শেষ বিকেলের মেয়ে

শেষ বিকেলের মেয়ে ! পর্ব- ৮

দেখবার চেষ্টাই-বা করলে কবে। সালমার কণ্ঠস্বরে অভিমান ঝরছে, নিজেকে নিয়েই তো ব্যস্ত থাকলে চিরকাল, অন্যের কথা ভাববার অবকাশ কোথায়। কথা বলতে গিয়ে বারবার মুখখানা লাল হয়ে উঠছিলো ওর। কিন্তু কাসেদের দিকে একবারও দেখলো না সে। চায়ের কাপটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখলো কাসেদ। বিব্রত গলায় বললো, আমার কথা বাদ দাও। তোমার নিজের কথা কি বলছিলে তাই বলো। অল্পক্ষণের জন্যে চুপ করে গেলো সালমা।
কাসেদের জবাবে সন্তুষ্ট হতে পারে নি। সে। এক চুমুক চা খেয়ে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে সালমা আবার বললো, সব মানুষই জীবনে সুখী হতে চায়। আমিও চেয়েছি। যাকে ভালবাসলাম তাকে পেলাম না। যাকে বিয়ে করতে হলো তাকে ঠিক মনের মতোটি করে পেতে চাইলাম। কিন্তু– বলতে গিয়ে সহসা থেমে পড়লো সালমা। মাথার ওপরে ফ্যানটা ঘুরছে জোরে।
এলোমেলো চুলগুলো উড়ছে বাতাসে। মুখ খুলে কাসেদের দিকে তাকালো সালমা। আস্তে করে বললো, সে চাইলো আমি তার মতো হই। পাতলা সিফনের শাড়ি পরে ঠোঁটে আর মুখে রঙ মেখে ওর সঙ্গে ক্লাবে যাই। ওর বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দিই, গল্প-গুজব করি। দুই মন, দুই মেরুতে বসে। মিল যেখানে নেই সেখানে সুখের তালাশ করা পাগলামো, তাই না?
কাসেদ কি বলবে ভেবে পেলো না। সালমা নীরব। কাসেদের কাছ থেকে উত্তরের অপেক্ষায় আছে সে। কাসেদ বললো, এ নিয়ে চিন্তা করে কি হবে সালমা? এ চিন্তার কি কোন শেষ আছে? সালমা উত্তরে বললো, বিপাশাকে যদি তোমার কাছে দিয়ে যাই তুমি রাখবে? কাসেদ অবাক হয়ে তাকালো ওর দিকে, কেন বলতো? সালমা কি যেন ভাবলো। ভেবে বললো, ওকে তোমার কাছে রেখে আমি কোথাও চলে যাবো। এ পাগলামাের কোন মানে হয় না, কাসেদ হাসতে চেষ্টা করলো। বললো, জীবনের পথ যত কঠিন আর যত দুৰ্যোগময় হােক না কেন, তার কাছ থেকে পালিয়ে যাওয়ার কোন অর্থ হয় না। ওটা কাপুরুষতার লক্ষণ।
তাই নাকি? অপূর্ব হাসলো সালমা। টেনে টেনে বললো, কাপুরুষ আমি না তুমি? কাসেদ ইতস্তত করে বললো, তার মানে? মানে, তুমি কি বলতে চাও, তুমি একজন বীর-পুরুষ? কাসেদ হেসে দিয়ে বললো, বীর-পুরুষ হয়তো নই, তবে কাপুরুষও নই। কাপুরুষ নও? সালমা শব্দ করে হাসলো, তাহলে একটা কথা বলি?
বলো। সালমা নীরবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। ওর ঠোঁটের কোণে মৃদু মৃদু হাসি। তারপর টেনে টেনে বললো, আজ এখান থেকে বেরিয়ে, তুমি আমাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারবে দূরে বহু দূরে কোথাও? কাসেদ চমকে উঠলো। সহসা সে বুঝতে পারলো না কি বলবে। কি বলা যেতে পারে। সালমা আবার লাল হলো। মুখখানা সরিয়ে নিলো অন্যদিকে। কিছুক্ষণ দু’জনে একেবারে চুপ।
একটু পরে সালমা আবার বললো, কি, চুপ করে রইলে যে, বীর-পুরুষের সাহসে কুলোচ্ছে না বুঝি? কাসেদ গম্ভীর গলায় বললো, একটা অসম্ভব প্রস্তাব করে বসলে তো আর চলে না। অসম্ভব? টেবিলের উপর ঝুঁকে এলো সালমা, তীক্ষা গলায় বললো, সাহসে কুলোচ্ছে না। তাই বলো। কেন মিছামিছি বাজে অজুহাত দেখাচ্ছে! সালমা নড়েচড়ে বসলো। বেয়ারাকে ডাকো। বিলটা চুকিয়ে দিই। কাসেদ বললো, কিন্তু কি দরকারী কথা আছে বলেছিলে, তাতো বললে না। সালমা বললো, থাক তার প্রয়োজন আর নেই। যে গাছে প্ৰাণ নেই তার গোড়ায় পানি ঢেলে কি হবে? খুব তো বড়াই করছিলে কাপুরুষ নই, কাপুরুষ নই। সহসা কান্নায় গলাটা ধরে এলো তার।
কাসেদ বললো, অকারণে কেন একটা সহজ সম্পর্ককে জটিল করে তুলেছে বলো তো? তুমি কি চাও আমার কাছ থেকে? কিছু না। কিছু না। কিছু না। এতক্ষণে সত্যিকার কান্না নেমে এলো তার দু’চোখ বেয়ে। কাপড়ের আচলে অশ্রুবিন্দু মুছে নিতে নিতে সে আবার বললো, কিছুই চাই না, আমি। চাই শুধু ঝগড়া করতে। সারাটা জীবন তাইতো করে এসেছি। এতক্ষণে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো কাসেদ। বললো, ওটা বোধ হয় আমাদের কপালে লেখা ছিলো সালমা। নইলে যখনই তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, আমরা ঝগড়া করেছি। করি। কেন করি? তুমি আমাকে আঘাত দিয়ে আনন্দ পাও, তাই।
কাউকে আঘাত দিয়ে কেউ আনন্দ পায় না সালমা। সালমা কোন জবাব দিলো না। পরনের শাড়িটা গুছিয়ে নিতে নিতে উঠে দাঁড়ালো সে। ওকি, চললে নাকি? চিরকাল বসে থাকবো বলে এখানে আসি নি নিশ্চয়। সালমার গলার স্বরটা অদ্ভুত শোনালো। কিছু বলতে গিয়ে চুপ করে গেলো কাসেদ। সালমা ততক্ষণে কেবিনের বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। কেবিন ছেড়ে কাসেদও বেরিয়ে এলো সঙ্গে সঙ্গে।
দিন কয়েক থেকে মায়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে জ্বর আসে। ছেড়ে যায়। আবার আসে। এই জ্বরের মধ্যেও মা নামাজ পড়া বাদ দেন নি। পড়েন, বসে বসে। আর সারাক্ষণ শব্দ করে দেওয়া দরুদ পাঠ করেন। মাঝে মাঝে দুঃখ প্রকাশ করেন নাহারের জন্যে আর কাসেদের জন্যে। বলেন, আমি মরে গেলে তোদের যে কি হবে ভেবে পাই না।
আজ বিকেলে কাসেদ বাসায় ফিরে এলে মা কাছে ডাকলেন ওকে। বললেন, এখানে এসে বসো, আমার মাথার কাছে। কপালে হাত রেখে কাসেদ দেখলো জ্বর আছে কিনা। নেই। নাহার বললো, এই একটু আগে জ্বর নেমে গেছে। মা বললেন, আমাকে নিয়ে তোরা ভাবিস নে। বুড়ো হয়ে গেছি, আর ক’দিন বাঁচবো।
