সাঁঝের প্রেম !! Part- 17
নিশি এমন এক সিদ্ধান্ত নিলো যা কোনো সুস্থ মানুষ মেনে নিবেনা। নিশি সবাইকে বলল,
-আমার ওর যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে আমিও ওর সাথে নিজেকে শেষ করে দিব। মা, তুর্না তোমরা কেঁদো না। তুর্নার নামে আমি একাউন্টে কিছু সেভিংস রেখে গেছি। আশা করি বছর তিনেক চলে যাবে আর ততদিনে তুর্না নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যাবে। (কথাগুলো অস্বাভাবিক ভাবে বলল নিশি)
-নিশি মা কি বলছিস তুই এসব? তোর ভেতর এখন আরেকটা প্রাণ আছে। তুই কেনো ওর প্রাণ কেড়ে নিবি? এসব কথা বলিস না মা। (নিশিকে বুকে জড়িয়ে আম্মু)
-মা আমি ওরে ছাড়া থাকতে পারবনা মা, পারবনা। আমি ওরে বাঁচাতেও পারবনা। আমার রক্তের গ্রুপ যে বি পজিটিভ। এবি নেগেটিভ তো ওর রক্ত। (কাঁদতে কাঁদতে নিশি)
-নিশি তুমি কি বললা? মাহবুবের রক্তের গ্রুপ কি? (ছোট মা)
-এবি নেগেটিভ।
ছোট মা সায়েমকে নিয়ে তখন ডক্টরের কাছে যায়। কারোরই মনের অবস্থা ভাল নেই। ছোট মা ডক্টরকে জিজ্ঞেস করে,
-কত ঘণ্টার মধ্যে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করতে হবে?
-পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে। পেশেন্টের বিপি ফল করছে, গ্লুকোজের পরিমাণ ও বেড়ে গেছে শরীরে। এ অবস্থায় আমাদের কি করা উচিৎ আমরা জানিনা। আপনারা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কিডনির ব্যবস্থা করুন। নয়ত পেশেন্টকে আসলেই বাঁচানো….
-না ডক্টর শুনুন। আমার ছেলেকে বাঁচতে হবে। ও তো বাবা হতে যাচ্ছে। মাহবুবের রক্তের গ্রুপ এবি নেগেটিভ। আমারো এবি নেগেটিভ। আমার একটা কিডনি আমি মাহবুবকে দিতে চাই।
-হ্যা একটা কিডনি দিয়েই দুজনে বাঁচতে পারবেন কিন্তু ব্লাড গ্রুপ মিললেই হবেনা, টিস্যু ও ম্যাচ করতে হবে।
-ডক্টর যা করার তারাতারি করুন। আমার ছেলের বউটা যে পাগল হয়ে যাচ্ছে।
-আম্মু কি বলছে এসব? হয়ত এতদিনকার পাপবোধ মনে আঘাত করছে! যাইহোক আজকে আমি আম্মুকে আটকাবো না। (মনে মনে অবাক সায়েম)
-আসুন তারাতারি।
মাহবুব আইসিউতে। সেই কখন থেকে মাহবুব চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। নিশির বুক ফেটে যাচ্ছে মাহবুবকে এভাবে দেখতে দেখতে। ছোট্ট সংসারটা তো ভালই চলছিলো। সুখের কোনো কমতি ছিল না। তো আজ কেন এমন হলো? আরাফ আর আরাফের বউ ও হাসপাতালে চলে এসেছে। চিটাগং সিটির সবচেয়ে বড় হাসপাতালে মাহবুব ভর্তি। আরাফ চেয়েছিলো মাহবুবকে ঢাকায় নিয়ে আসতে কিন্তু নিশি দেয়নি। ভাগ্যবশত মাহবুবের ছোট মায়ের সাথে মাহবুবের টিস্যু আর ব্লাড ম্যাচ করে যায়। সায়েম সবাইকে জানায় মা ভাইয়াকে একটা কিডনি দিচ্ছে। অপারেশন শুরু জন্য হাসপাতালের রিসিপশনে মাহবুবের আব্বু চারলাখ টাকা জমা করে। দুই ঘণ্টার মধ্যে মাহবুবের অপারেশন শুরু হয়। নিশি অনবরত কেঁদেই যাচ্ছে আর আল্লাহকে বলছে,
-কেড়েই যখন নিবে তখন ক্ষণিকের সুখের জন্য কেনো ওকে দিয়েছিলে আল্লাহ? কেনো পিতৃহারা হবে আমার সন্তান? কোনোদিন তোমায় ভুলে যাইনি। জীবনে কখনো যদি কোনো ভাল কাজ করে থাকি তার বিনিময়ে হলেও আমার মাহবুবকে আমায় ফিরিয়ে দাও আল্লাহ। আমি না হয় মরেই যে যাব। তিনটা প্রাণ তুমি শেষ করে দিওনা খোদা। ফিরিয়ে দাও না আমার মাহবুবকে আমার কাছে। সুখের মুখ দেখিয়ে আজ দুঃখ কে কেনো আলিঙ্গন করাচ্ছো তুমি? (নিশি আম্মুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেই)
সায়েম, তুর্না, মাহবুবের আব্বু সবাই কাঁদছে। কেউ কাউকে সামলানোর মতো অবস্থায় নেই। নিশি সেন্সলেস হয়ে যায়। তখন সায়েম নিশিকে কোলে নিয়ে বেডে শোয়ায়। ডক্টর নিশিকে দেখার পর বলে,
-এইভাবে চললে ওনার পেটের বাচ্চাটার ক্ষতি হয়ে যাবে। এক কাজ করি আমি ওনাকে একটা ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে দেই। উনি ঘুমাক। তিনঘণ্টা মেয়াদি মেডিসিন দিচ্ছি।
-যা ভাল হয় করেন। কিন্তু ভাবিকে ঠান্ডা করুন আগে।
তুর্না নিশির চুল ঠিক করে দিচ্ছে আর নিশির কপালে চুমু দিয়ে মনে মনে বলে,
-আপুর এই সুখটুকু তুমি কেড়ে নিওনা মালিক। সারাজীবন আপু আমাদের জন্য করে এসেছে। নিজে কিছুই পায়নি। আমার জীবন টাই তুমি আমার ভাইয়াকে দিয়ে দেও। বাঁচিয়ে দেও আমার ভাইয়াকে। নয়ত যে আমার আপু পাগল হয়ে যাবে। (তুর্না)
ডক্টর নিশিকে মেডিসিন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। তুর্না আর মা নিশির পাশে বসা। সায়েম শুধু হাসপাতালের বারান্দায় পাইচারি করছে। সাড়ে তিনঘণ্টা পর,
-ডক্টর আমার ভাইয়া? (উত্তেজিত হয়ে সায়েম)
-He is now out of danger but সম্পূর্ণ তিনমাস ওনাকে বেড রেস্টে রাখতে হবে।
-থ্যাংকস আল্লাহ! আর আমার আম্মু?
-উনিও ভাল আছেন। ওনারো বেড রেস্টের প্রয়োজন।
-আমি ভাবিকে বলে আসছি।
সায়েম দৌড়ে নিশির কাছে যায়। হাসিমুখে নিশিকে বলে,
-ভাবি আর কেঁদোনা। ভাইয়ার অপারেশন সাক্সেসফুল। তোমার ফরিয়াদ আল্লাহ শুনেছে। এক ঘণ্টা পর ভাইয়ার সাথে দেখা করতে পারবে তুমি। নিজের আর বাচ্চাটার আর কোনো ক্ষতি করনা তুমি।
-কিহ? তোমার ভাইয়া কোথায়? (লাফ দিয়ে নিশি বেড থেকে নেমে)
-আস্তে ভাবি। ভাইয়া ওটিতেই আছে। কিছুক্ষণ পর ভাইয়াকে বেডে দেওয়া হবে।
-ছোট মা কেমন আছে?
-আম্মু ও ভাল আছে।
-আমি যে ছোট মা’র কাছে আজীবনের জন্য ঋণি হয়ে গেলাম। (নিশি চোখের পানি মুছে)
আরাফ আর আরাফের বউ নিশিকে বলে,
-এখন তো থামো পাগলি। আর কেঁদো না। মাহবুব এইসব শুনলে মারবে তোমায়। আর এসবের কি তুমি কিছুই জানতে না? একদিনে তো আর এই অবস্থা হয়নাই মাহবুবের। (আরাফ)
-না ভাইয়া আমি কিচ্ছু জানতাম না। শেষ কয়েকদিনে দেখি ওর অসুখ ভালই হয়না তাই তো হাসপাতালে এনে জানতে পেরেছি। ওর খুব ইচ্ছে হয়েছিলো আমায় রেখে চলে যাওয়ার। তাই চলে যাচ্ছিলো। একবার ওর জ্ঞান ফিরুক শুধু….
এক ঘন্টা পাঁচ মিনিট পর,
মাহবুব ওর বেডে শুয়ে আছে। কোমড়ের উপরে ব্যান্ডেজ করা। নড়াচড়া করা যাচ্ছেনা। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তাই অক্সিজেন মাস্ক লাগানো মুখে। চোখ খুলেই মাহবুব আগে নিশিকে খুঁজছে। চোখ খুলে ভালকরে তাঁকাতেও পারছেনা ও। ডক্টর মাহবুবের গ্লুকোজ কমানোর জন্য ইঞ্জেকশন দিলো আর বিপি চেক করে ওষুধ দিলো। ডক্টরের মুখেও হাসি। ডক্টর নার্সকে বলে,
-ওনার ওয়াইফকে ডেকে আনুন।
-ইয়েস স্যার।
নার্স গিয়ে নিশিকে ধরে ধরে নিয়ে আসে। মাহবুব তখন চোখ বন্ধ করে হাত পা টান করে শুয়ে আছে কারণ হাতে রক্ত চলছে। নিশি এসে মাহবুবের মাথার পাশে চেয়ারে বসে। নিশি বসার পর মাহবুব চোখ মেলে তাঁকায়। নার্স সরে গিয়ে দাঁড়ায়।
-তুমি কেঁদেছো? (অক্সিজেন মাস্ক খুলে মাহবুব)
-না হেসেছি। দেখছো না আমি হাসছি? (নিশি চোখ মুছে)
-এইত তুমি কাঁদছো! আমি বেঁচে আছি কিভাবে? এতক্ষণে তো আমার জানাজা হওয়ার কথা।
-চুপ একদম! এইসব কি বলছো তুমি? কিচ্ছু হবেনা তোমার। ছোট মা তার নিজের কিডনি দিয়ে তোমায় বাঁচিয়েছে।
চলবে