সাঁঝের প্রেম

সাঁঝের প্রেম !! Part- 14

মাহবুবের সাথে নানান তর্ক বিতর্কের পর নিশি কড়া কথায় বলে,

-আপনি বিয়ে করে নিবেন। ভুলে যান গতকালকের সন্ধ্যা আর ভুলে যান গত কয়েকমাসের স্মৃতি! আমি যে আপনার জীবন থেকে সরে এসেছি। নিজেকে আর জড়াবো না। জড়িয়ে জড়িয়ে অনেকটা প্যাঁচে গেছি তাই প্যাঁচ খুলব এখন।
-হাহাহা! তারপর? (কথাগুলো শুনে মাহবুবের চোখ থেকে পানি পরছে)
-তারপর আর কিছুইনা। দুজনার পথ আলাদা, বাড়ি আলাদা আর ঘর ও আলাদা! পাতা হবেনা আর কলা পাতার সংসার, ছিঁড়ে গেছে সেই পাতা আজ।
-নিশি আমার ধৈর্য কিন্তু শেষ! কথা দিয়েছিলে আমার হবে তবে আজ কেনো এসব বলছো? কেনো? কেনো? কেনো? (দেয়ালে আঘাত করে মাহবুব)
-আর কোনোদিন ফোন দিব না আমি আপনাকে আর আপনিও আমাকে আর ফোন দিবেন না। শেষ এখানে নিশি-মাহবুবের সাক্ষাৎ! সুখে থাকবেন হ্যা? ভালো রাখবেন সবাইকে আর বিয়েটা করে ফেলবেন।
-ওহ এইটুকুই? (মাহবুবের প্রচণ্ড রাগ লাগছে)
-হ্যা এইটুকুই।

নিশির জবাব শুনে মাহবুব ওর ফোনের সিম খুলে ভেঙে ফেলল আর ফোনটাও জানালা দিয়ে ছুড়ে মারলো। এরপর অনেকক্ষণ কান্না করলো মাহবুব। কারণ জীবনের সবচেয়ে ভাইটাল মোমেন্টে এসে সবচেয়ে বড় কষ্টটা ও পেলো। তিনমাস পর্যন্ত মাহবুব কারো সাথে কথা বলেনি আর নিশির সাথেও কোনো যোগাযোগ রাখেনি। এরপর এক বছর পর ছোট মায়ের সাথে ঝগড়া করে চিটাগং ট্রান্সফার হয়ে চলে আসে আর সেখানেই সেটেলড হয়ে যায়। এর মাঝে অনেকবার নিশির কথা মনে করেছে কিন্তু কোনো লাভ নেই। নিশি ভুলে গেছে তাইতো সরিয়ে দিয়েছে ওকে জীবন থেকে। আর এইদিকে নিশি ধুকে ধুকে মরছে। কোনোমতে বেঁচে আছে ও! কারণ এখন যে ওর সর্বস্ব মাহবুবকে লুটিয়ে দিয়েছে৷ আর তো কিছুই রইলো না ওর। বাবাকে প্রতিজ্ঞা করেছে ও আর মাহবুবের সাথে যোগাযোগ রাখবেনা আর কথাও বলবেনা। তাই নিজের প্রতিজ্ঞা বাঁচাতে সব কষ্ট মুখ বুজে সহ্য করছে। এইদিকে নিশির বাবা অনেক জায়গায় নিশির জন্য পাত্র দেখেছে নিশির অনিচ্ছা সত্বেও। প্রতিবার পাত্রকে নিশি বলেছে “আমি কুমারী নই, সর্বস্ব লুটিয়ে দেওয়া কোনো এক পাগলি প্রেমিকা আমি”। এই কথা শুনে পাত্র পক্ষ বারবার রিজেক্ট করেছে নিশিকে। কিন্তু নিশির এতে বিন্দুমাত্র আফসোস ছিল না শুধু ছিল মাহবুবের প্রতি শ্রদ্ধা আর অসীম ভালবাসা।”

-ব্যাস এইভাবেই কাটিয়ে দিলাম পাঁচটা বছর। অনার্স শেষ করলাম, মাস্টার্স করলাম, জব করলাম এরপর আমি এই জায়গায়। (নিশি)
-অনেক স্ট্রাগল করতে হয়েছে তাইনা ভাবি? (সায়েম)
-তা তো একটু আধটু করেছিই!
-আংকেল মারা গেলো কিভাবে?
-আমাদের রিলেশন ব্রেকের দেড় বছরের মাথায় বাবার হার্ট এটাক হয়। হার্ট এটাকের চারদিনের দিন বাবা মারা যায়। তখন আরো বড় টেনশন ছিলো আমার মাথায়।
-ভাল জিনিস সবসময় দেরিতেই হয় ভাবি। এত কষ্ট করেছো বলেই আজকে তুমি আমার ভাইয়ের বউ, তাও যে সে ভাইয়া নয়। এখন সে একজন সিনিয়র অফিসার।
-ফান ছাড়ো। তোমার কি কেউ নেই? (রান্না করতে করতে নিশি)
-আপাতত নেই। ভাবছি বিয়ে করব একবারে।
-এইটাই ভাল। প্রেমের ব্যাথা অনেক বড় ব্যাথা। তোমার ভাইয়া আর আমি জানি সেইটা বুঝছো।
-আমি তো কলাপাতার সংসার পাতবো না ভাবি যে ব্যাথা পাবো। আমি পাতব সিমেন্টের সংসার যার ঝালাই থাকবে আজীবন। হাহাহা।
-মানুষ হবা কবে? (হাসতে হাসতে নিশি)
-এইত বিয়ের পরেই। মাত্র পড়ি অনার্স থার্ড ইয়ারে! আরো তিনবছর!! বাপরে!
-পরে কি বাপের টাকায় বউকে খাওয়াবা নিজে কিছু না করলে?
-বউ কি হাতি নাকি যে বেশি খাবে? বাপের টাকায় চলে যাবে।
-বউ হাতি না বলেই নিজের কিছু করা লাগবে। তোমার পায়ের এখন কি অবস্থা?
-এখন জলুনি কমে গেছে। বিকেলে বের হব ভাবছি।
-না। তোমার ভাইয়া নিষেধ করে গেছে কিন্তু!
-ধুর ভাল্লাগেনা! আচ্ছা তুমি রান্না কর। আসছি আমি।

সায়েম টি শার্ট পরে আর থ্রি কোয়ার্টার এর পকেটে হাত রেখেই বাইরে চলে যায় হাঁটতে। বাড়ির আশেপাশেই হাঁটাহাঁটি করে সায়েম চলে আসে। নিশি রান্নাবান্না শেষ করে ঘরের সব কাজ শেষ করে নেয়। তখন তুর্না ফোন করে বলে,

-আপু মাহবুব ভাইয়া এতগুলো টাকা কেনো পাঠালো?
-কবে?
-এইত এগারোটায় টাকা সেন্ড করে আমায় কল করে বলল আমার কলেজ আর প্রাইভেট ফি যাতে দিয়ে দেই আর আম্মুর সব ওষুধপত্র যেন কিনে দেই। যা যা দরকার তা যেনো ভাইয়াকে বলি।
-আমাকে কিছু বলেনি এই ব্যাপারে তাই আমি জানিনা। কত টাকা দিয়েছে?
-২০ হাজার।
-আচ্ছা আমি ওর সাথে কথা বলব নে। তোর এক্সাম প্রিপারেশন কেমন?
-আলহামদুলিল্লাহ ভালো।
-ভালভাবে পড়াশোনা করবি। আম্মু কে চিল্লাচিল্লি করতে দিবিনা।
-আচ্ছা আপু। ভাইয়ার রাগ কি কমেছে তোমার উপর?
-হ্যা কমেছে।
-যাক! আম্মু এইটা নিয়া চিন্তা করছিলো অনেক। আম্মু বারবার আমাকে বলছিলো ওদের ভাব হলো নাকি কে জানে? মা হয়ে তো জিজ্ঞেস ও করতে পারিনা।
-পাকামো কম কর। (লজ্জা পেয়ে নিশি)।
-আরে আপু আস্তে। চিনি আমি তোমায় বুঝছো আর আমি কিন্তু ছোট নই হ্যা? বিয়ের বয়স হয়ে গেছে আমারো। তাছাড়া এখন বায়োলজি পড়ছি। (তুর্না হাসছে)
-আবার শুরু করলি তুই? (ধমক দিয়ে নিশি)
-আচ্ছা যাও থামলাম। ইনশাআল্লাহ দেখা হবে। আর ভাইয়াকে এখন ভাল রেখো। রাখছি আমি।
-বাই।

তুর্না ফোন কাটার পর নিশি মাহবুবকে ফোন দিলো। মাহবুব তখন অফিসে জুনিয়রদের সাথে কথা বলছিলো। মাহবুব স্ক্রিনে বউ নামটা দেখে কেটে দিলো। তখন এক জুনিয়র বলল,

-মে বি ম্যাডাম ফোন করেছে। স্যার আপনি কথা বলে আসুন। আমরা ওয়েট করছি।
-না সমস্যা নেই। কার কি প্রবলেম বল।

মাহবুব সবার ঝামেলা শেষ করে, ফাইল সাবমিট করে নিশিকে কলব্যাক করলো। তখন লাঞ্চ টাইম।

-হ্যা বলো। ফোন দিয়েছিলে?
-লাঞ্চ করছো? (নিশি)
-না করিনি এখনো। সময় পাইলে করব। বসের তো খেয়ে দেয়ে কাজ নেই সব আমার উপরেই বর্তিয়ে দিয়ে যায়।
-আগে খেয়ে নাও তারপর বাকি কাজ। আর শোনো
-কি?
-তুর্না ফোন দিয়েছিলো। তুমি নাকি ওরে টাকা পাঠাইছো?
-হ্যা।
-কিন্তু কেনো?
-এইটা ইউজলেস কুয়েশ্চন নিশি। আগে তো তুমি দেখতা তোমার ফেমিলিকে। এখন আমার দেখা উচিৎ আর সেইটা আমি ভালবেসেই দেখি। তুমি যদি চাকরিটা না ও ছাড়তা তাও আমি ওদের দেখতাম কারণ দে আর অলসো মাই রেসপন্সিবিলিটি।
-এইজন্য বিশ হাজার টাকা কেনো?
-যা লাগবে খরচ করবে বাকিটা পরে করবে।
-আমি শ্বশুর বাড়ি থেকে এই নিয়া কোনো কথা শুনতে চাইনা।
-তোমার কোনো শ্বশুর ঘর নেই ওকে? কেউ তোমাকে কিছু বলতেও আসবেনা।
-আচ্ছা তুমি খেয়ে নাও এখন। পাঁচ মিনিট পর ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করছি খেয়েছো কি না!
-আচ্ছা।

মাহবুব ফোন কেটে অফিস ক্যান্টিনে গেলো। সবার সাথে কথা বলতে বলতে মাহবুব লাঞ্চ করলো। এরপর নিশিকে ফোন দিয়ে জানালো লাঞ্চ করেছে আর নিশিকে বলল ও যাতে লাঞ্চ করে নেয়। সন্ধ্যের সময় চাঁদের জ্যোৎস্না গায়ে মেখে মাহবুব বাড়ি ফিরছিলো। মাহবুবকে দেখে নিশি ওর বাঁকা দাঁতে খুব মিষ্টি একটা হাসি দেয়।

-হাসির রহস্য? (ঘড়ি খুলতে খুলতে মাহবুব)
-নাথিং।
-সায়েম কই?
-ঘরে। সারাক্ষণ ঘরেই ছিলো।
-ওহ
-কেনো?
-ফর দিজ! (নিশিকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে মাহবুব)
-মনে আছে তোমার?
-প্রতিটা মোমেন্ট মনে আছে।
-ফ্রেশ হয়ে আসো কফি করে দেই! (মাহবুবের ভেজা শার্টের গন্ধ নিয়ে নিশি)
-এই শার্টে কি আছে এমন?
-তা তুমি বুঝবেনা।
-এই শীতেও আমি ঘামে ভিজে যাই! নিজেকে আমার মাঝে মাঝে আশ্চর্য লাগে!
-পৃথীবির সপ্তম আশ্চর্যের তুমি একটা!
-আমি মোটেও তা নই।
-সেইটা আমি জানি ঠিক আছে! এখন আসেন আপনি।

