হারিয়ে খুজবে আমায়

হারিয়ে খুজবে আমায় !! Part- 13

সারা ঘর সমানে পায়চারি করছে শাফিন। একবার ঘরে যাচ্ছে আবার সিঁড়ির কাছে যাচ্ছে। কখন মা আসবে সে অনুর খবর নিতে পারবে এই আশায়। তার চিন্তার অবসান ঘটিয়ে তার মা এল। কিন্তু তার চোখ-মুখ ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। তার বুকটা ধ্বক করে উঠলো তাহলে কি মা অনুকে মানাতে পারেনি। না না মা তাকে বলেছে অনুর সাথে কথা বলবে আর মা কিছু বললে অনু তা কখনোই অমান্য করবেনা সে জানে তাই কৌতুহল ধরে রাখতে না পেরে সে জিজ্ঞেস করল

শাফিন: মা কথা হয়েছে তোমাদের কি বলেছে অনু? ও আমার কাছে ফিরবে বলেছে তাই না? আমি জানতাম ও তোমার কথা ফেলতে পারেনা। ও ঠিক চলে আসবে। তোমার তো খুশি হওয়ার কথা তোমার মুখটা এমন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে কেন? ওহ তুমি তো আবার ওকে পছন্দ করো না। মা একটু এডজাষ্ট করে নাও প্লিজ অনু অনেক ভালো মেয়ে তোমাকে অভিযোগের কোন সুযোগ দেবেনা। একবার ওকে আসতে দাও আমরা সবাই আবার একসাথে থাকব এই সময় তো সবার একসাথে থাকার প্রয়োজন। আমি তো সারাদিন অফিসে থাকব ওর দেখাশোনা করতে হবে। তাহলে আমরা এক কাজ করি অনু কবে আসবে বলেছে? আমি কালি জিনিসপত্র সব স্বিফট করে ফেলি নয়তো দেখবে অনু এই অবস্থায় কাজ করা শুরু করে দেবে। নিজের খেয়াল তো রাখেই না কি জানি আমার বাবাটার কি খেয়াল রাখছে। আচ্ছা তাহলে আমি উঠি মালপত্র গুলো সেট করার ব্যবস্থা করি।

রাহেলা:অনু ফিরবে না। শাফিন উঠে যাচ্ছিল মায়ের কথা শুনে আবার তার দিকে জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকালো,

শাফিন:অনু ফিরবে না মানে?

রাহেলা: ফিরবে না মানে ফিরবে না। ও তোর সাথে সংসার করতে ইচ্ছুক না।

শাফিন: সংসার করতে ইচ্ছুক না মানে কি? ওর ইচ্ছা-অনিচ্ছা কি আসে যায় আমি সংসার করতে ইচ্ছুক। সংসার তো আর ওর একার না আমারও তাহলে ও একা কেন সিদ্ধান্ত নেবে। আমি ওর সাথে কথা বলব আমি যাচ্ছি।

শাফিনের কথা শুনে শাওন বলে উঠলো

শাওন: যাচ্ছি মানে কই যাচ্ছিস। আগে মায়ের পুরো কথাটা শুনে যা। কি কথা হয়েছে তাদের মধ্যে। তারপর মিসেস রাহেলা তারার অনুর কথাগুলো বিস্তারিত বলল। আর অনু যে শাফিনের কাছে ফিরবে না তা পরিষ্কার করে জানিয়ে দিল।

ঠিকই তো করেছে ওর জায়গায় আমাদের বোন থাকলে আমি নিজেই সারাজীবন ওকে ঘরে বসিয়ে রাখতাম তারপরেও চরিত্রহীন পুরুষের সংসার করতে দিতাম না।আমার মতে অনু ঠিক কাজ করেছে। আর আমি জানি ও ঠিক নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারবে। আর মা তুমি বা কিভাবে এসব কথা অনুকে বলতে পারলে। এতদিন তো ঠিক মেয়ে মেয়ে করেছ এখন ছেলের অভিনয় দেখেই পর করে দিলে। অনু যদি তোমার মেয়ে হত তাহলে কি পারতে তাকে শাফিনের মত লোকের কাছে ফেরত পাঠাতে।বা শাফিনের জায়গায় যদি অনু হত তাহলে কি শাফিন তাকে মেনে নিত ?কখনোই না তাহলে অনু কেন মানবে মেয়ে বলে ?মেয়েদের কি আত্মসম্মান নেই যে তারা এত অপমানের পরেও শাফিনের মত মানুষের সাথে সংসার করবে। ওর বাবা মা ভালো মানুষ বলে এখন পর্যন্ত শাফিন কে কিছু করেনি আমি হলে জ্যান্ত পুঁতে দিতাম।

আর বারবার সে এতো ভালোবাসা ভালোবাসা করছে আজকে যদি ইরা তাকে মাঝরাস্তায় ফেলে না যেত তাহলে সে এতক্ষণে ইরার পেছনে ঘুরত। অনুর কথা মুখেও আনত না ।এখন ইরা নেই বলে অনুকে চাই। কি বিশ্বাস আছে ওর যে অন্য ইরাকে পেয়ে আবার অনুকে ছেড়ে যাবে না?

শাফিন সম্পূর্ণ নীরব হয়ে আছে মাথা নিচু করে মা আর ভাইয়ের কথাগুলো শুনছে ঠিকই তো বলছে তারা। খুব তো অন্যায় করছে সে অনুর সাথে। তাই বলে কি ক্ষমা হয় না? একবার কি মাফ করা যায় না? সে তো তার ভুল বুঝতে পারছে আর কষ্টও হচ্ছে। অনুকে যে করেই হোক ফিরিয়ে আনতে হবে দরকার হলে পায়ে ধরবে। যতক্ষণ না পর্যন্ত মাফ করবে ততক্ষণ পর্যন্ত হাল ছাড়ছে না সে। সে তার অনাগত বাচ্চাও অনুকে নিয়ে সুখে থাকতে চায়।

তারপর ভাবল আজকে আর না এমনিতেই অনেক ধকল গেছে অনুর উপর। তাই আর আজকে যাবে না সে অনুর কাছে কাল যাবে। একদিনে বেশি উত্তেজিত হলে অনু অসুস্থ হয়ে যাবে।এমনিতেই ডক্টর নিষেধ করেছে বেশি মানসিক চাপ না দিতে।

দুদিন পর, সকাল 4 টা
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে আছে অনুর বাবা-মা অনু ও সাদাত। তারা অনুকে সি অফ করতে এসেছে। অনুর মা প্রচন্ড কান্না করছে কান্না দেখে মনে হচ্ছে অনু সারা জীবনের জন্য চলে যাচ্ছে।

অনু: হয়েছে মা আর কত কাঁদবে আমি তো আর সারা জীবনের জন্য যাচ্ছি না। তুমি এমন করে কাঁদালে আমি কি যেতে পারবো ?আমারও তো কষ্ট হচ্ছে কই আমি তো কাঁদছি না আর তাছাড়া প্রতিদিন কথা হবে তোমাদের সাথে। খুব বেশি খারাপ লাগলে চলে যাবে আমাকে দেখতে। খুব কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছি ।কান্না বন্ধ করো নয়তো আমি যাচ্ছি না।

অনেক কষ্টে রাবেয়ার কান্না থামে । একমাত্র মেয়ে কয় বছরের জন্য বিদেশ যাচ্ছে। তাছাড়া মেয়েটা একা এত দূরে পরদেশে গিয়ে কি মেয়ে ভালো থাকবে? কি খাবে না খাবে কে যত্ন নিবে তার?এ নিয়ে বেশ চিন্তা হচ্ছে তার যদিও সাদাত তাকে আশ্বস্ত করেছে অনুর কোন ধরনের অসুবিধা হবে না তবুও মায়ের মন তো।

আরো কয়েকদিন থাকতে পারতো সে কিন্তু শাফিন ছেলেটা আবার এসে সব গন্ডগোল করে দিল তাই বড় কিছু হওয়ার আগেই অনুমান এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যেতে চায়।অনেক কষ্টে সামলেছে নিজেকে কিন্তু শাফিন বারবার এসে তাকে লন্ডভন্ড করে দিয়ে যায়।

আর গতকালকে ব্যবহার তো সে চাইলেও জীবনেও ভুলতে পারবে না। শাফিনের জন্য অনুর মনে যে সম্মান টুকু ছিল তাও শেষ হয়ে গেল।

গতকাল ভোরের কথা,
অনু মাত্র নামাজ থেকে উঠেছে এ মধ্যেই সে শুনতে পেল বাইরে থেকে কে যেন তার নাম ধরে ডাকছে অনুর বুঝতে দেরী হলো না এটা কার গলা। সে চুপচাপ বসে রইল শাফিনের ডাকগুলো সে শুনেও না শোনার ভান করে থাকলো কিন্তু তার আকুতি মিনতি ভরা কন্ঠ শুনে আর তাকে উপেক্ষা করতে পারল না। প্রথম ভালোবাসা বলে কথা। সে বারান্দায় বেরিয়ে এলো।

অনু:বলুন কি বলতে চান। কালকেই তো সব ক্লিয়ার করে দিয়েছি আমি আপনার সংসার করছি না আপনাকে মুক্তি দিয়ে দিয়েছি। আমার মুখ আর আপনার দেখার প্রয়োজন পড়বে না।

শাফিন:অনু প্লিজ এভাবে বলোনা তুমি তো জানো কতটা অগোছালো আমি। রাগের মাথায় আমি কি বলে ফেলি নিজেও জানিনা। অনু আমি ভুল করেছি এবারের মত মাফ করে দাও। আবার আগের মত হয়ে যাই।

অনু বারান্দায় আর শাফিন নিচে দাঁড়িয়ে কথা বলছে।তাই সুবিধার জন্য শাফিন অনুকে নিচে নামতে বললো ।নীচে নেমে শাফিনের মুখোমুখি দাঁড়ালো অনু।

অনু: কত সহজ না মুখে বলতে সবকিছু ভুলে যাও আবার আগের মত হয়ে যাই। কিন্তু সত্যিই কি এত সহজ। আপনার কি মনে হয় এত তাড়াতাড়ি অমি আমার অপমানের কথা আমি ভুলে যাব। আপনি আমার যোগ্যতা নিয়ে আমার লাইফ স্টাইল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খাওয়া নিয়ে খোটা দিয়েছেন ইভেন আমাদের ভালোবাসা মুহূর্তটাকে আপনি সেটিসফেকশন এর নাম দিয়ে জঘন্য করেছেন। একটা বাইরের মেয়ের সাথে আমার তুলনা করেছেন।এতকিছুর পরেও মনে হয় আপনার কাছে আমি ফিরব? এ কয়েক বছরে এই চিনেছেন আমাকে।সত্যি কথা বলতে আপনি আমাকে ভালোবাসেননি।ভালোবাসাটা একতরফা শুধু আমার পক্ষ থেকে ছিল।

আপনার সবগুলো প্রশ্নের জবাব নিয়ে আমার যোগ্যতা প্রমাণ দিয়ে তবে আমি আপনার সামনে আসব কিন্তু আপনার স্ত্রী হিসেবে না সে তো সেদিনই মারা গেছে যেদিন তার স্বামী তাকে রেখে অন্য নারীকে নিয়ে মেতে উঠেছে।

শাফিন: প্লিজ অনু সেগুলো একটাও সত্যি কথা ছিল না আমি মন থেকে একটা কথা বলিনি। রাগের মাথায় বলে ফেলেছি তুমি তো জানোই রাগ উঠে আমি একটা জানোয়ার হয়ে যাই। প্লিজ অনু অন্তত আমাদের বাচ্চাটার কথা ভাবো আমার বাবা ডাক থেকে বঞ্চিত করো না।আমি যখন জানতে পেরেছি আমার কেমন যে অনুভূতি হয়েছিল তোমাকে বলে বোঝাতে পারবোনা আমার কাছ থেকে আমার এই অনুভূতিকে কেড়ে নিও না। আমি একজন ভালো বাবা হতে চাই ভালো স্বামী হতে চাই। আমার সন্তানের সব দায়িত্ব পালন করতে চাই। আমাকে একটা সুযোগ দিয়ে দেখো কখনোই তোমার অমর্যাদা করবো না। তোমার কাছ থেকে দূরে গিয়ে আমি বুঝতে পেরেছি তুমি আমার জন্য কি ।তুমি বিশ্বাস করবে না কিনা জানিনা তুমি যাওয়ার পর একটা রাত আমি ঘুমাতে পারিনি। তোমাকে আমি ভালোবাসি অনু।

কোন উত্তেজিত হয়ে উঠলো,

অনু: আপনার এই ভালোবাসা কোথায় ছিল যখন আপনি অন্য মেয়ের সাথে রাত কাটিয়েছেন, এই ভালোবাসা কোথায় ছিল যখন আমার গায়ে হাত তুলেছেন, আপনার ভালোবাসা কই ছিলো যখন আপনি আমাকে অপমান করেছিলেন।ভালোবাসার মানুষকে আর যাইহোক কষ্ট দেওয়া যায় না কই আমি তো পারিনি এত কিছুর পরেও আপনার ক্ষতি করতে কারন আমার ভালোবাসাটা সত্যি ছিল।

আর আপনি আমাকে কেন নিতে চাচ্ছেন আমি তো আপনার যোগ্যই না আপনাকে শারীরিক দিক দিয়ে সুখী করতে পারি নি এখন তো আরো পারবোনা প্র্যাকটিস নেই তো অনেক দিনের তাই আমাকে নিয়ে লাভ হবে না।তাছাড়া প্রেগনেন্ট অবস্থায় পারফরম্যান্স ভালো হবে না। তার থেকে ভালো যে আপনার যোগ্য স্টাইলিশ মডেলের মত দেখতে হবে, আপনাকে প্রপার ভাবে স্যাটিসফাই করতে পারবে, বসে বসে আপনার অন্ন ধ্বংস করবে না, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করবে এমন মেয়েকে বিয়ে করা উচিত।যাকে দেখে আপনার ফ্রেন্ডরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ করবে আর আমি থাকলে তো আপনি বারবার তাদের কাছ থেকে অপমানিত হবেন বিব্রত হবেন।

এবার শাফিনের মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছে।সে কি বোঝাতে চাচ্ছে বারবার আর অনু কি করছে এর মধ্যেই হঠাৎ আগমন হয় সাদাতের।

সাদাত: অনু তুই এত সকালে বাইরে তাও আবার এই লোকটার সাথে। আর তোর সাহস কিভাবে হল আবার অনুর সাথে কথা বলতে ।তোকে না আমি নিষেধ করেছিলাম এই এলাকায় না আসতে আর অনুর আশেপাশে না ঘেঁষতে (শাফিনের কলার ধরে) এবার শাফিন আর নিজের রাগকে ধরে রাখতে পারলো না তাই সে সাদাতের নাক বরাবর ঘুসি দিল সাদাত ও কম না।দুজনের মধ্যে মারামারি লেগে গেল। অনু তাদের থামাতে চেষ্টা করছে । শেষে না পেরে সে শাফিনের গালে চড় মারল।

এই রাগটাই শাফিনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো আর অনুর চর যেন আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করলো।

শাফিন: ও তাহলে এই ব্যাপার এজন্যই তুমি আমার কাছে যেতে চাচ্ছো না নতুন নাগর জুটিয়েছো। এসব তো আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল।এই সত্যি কথা বলতো বাচ্চাটাকি আমার নাকি তোমার সাদাত ভাইয়ের? না মানে তুমি তো তাই প্রায় মায়ের নাম করে এখানে আসো তখন হয়তো তোমাদের মধ্যে সম্পর্ক হয়ে গেছে । আমি তো আর তোমাকে পাহারা দিয়ে রাখতাম না। আর এসব কুকীর্তি কারে প্রেগনেন্ট হলে আর বাচ্চাটাকে আমার নামে চালিয়ে দিচ্ছো।আর ইরা তো একটা ইস্যু মাত্র আমার কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য।এবার আমি সব ঘটনা বুঝতে পারছি। কেন তুমি এতকিছুর পরও বেশ হাসিখুশি ছিলে।

কথাটা শুনে অনু হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না শেষ পর্যন্ত এই অপবাদ শুনতে হলো নিজের চরিত্র নিয়ে। আর অন্য দিকে সাদাত কথাগুলো শোনা মাত্রই ইচ্ছেমতো শাফিনকে পিটিয়ে পুলিশ খবর দিল আগে থেকেই তার নামে জিডি থাকার কারণে সহজ হলো।কারণ সাদাত জানত শাফিন এত সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নয় সে আবার আসবে।আর অনু বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়ল।

অনু সারাদিনে আর একটা কথাও বলেনি সবাই তাকে নানান ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছে কিন্তু সে একদম নির্বাক শুধু একটা কথাই বলল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি এখান থেকে চলে যেতে চাই পারলে আজকেই।

তারপর থেকেই সাদাত টিকিটের জন্য অনলাইনে ঘাঁটতে লাগল যেহেতু ভিসা আছে যেকোনো সময় যেতে পারবে কিন্তু টিকিট দুইদিন পরের পাওয়া গেল।

আর তাই আজ তারা দেশ ছাড়ছে নির্ধারিত সময়ের তিন দিন আগে। এ দুইদিন শাফিন জেলে ছিল তাই ওর সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি।

চলবে,…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *