স্বীকৃতি

স্বীকৃতি !! Part- 09

সন্ধ্যে নামার সাথে সাথে কষ্ট টা যেনো বাড়তে থাকে। এই বাড়িতে আসার পর সেই কষ্টটা তীব্রতর হয়ে গেলো।
অনেক বেশিই মনে পড়ছে খুশবুর ফারাজকে। যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলো, তাকে না পাওয়ার যন্ত্রনা যে পায়না সেই বুঝে। এমন টা না হলেও চলতো।
.
কিছুক্ষণ নিজের রুমে পায়চারী করে খুশবু তার ড্রয়ারটা খুললো।
একটি বড় বক্স রাখা আছে। বক্সটি নিয়ে মেঝেতে বসলো খুশবু। এর ভেতরে যা আছে সবই ফারাজের দেয়া উপহার। অনেক যত্ন সহকারে সে রেখে দিয়েছে সে এসব।
.
একেএকে বের করতে লাগলো সব উপহার। কিছু শুকনো ফুল! খুশবুর কাছে মনেহচ্ছে এখনো তাজা। একটা পারফিউমের খালি বোতল। খালি হলেও ঘ্রাণ টা যেনো পাচ্ছে সে! কয়েকটি কার্ড৷ তাতে আছে ফারাজের হাতের লেখা। এরপর সে পেলো তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটি। একটি রিং। এই রিংটি সম্পর্কের শুরুতেই খুশবুর আঙুলে পরিয়ে দিয়েছিলো ফারাজ। একেবারেই রঙ চলে গিয়েছে রিংটির। এতোদিন তা বক্সের মাঝে রাখলেও, আজ খুশবুর খুব করে ইচ্ছে করছে রিংটি পরতে। দেরী করলোনা সে। চুপচাপ নিজের আঙুলে ঢুকিয়ে নিলো রিংটি। আবারো মনোযোগ দিলো ফারাজের দেয়া উপহার গুলোর দিকে।

যে ছেলে বিয়ের আগে নিজের ভালোবাসার জন্য কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনা, বিয়ের পরে মেয়েটির স্বামীর কাছে তাকে ছোট করে নিজের করতে চায়, এমন একটা ছেলে কখনো কাউকে ভালোবাসতে পারেনা। আর তার হাতে খুশবুকে সে তুলে দিতে পারেনা। হোকনা সে খুশবুর ভালোবাসা। কথায় আছে, ভালোবাসা মানুষকে অন্ধ করে দেয়। খুশবুকেও নিশ্চয় করে দিয়েছে। তাই আরহাম সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে, খুশবুর মন থেকে ফারাজ নামক ছেলেটির নাম মুছে দিতে। খুশবুর মনে নিজের জন্য জায়গা তৈরী করতে হবে। আর এজন্য খুশবুর উপলব্ধি করতে হবে, আরহাম তাকে ভালোবাসে। যে ভালোবাসায় কোনো স্বার্থ নেই।
তবে কি সে সত্যিই ভালোবাসে খুশবুকে? কিন্তু কেনো? যে মেয়েটির সম্পর্কে বিয়ের রাতেই খারাপ ধারণা পেয়েছে, সে মেয়েটিকে কি করে সে ভালোবাসতে পারে?
পকেটে হাত দিয়ে একটা রিং বের করলো আরহাম। কয়েকদিন আগেই সে খুশবুর জন্য এটি কিনেছে, কিন্তু দেয়নি। আজ কি রিংটা দিবে সে?
ভাবতে থাকলো আরহাম।

সবেমাত্রই বৃষ্টি বন্ধ হয়েছে। তবে হালকা বাতাস বইছে চারদিকে। আফসানা ড্রয়িংরুমের জানালা খুলতেই ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো।
মাত্রই এসেছে ফাহিম। আফসানার মুখ দেখে বুঝতে পারলো ভয় পেয়েছে সে। দ্রুত জানালার পাশে এসে ফাহিম বললো-
শব্দ করোনা। একটা জিনিস দিয়েই চলে যাবো। ভালোই হলো তোমাকে এখানে পেয়ে, আর ফোন করতে হলোনা।
.
আফসানা খেয়াল করলো, ফাহিম ভিজে একাকার হয়ে গিয়েছে। এই বৃষ্টির মাঝে কি দিতে এসেছে সে!
একটা প্যাকেট জানালার ফাঁক দিয়ে খুব সহজেই ঢুকিয়ে দিলো ফাহিম।
আফসানা বললো-
কি আছে এতে?
-দেখে নিও। আমি আসি এখন।
-একটু বসলেই পারতেন।
-তোমাদের সুন্দর সোফা গুলো ভিজে যাবে।
.
কথাটি বলেই ফাহিম চলে গেলো।
আফসানা সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে প্যাকেট টি খুললো। একটা গোলাপি রঙের জর্জেটের শাড়ি তাতে! শাড়িটা দেখেই মুখে হাসি ফুটলো আফসানার। এমন অপ্রত্যাশিত উপহার পেতে কার না ভালো লাগে!
-এ কি! এই রাতে তোকে এই উপহার কে দিলোরে জানালা দিয়ে?
.
মায়ের প্রশ্নে আফসানা মুচকি হেসে জবাব দিলো-
ভুত!
.
.
.
খুশবুর রুমে এসে তাকে এই অবস্থায় দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো আরহাম।
মেয়েটা নিশ্চয় কেঁদেছে, তাইতো চোখে দেয়া কাজল গুলো কালো পানি হয়ে বেয়ে পড়ছে। মেঝেতে বসে আছে নিশ্চুপ ভাবে।
আরহাম তার পাশে এসে বসতেই নড়েচড়ে উঠলো খুশবু।
হাত দিয়ে চোখের পানি গুলো মুছতে লাগলো। কাজলের কালি সারামুখে লেপ্টে গেলো। আরহাম বললো-
ওয়াশরুমে গিয়ে মুখটা ধুয়ে আসো একেবারে।
-জ্বী।
.
খুশবু ওয়াশরুমে আসতেই আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে চোখ পড়লো।
নিজেকে দেখে নিজেই চমকে গেলো সে। কিন্তু আরহাম তার এই অবস্থা কেনো জিজ্ঞাসা করেনি! করেও লাভ কি। আরহাম তো তার প্রতি মগ্ন নয়। ভালোই হলো। যদি স্বামীর অধিকার আদায় করতে চায়তো, তাহলে কি করতো সে? ফারাজ ছাড়া অন্য কাউকে মেনে নেয়া সম্ভব নয় খুশবুর পক্ষে।
এসব ভেবে মুখটা ধুতে লাগলো খুশবু।
.
ওয়াশরুমের বাইরে আসতেই তার দিকে তোয়ালে এগিয়ে দিলো আরহাম।
খুশবু তা নিয়ে মুখটা মুছতে লাগলো।
আরহাম বললো-
একটা জিনিস দিতে চাই তোমাকে। না মানে, তোমার পরিবারের সকলে দেখলে খুশি হবে। মেয়ের জামাই মেয়ের জন্য কিছু এনেছে জানলে সব মা বাবাই খুশি হয়। নিবে তুমি?
-জ্বী।
.
আরহাম রিংটা এগিয়ে দিলো খুশবুর দিকে।
খুশবুর আঙুলে ফারাজের দেয়া রিংটা রয়েছে। রঙহীন এই রিংটিই যেনো খুশবুর কাছে শ্রেষ্ঠ উপহার।
খুশবুর যে আঙুলে আরহামের দেয়া রিং থাকা উচিত সেই আঙুলে একটি রঙহীন রিং! আরহামের বুঝতে বাকি রইলো না, কার দেয়া এটি। খুব স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টা নিলো আরহাম। খুশবুর উদ্দেশ্যে বললো-
আমার দেয়া রিংটি অন্য আঙুলে পরে নিও। ওটা খুলতে হবেনা। যেকোনো একটা আঙুলে ঠাই দিলে চলবে।
.
আরহামের কথা শুনে খুশবুর মুখে এক চিলতে হাসি ফুটলো। কিছু জানেনা মানুষটি, তবুও এতো ভালোভাবে বুঝে কি করে সে খুশবুকে?
.
.
একটা রাত কেটে গেলো।
কাক ডাকা ভোরে খুশির ফোনের রিং টুন বেজে উঠলো। অনন্তের ফোন পেয়ে খানিকটা অবাকই হলো সে। খুশির কাছে বেরসিক একজন প্রেমিক অনন্ত। যে প্রেমের মানেই বুঝেনা। সারাদিনে দু’একবার ফোন দেয় খুশিকে। খুশিই ফোন দিতে থাকে।
অনন্তের একটাই কথা। পাশাপাশি বাসায় এতো ফোন কেনো দিতে হয়? উঠতে বসতে দেখা হয় তাদের।
ফোনে কথা বলার কি আছে!
আজ সেই ছেলেই কি করে কাক ডাকা ভোরে ফোন দিলো!
এসব ভাবতে ভাবতেই ফোন কেটে গেলো। খুশি নিজের মাথায় একটা বারি দিয়ে কল করলো অনন্তকে।
-হ্যালো অনন্ত?
-জেগে আছো তুমি?
-তোমার ফোনে উঠলাম।
-ওহ! আসতে পারবে একটু বাইরে?
-কেনো?
-আসোইনা।
.
অনন্তের আচরণে চমকে যাচ্ছে খুশি। কি হলো তার হঠাৎ?
.
উঠোনে এসেই অনন্তকে দেখতে পেলো খুশি।
তার হাতে এক গুচ্ছ তাজা লাল গোলাপ। মনেহচ্ছে মাত্রই গাছ থেকে ছিড়েছে। খুশি চেঁচিয়ে বলে উঠলো-
ও মাই গড!
-ধীরে খুশি! কেউ শুনে ফেলবে।
.
অনন্তের কাছে এসে তার হাত থেকে ফুলগুলো নিলো খুশি। ফুল পেয়েও এতো খুশি কেউ হতে পারে! খুশিকে না দেখলে যেনো জানতোই না অনন্ত।
-ফুল ভালো লাগে?
-অনেক বেশি। প্রিয় মানুষটির কাছ থেকে পেতে তো আরো বেশি।

