সাঁঝের প্রেম

সাঁঝের প্রেম !! Part- 22

নিশিকে তুর্না, নিশির মা, ছোট মা সবাই বুঝাচ্ছে। নিশি নিজের মতো মাইসারাকে খাওয়াচ্ছে। নিশির এহেন আচরণে নিশির মা নিশির হাত ধরে ঝাঁকিয়ে বলে,

-কি বলছি তুই কি শুনছিস?
-হ্যা শুনেছি আর আমার সিদ্ধান্ত একটাই আর সেইটা হচ্ছে আমি বিয়ে করব না। বিয়ে কি বুঝো মা? ছয়টা বছর ধরে যাকে ভালবেসেছি, যাকে স্বামী হিসেবে মেনেছি তার জায়গায় অন্য কাউকে বসাবো? আমার কি মন বলে কিছুই নেই? ভালবাসা বলতে কিছুই নেই? বিয়ে মানেই কি দুটো মানুষের মিল? মনের মিল না? কবে আমি সায়েমকে নিজের স্বামীর চোখে দেখেছিলাম বলো তো? ছিহ এই কথা ভাবতেও আমার ঘৃণা হচ্ছে। (মাইসারাকে কোলে নিয়ে দাঁড়ালো নিশি)
-নিশি এখনকার সিচুয়েশন আলাদা। (ছোট মা)
-না ছোট মা। নেক্সটবার আমাকে কেউ বিয়ের কথা বললে আমি আমার মেয়েকে নিয়ে এই বাসা ছেড়ে চলে যাব। এইটাই আমার শেষ কথা।

নিশির কথায় সবাই থ হয়ে গেলো। নিশি ছোটবেলা থেকেই জেদি সেইটা ওর মা জানে। কিন্তু এই সময়ে নিশির জেদটা কতটুকু যৌক্তিক? সেইটা নিয়েই সন্দিহান সবাই। এইদিকে সায়েম ও নিশির সামনে যায় না। নিজের অজান্তেই সায়েম চাইতো ভাবি ভালো থাকুক। যদি ভাবি একা ভাল থাকে তো থাকুক। সেই জায়গায় সায়েম কিছুই বলবেনা। কিন্তু দিনশেষে আদৌ কি ভাবির ভালো থাকা সম্ভব? সব পিছুটান ফেলে মেয়েকে নিয়ে থাকা সম্ভব? এখন যদি ভাবির একটা সংসার হতো তবে কি ভাবি ভাইয়াকে ভুলতে পারত না? পিছুটান ভুলতে পারত না? আঁধারের প্রেম আঁধারেই শেষ হয়ে গেলো!

দুই বছর পর ভোরবেলা,,

মাইসারার বয়স আজ দুই বছর পূর্ন হলো। জায়নামাজে বসে নিশি কুরআন পাঠ করছে। বিছানায় ঘুমিয়ে আছে সায়েম আর সায়েমকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে মাইসারা। মাইসারাকে জড়িয়ে ধরে আছে সায়েম। নিশির কুরআন পাঠ শেষ হলে জায়নামাজ ছেড়ে উঠে। ঘড়ির দিকে তাঁকিয়ে দেখে পৌণে ছয়টা বাজে। নিশি দ্রুত জানালার পর্দা সরিয়ে দেয়। জানালার পর্দা সরানোর সাথে সাথে সায়েমের ঘুম ভেঙে যায়। কপাল কুঁচকে তাঁকায় সায়েম নিশির দিকে। নিশি মিষ্টি একটা হাসি দেয় সায়েমের দিকে তাঁকিয়ে। সায়েম নিশির হাসি দেখে বলে,

-আবার হাসছো তুমি? কতবার না বলেছি আমি ঘুম থেকে না উঠা পর্যন্ত পর্দা সরাবেনা? তাও সরিয়েছো কেনো?
-নামাজ না পড়ার শাস্তি এইটা। উঠো। আব্বু আবার ডাকবে এখন তোমায়। (নিশি)
-অফিস নয়টায় আর উঠব ছয়টায়? প্লিজ পর্দাটা টেনে দাও। ঘুমাই একটু। আলো লাগছে চোখে।
-উহুম পর্দা সরানো যাবেনা। রাতে তো চুরি করতে যাও নাই। তো এত ঘুম কিসের? কালকে থেকে টেনে বিছানা থেকে নামাবো নামাজ পড়ার জন্য।
-সে তুমি নামিয়ো। এখন তো পর্দা টানো। মেয়েটা নয়ত এখন উঠে যাবে।
-বলেছি না সরাবো না। (চোখ রাঙিয়ে নিশি)
-দাঁড়াও।

সায়েম বিছানা থেকে উঠে টি শার্ট ঠিক করে দাঁড়ায়। স্যান্ডেল পরে ও নিশির সামনে যায়। নিশি দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকতে যায় আর সায়েম নিশির হাত ধরে।

-তুমি নিজে পর্দা টানবা, টানো। (সায়েম)
-ছোট মা আপনার ছেলে আমায় মারছে দেখে যান। (নিশি)
-কি মিথ্যাবাদী রে! মেরেছি কোথায় বউ? এইজন্যই বলে সিনিয়র বউ ঝামেলার!
-আবার আমায় সিনিয়র বউ বলছো?
-আচ্ছা বলব না। দুই ঘণ্টা ঘুমাই? কালকে দেখেছোই তো রাতে কি করেছি!
-প্রতিদিন ই তো সেইসব কর। তোমার বিজনেস কবে যেন আমি ধুলায় মিশাইয়া দেই।
-পারবানা কারণ বিজনেস তোমার নামেই। (হাসতে হাসতে সায়েম নিশিকে জড়িয়ে ধরে)
-হইছে ছাড়ো৷ আজকে মাইসারার সেকেন্ড বার্থডে জানো?
-সেইটা কি ভুলব আমি? আমার হাতেই তো ও দুনিয়ায় এসেছে। কি নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে আমার মেয়েটা।
-তোমার ভাইয়ার কবর যিয়ারতের জন্য যাবেনা?
-হ্যা সন্ধ্যায় যাব।
-আচ্ছা।

সায়েমকে ছাড়িয়ে নিশি রান্নাঘরে যায়। তুর্নার বিয়ে হয়ে গেছে। এখন আর তুর্না এ বাড়িতে থাকেনা। এখানে নিশির মা, ছোট মা, আব্বু, নিশি, সায়েম আর মাইসারা ই থাকে। নিশিকে এত সকালে রাম্নাঘরে দেখে ছোট মা বলে,

-বউমা তুমি এত সকালে কেন? সায়েম কই?
-সায়েম মাত্র উঠেছে ছোট মা।
-আজকে তো আমার দিদুনের জন্মদিন। আজকে স্পেশাল কি বানাচ্ছো?
-মা আজকে স্পেশাল কিছুই হবেনা। সায়েমকে বলব মসজিদে মিলাদ পরিয়ে দিতে। কোনো কেক বানাবো না।
-সে তুমি করনা। কিন্তু স্পেশাল কিছু রান্না তো করতে পারো?
-হ্যা সেইটা পারি।

সকাল আটটায়,

সায়েম মাইসারাকে কোলে নিয়ে ড্রইংরুমে আসে। মাইসারা জুস খাচ্ছে। ছোট মা আর আব্বু ড্রইংরুমেই বসা। মাইসারা সায়েমকে বলে,

-বাবাই মা যাব।
-তোমার মা রান্না করে আম্মু। তুমি আমার কোলে বস। (মাইসারাকে চুমু দিয়ে সায়েম)
-দিদুন তুমি আমার কাছে আসো। (ছোট মা)
-আমি মা যাব। (মাইসারা)
-নিশি শুনো! (সায়েম)
-আসছি। বলো। (নিশি)
-মাইসারা কাঁদছে তোমার কাছে যাবে বলে। কোলে নাও। আমি দেখছি রান্নাঘরে গিয়ে। আর আম্মু আমি না তোমায় বলেছি ২৪ ঘণ্টার জন্য একটা সার্ভেন্ট রাখতে? (সায়েম)
-পাওয়া যায় না তো।
-নিশি তো সারাদিন এসব পারেনা। মাইসারাকে দেখতে হয়, ঘরের সব কাজ ও একাই করে। প্রতিদিন চিল্লাই একটা কাজের লোক রাখো। আমার কথায় কি কোনো দাম নেই নাকি? (সায়েম)
-তোর কথা ছাড়া এ বাড়িতে কি হয় শুনি? (ছোট মা)
-আমি দুইদিনের মধ্যে এ বাড়িতে কাজের লোক দেখতে চাই। নিশি এতে না করুক বাট ওর কথা শুনবেনা।
-সকাল সকাল চেঁচাচ্ছো কেন? আমার কোনো কষ্ট হয় না কাজ করতে! তুমি কফি খাও এরপর ব্রেকফাস্ট দিচ্ছি খেয়ে অফিসে যাও। (মাইসারাকে কোলে নিয়ে নিশি)
-এই তোমার কথা আর শুনব না আমি। অনেক শুনেছি। আম্মু আমি যা বলেছি সেইটাই ফাইনাল।
-আচ্ছা বাবা।

নিশির মা, ছোট মা আর আব্বু হাসছে ওদের ঝগড়া দেখে। মাইসারা একবার আম্মুর মুখের দিকে তাঁকাচ্ছে আরেকবার বাবাইয়ের মুখের দিকে। সায়েম খেয়ে দেয়ে অফিসে চলে গেলো। নিশি সায়েমের হাতে ঘড়ি পরিয়ে দিচ্ছিলো। সায়েম তখন বলে,

-আমার ফিরতে আজকে লেইট হবে।
-কখন আসবা?
-রাত একটা বাজবে।
-কিহ? এত রাত কেনো?
-একটা জরুরি কাজ আছে।
-জাবিনের সাথে? (ঠোঁটে হাল্কা হাসি টেনে নিশি)
-না নিশি। ওর সাথে আমার কি কাজ থাকবে? আমার আজকে একটা ডিল ফাইনাল হওয়ার কথা। এইজন্যই দেরি হবে।
-ওহ! অল দ্যা বেস্ট। (নিশি সরে আসে)
-নিশি তুমি আবার মুড অফ করলা? তোমায় ছুঁয়ে বলছি জাবিনের সাথে আমি খুব কম কথা বলি। নেহাৎ ভালো মেয়ে আর আমার পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট তাই চাকরি থেকে বের করে দিতে পারছিনা। (নিশির হাত ধরে সায়েম)
-আচ্ছা অফিসে যাও৷ সাবধানে ফিরে এসো। আশা করছি নামাজগুলো আদায় করে নিবা। আল্লাহ হাফেজ।
-হ্যা পরব নামাজ। আসছি। আল্লাহ হাফেজ। (নিশির কপালে চুমু দিয়ে সায়েম)

সায়েম মাইসারাকে কিছু না বলেই বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। কারণ মাইসারা সায়েমকে বের হতে দেখলেই কাঁদবে। সায়েম অফিসে যাওয়ার পর মনে পরে ও ফাইলগুলো নিয়ে আসেনি। সায়েম সাথে সাথে নিশিকে ফোন দেয়।

-নিশি আমার ফাইলগুলো রেখে এসেছি। আব্বু কি বের হয়ে গেছে?
-এই মাত্রই বের হলো। দারোয়ান ও তো ছুটিতে আছে। কাকে দিয়ে পাঠাবো এখন?
-আচ্ছা আমিই আসছি। ড্রাইভারকে বিশ্বাস করিনা আমি।
-এই দাঁড়াও। আমি যাব তোমার অফিসে যদি তোমার প্রেস্টিজ লস না হয় তাহলে!
-কেনো আমার প্রেস্টিজ লস হবে নিশি? এইসব কি কথা বল তুমি? তুমি দেখতে খারাপ নাকি ৮০ বছরের বুড়ি? বারবার এক কথা বলো তুমি। কতবার তোমায় বলেছি আমার অফিসে আসতে? এসেছো তুমি?
-আচ্ছা আমিই আসছি ফাইল নিয়ে।
-আচ্ছা। আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি বাসায়।
-হুম।
-মাইসারাকে আম্মুর কাছে রেখে এসো।
-আচ্ছা।

নিশি রেডি হয়ে সায়েমের অফিসে গেলো। হাতে এক গাদা ফাইল। নিশিকে অফিসে দেখে সিকিউরিটি সালাম দিল আর হাত থেকে ফাইলগুলো নিয়ে নিলো। নিশি সায়েমের কেবিনের দিকে যাচ্ছে আর তখনি জাবিনকে দেখে নিশি। জাবিন শর্ট স্কার্ট পরেছিলো। গায়ে ওড়না পর্যন্ত নেই। দেখতে যথেষ্ট সুন্দরী। স্কার্টটায় লিখা ছিলো জাবিন তাই নিশি চিনতে পারলো। নিশি আর কিছু না বলে সায়েমের কেবিনে গেলো। নিশিকে দেখে সায়েম জিজ্ঞেস করে,

-মাইসারাকে আম্মুর কাছে দিয়ে এসেছো না?
-হ্যা। বাট এইসব কি চলে তোমার অফিসে?
-কি চলে?
-তোমার সুন্দরী PA জাস্ট একটা শর্ট স্কার্ট পরা, বুকে ওড়না পর্যন্ত নেই, যাচ্ছে তাই এটিটিউড! আর তুমি ওকে ভালো মেয়ে বলছিলে সকালে? এইজন্যই তোমার ফিরতে লেইট হবে আজকে বাসায়? এইসব ড্রেসে কিভাবে ওকে এলাউ কর তুমি সায়েম?
-জাবিন আমার কেবিনে এসো তারাতারি। (জাবিনকে ফোন দিয়ে সায়েম)
-ওকে স্যার।

জাবিন আসার পর নিশিকে সায়েমের কেবিনে দেখে জাবিন সালাম দেয়। নিশি সালামের উত্তর না নিয়ে সায়েমের দিকে তাঁকায়। সায়েম জাবিনকে বলে,

-উনি কে চিনো নিশ্চই!
-জ্বি স্যার। আপনার ওয়াইফ।
-নিশি তুমি কি বলবে বলো।
-সায়েম আমি কিছুই বলব না বাট নেক্সট বার আমি অফিসে এসে যেন তোমার স্টাফদের এই উলঙ্গ ড্রেসে না দেখি।
-ম্যাম এসব কি বলছেন? আপনি কিন্তু আমায় অপমান করছেন। (জাবিন)
-সম্মান আছে তোমার? যদি থাকতো তাহলে এইভাবে পুরো অফিস ঘুরো কিভাবে? বসের সামনে আসো কিভাবে? লজ্জা করেনা? (নিশি)
-কালকে থেকে মার্জিতভাবে অফিসে আসবে জাবিন। (সায়েম)
-ওকে স্যার।

জাবিন চলে যাওয়ার পর নিশি সায়েমকে বলে,

-রাত দশটার মধ্যে তোমায় আমি বাসায় দেখতে চাই। তোমার যত টাকার ডিলই হোক না কেনো সেই ডিল আজকে ক্যান্সেল।
-এক্ষুনি ক্যান্সেল করে দিচ্ছি।

নিশি জানে সায়েম ওকে ভীষণ ভয় পায়। কিন্তু সায়েমের কাছে ভয়টা ভালবাসা মনে হয়। সায়েম কোনোদিন বিরক্ত হয়নি নিশির উপর আর নিশি যখন যা বলেছে তাই করেছে। সায়েম কোনোদিন মেয়েদের অসম্মান করেনি আর বিয়ের পর ভুলেই গিয়েছে কিভাবে বউ ছাড়া বাইরের মেয়েদের দিকে তাঁকাতে হয়!

নিশি কিছুক্ষণ অফিসে থেকে এরপর চলে যায়। নিশি যাওয়ার পর সায়েম চেয়ারে গা এলিয়ে হাসছে। পেন্সিল হাতে ঘোরাচ্ছে সায়েম আর ভাবছে,

-নিশি ওর জীবনে আসার পর আসলেই জীবনটা পাল্টে গেছে। নিশি ওর জন্য আশীর্বাদ। নিশির কড়া শাসনগুলো কেন আমার এত ভালো লাগে? নিশিকে কি আসলেই আমি ভাল রেখেছি বা পারব ভাল রাখতে?

চলবে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *