যদি তুমি জানতে !! Part- 13
সেদিন ওকে আমার সামনে রাখার পরও আঘাত থেকে বাচাতে পারিনি, আর আজ ও কোথায় আছে কেমন আছে কি হালে আছে, কিচ্ছু জানিনা!!আমার নাবিলা যে বড় এক বিপদে পড়ে আছে!আর আমি একদম হাতেহাত রেখে বসে আছি। কি করবো?
দিপের হলুদ অনুষ্ঠান পর্ব শেষ। সবাই এখনো ব্যস্ত। দুপুর গড়িয়ে এখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। এদিকে কারোর কোনো খেয়াল নেই যে নাবিলা অনুপস্থিত। কিন্তু জানিনা কখন এসে সবাই খুজতে শুরু করবে। আম্মুর কাছ থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে ওকে খুজতে বের হলাম। এলাকার যত অলিগলি, মেইনরোড, হাইওয়ে আছে সব জায়গায় খুজলাম, কিন্তু নাবিলাকে কোথাও পাইনি, কেউ এই মেয়েকে আসতে বা যেতেও দেখেনি। এভাবে একটা কলেজ পড়ুয়া মেয়ে গুম হয়ে গেল? মন কোনোভাবেই মানছে না! আমার নাবিলা কোথায়? কি হালে আছে…..?
সব জায়গায় খুজা শেষ করে গাড়ি ঘুরিয়ে বাসার দিকে রওনা দিতেই আম্মু কল করল-
-হ্যালো আম্মু বলো
-সাঈদ সত্যি করে বল তুই কোথাও?
-আম্মু কিছু হয়েছে? সব ঠিক আছে তো?
-বাড়ি আয়।
-হঠাৎ তুমি এভাবে কেন বলছো? কিছু হয়েছে নাকি?
-বললাম তো বাড়ি আয়। আর এক্ষুণি আসবি।
আম্মুর কথা শুনার সাথে সাথে হাই স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছি।হঠাৎ এতো ব্যস্ততার মধ্যে আম্মু এভাবে কেন বললো? বাড়িতে কিছু হয়নি তো? নাবিলা কি চলে এসেছে নাকি? নাকি আবার খারা…..নাহ্! এই মূহুর্তে এসব নেগেটিভ চিন্তাভাবনা করা যাবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়িতে পৌছতে হবে।।
বাড়িতে দরজা দিয়ে ঢুকতেই আম্মু সদর দরজার সামনে দাড়িয়ে। মেজোখালামনি, ছোটখালামনি, দিপ সহ সবাই একত্রে জড় হয়ে আছে। সবার নজর আমার দিকে। আম্মু কাছে এসে বললেন-
-কোথায় ছিলি?
-এইতো কিছু আনার জন্য বাইরে ছিলাম। কেন কিছু হয়েছে?
-ফিহা কোথায়?
-আমি কীভাবে বলব? আমি কি ওর এসিসটেন্ট নাকি যে খবরাখবর রাখব!
-চুপ ! কোনো বাড়তি কথা বলবি না। ফিহার স্যার সাইফুলকে কেন পিটিয়েছিস!
-মানে আম্মু আসলে..হয়েছিল..কি..
-সাইফুল সব বলে দিয়েছে। আর মানে মানে না করে বল ফিহা কোথায়?
-আম্মু নাবিলার কোনো খোজ পাওয়া যাচ্ছেনা, হলুদের অনুষ্ঠানের পর থেকে ও লাপাত্তা!!
-ওও আচ্ছা।।তুই এ খবরটা আর আমার কানে পৌছে দেসনি।।। জানিস! মাঝেমাঝে আমার সন্দেহ হয় তুই কি আমার ছেলে নাকি! এ কেমন ছেলে আমি পেটে রেখেছিলাম!
-চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম এজন্য জানাতে ভুলে গেছি।। সরি আম্মু!! নাবিলাকে দুপুর থেকে আমি খুজে চলছি আম্মু, আমি জানি না সবার মাঝ থেকে ও কীভাবে নিখোজ হয়ে গেল।
-ও নিখোজ না। বাড়িতে আছে।।
-কোথায় ও? আমি দেখা করব!
-সেটা তোর জানতে হবে না! ওর কোনো ব্যাপারে আজকের পর থেকে নাক গলাবি না,দূরে থাকবি! তোর ছায়াও যেন ওর আশপাশে না পড়ে!সাবধান করে দিলাম।
আম্মু কথা বলা শেষ করে রুমে চলে গেলেন। সবাই আমাদের তলব দেখার পর এক এক করে প্রস্থান করলেন। কিন্তু আমি এখনো পরিস্থিতি সামলাতে পারছিনা।। আজ আমার জন্য নাবিলা ওভাবে নিখোঁজ হয়েছিল, আমার ব্যর্থতার জন্য ওকে আমি হারিয়ে ফেলতে পারতাম! আমি যদি ওকে আরো চোখে চোখে রাখতাম তাহলে এরকম কিছু কখনোই দেখতে হতো না।।
কাল বিয়ে। সবাই ব্যস্ত। নাবিলা কোন রুমে আছে, কোথায় আছে, কেউ বলছে না। মেজো খালামনি নাবিলার ব্যাপারে কিছু বলবেই না সোজা মুখের উপর পরিষ্কার বলে দিয়েছে।ছোট খালামনি আম্মুর শাসানো খেয়ে মুখ বন্ধ করে আছে। দিপ ওর নিজের বিয়ের জন্য ব্যস্ততার মধ্যে । দুই খালুর এক খালুও কথা ঠিক করে বলছে না, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কাজের ঠাই দেখাচ্ছেন। সবাই আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে চলছে। কেউ কিছুই বলছেনা। বাকি আছে শুধু আব্বু। কিন্তু ইনিই একজন ব্যক্তি যাকে আমি, জুনায়েদ সাঈদ পযর্ন্ত ভয় পাই। ওনার স্ট্রিক্টনেস আমার কলিজা কাপিয়ে দেয়।। আর্মির মেজর হলে যা হয় আরকি।
আব্বুর কাছে গিয়ে দেখি আব্বু এখানে বসেও ফাইলে কাজ করছেন। আমাকে রুমে আসতে দেখে কাজে মগ্ন থেকেই বলে উঠলেন-
-কেউ ফিহা মায়ের ব্যাপারে জানতে আসলে, আমি কিছু জানি না। সে এখন যেতে পারে।
-তুমি জানলে কিভাবে আমি এখানে নাবিলার কথা জানতে এসেছি?
-তুই নিজের প্রয়োজনে কখনো আমার কাছে আসিস না সেটা আমি খুব ভালো করে জানি।
-আব্বু প্লিজ, কখনো তোমার কাছে কিছুর জন্য বলিনি, আজ বলছি.. নাবিলা কোথায়? ওকে আম্মু কোথায় রেখেছে?
-আমার কাজ ফিহার ব্যাপারে কিছু না বলা। আমি আমার কাজের সাথে বেইমানি পছন্দ করিনা।তুই যেতে পারিস।
-আমি জানি আব্বু,আমি ঠিকমতো ওর খেয়াল রাখতে পারিনি, এটাও জানি আমি আজ ব্যর্থ। তবুও একটা সুযোগ চাই, আব্বু, প্লিজ। কোথায় আছে নাবিলা?
-একটা প্রশ্নের জবাব দিবি?
-একটা না একশ টা করো তবুও নাবিলার খোজ টা দাও।।
-ফিহা নাকি নাবিলা?
-নাবিলা।
-ফিহা মাকে এই নামে কেনো ডাকিস কখনো মুখে মুখে জিজ্ঞেস করিনি। আজ করছি। কেন ডাকিস এই নামে?
-জানি না। আমার কাছে এটার জবাব দেওয়ার হলে এটাই বলব “নাবিলা” নামটা সুন্দর।
-যদি বলি নাবিলা এখন বিপদে আছে, কি করবি?
-আমার নাবিলার কিচ্ছু হতে দিব না !
-আমার জবাব আমি পেয়ে গেছি। ফিহা মা দিপের বান্ধবীর বাসায় আছে। একজেক্ট কোন রুমে বা কোন খানে আছে জানি না।বান্ধবির মা ঘটনার বিষয়বস্তু জানেনা। এজন্য ফিহার কাছে যাওয়ার পথ নাও আটকাতে পারে।
-বাকি টা আমি সামলে নিবো !!! থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ আব্বু!!!
দিপের বান্ধবী একটাই “ইথিলা”, দ্যা ছেসরা ফাউল মেয়ে ! আম্মু কোন সেন্সে নাবিলাকে ইথিলার বাসায় পাঠালো বুঝতে পারছি না। ইথিলার বাসা দিপের বাড়ির পরের গলি। আমি তাড়াহুড়ো করছি ওর বাসায় যাওয়ার জন্য!ছোটবেলায় দিপ,আমি, ইথিলা অনেক খেলেছি ওদের বাসায়। তিনতলা বিল্ডিং, ওরা দোতলায় থাকে। বাকিসব ভাড়া দেয়া। ওদের বাসায় যেয়ে কলিং বেল বাজাতেই ইথিলার আম্মু দরজা খুলে বললেন-
-আরে সাঈদ তুমি এখানে, আসো আসো ভেতরে আসো।।
-ধন্যবাদ আন্টি। আন্টি আম্মু আপনাকে ডাকছে।
-এইতো একটু আগেই দিপের বউকে দেয়ার জন্য ব্যাগ গুছিয়ে এলাম। আর নাকি কোনো কাজ নেই। এখন আবার ডেকে পাঠালো?
-আন্টি বুঝেন না, বিয়ে বাড়ির মধ্যে কত কাজ থাকে, এখন বোধহয় অন্য কাজের জন্য ডেকে পাঠিয়েছে।
-আচ্ছা, তুমি বসো। ইথিলা পার্লারে গেছে, এখনি চলে আসবে। তোমার ভেতরে বোন আছে,যাও, বসো, ইথিলার রুমে।
-আচ্ছা আন্টি ধন্যবাদ ।।
-আচ্ছা বাবা তুমি থাকো আমি দেখে আসছি।
আন্টি চলে যাওয়ার পর সোফায় বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে ইথিলার রমের দিকে গেলাম। দরজার নব্ মোচড়াতেই দরজা খুলে গেলো। ভেতরে ঢুকে দেখি নাবিলা বিছানায় বসে বই পড়ছে। দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে নাবিলা বই থেকে চোখ তুলে দেখে আমি। আমি কিছু বলবো তার আগেই নাবিলা বই ফেলে দৌড়ে আমাকে গলা জড়িয়ে ধরে। দুহাতে এতো শক্ত করে ধরেছে আমি ওর হৃৎপিন্ডের ধুকপুক শব্দ শুনতে পাচ্ছি।
টের পাচ্ছি নাবিলা কান্না করছে। আমি ওকে জড়িয়ে ধরে কানে কানে বললাম-
-কান্না করলে আম্মু ডাউট করবে। এরপর আমাকে কালকের মতো আজকেও বকা দিবে ।চুপ কর।
নাবিলা এখনো কান্না করছে। না আমাকে ছাড়ছে, না কান্না বন্ধ করছে। আমি এখনো ওই অবস্থায় জড়িয়ে ধরে আছি।ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। মাথায় ঘন করে ঠোট ছুয়িয়ে দিলাম। ও কিছুটা শান্ত হলে ওকে ছেড়ে দিয়ে মাথা তুলে দেখি চোখ মুখ ফুলিয়ে শেষ। চোখ, নাক লাল হয়ে গিয়েছে। চোখ মুছিয়ে বিছানায় নিয়ে পাশে বসিয়ে নেই। নাবিলার কান্না বন্ধ হলে বলি-
-কাল কি হয়েছিল? তুই কোথায় ছিলি?
-সাঈদ ভাই স্টোররুমে আটকা পড়েছিলাম। দিপ ভাইয়ের হলুদ শেষে রঙ দিয়ে খেলব বলে সেখান থেকে আনতে গিয়েছিলাম। ভুলবশত দরজা লক হয়ে যায়।
-তুই জানিস আমি তোকে কই কই না খুজেছি! পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম তোকে না পেয়ে!
-সরি ভাই। আমি বুঝতে পারিনি এত বড় কিছু হয়ে যাবে।
-সরি বললে কি আম্মু এখন তোর সাথে আমাকে থাকতে দিবে!
-আমার সাথে না থাকলেই তো তুমি খুশি।।
-তোকে এসব আজগুবি কথাবার্তা কে শিখায় বলতো! কোথা থেকে শিখেছিস এসব!
-ঠিক বলছি।
-তোর ঠিকের আমি গুলি মারি! গর্দভ কোথাকার!
-ভাই কিছু করো! খালামনিকে বুঝাও। আমি এই ইথিলার বাসায় থাকব না।।।কাল রাত থেকে তোমার গুনগান গেয়ে জালিয়ে মারছে!
-জেলাসি ফিল হচ্ছে সেটা বলে না, কথা ঘুরিয়ে আরেকটা বলছে!আপাতত কালকের বউভাত পযর্ন্ত অপেক্ষা কর। তারপর দেখা যাবে কি করা যায়।
-না..এত দেরি সম্ভব না..বেশি দেরি করলে সব শেষ….
-কি শেষ? থামলি কেন?
-না মানে ওইযে মজা করব।। প্লিজ তোমাকে আমার আজকেই চাই!
-বিয়ে করবি নাকি! এত উতলা হয়ে বলছিস যে!
-প্লিজ ফাইজলামি না, তোমাকে দরকার আমার।
-কোন কারনে?
-সবসময় সবকিছু বলতে হয় না। কিছু জিনিস বুঝে নিতে হয়।
-এত বড় কবে হলি, আমাকে জ্ঞান দিচ্ছিস!!
-তুমি দুপুর আড়াই টার দিকে মেইনরোডে গাড়ি নিয়ে রেডি থাকবে। আমি আসব, তারপর একসাথে যাব।
-দিপের বিয়ে রেখে কোথায় যাবি? আম্মু যে তোকে পারমিশন দিবে না জানিস তো!!
-তুমি আমাকে নিয়ে যাবে কিনা এতটুকু বলো?
-আমি না করব না। রেডি থাকিস।
নাবিলার সাথে কথা বলা শেষ করে পিছন ফিরে আসতে নিব ও আবার বলে উঠে-
-সাঈদ ভাই?
-হ্যাঁ বল,
-আমাকে বিশ্বাস কর?
-হুর! তোর মতো বোকাকে কে বিশ্বাস করে!
-জানতাম!! আচ্ছা তোমার কিছু হলে কার আগে খারাপ অবস্থা হবে?
-আম্মু আব্বু ছাড়া…..উমমম না কেউ নাই। এই দুইজনের খারাপ অবস্থা হবে।
-দেরি করো না। সময়মতো এসো।
-আচ্ছা।।
নাবিলাকে বিদায় দিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলাম। ঘড়িতে দুপুর পনে একটা। দিপের বিয়ের গাড়ি সহ বরযাত্রি রওনা হবে বিকেল চারটার দিকে।এদিকে নাবিলাকে আমার কাছ থেকে দূরে রাখার, ভালো একটা টোটকা! আম্মু এ্যাপ্লাই করেছে। জাষ্ট জোশশ!!
বাড়িতে গিয়ে দেখি সবাই নাকে তেল দিয়ে হরদমে কাজ করছে। এটা ওটা নিয়ে সবাই যেন খুব ব্যস্ত। আমি আর দিপ আজকে শেরওয়ানি পড়ব। কারন, বতর্মানে বড় হিসেবে আমরা দুজনই বাকি। শেরওয়ানি দেখতে দিপের রুমে গেলে ওকে অনেক অস্থির অস্থির দেখায়, আমি ওকে কিছু জিজ্ঞেস করতে নিব, তার আগেই ও বলে-
-সাঈদ, ভুলে না আমি তোর ভাবি জন্য আংটি কিনতে ভুলে গেছি!!
-খালামনি আংটি কিনেনি?
-না। উনিও নাকি ভুলে গেছে।
-এখন কি করবি? সময় বেশি নাই তো!
-এক কাজ করি তুই এখানকার সবকিছু সামলা আমি ততক্ষণে আংটি নিয়ে আসি। থাক তুই!
-আচ্ছা যা। দেরি করিস না।
দিপ আংটি কেনার জন্য তাড়াহুড়ো করে চলে গেল। আমি রুমে বসে শেরওয়ানি ঠিক করছি। দিপেরটা সাদা কালার আর আমারটা গাঢ় সবুজ কালার। দুজনেরটা বলতে গেলে সেমই বাট দিপেরটা বেশি গর্জিয়াস, বরের শেরওয়ানি বলে কথা। শেরওয়ানি দুটো ইস্ত্রি করে গোসল সেরে নিলাম। এসে দেখি দুইটা পনের বাজে। দিপ রুমে মাত্র এসে ঢুকল। ওকে জিজ্ঞেস করলাম-
-কিরে আংটি কোথায়?দেখি!!
-আম্মুর কাছে দিয়ে এসেছি। তুই গোসল করে নিয়েছিস?
-হ্যাঁ, আর শোন তোর শেরওয়ানিটা ইস্ত্রি করে রেখেছি।গোসল সেরে পড়ে নিস।
-তুই কোথাও যাবি নাকি?
-একটু কাজ আছে বাইরে যাব।
-এই না, এখন এইসময় তোকে আমার পাশে লাগবে!!
-সরি ভাই। ইটস আর্জেন্ট!! নো টেনশন আমি তাড়াতাড়ি আসছি।
-আচ্ছা যা। একটু জলদি করিস।।
চুল ঠিক করে শেরওয়ানি গায়ে দিয়ে চাবি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। গাড়ি চালিয়ে মেইনরোডে আসতেই দেখি নাবিলা রোডের সাইডে দাড়িয়ে আছে। আমি ওকে গাড়িতে তুলে জিজ্ঞেস করলাম-
-নাবিলা হঠাৎ এভাবে কেন বেরিয়েছি বলবি? নাকি এখনো বলবি না!!
-হুম বলব। সাঈদ ভাই এখানকার গ্রিন পয়েন্ট সাইটটা চিনো?
-হ্যাঁ চিনবো না কেন!! কিন্তু তুই কেন জিজ্ঞেস করছিস?
-ওখানে নিয়ে চলো।
-পাগল হলি নাকি!ওখানে যেতেই লাগবে আধঘন্টা কি একঘন্টার মতো! দিপের ওখানে যেতে লেট হয়ে যাবে।
-সারপ্রাইজ আছে সাঈদ ভাই!!!
-এই অর্ধেক রাস্তা আসার পর তুই যদি গন্তব্যের নাম বলিস, সাথে আবার সারপ্রাইজ আছে বলিস, এখন তোকে কি করতে ইচ্ছে করছে আমার!
-ভাই তুমি না স্পেশাল জিনিস পছন্দ করো, আজকে আমি নিজে থেকে তোমাকে লাল মরিচের মশলা মাখা আদর দিবো।।
-ঘুষ কিভাবে দিচ্ছিস! ছি ছি !!
-চলো এখন।
নাবিলা আজ খুব সুন্দর করে এসেছে। ওকে আমি যেভাবে দেখতে চাই ঠিক ওভাবেই সেজেছে। লাল, বেগুনি সবুজের শাড়ি, লাল পার। চোখদুটো কাজলকালো। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক।হাতদুটো লাল চুড়িতে ভর্তি। চুলগুলো মাঝে সিথি কেটে দুপাশ করে সামনে এনে ছেড়েছে।
আজ আমি সেরওয়ানিতে, সিটের পাশে শাড়িতে নাবিলা।। সময়টা যদি এখানেই থেমে যেত!! আমি পারলে সময়টাকে থামিয়ে দিতাম। পলকহীন ভাবে দেখতাম নাবিলাকে। আজ ও আমার পাশে বসে, আমার কাছে, তবুও চুপচাপ ভাবে দেখতাম।। ওর সেই তথাকথিত “লাল মরিচের মশলা মাখা আদর” টা ওর মতোই স্পেশাল !!চাই না কখনো আমার কাছ থেকে দূরে থাকুক, না কক্ষনো দূর হোক !! জুনায়েদ সাঈদ কারোর না হলেও আজ নাবিলার!!
পয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যে আমরা গ্রিন পয়েন্টে পৌছে যাই। সাইটটা এই জায়গার সবচেয়ে পরিচিত একটা দিক। পাহাড়ের সম্মেলন এখান থেকে খুব স্পষ্ট ভাবে দেখা যায়। ঠিক পাহাড়ি সাইট এটা। সিড়ি বেয়ে উঠতে হয়। নাবিলা আর আমি সিড়ি দিয়ে উপরে উঠছি। আশেপাশে মানুষ নেই। কারন,এখন দুপুর বেলা। বিকেলের দিকে মানুষ আসতে শুরু করবে।কিছুক্ষন পর সেখানকার গ্রিন পয়েন্টের স্পটটায় পৌছে যাই। স্পটটা যেহেতু পাহাড় তাই রেলিং দেওয়া হয়নি। ওখানে বসার জন্য বেন্চের ব্যবস্থা করা আছে। নাবিলা আমার হাত ধরে বেন্চে বসিয়ে ও আমার কোলে ঠিক পায়ের উপর বসল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল-
-সাঈদ ভাই জায়গাটা সুন্দর না?
-মাথার উপর সূর্য ! একটু পর ঘেমে ভূত হলে বলিস, খুব সুন্দর জায়গাটা !
-ভাই তোমাকে না খুব সুন্দর লাগছে এই ফর্মে।
-আশকারা না দিলেও পারতি!
-সত্যিটাই বললাম, আশকারা না। তুমি দেখতে অনেক সুন্দর।
-হঠাৎ আমার প্রশংসা করছিস? কারন কি?
-তোমাকে প্রশংসা করতে সময় লাগবে নাকি?
-না কিন্তু আজ তুই একটু অন্যরকম আচরন করছিস।
-সহ্য হয়না?
-তোর মতো বেক্কলকে কতদিন ধরে সহ্য করছি!
-ভাই আমি যে এভাবে তোমার কোলে বসলাম, বিরক্ত বোধ করছো?
-জানি না।
-আমি তোমার পাশ ঘেষে বসি, তুমি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওনা কেনো?
-সেটাও জানি না।
-আমার কথা মতো কিছু না জেনেই এখানে কেন এলে?
-বিশ্বাস আছে তুই খারাপ বা ভুল কিছু করবিনা।
-যদি কখনো ইচ্ছে করে ভুল করি, তখন তুমি কি করবে?
-জানি না। কিন্তু সেদিনের মতো থাপ্পড় বা আঘাত করব না।
-আমি যে আদর করি সেটা কি থার্ড ক্লাস লাগে?
