বধুবরন-সিজন-2 ! Part- 15
৪বছর পর,,,,
“-আকাশের নীল সাগরের নীল এখানে মিলেমিশে একাকার।তীরে নৌকা বাঁধা,সারি সারি নারিকেলে বৃক্ষ এই নীল সাগরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা মৃদু মন্দ পবনের স্পর্শ সকল কষ্ট, ক্লান্তি দূর করে দেয়।এখানে দাড়িয়ে আমি ভুলে থাকতে পারি আমার ভালোবাসার মানুষটাকে।( দীর্ঘশ্বাস টেনে বন্ধ চোখে)
“- মাম্মী! মাম্মী! সমুদ্রের বালুচরে দাড়ানো শুভাকে পেছন থেকে দৌড়ে এসে আকড়ে ধরে নুরভি,শৌর্য।বালুচরে হাটুমুড়ে বসে সন্তানদুটোকে দুবাহুর মাঝে জড়িয়ে নেয়।মা পাখি যেমন তার ছোট্ট ছানাদুটোকে আগলে রাখে ডানার আড়ালে।
“- মাম্মী! তোমার মন খারাপ? কে বকেছে? ঐ কেডা বকছে আমার মাম্মীকে
“- আহ! শৌর্য চিল্লাও কেন? কানে লাগে না।কড়কড়ে মোরগছানা।
“- চুপ কর নুনতা নারকেল পানি! মাম্মী এই তিতা নিমকে আমার বোন কেন বানিয়েছ? মনমতো চিল্লাতেও পারি না।উফ!
“- অসহ্য একটা তুই ভাই।
“- তুই অসহ্য টু বোন।টুইন টুইন! নুরভির রাগে লাল হওয়া নাকটা টেনে।
“- মাম্মী!নুরভি হাত পা ছড়িয়ে নাকে কাঁদতে লাগলো। তা দেখে শৌর্য হেসে হাত তালি দিচ্ছে আর ভেঙ্গাচ্ছে। শুভার মনে পড়ে গেল চার বছর আগের কথা।নীলের সাথে শুভাও এমন করতো।শুভার চোখে নোনাজলে ভরে আসলো।মুখে হাত দিয়ে শব্দ করে কাঁদতে লাগলো।মায়ের কান্না দেখে শৌর্য নুরভি ছুটে এসে মায়ের মাথা বুকে নিয়ে স্বান্তনা দিল।
“- কেদো না মাম্মী! বাবায়ের কথা পড়ছে তাই না মাম্মী।বাবাই খুব পঁচা। খুব।
“- না! মা! বাবাই পচা না।বাবাই বেস্ট বাবাই ওয়াল্ডের।
“- না! পঁচা বাবাই।পঁচা বাবাই!নুরভি রেগে বাড়ির দিকে ছুটতে থাকে।
“- নুরভি! দাড়া মা।নুরভি।
“- মাম্মী! তুমি চিন্তা করো না।আমি বোনকে বুঝাবো।বাবাই বেস্ট বাবাই ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড।
“- গুড বয়টা আমার।ছেলের কপালের চুমু দিয়ে জড়িয়ে ধরে।
শৌর্য নুরভির পিছু পিছু দৌড়ে যায়।শুভা ঠাই দাড়িয়ে নিজের কলিজার টুকরো,ভালোবাসার শেষ স্মৃতিটুকু দেখে।বেঁচে থাকার তো এই মাধ্যম টুকুই শুভার আছে।শুভা চোখের জল মুছে মাথার ওড়নাটা ঠিক করে নীলাশ এর দিকে পা বাড়ায়।শুভার স্বপ্ন এই নীলাশ।হয়তো আজ না হোক কাল থাকবে না। তবিও শুভা আপ্রাণ চেষ্টা করছে নীলাশকে ধরে রাখার।আধাপাকা একতলার এই বাড়িটার এক তৃতীয়াংশ জুড়ে শুভার নীলাশ।গত ৪ বছর ধরে একটু একটু করে কঠোর শ্রম আর মেধার জোরে তৈরি করেছে এই ছোট রেস্টুরেন্টের মতো হোটেলটা। পেছনের দুটো রুমে শুভা বাচ্চাদের নিয়ে মালেকা খালার সাথে থাকে।শুভাকে বাইরে দাড়িয়ে দেখে মালেকা বেরিয়ে আসে।
“- ও শুভা!কোথায় ছিলি? কাস্টমার সামলানো যাচ্ছে না তো? তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে যা।লাভলী আর মজনু তো হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে।
“- যাই খালা!শুভা এপ্রোন পড়ে রান্নাঘরে রান্না করতে লেগে গেল।নীলাশ হোটেলের সবচেয়ে ফেমাস আইটেম হলো শুটকি আর সামুদ্রিক মাছের বিভিন্ন পদ।দেশ বিদেশ থেকে বহু পর্যটক সেন্টমার্টিন আসলেই শুভার এই নীলাশে আসার চেষ্টা করে।দেশি বিদেশী সব খাবারের আইটেমই শুভা বানাতে পারে।হোটেলের পাশে একটা ডায়রি মতো আছে।শুভার রান্না খেয়ে প্রশংসা করে পর্যটকরা দুচার লাইন লিখে যায়।কষ্টের মাঝেও শুভার বড় প্রাপ্তি এগুলোই। রাতে যখন শুয়ে শুয়ে ডায়রীর লেখা গুলো পড়ে শান্তি পায় মনে।শৌর্য নুরভিকে মানিয়ে নিয়ে এসেছে।মুখ ফুলিয়ে টেবিলে পা ঝুলিয়ে বসে আছে নুরভি।নীলকে চাইলেও শুভা ভুলতে পারে না।নুরভির মধ্যে নীলের প্রতিচ্ছবি পাই।হাব ভাব চেহারা সবটাই নীলের কপি।শৌর্য কে রান্নাঘরে হাসি মুখে আসতে দেখে শুভা মুচকি হেসে বলে,
“- মেনেছে মুডি কন্যা!
“- উফ! মাম্মী! অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। দেখো ওকে বুঝাতে গিয়ে শুকিয়ে আধা হয়ে গেছি আমি।
“- হি!হি! ওলে আমার বাবা টা! আচ্ছা গিয়ে বস ওর পাশে।মাম্মী খাবার নিয়ে আসছে।
“-আচ্ছা!
খাবার প্লেট হাতে মাকে এগিয়ে আসতে দেখে বগল দাবা হয়ে মুখ ফিরিয়ে বসে নুরভি।শুভা খাবার প্লেটগুলো টেবিলে রেখে নুরভির দুপাশে ঝুলে থাকা বেনি গুলো ঠিক করতে করতে বলে,
“- আমার প্রিন্সেস কি খুব রেগে আছে?
“- হুমম! খুব
“- মাম্মীর সাথে কথা বলবে না?
“-এখন বলবে না।রাগ কমলে বলবে।হু!
“- ঠিক আছে! আমি আর শৌর্য মিলে এই ইটালিয়ান পিজ্জা,আর পাস্তাটা খেয়ে ফেলবো হুম।শৌর্য ফিক করে মুখ টিপে হাসে।
“- পিজ্জা! ইয়ামমম! মাম্মী আমি খাবো।আমি খাবো।
“- না! যে আমার সাথে কথা বলবে না।তাকে আমি দেবো না।
“- কে বলেছে কথা বলবে না? আমি বলবো,আমার ঘার বলবে,ঠোঁট বলবে,হাত বলবে এই যা এগুলো তো কথা বলে না।মাম্মী! ( ঠোট ফুলিয়ে)
“- আচ্ছা! তুই ই খাবি।আগে মাম্মী কে টাইট করে একটা ঝাপ্পি দে।
হাটুসমান লালটুকটুকে ফ্রক পড়া ৩বছরের নুরভি যখন হাসে শুভার বুকটা ভারি হয়ে ওঠে নীলের স্মৃতিতে।নুরভি মাম্মীকে জড়িয়ে ধরে পিজ্জা খাওয়ায় মনোযোগ দেয়।শৌর্যকেও নিজ হাতে খাইয়ে দেয়।তারপর শুভাকে।শুভা কাজের চাপে নিজ হাতে খাওয়া ভুলেই গেছে।এই নুরভি আর শৌর্য মনে করে মাকে খাইয়ে দেয়।শুভার জীবনের অমূল্য রত্ন এ দুটো।এদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্যই দিনরাত এক করে এই হোটেলটা দাঁড় করিয়েছে।
|
|
আমেরিকার ফ্লাইটেই নীল রায়ান খান সবেমাত্র ঢাকা এয়ারপোর্টে নেমেছে।
চোখে নীল সানগ্লাস,সাদা শার্টের উপর কালো ব্লেজার,চকচকে কপালের উপরের চুলগুলো পেছন দিকে আচরানো,চাপ দাড়িতে কোনো মুভির হিরোর চেয়ে কম লাগছে না।মেয়েরা হুড়োহুড়ি শুরু করেছে নীলকে দেখার জন্য।
“- ইশশ! কি এটিটিউড দেখেছিস? পুরাই অস্থির।একবার তাকায় না কেন? উফ!কি হ্যান্ডসাম রে।
“- বয়স নাকি ৩১ পড়লো অথচ ভাব, স্টাইল,লুক দেখ জাস্ট চেটে পুটে আইসক্রিম বানিয়ে খেয়ে ফেলতে মন চাই।মেয়েদুটোর কথা শুনে দুটো বডিগার্ড মুচকি হাসলো।
চারপাশে দুতিনজন বডিগার্ড ঘিরে রেখেছে হুমড়ে পড়া সাংবাদিকদের বাঁধা দিয়ে।চারিদিক থেকে প্রশ্নে ছোড়া হচ্ছে। নীল এমনভাবে হাটছে যেন কিছুই তার কানে যাচ্ছে না।
“- মি.নীল! এবার কতোদিনের জন্য আসলেন?মি. রায়ান খান প্লিজ সে সামথিং। ( ১ম সাংবাদিক)
“- শুনলাম আপনার কাজিনের বিয়ে।আপনি কি সেখানে এটেন্ড করতে এসেছেন? ( ২য় সাংবাদিক)
“- আপনি বিয়ে করবেন কবে? আপনার স্ত্রী গত হলো তো অনেক দিন( ৩য় সাংবাদিক)
নীল এবার থমকে দাড়ালো।বডিগার্ডকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে ৩য় সাংবাদিকের নাক বরাবর ঘুষি মারলো।
“- ব্লাডি বিচ! তোর সাহস কি করে হয় আমার স্ত্রী কে গত বলার।ইচ্ছা মতো লাথি দিয়ে আশেপাশের সাংবাদিক যারা এগিয়ে আসছিল তাদেরও মারে নীল।বডিগার্ডরা অনেক কষ্টে গাড়িতে নিয়ে আসে নীলকে।চুলগুলো ঠিক করতে করতে সাংবাদিকদের আঙুল তুলে শাসায়। নেক্সট এভাবে না বলার জন্য সাবধান করে।
সমস্ত টিভি চ্যানেলের হেড বুলেটিন হয়ে গেল নীলের সাথে সাংবাদিকের মারামারির ভিডিওটা।খান বাড়ির সবাই চিন্তিত চোখে খবর পড়ে যাচ্ছে। অয়ন মোবাইল বের করে নীলের সাথে কথা বলার জন্য বেরিয়ে পড়লো।রোদি রুমে বসে ভাইয়ের এগ্রেসিভ রূপটা দেখে কেঁদে ভাসাচ্ছে। আশিক রোদির মাথাটা বুকে নিয়ে স্বান্তনা দিতে লাগলো।নীল বাড়ি এসে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হতেই বেডরুমের দেয়ালে নীলের গলা ঝুলে হাসমুখের দাঁড়ানো শুভার ছবিটা দেখে।থমকে যায় নীলের চারপাশ।শুভার ছবিকে আকড়ে ধরে কাঁদে। দূরে মাগরিবের আজান শোনা যাচ্ছে। নীল প্যান্ট পাঞ্জাবি শরীরে জড়িয়ে মসজিদের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।আজও রোজা রেখেছে নীল।জুস খেয়ে নামাজ শেষে মোনাজাত ধরে কাঁদে। আশেপাশের সব মুসল্লী এগিয়ে এসে স্বান্তনা দেয়। সবাই চলে গেলে ঈমাম সাহেব নীলকে হাত ধরে নিয়ে খেতে বসায়।
“- চিন্তা করিস না বাবা! যার কাছে ধর্ণা দিয়েছিস সে তোকে খালি হাতে ফেরাবে না।ধৈর্য্য ধর। মালিক তোকে ইনশাআল্লাহ তোর মানুষটাকে ফিরিয়ে দেবে।
“- চাচা! সবাই তো বলে ও বেচে নেই।আমার শুভাকে কি তাহলে কোনোদিন পাবো না চাচা! আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা কি আমাকে আমার আমার ভালোবাসা ফিরিয়ে দেবেন না?আমার পাপের কি ক্ষমা হবে না তার দরবারে চাচা?
“- ভরসা রাখ ঐ এক অদ্বিতীয় স্বত্বার উপর।সে যেমন কেড়ে নিতে পারে তেমন ফিরিয়েও দিতে পারে।শুধু বলে কুন হয়ে যা,হয়ে যায়।তাকে বেশি বেশি ডাক।আরও কাতর ভাবে ডাক নীল।ইনশাআল্লাহ তিনি তোকে খুশি করবে।তোর হারানো সব ফিরিয়ে দেবে।
নীলকে ভেঙে পড়তে দেখে ঈমাম সাহেব আইয়ুব ( আ), ইউসুফ ( আ) এর কাহিনি শোনায়। কিভাবে আইয়ুব( আ) সব হারিয়ে কঠিন দূরারোগ্য ব্যাধিতে জর্জরিত হয়েও ঈমান হারা হয় নি।দিন রাত আল্লাহ কে ডেকেছেন।ইউসুফ( আ) এর ভাইয়েরা হিংসার বশবর্তী হয়ে আপন সহোদর কে কূপে ফেলে চলে যায়।কতো বাঁধা না এসেছিল তাদের জীবনে তবুও তিনারা ঈমান হারা,ধৈর্য হারা হোন নি।ধৈর্য্যের উজ্জ্বল দৃটান্ত রেখে গেছে আমাদের শিক্ষক হয়ে।তাদের ঈমানী পরীক্ষার সফলতায় আল্লাহ খুশি হয়ে তাদের সব ফিরিয়ে দিয়েছিল।তুইও ডাক।আমার বিশ্বাস মালিক তোকে নিরাশ করবে না।নীল ঈমাম চাচার কথা শুনে আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়।ইফতার করে চাচার কাছে দুআ নিয়ে মসজিদ থেকে বের হয়ে আসে।বাসায় আসতেই অয়ন আর শর্মিকে বসে থাকতে দেখে হেসে সালাম দেয়।
“- কেমন আছেন ভাইয়া!
“- এই তো আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ পাক যে হালে রেখেছে তাতেই শুকরিয়া।তারপর বলো কি অবস্থা তোমাদের?
“- এই তো ভাইয়া। আলহামদুলিল্লাহ। ভাইয়া রাতেই কিন্তু কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হবো। পরদিন টেকনাফ থেকে সোজা সেন্টমার্টিন। আব্বু একটা রেস্টুরেন্ট বুক করে রেখেছে হলুদের,বিয়ের ফাংশনের জন্য ।থাকার জন্য আশেপাশের হোটেল ভাড়া করা হয়েছে।
“- হুমম!জ্যাককে খাবার দিতে দিতে।
“- তুই যাচ্ছিস তো নীল ভাই।প্লিজ মত পাল্টে ফেলিস না।জাস্ট তিনদিনের জন্য। তারপর তুই চলে আসিস।প্লিজ ভাই।বড় মা, রোদি খুব চাচ্ছে তুই যেন আসিস।
“- আমি যখন কথা দিয়েছি অনিচ্ছা স্বত্বে হলেও যাবো।তবে রাতে নয়।কাল সকালের ফ্লাইটে।সোজা সেন্টমার্টিনই দেখা হবে।
“- আমাদের সাথে যাবি না ভাই
“- না!
“- আচ্ছা ঠিক আছে ভাই।অয়ন চুপ! তাহলে ভাইয়া আসি।একটু পরই তো বের হতে হবে।
“- ওকে।আল্লাহ হাফেজ।
শর্মি অয়ন চলে যেতেই রিনা বুয়াকে কফি দিতে বলে নীল রুমে চলে আসে।এ ঘরে আসলে দুচোখের পাতা এক হলেই কান্না আসে নীলের।আশায় বুক বাঁধে শুভাকে ফিরে পাওয়ার।এই চার বছরে কতো না খুজেছে।যারা কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়েছিল তাদেরও ধরেছে কিন্তু শুভার খোজ তারা দিতে পারে নি।নীলের সন্দেহ হয় ওরা কিছু লুকিয়েছে।কি লুকিয়েছে সেটাই নীল বুঝতে পারে না।
চলবে,,,