কাসেদ বললো, ওসব অলক্ষুণে কথা কেন বলছে মা, তুমি এখন ঘুমোও। এইতো কাল সকালেই ভাল হয়ে যাবে। মা চুপ করলেন না। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিলো তাঁর। তবু বললেন, তোর খালু এসেছিলো, নাহারের বিয়ের সেই পুরানো প্রস্তাবটা নিয়ে। শ্বাস নেবার জন্যে থামলেন মা। নাহার বিছানার ওপাশে এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলো। বিয়ের কথা শুনে বারকয়েক ইতস্তত করে পাশের ঘরে সরে গেলো সে। মা আবার বললেন, আমি এ বিয়েতে মত দিয়েছি। অসুখে যেমন ধরেছে কে জানে কখন মরে যাই। যাবার আগে ওকে স্বামীর ঘরে তুলে দিয়ে যেতে চাই। নইলে মরেও শান্তি পাবো না। আমি। গলাটা ধরে এলো মায়ের। বার দু’য়েক ঢোক গিলে নিয়ে বললেন, তাছাড়া ছেলেটাও তো খারাপ না, ভালোই, এখন তুই মত দিলেই হয়ে যায়।
মায়ের কথায় মৃদু হাত বুলোতে বুলোতে কাসেদ আস্তে করে বললো, আমার মতামতের কি আছে, তোমরা যা ভালো মনে করো, করবে। অবশ্য নাহারকে একবার জিজ্ঞেস করে নিয়ো। ওকে আবার জিজ্ঞেস করবো কি? মা চোখ তুলে তাকালেন ওর দিকে। আমরা কি ওর খারাপ চাই? ছেলেটা শুনেছি, দেখতে শুনতে ভালো। মা পাশ ফিরে শুলেন। কাসেদ নীরবে ওঁর মাথায় হাত বুলোতে লাগলো।
রাতে ওর ঘরে খাবার নিয়ে এলে নাহারকে বসতে বললো কাসেদ। বললো তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে। নাহার ঈষৎ বিস্ময় নিয়ে তাকালো ওর দিকে। বসলো না। দরজার কপাট ধরে নীরবে: দাঁড়িয়ে রইলো সে। কাসেদ ভাবলো কথাটা কিভাবে বলা যেতে পারে। বিছানার ওপর থেকে উঠে টেবিলের পাশে গিয়ে বসলো সে। নাহার অপেক্ষা করছে দাঁড়িয়ে। থালার মধ্যে ভাত ঢেলে নিতে নিতে কাসেদ বললো, তোমার বিয়ের জন্যে খালু একটা প্ৰস্তাব এনেছেন শুনেছো–
নাহার কোন জবাব দিলো না। কাসেদ ভাতের থালা থেকে মুখ তুলে দেখলো তাকে। তবু সে চুপ। কাসেদ বললো, মা অবশ্য তাঁর মত দিয়েছেন। তুমি যদি মত দাও, তাহলে আমারও আপত্তির কিছু নেই। নাহার নড়েচড়ে দাঁড়ালো। ক্যাঁচ করে একটা শব্দ হলো দরজায়।
কাসেদ এবার আর তাকালো না। নিঃশব্দে ভাত খেতে লাগলো সে। খেতে খেতেই বললো, তোমার ইচ্ছা হলে ছেলেটিকে দেখতেও পারো। আর যদি মত না থাকে তাও বলতে পারো। সঙ্কোচের কিছু নেই। তবু চুপ করে রইলো নাহার। মুখখানা নুইয়ে পায়ের পাতার দিকে চেয়ে রইলো সে। কি ব্যাপার, কিছু বলছে না যে? নাহার নীরব। তোমার কি কোন মতামত নেই? তবু চুপ সে।
তুমি কি কিছুই বলবে না? কাসেদ স্থির দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে। আমি কি বলবাে? এতক্ষণে কথা বললো নাহার। ওর গলার স্বরে বিরক্তি আর বিতৃষ্ণা, আপনারা যা ভালো মনে করেন তাই করবেন, আমার কোন মতামত নেই। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলো। সে। শেষের দিকে গলাটা জড়িয়ে এলো তার। তখনো দাঁড়িয়ে সে। হ্যারিকেনের আলোয় মুখখানা ভালো করে দেখা গেলো না।
পাশের ঘরে মা দরুদ পড়ছেন শুয়ে শুয়ে। এখান থেকে সব কিছু শোনা যাচ্ছে স্পষ্ট। ভাত খেয়ে উঠে দাঁড়াতে থালাবাসনগুলো নিয়ে বেরিয়ে গেলো নাহার। ও চলে যেতে খাতা-কলম নিয়ে বসলো কাসেদ। লিখবে। ভীষণ লিখতে ইচ্ছে করছে ওর।
শেষ বিকেলের মেয়ে ! পর্ব- ৯