছু হয়নি। আচ্ছা আমি আজ কোন রঙের জামা পরে বেরিয়েছি বলতে পারবেন?”
একদন্ড চুপ থেকে ওপাশ থেকে মেসবাহ বললো,
“পেশেন্ট এসে পড়েছে উল্লাসী। তুমি বাসায় পৌঁছে আমাকে জানিয়ো। আমি রাখছি।”
(চলবে)