নিশি রান্নাঘরে এসে কফি বানায় আর সায়েম নিজের ঘরেই বসে আছে। মাহবুব ফ্রেশ হয়ে সায়েমকে ডাকে ড্রইংরুমে। এরপর তিনজন মিলে আড্ডা দেয়। সায়েম মাঝে সাঝেই মাহবুবকে খোচাচ্ছিলো বিভিন্ন টপিকস নিয়ে। রাতে ডিনার করে এজ ইউজুয়াল সাড়ে দশটার মধ্যে মাহবুব শুয়ে পরেছে। নিশি প্লেটগুলো ধুয়ে এরপর ঘুমাতে আসে।

-এই মশাড়ি টানাও। (নিশি)
-পারব না। (ফোন টিপতে টিপতে মাহবুব)
-দেখো পারবনা বলবানা। আমার অনেক মশা লাগে।
-তো টানিয়ে নাও। এরোসল দেওয়ার পরেও যদি বলো মশা লাগে তো আর কি বলব?
-আমার একদম ই ভাললাগেনা মশাড়ি টানাতে। প্লিজ তুমি কর না। (মাহবুবকে ঠেলতে ঠেলতে নিশি)
-আমারো ভাল লাগেনা।
-তাহলে মশার কামড় খাও! এছাড়া আর কি!
-তুমি টানাবেনা? (চোখ রাঙিয়ে নিশি)
-না। আমি কোনোদিন মশাড়ি টানাইয়া ঘুমাইনাই। ঘুম আসেনা আমার শরীরে মশাড়ি লাগলে। মশার কামড় খাব তাও মশাড়ি টানাবো না।
-ঠিক আছে আমিই টানাচ্ছি। বাট তুমি মশাড়ির বাইরে ঘুমাবা।
-বাহ! এইটাই তো চাই। টানাও।

নিশি মশাড়ি টানিয়ে মাহবুবের পাশে দিয়ে মাহবুবকে মশাড়ির বাইরে বের করে দেয়। মাহবুবের পায়ের পশমগুলোতে বারবার মশাড়ি লাগছে। মাহবুব খুবই বিরক্ত হচ্ছে। নিশি একটা পাতলা কম্বল গায়ে দিয়ে পাশ ঘুরে শুয়ে পরে। মাহবুব মশাড়ির ভেতর ঢুকে বলে,

-এই মশাড়িকে হাজার শিকের কারাগার মনে হয় আমার! ওই! (নিশির পিঠে হাত দিয়ে)
-আবার হাত দাও কেনো? সরো তুমি! আর মশাড়ির ভেতর কেনো ঢুকছো? (মাহবুবের দিকে ঘুরে নিশি)
-তোমার চেহারা দেখার জন্য আসছি।

মাহবুব বালিশে শুয়ে পরে আর নিশি মাহবুবের বুকের উপর মাথা রেখে মাহবুবকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে যায়। রাত তখন ১১ টার ওপরে। মাহবুব নিশিকে হালকা করে কিস করে বিছানা থেকে উঠে গিয়ে মশাড়িটা খুলে। মশাড়িটা বারান্দার কোনায় রেখে আসে যাতে নিশি খুঁজে না পায়। এরপর নিজের অফিসের ব্যাগে থাকা একটা পকেট থেকে অনেকগুলো জিনিস বের করে মাহবুব। এরমধ্যে ৩৩ টা মোমবাতি দিয়ে পুরো ঘর সাজায় মাহবুব। ছোট ছোট মোমবাতি গুলো দিয়ে ফ্লোরে লাভ চিহ্ন আঁকে আর মাঝখানে ফুলের পাপড়ি দিয়ে লিখে নিশি মাহবুব। আর বিছানার একপাশে কতগুলো ফুল ছড়িয়ে দেয় আর নিশির গায়ে গোলাপের সুগন্ধি মেখে দেয়। পুরো ঘর সাজানো হয়ে গেলে মাহবুব নিশিকে ঘুমন্ত অবস্থাতেই কোলে নেয়। মাহবুব নিশির কপালে ডিপ কিস করে।

চলবে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *