প্রেমে পড়া বারণ

প্রেমে পড়া বারণ ( সিজন-2 ) Part- 10

কাঞ্চন সেদিন ডাসা ডাসা পেয়ারা আঁচলে গুঁজে নিয়ে পেয়ারা খেতে খেতে বাড়ি ফিরছিলো। তখন দেখলো ম্যানেজার বাবুর সাথে কয়েকজন মানুষ বাগান ঘুরে ঘুরে দেখছে।সবাই প্রনাম ঠুকছে।
কাঞ্চন তখন জানতে পারলো সাহেব লোকটা বড় বাবু; ওদের মালিক। উনার সাথের সুন্দরী মহিলাটি উনার স্ত্রী আর সিনেমার নায়িকা মতো যে মেয়েটা… ওনাদের মেয়ে!
কাঞ্চন দূর থেকে দেখে চলে যাচ্ছিলো।ম্যানেজার বাবু ওকে দেখে ডাক দিলেন। কাঞ্চন কাছে যাবার পরে উনি আস্তে করে বললেন
– বাগানের সবচেয়ে ভালো পেয়ারা নিয়ে বিকেলে বাংলোতে এসো।মালিক এসেছে, বুঝেছো?
ম্যানেজার বাবুও জানতেন বাগানের সব গাছের খোঁজ সবচেয়ে ভালো কাঞ্চন জানে!!
কাঞ্চন মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়,তারপর চলে যায়।
কিছু দূর যাবার পরে একটা গাছে ঢিল ছুড়ে।
– ও বাবা গো!…. উফফফ
কারো আর্তনাদ শুনে কাঞ্চন দেখে একটা ছেলে কপালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
পেয়েরাটা ছেলেটার কপালে পড়েছে!!
কাঞ্চন ভয় পেয়ে দৌড় দেয়।
– এই মেয়ে শোন…
কাঞ্চনকে আর পায় কে?!!…..সে কি দৌড়!!
হিহিহিহি….
জয়িতা হাসছে।
প্রত্যেকটা জিনিস আমার চোখের সামনে ভাসছে।আমি সব দেখতে পাচ্ছি।
বিকালবেলায় কাঞ্চন পেয়ারা নিয়ে বাংলোয় যায়।বড় বাবুসহ সবাই তখন বাগানে বসে ছিলো।
ম্যানেজার বাবু রাধুনিকে ডেকে পেয়ারাগুলো নিতে বললেন। পেয়ারা দিয়ে চলে আসবে এমন সময় সেই ছেলেটা বাংলো থেকে বেরিয়ে এলো। কাঞ্চনকে দেখে মিটিমিটি হাসছে।
ভয়ে কাঞ্চনের গলা শুকিয়ে যায়।পালাতে পারলে বাঁচে।
কাঞ্চন আস্তে আস্তে এক পা, দুপা করে সরতে থাকে।
– এই মেয়ে পালাবে না।
ছেলেটা এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে কাঞ্চন আবার দিলো দৌড়! এক ছুটে বাড়ি চলে যায়।
বড় বাবু,মানে বড় সাহেব ছোট বাবুকে জিজ্ঞেস করলেন – মেয়েটা এভাবে পালালো কেন??
ছোট বাবু বললেন – গতকাল পেয়ারায় ঢিল ছুড়ে ছিলো, সেই পেয়ারা আমার কপালে পড়ে।তাই ভয় পেয়ে পালিয়েছে।
– হাহাহা… সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।
পরদিনই বড় বাবু তারা চলে যান,কিন্তু ছোট বাবু থেকে গেলেন। বাগানের অনেক আন্দোলন চলছিলো। সেসব ঠিক করার জন্য ছোটবাবু থেকে গেছেন।
একদিন সকালে ছোট বাবু হাঁটতে বেরিয়ে দেখলেন কাঞ্চন বাংলোর সামনের টিলায় ফুল কুড়াতে এসেছে।
কাঞ্চন বুঝতে পারেনি বাবু এসেছে!
একমনে ফুল কুড়াচ্ছে,হঠাৎ সামনে একজোড়া পা দেখে চোখ তুলে দেখে ছোট বাবু!!!
তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ায়, আবার পালানোর ফন্দি আঁটে। যেই এক পা বাড়িয়েছে, ছোট বাবু খপ করে হাত ধরে ফেললেন।
– আজ কোথায় পালাবে??
– ছোট বাবু!…. আমার ভুল হয়ে গেছে। মাফ করে দিন। আর এমন ভুল হবে না।
– সত্যি হবে না তো?
– সত্যি, দিব্যি কেটে বলছি।এইযে কান ধরছি…
বলেই কাঞ্চন কানে ধরে।
– হাহাহা….
কাঞ্চনকে কান ধরতে দেখে ছোট বাবু হাসতে হাসতে শেষ।
– হয়েছে.. হয়েছে। কান ধরতে হবে না। বিশ্বাস করেছি।কিন্তু অন্যায় তো করেছো,শাস্তি একটা পেতেই হবে।
ভয়ে কাঞ্চনের মুখ শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে।
– বাবু আর করবো না।ভুল হয়ে গেছে।
– না না।শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে।
কাঞ্চন ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো – কি শাস্তি, ছোট বাবু?
– যতদিন আমি থাকবো,প্রতিদিন সকালে বাংলোয় তাজা তাজা ফুল দিয়ে যাবে। এটাই তোমার শাস্তি!
ছোট বাবু মিটিমিটি হাসে।।
কাঞ্চন থ মেরে গেছে, কিছুক্ষণ পরে বুঝতে পেরে নিজেও হেসে ফেললো।
এরপর থেকে রোজ ফুল দিতে সকালে বাংলোয় যায় কাঞ্চন।
জয়িতা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
এদিকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার আধার নেমে এসেছে। সেদিকে আমার খেয়াল নেই।আমি ডুবে আছি জয়িতার গল্পে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে জয়িতা বললো – এটাই কাঞ্চনের কাল হয়ে যায়। ছোট বাবুর সাথে ওর ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। বাগানে কানাঘুঁষা শুরু হয়।
শীতলের সাথে কাঞ্চনের অনেক দিনের বন্ধুত্ব,কিন্তু শীতলের সাথে কথা বলার সময় হয় না কাঞ্চনের। এখন সে শুধু সকালে নয়, যখন-তখন ছোট বাবুর সাথে দেখা করতে যায়।কখনো বাংলোয়,কখনো বাগানে!
শীতলের এসবকিছু জানে। দু’একবার বুঝাতে চেয়েছিলো , তাতে কাঞ্চনের সাথে যে টুকু সম্পর্ক ছিলো তাও নষ্ট হয়ে যায়।
দিনদিন কাঞ্চন আর ছোট বাবুর কথা রটতে থাকে। কথায় বলে যা রটে.. তার কিছু না কিছু বটে!
কাঞ্চনের সাথে ছোট বাবুর সম্পর্কের কথাও মিথ্যে ছিলো না। ততদিনে তাদের মধ্যে গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠে।।
কাঞ্চনের বাবার কানে আসলে, উনি কাঞ্চনকে অনেক বোঝান,মারধর করেন। কিন্তু ওকে ফেরাতে পারেনি।
শীতল আর কিছু বলে না। কাঞ্চন নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছে, এটা বুঝালেও এখন আর বুঝবে না।কারণ ছোট বাবুর প্রেমে অন্ধ হয়ে গেছে।
ছোট বাবু কাঞ্চনকে বিয়ে করবেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এই বিশ্বাসে কাঞ্চন নিজের সর্বস্ব দিয়ে ভালোবেসেছে ছোট বাবুকে।
ছোট বাবুকে ঘিরেই কাঞ্চনের জীবন। ছোট বাবু এতো ভালোবাসতেন… মাঝেমধ্যে কাঞ্চনের চোখে জল চলে আসতো!
গরীব কুলির অশিক্ষিত মেয়েকে ছোট বাবু এভাবে আপন করে নিয়েছেন, কিভাবে উনাদের সমাজে কথা বলতে হয়,কিভাবে চলতে হয়… এসব শিখিয়েছেন। বিয়ের পরে যাতে কাঞ্চনের সমস্যা না হয়। কাঞ্চন ছোট বাবুর মন জয় করেছিলো, তাই ওকে নতুন নামে ডাকতো ছোট বাবু।
ভাবতেই কাঞ্চনের চোখে জল আসে।এতো ভালোবাসা সইবে তো কপালে??