খুশির একটা হাতে নিজের হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করলো অনন্ত।
খুশি চমকে গেলো!
-কি ব্যাপার? এমন ভাবে চমকালে যেনো আগে কখনো হাত ধরিনি?
-সেতো বন্ধু ছিলে, প্রেমিক অনন্ত তো ধরেনি।
-প্রেমিক অনন্ত আরো অনেক কিছুই পারে।
-কথাই না বলে মাঝেমাঝে কিছু করে দেখাতে তো পারে।
-তাতে খুশি আরো বেশি খুশি হবে?
-হু। কেননা খুশি মাতাল হতে চায় প্রেমে।
.
.
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ছাদে হাঁটা অভ্যেস ছিলো খুশবুর। বিয়ের পরে শ্বশুর বাড়িতে অভ্যেসটা বদলাতে চায়লেও এখানে এসে পারলোনা। হাটাহাটি করতে লাগলো ছাদে।
হঠাৎ চোখ যায় তার উঠোনের দিকে।
উঠোনের মাঝখানে বড়সড় একটা দোলনা রাখা আছে। সেই দোলনায় বসে আছে অনন্ত ও খুশি। অনন্তের কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে খুশি। এমন একটা দৃশ্য দেখে খুশবু যেনো বড়সড় একটা ধাক্কা খেলো! এগিয়ে যেতে থাকলো সে নিচের দিকে।
.
চলবে