-নাহ্, কেন লাগবে!
আমি বলতে না বলতেই নাবিলা ওর দুহাত দিয়ে আমার গাল জড়িয়ে কপালে, দুচোখের পাতায়, থুতনিতে ঠোট ছুয়িয়ে দিল। কোলে বসেই আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল-
-সাঈদ ভাই, আমার প্রত্যেকটা প্রশ্নের জবাব তুমি দিয়ে দিও। আমি শুনতে চাই।
-নাবিলা তোর কিছু হয়েছে?আজ তুই কেমন যেনো বিহেব করছিস।
-কিছু না। আদরটার ডোজ শুধু বাড়িয়ে দিলাম। চলো উঠো ওখানে যাই।
আমাকে ছেড়ে নাবিলা বসা থেকে দাড়িয়ে পাহাড়টার শেষপ্রান্তে এসে দাড়ালো। আমিও ওর পিছু পিছু পাশে যেয়ে দাড়ালাম। বাতাসে লম্বা চুলগুলো উড়ছে নাবিলার। ওর দৃষ্টি সামনের দিকে। শীতল চোখ দুটো দিয়ে ও তাকিয়ে দেখছে। আমি ওর কাধে হাত রেখে বলি-
-নাবিলা আজ নিরব। ব্যাপার কি??
-নাবিলা আজ সাঈদের পাশে দাড়িয়ে শেষ দেখছে।
-না…মানে…আচ্ছা আজকে তুই ভিন্নবেশে কথা বলছিস! কি হয়েছে তোর বলবি?
-শুনতে চাও?
-প্রস্তুত।
নাবিলা আমাকে ওর পাশ থেকে সরিয়ে ওর সামনে এনে দাড় করালো। পিছনে কোনোভাবে এক পা গেলে শেষ! ও আমার হাত ধরে বলল-
-আমাকে বিশ্বাস করো?
-এই সময় এমন প্রশ্ন আবার কেন করছিস?
-আল্লাহ্ হাফেজ সাঈদ ভাই।
-মানে?
আমি নাবিলাকে প্রশ্ন করলে ও সেটা পরোয়া না করে আমাকে ধরা হাতটি ছেড়ে ধাক্কা দিয়ে দেয়। হঠাৎ ওর এমন কাজে আমি উল্টে উচু থেকে পড়তে নেই। আমি পড়ে যেতেই ও আবার আমার হাত খাবলে ধরে, আর বলে-
-এখন বলো, আমাকে বিশ্বাস করো ভাই?
-নাবিলা হাত ছাড়িস না! আমি পড়ে যাব!
-বলো সাঈদ ভাই প্লিজ, আমার হাতে সময় নেই।।
-নিজের চেয়েও বেশি বিশ্বাস করি তোকে! যতটুকু আমি নিজের ওপর রাখতে পারিনি তার চেয়েও বেশি করি!
-আমি তোমাকে এখান থেকে ফেলে দিলে তোমার যে মৃত্যু হবে তা তুমি জানো?
-জানি!
-হাত ছেড়ে দেই?
-হাত ছেড়ে দিয়ে যদি তুই শান্তি পাস, তাহলে এক্ষনি ছেড়ে দে।
-রাগ নাকি ক্ষোভে বলছো?
-একটাও না।
-তাহলে?
-নাবিলার হাত থেকে মরতে যাচ্ছি, ভয় নেই।
-তোমার কিছু হলে কার খারাপ অবস্থা হবে?
-আব্বু আম্মুর এরপর তোর!
-সাঈদ ভাই আমাকে মাফ করে দিও!! আজ তোমাকে এখান থেকে ফেলে দেয়া ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই! আমি পারলে নিজে শেষ হয়েও তোমাকে বাচাতাম কিন্তু বিশ্বাস কর আমি নিরুপায় ভাই!! মাফ করে দিও!!
-নাবিলা, আজ জানিনা কেন তুই এভাবে আমাকে মৃত্যুর মুখে ফেলে দিচ্ছিস! শুধু এতটুকু শেষবারের মতো জানতে চাই, কে এসবের পিছনে?কেন করছিস?
-তোমার আপন কেউ সাঈদ ভাই। তোমার কাছের কেউ। আমি তোমাকে তার নাম বলার সাহস পাচ্ছিনা ভাই!! আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও। আমাকে জোর করো না তার নাম জানতে, সাঈদ ভাই!প্লিজ!ক্ষমতা নেই আমার বলার!!
-একটা শেষ ইচ্ছা রাখবি?
-……………………
-মরার আগে বলে যাই, পূরন করলে করিস। আমার রুমে যেয়ে টেবিলের কোনায় দেখবি একটা কাগজ মোড়ানো, ওটা যত্নে রাখিস। আমার চিহ্ন হিসেবে।।
-পারবো না ভাই, আমি পারবো না… তোমাকে নিজের হাতে শেষ ক….
-ছেড়ে দে হাত নাবিলা
-ভাই মাফ করে দিও….
-….ভালো থাকিসস
নাবিলা হাত শেষমেশ ছেড়েই দিল। কখনো চোখের সামনে থেকে মৃত্যু দেখতে দেখতে পড়ব জানা ছিলো না। কিছুক্ষন আগেও ওকে নিয়ে নানারকম স্বপ্ন দেখছিলাম, ওকে ঘিরে চলতে চেয়েছিলাম, সাথে নিয়ে বাচতে চেয়েছিলাম………….আর এখন আমার পরিণতি হয়তো “শেষ”…………..
.
.
সাঈদ ভাইকে নিজের ঠিক এই দুহাতে, এই দুহাতেই শেষ করে দিলাম। জানো, সাঈদ ভাই তোমাকে এতদিনের ব্যবধানে এভাবে মনে গেথে ফেলব, আমি কখনো বুঝতে পারিনি। আমার জন্য তোমার এমন কিছু হবে আমি কখনো তা কল্পনাও করতে পারিনি। জানো? আমি ভেবেছিলাম তোমাকে তোমার নাম ধরে ডাকব! তোমার নামের পাশে সেই “ভাই” শব্দটা আর ব্যবহার করব না। কিন্তু দেখছো ভাই?? ভাগ্য দ্বিতীয়বার সুযোগ দিলোনা।।।
ভাই যেই গাড়ি এনেছিল সেটা ওখানেই ফেলে আসলাম। একটা ট্যাক্সি বুক করে সেটা দিয়ে বিয়ে বাড়িতে পৌছলাম। বাড়িতে ঢুকতেই দেখি বরযাত্রি রেডি। যেকোনো মূহুর্তে সবাই কনেবাড়ির জন্য বেরুবে। আমি সিড়ি বিয়ে উপরে উঠে দোতলার কোনার রুমে গেলাম বর হিসেবে আমার দিপ ভাই বসে আছে। দিপ ভাই আমাকে দেখে বললেন-
-কিরে কাজ এতো তাড়াতাড়ি করে আসলি দেখছি!! ওয়াও! আ’ম ইম্প্রেসড্!!
-লজ্জা থাকা উচিত ! আজ যা করছো একদিন তোমার সময় ঠিকি আসবে দিপ ভাইয়া।। এই সময় কাউকে ছাড় দেয়না!
-আমার এসব গুনিবাক্য শুনে লাভ নেই। যা আমার চাই তা আমি বাকাত্যাড়া যে রাস্তাই হোক পেয়ে ছাড়ি! থ্যাংক গড!! নাও আ’ম হ্যাপি।। এনিহাও দ্যা জুনায়েদ সাঈদ ইজ ওভার!
-আমার হাত দিয়ে জুনায়েদ সাঈদ কে মেরে খুব শান্তি পাচ্ছো, তাইনা দিপ ভাই??
-চলবে