আর এই ভালোবাসার ফসল ও ধারণ করছে!
কাঞ্চন ছোট বাবুকে যখন জানালো ওর গর্ভে সন্তান এসেছে, ছোট বাবু থ মেরে গেলেন। দীর্ঘসময় চুপচাপ বসে রইলেন। তারপর কাঞ্চনকে বললেন – তুমি চিন্তা করো না, আমি দু’এক দিনের মধ্যেই আব্বু আম্মুকে সব বলবো।
এদিকে বাগানে কারো জানতে বাকি রইলো না কাঞ্চন গর্ভবতী!
পরদিন ছোট বাবু চলে গেলো। দুদিন পরেই ফিরে আসবেন।
কাঞ্চন আশা নিয়ে বসে রইলো ছোট বাবু আসবে।
দুদিন যায়…তিন দিন যায়…… এক সপ্তাহ যায়…. কিন্তু ছোট বাবু আর আসে না।
কাঞ্চন নাওয়া খাওয়া ছেড়ে ছোট বাবুর পথ চেয়ে বসে থাকে।
ছোট বাবু ওরে ঠকাতে পারেনা। এক একটা দিন কি দুঃসহ হয়ে উঠে কাঞ্চনের জন্য! উঠতে বসতে মানুষের কটু কথা আর ঘরে বৃদ্ধা ঠাকুমা শুধু কাঁদে!
মা- বাবা কপাল চাপড়ায়।।
কাঞ্চনের চোখের নিচে কালি পড়ে…..
” প্রেম করে ভাসলো সাগরে
অনেকে পাইলোনা কূল….
জগৎ জুড়ে বাজে শুনি,
পিরিতের কলঙ্কের ঢোল….!”
জয়িতা গান গাইছে ঠান্ডা -শীতল গলায়।
আমি স্পষ্ট যেন দেখতে পাচ্ছি। আমার চোখের সামনে কাঞ্চনের হাসি-কান্না-কষ্ট!
এদিকে সন্ধ্যা হয়ে গেছে অনেক আগেই। আমার এখনো খেয়াল নেই আমি কোথায় বসে আছি। আমি কেবল কাঞ্চনের কথা শুনতে চাইছি।।
মাঝখানে গান থামিয়ে জয়িতা আবার বলতে শুরু করলো-
কাঞ্চনের কথা জানাজানি হবার পরে কেউ ওকে কেউ বিয়ে করতে চাইবে না, এটাই স্বাভাবিক। আর মেয়ের কলঙ্ক বাবা-মা ঢাকতে পারবেন না। তাই উনারা গলায় দড়ি দিলেন এক সাথে। ভাগ্যিস শীতল টের পেয়েছিলো। অল্পের জন্যে প্রাণে বাঁচাতে পারে।
শীতল বলে – কাকা… আমি কাঞ্চনকে বিয়ে করবো।
কাঞ্চনের বাবা-মা রাজি হয়ে গেলো , কিন্তু কাঞ্চন রাজি হয় না। শীতলকে গিয়ে বললো
– করুণার নামে সুযোগের ফায়দা নিতে চাস? মরে যাবো, তবুও তোকে বিয়ে করবো না।
শীতলকে কাঞ্চন বন্ধু ভাবলেও কাঞ্চন মনে প্রাণে ওকে ভালোবাসতো।ছোট বাবুর সাথে কাঞ্চনের সম্পর্ক; অনেক কষ্ট দিতো।তবুও চেয়েছিলো কাঞ্চন যেন ওর ভালোবাসা পায়।কিন্তু ছোট বাবু তো আর আসছে না। এখন কাঞ্চনের মান বাঁচাতে হলে ওকে বিয়ে করতে হবে।এতে কাঞ্চন যা ইচ্ছা ভাবুক।
বিশ -পঁচিশ দিন হয়ে গেছে ছোট বাবু আসেনি। এদিকে কাঞ্চনের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। দুদিন পরেই বিয়ে।
দেখতে দেখতে দুদিন চলে গেলো।
রাতে বিয়ের লগ্ন,কিন্তু দুপুরেই ছোট বাবু ফিরে আসেন।
চলবে….

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *