সাঁঝের প্রেম

সাঁঝের প্রেম !! Part- 24

সায়েম সকালে এক প্রকার বাধ্য হয়েই অফিসে গেলো কিন্তু মনটা পরে আছে নিশির দিকেই। নিশি অসুস্থ। আসার সময় মাইসারা ও কাঁদছিলো। কোনোমতে অফিসে সবাইকে সব বুঝিয়ে দিয়ে সায়েম অফিস থেকে বেরিয়ে আসে। বাসায় এসে দেখে নিশি মাইসারাকে কাছে নিয়ে ঘুমিয়ে আছে আর মাইসারাও ঘুমাচ্ছে। মনের ভেতর এক অদ্ভুত শান্তি লাগলো সায়েমের। সায়েম শার্টের বোতাম খুলছিলো আর মনে মনে বলছে,

-জানিনা ভাইয়া কতটুকু সুখে বা শান্তিতে রাখতে পেরেছি নিশিকে। হয়ত তোর মতো ভালবাসা পাইনি ওর থেকে কিন্তু যেটুকু পেয়েছি সেইটুকু নিয়েই বেঁচে আছি। কেনো যেনো আমার মনে হয় আমি তোর মতো হতে পারবনা যদিও আমি সেইটা চাইনা। সত্যি তুই অনেক লাকি ছিলি ভাইয়া নিশির জন্য। ওর মতো শান্ত, ধৈর্যশীল আর স্বামীভক্ত মেয়ে হয়না।

-সায়েম বাবা লাঞ্চ করবিনা? (ঘরে ঢুকে ছোট মা)
-হুশ! আস্তে কথা বলো। মা মেয়ে ঘুমাচ্ছে৷ আমার নাম শুনলেই জেগে যাবে। (আম্মুর দিকে এগিয়ে গিয়ে সায়েম)
-আচ্ছা তুই আয়।
-নিশি জাগুক। এক সাথে খাব। আমি এখন একটু বাইরে যাব।
-কেন?
-নিশির কতকিছু নাই। মার্কেটে যাই, গিয়ে নিয়ে আসি। কোনোদিন নিজে বলেনি আমার এইটা লাগবে। আমারই দেখতে হয়।
-বাইরে যাবি তাহলে শার্ট খুলছিস কেন?
-পাঞ্জাবি পরে যাব।
-আচ্ছা যা। আর তোর শ্বাশুড়ির ওষুধ শেষ নিয়ে আসিস।
-কোন ওষুধ?
-হার্টের ওষুধ টা।
-আচ্ছা যাচ্ছি। আর তোমার কিছু লাগবেনা?
-না আমার কিছু লাগবেনা। নিশি আমার প্রতিটা জিনিস খুঁতিয়ে খুঁতিয়ে দেখে আর তোকে বলে আনার জন্য। মেয়েটা সত্যিই খুব ভালো। ওর মতো ছেলের বউ হয়না৷
-হুম।

সায়েম পাঞ্জাবি, জিন্স আর স্যান্ডেল পরে বের হলো বাইরে যাওয়ার জন্য। পাঞ্জাবির হাতা বটতে গিয়ে সায়েম হাতার উলটা ভাঁঝে একটা কাগজ দেখলো। সায়েম টান দিয়ে কাগজ তুললো। পাঞ্জাবির সাইজ নাম্বার লিখা ছিলো কাগজটাতে। সায়েম ভেবেছিলো হয়ত নিশি ইচ্ছে করে কাগজ সেলাই করে রেখেছে সায়েমকে হ্যারাস করার জন্য। এইসব নিশি সবসময় করে আর সায়েমকে বলে স্বামী স্ত্রী মজা করা সুন্নত। এইসব শুনে সায়েমের অটোমেটিক হাসি চলে আসতো। সায়েম মার্কেটে গিয়ে নিশির জন্য কিছু কসমেটিকস আর থ্রি পিস কিনলো। নিশি কোনোদিন দামী থ্রি পিস পরতে চায়নি। সবসময় সাদাসিদে থাকতে পছন্দ করে। সায়েম এইবার উলটা কাজ করলো। নিশির জন্য দামী থ্রি পিস ই কিনে নিয়ে গেলো। সায়েমের তখন মনে হলো একটা বোরকাই তো নিশি পরে কয়েকমাস ধরে তখন নিশির জন্য বোরকা ও কিনলো। যদিও নিশি আজ সায়েমকে অনেক বকবে তবুও সায়েম কেয়ার করলো না। বাসায় আসার সময় সায়েম মাইসারার জন্য ও খেলনা নিয়ে আসে অনেকগুলো। বাসায় আসার পথে সায়েমের এক বন্ধুর সাথে দেখা। বন্ধু সায়েমকে বলে,

-বিয়ের পর তুই অনেক পালটে গেছিস সায়েম। আগে আমরা একসাথে আড্ডা দিতাম, খেলতাম, ঘুরতাম, কত্ত মজা করতাম। আর এসবের লিডার ছিলি তুই। এখন তুই নেই বলে ওইসব করাও হয়না।
-কিছু করার নেই। নিশি চায়না তাই আমি ওইসব করিনা। কিন্তু তোদের জন্য ভালবাসাটা থাকবে।
-ভাবিকে ভালো রাখিস। প্রাউড অফ ইউ বন্ধু! তোর মতো বন্ধু হয়না।
-ছাড় তো! তুই কবে বিয়ে করছিস?
-এজ সুন এজ পসিবল।

সায়েম ওর বন্ধুর সাথে কথা বলতে বলতে বাসায় আসে। সায়েমের হাতে এতকিছু দেখে দারোয়ান এগিয়ে এসে সাহায্য করে। কিন্তু সায়েম নিষেধ করে। সায়েম ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র গুলো ড্রইংরুমে রাখলো আর তখন তুর্না বের হলো নিশির ঘর থেকে। তুর্নাকে দেখে সায়েম হেসে জিজ্ঞেস করে,

-কখন আসলা?
-এইত দশ মিনিট আগে।
-মেহরাব আসেনি?
-আসতেছে। তুমি ভালো আছো?
-আলহামদুলিল্লাহ! তুমি কেমন আছো?
-হ্যা ভালো।
-তো হঠাৎ?
-কেন আসতে পারবনা?
-অবশ্যই পারবা। আফটার অল আমার শালিকা হও। যখন ইচ্ছা আসতে পারো।
-আগের থেকে অনেক বেশি স্মার্ট হয়ে গেছো।
-ক্ষেত ছিলাম কবে?
-কোনোকালেই না! তারপরেও।
-তোমার বোন কি জেগেছে?
-হ্যা কিছুক্ষণ আগেই জেগেছে।
-তুমি মায়ের সাথে কথা বলো। আমি তোমার বোনকে দেখে আসি।
-আচ্ছা যাও।

তুর্না সায়েমের আনা জিনিসপত্র গুলো গুছিয়ে রাখে। মাইসারার খেলনা গুলো টেবিলের উপর রাখে আর নিশির জন্য আনা জিনিসগুলো গুছিয়ে রাখে। মায়ের ওষুধ মা কে দিয়ে আসে।

-ঘুম ভাঙছে? (সায়েম)
-হ্যা। তুমি বাসায়? ছোট মা তো কিছু বলল না? (অবাক হয়ে নিশি)
-হ্যা বাসায় এসেছি লাঞ্চ টাইমে৷ উঠে ফ্রেশ হও। তোমার সাথে লাঞ্চ করব বলে আমি না খেয়ে আছি এখনো। (মাইসারাকে কোলে নিয়ে আদর করছে সায়েম)
-আসছি। (চোখ বড় বড় করে তাঁকিয়ে নিশি)
-এভাবে তাঁকাও কেন?
-না ভাবছি কে কি বলছে।
-এহ খাই না মনে হয় একসাথে?
-হ্যা সেইটা আমি জোর করার পর।
-চাপা!
-চুপ।

সায়েম মাইসারাকে কোলে নিয়েই শ্বাশুড়ির ঘরে গেলো।

-মা ওষুধ পেয়েছেন?
-হ্যা বাবা।
-তুর্না মাইসারাকে ধরো। আমি আর নিশি লাঞ্চ করে আসি।
-এখনো খাও নাই তোমরা? (মাইসারাকে কোলে নিয়ে তুর্না)
-না। খেয়ে আড্ডা দিব নে। তুমি লাঞ্চ করছো?
-হ্যা করেছি।

সায়েম খাবার বেড়ে নিশি আর ওর জন্য একপ্লেটে নিয়ে গেলো। নিশি তখন মুখ মুছছিলো।

-আরে বাবা বসো না। ক্ষুধা লাগছে। (নিশিকে সায়েম বলল)
-আসছি।
-হা কর খাইয়ে দিচ্ছি।
-করলাম।
-পেট ব্যাথা কমেছে?
-হ্যা কমেছে।
-মাথা ঘুরছে?
-না।

সায়েম আর নিশি একসাথে লাঞ্চ করলো। খাওয়া শেষে সায়েম যখন রান্নাঘরে প্লেট ধুচ্ছিলো তখন দেখে মেহরাব মাইসারাকে কোলে নিয়ে ড্রইংরুমে বসে আছে। প্লেট ধুয়ে সায়েম মেহরাবের সামনে গেলো।

– আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া। ভালো আছেন? (মেহরাব)
-হ্যা। তুমি ভালো আছো? (মেহরাবকে জড়িয়ে ধরে সায়েম)
-হ্যা আলহামদুলিল্লাহ। আপনি আর আপু খাচ্ছিলেন তাই আর বিরক্ত করিনি।
-বিরক্ত করার কি আছে? কখন আসলা? আর দুইজন আলাদা আলাদা কেন? (সোফায় বসে সায়েম)
-আমি অফিস থেকে এসেছি আর ম্যাডাম বাসা থেকে এসেছে। আপু আসসালামু আলাইকুম। (নিশিকে সালাম দিয়ে মেহরাব)
-ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছো ভাই? (নিশি)
-আলহামদুলিল্লাহ। আপনার বোনের আদেশ আজকেই নাকি আসা লাগবে এইখানে। অনেকদিন ধরে নাকি আসেনা।
-ঠিকই তো মেহরাব। কতদিন হয়েছে বলো তো? (ছোট মা)
-আন্টি আপনি আর তুর্নাকে সায় দিয়েন না। ও যা জেদি। (মেহরাব)
-শুরু হয়ে গেছে আমার বদনাম করা? (তুর্না)
-হাহাহা মেহরাব বউয়ের বদনাম করতে নাই। জায়গামতো ধুয়ে দিবে পরে। (সায়েম)
-হ্যা সে আবার এসব ভালো বুঝে! (নিশি)

সবাই যখন গল্প করছে তখন নিশি সায়েমকে ইশারায় একটু ডাকে। সায়েম উঠে আসে নিশির কাছে৷ নিশি সায়েমকে বলে,

-একটু বাজারে যাও তো।
-কেন? কি লাগবে?
-কিছু মশলা লাগবে। রাতে রান্না করা লাগবে।
-কে রান্না করবে? (চোখ পাঁকিয়ে সায়েম)
-আচ্ছা এমন করে তাঁকাও কেন? আমি ছাড়া আর কে রান্না করবে?
-চুপ। তুমি অসুস্থ জানো না? আমি রান্না করব নে।
-হাহা তারপর সেগুলো সবাই বমি করে ফেলে দিবে।
-জ্বি না। আমি শিখছি রান্না করা।
-সাহায্য করো আমাকে তাহলেই হবে। এখন গিয়ে মশলা আনো যাও।
-লিখে দাও নয়ত ভুলে যাব।
-দিচ্ছি।

নিশি ছোট মা কে বলছে কি কি রাঁধবে আর ছোট মা হ্যা বলে যাচ্ছে। বাজার থেকে এসে সায়েম নিশিকে হেল্প করে রান্নার কাজে। তুর্না তখন মেহরাবকে ডেকে বলে,

-ওদের দেখে শিখো কিছু। সারাক্ষণ তো হুকুমজারি করেই যাও।
-আমি চাইলেও সায়েম ভাইয়া হতে পারবনা। তুমি আগে নিশি আপুর মতো হয়ে দেখাও এরপর আমি সায়েম ভাইয়া হওয়ার ট্রাই করব নে।
-কি খারাপ ছেলে রে!

রাত নয়টায়,

সায়েম নিশিকে বসতে বলে নিজেই ডায়নিং সাজাচ্ছে আর সাহায্য করছে ছোট মা আর তুর্না। সব খাবার সার্ভ হয়ে যাওয়ার পর মেহরাবকে ডেকে আনে সায়েম। সবাই একসাথে খেতে বসে কিন্তু নিশি টায়ার্ড। নিশির বদলে সায়েম সবাইকে সার্ভ করছে। তুর্না সার্ভ করতে চাইলে তুর্নাকে ধমক দিয়ে বসায় সায়েম। নতুন পাঞ্জাবিটার বারোটা বাজিয়ে ফেলেছে সায়েম। সবাই ডিনার করার পর সায়েম নিশিকে খাইয়ে দিয়ে নিজে ডিনার করে। গল্প করে সবার ঘুমাতে ঘুমাতে অর্ধ রাত হয়ে যায়। মাইসারা সায়েমের কোলেই ঘুমিয়ে যায়। রাতে সবাই যে যার যার ঘরে শুতে গেলো। সায়েম দরজা লাগিয়ে পাঞ্জাবি চেঞ্জ করে টি-শার্ট পরে। নিশি তখন মাইসারার ঘুমন্ত মুখে হাত বোলাচ্ছে।

-নিশি?
-হ্যা বলো।
-চাপো আমি একটু শুই। তোমাদের মা মেয়ের পুরো খাট লাগে। আমি বেচারা একটু জায়গায় পরে থাকি।
-আমার লাগেনা। তোমার মেয়েরই লাগে। সারারাত নড়াচড়া করে আর আমায় পেছাতে হয়। বাই দ্যা ওয়ে নামাজ পড়ছো?
-হ্যা ডিনারের আগেই না পড়লাম।
-ও হ্যা ভুলে গেছিলাম। গুড বয়। (হাসি দিয়ে নিশি)
-থ্যাংক ইউ। (নিশির নাকে নাক ঘষে সায়েম)
-সায়েম আমার না ঘুম আসছে না।
-দিনে ঘুমাইছো যে! জামাকাপড় গুলো পছন্দ হয়েছে?
-হ্যা কিন্তু এত দামী ড্রেস আমি পরিনা। জানো না?
-এখন থেকে পরবা। তুমি সায়েমের বউ ওকে? সায়েমের একটা প্রেস্টিজ আছে।
-প্রেস্টিজ ধুয়ে পানি খাও। আমি তো বের হইনা যে তোমার প্রেস্টিজ যাবে!
-আমার মনের প্রেস্টিজেই লাগে। আমার বউ অত্যন্ত সুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও এভাবে থাকে সেইটা আমার পছন্দ না।
-আচ্ছা থাকবনে গুছিয়ে।
-ভেরি গুড বউ। ঘুম পাড়িয়ে দেই?
-না ঘুম আসছে না।
-আসো তাহলে।
-কোথায়?
-বারান্দায় যাই।
-যাও আমি আসছি।

নিশি হাতখোপা করে ওড়না ছাড়াই বারান্দায় গেলো। সায়েম আর্ম চেয়ারে বসেছিলো। নিশি আসার পর নিশি কে সায়েম ওর কোলে বসালো আর নিশি আরেক চেয়ারে নিজের পা ছড়িয়ে দেয় আর মাথা রাখে সায়েমের বুকে।

-নিশি একটা কথা বলি? অনেকদিন ধরেই ভাবছি বলব বলব। কিন্তু সেই সাহস হয়না আমার। (সায়েম নিশির চুলে বিলি কাটতে কাটতে)
-হুম বলো৷
-আরেকটা সন্তান আসবেনা আমাদের?

নিশি কতক্ষণ চুপ করে থাকে। এর জবাব ও কি দিবে সেইটাই ভাবছে। সায়েম ও যে ভুল কিছু বলেছে তা নয় কিন্তু আরেকটা সন্তান আসলে সায়েম কি মাইসারাকে অবহেলা করবে? এই প্রশ্নের জবাব আগে সায়েমের থেকে নিতে হবে।

চলবে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *