সাঁঝের প্রেম

সাঁঝের প্রেম !! Part- 07

মায়ের মুখ থেকে “জামাই” ডাক শুনে নিশি আর মাহবুব দুজনেই মর্মাহত কারণ এইটা কখনো সম্ভব নয়। আরাফ তখন দাঁড়িয়ে যায় আর মাহবুব পেছনে ঘুরে তাঁকিয়ে একটা অর্থহীন হাসি দেয়। মাহবুবের হাসির মানে কেউ না বুঝলেও নিশি বুঝেছে৷ মাহবুব কয়েক পা এগিয়ে এসে আন্টিকে বলে,

-আন্টি এইরকম ডাক মানায় না। আপনি আমার নাম ধরেই ডাকবেন। আমি খুশি হব।
-আমি তোমায় এই নামেই ডাকব। তোমার আর নিশির সাথে আমার কথা ছিলো কিন্তু আমি বলব না। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি যে আগামীকাল তোমাদের বিয়ে। আগামীকাল সোমবার একটা শুভ দিন।
-আম্মু? (জোরে চিৎকার করে নিশি)
-একদম চুপ। কাল যদি তুই মাহবুবকে বিয়ে না করিস তাহলে যেদিকে দুচোখ যায় আমি আর তুর্না চলে যাব। তোর মতো মেয়ের আমার দরকার নাই।
-না আন্টি কারো অমতে আমি কাউকে বিয়ে করতে চাইনা। মাফ করবেন আমায়। (মাহবুব)
-তাহলে আমার কথার কোনো দাম রইলো না? (আম্মু)
-সম্ভব নয় এইটা কোনোদিন আম্মু। আমি আজীবন এভাবেই থাকব। চাইনা আমি বিয়ে করতে। (নিশি)

নিশি এ কথা বলার পর আম্মু গিয়ে নিশির গালে ঠাস করে চড় মেরে দেয়। মাহবুব আর আরাফ এইটার জন্য প্রস্তুত ছিলো না।

-সবসময় তোর জেদে হবেনা। তিনবছর আমাদের দেখে উদ্ধার করে ফেলেছিস আমাদের? কি ভেবেছিস তুই পাশে না থাকলে না খেয়ে মরে যেতাম? কোনোদিন ও মরতাম না। দরকার হলে ভিক্ষা করে খেতাম। (আম্মু জিদ থেকে কথাগুলো বলছে)
-আম্মু? (নিশি)
-হয় কাল তুই মাহবুবকে বিয়ে করবি নয় আমাকে আর তুর্নাকে ছাড়বি। তোর আব্বুর কথা ভাবছিস তো? আমি বলছি তুই মাহবুবকে বিয়ে করবি। আর মাহবুব তুমি কি আমার মেয়ের দায়িত্ব নিবেনা?
-আন্টি আমার কিছু বলার নাই। কিন্তু এইটাও মিথ্যে না যে আমি ওকে ভালবাসি৷ (মাহবুব)
-দয়া কর বাবা। আগামীকাল তোমাদের চারহাত আমি এক করে দিতে চাই। এর মাঝে কোনো ঝামেলা আমি আসতে দিবনা।
-এভাবে বিয়ে হয়না আন্টি। আপনার মেয়ে যেখানে রাজি না, সেখানে আমি কি বলব?
-ও রাজি তো হবেই। আগামীকাল সন্ধ্যায় তোমাদের বিয়ে। আরাফ তোমরা দুজন চলে এসো। (আম্মু)

মাহবুব আর কিছু না বলেই বেরিয়ে যায়। আরাফ ও আন্টির সাথে কিছু কথা বলে বেরিয়ে যায়। নিশি সোফার উপর ধপাশ করে বসে পরে। তুর্না আর আম্মু দুজনেই নিশিকে ছেড়ে রেস্ট নিতে চলে যায়। সারারাত নিশি একভাবেই বসে ছিলো আর কাঁদছিলো। মা উঁকি দিয়ে দেখে গেছে কিন্তু আটকায়নি নিশিকে। মাহবুবের ও একই অবস্থা। কেউ ভাবেনি দুজন আবার এক হতে পারবে! এতকিছুর পরেও নিশি আর মাহবুব এক কি হবে? এই প্রশ্নটাই আম্মুর মাথায় ঘুরছিলো কিন্তু উনি এক করিয়েই ছাড়বেন।

পরেরদিন সকালে,

নিশি ভোরে নামাজ পড়ে জানালার গ্রিল ধরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। মাহবুব মসজিদ থেকে এসে আরাফকে জিজ্ঞেস করে,

-আজ কি সত্যিই নিশির সাথে আমার বিয়ে?
-হ্যা। একটু পর পাঞ্জাবি কিনতে বের হব। নিশির জন্য বিয়ের শাড়িও কেনা লাগবে। মেন্টালি স্ট্রং হ।
-মাহবুব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

মা নিশির গায়ে হলুদ করালো সকালে এরপর নিশিকে গোসল করিয়ে তুর্না হাতে মেহেদি পরিয়ে দিলো। আর নিশির মা বারবার মাহবুবকে ফোন করছে। নিশি সারাদিনে একটা কথাও বলেনি। যে যা বলেছে সেইটাই করেছে। দুপুরে এসে আরাফ নিশির শাড়ি আর গোল্ড প্লেটের গহনা দিয়ে যায়। বিকেলে তুর্না নিশিকে বউ সাজাতে বসে। তুর্না ওর সমস্ত মেকাপ খাটে ছড়িয়ে নেয় যাতে খুব সহজেই হাতের কাছে সব পাওয়া যায়। প্রথমে তুর্না নিশির চুলগুলো সুন্দর করে স্ট্রেইট করে। এরপর মেকাপ করে। চুলগুলো খোপা করে তাতে ফুল বেঁধে দেয়। চোখে টানা টানা কাজল আর ঠোঁটে গাঢ় লাল রঙের লিপস্টিক। শাড়িটাও লালচে খয়েরি। তুর্না নিশির পায়ে সুন্দর করে আলতা পরিয়ে দেয়। নিশির পুরো শরীরে গহনা আর নাকে বড় একটা নোলক। নিশি আজ অন্যরকম নিজেকে দেখছে। গত তিনবছরে নিশি ঠোঁটে লিপস্টিক ও ছোঁয়ায় নি। তুর্না নিশিকে দেখে বলে,

-আপু তুমি কত সুন্দর দেখেছো? কিন্তু তাও নিজেকে কেমন করে রাখতে! দেখো আজ মাহবুব ভাইয়া তোমার থেকে চোখ ফেরাতে পারবেনা।
-নিশি তুর্নার দিকে রাগী দৃষ্টি নিয়ে তাঁকালো।

খোপা পর্যন্ত নিশির মাথায় ঘোমটা টানা। হাতে মোটা মোটা বালা আর চুরি। মায়ের আংটি খুলে মা নিশিকে পরিয়ে দেয়। নিশির যখন সব শেষ হলো তার কিছুক্ষণ পরে আরাফ আসে, পিছনে মাহবুব। নিশি নিশির ঘরে। আম্মু মাহবুবকে ড্রইংরুমে বসায়৷ আরাফ ভীষণ খুশি কারণ মান অভিমান যতই থাকুক বিয়ের পর তা ঠিক হতে বাধ্য। মাহবুব তুর্নার সাথে কথা বলছে টুকটাক। তুর্না মাহবুবকে বলছে,

-আজ থেকে তাহলে আমি তোমার শালিকা হব তাইতো দুলাভাই? (তুর্না মাহবুবকে শরবত দিতে দিতে)
-হয়ত! থ্যাংকস বাট আমি কিছুই খাব না এখন। (মাহবুব)
-মাহবুব তুই সারাদিনে কিন্তু কিছুই খাস নি! (আরাফ)
-তো? মরব না তো।
-মাহবুব তোমার জন্য আমি চিঁড়ার পোলাও বানিয়েছি। তোমার পছন্দের তো? (আম্মু)
-কিন্তু আন্টি আমি এখন কিছুই খাব না৷
-ভাইয়া আমি খাইয়ে দিচ্ছি। শালিকে না করবানা নিশ্চই? (তুর্না)
-তুর্না খাওয়াটা জরুরি না তো। (মাহবুব)
-বিয়েটা হবে কিছুক্ষণ পর৷ আপু ও আজ সারাদিন কিছুই খায় নি।
-তো তাকেই গিয়ে খাওয়াও।
-আগে তুমি খাও। আম্মু প্লেট টা দিয়ে যেয়ো আমায়।
-আচ্ছা। (আম্মু)

নিশির আম্মু প্লেটে করে চিড়ার পোলাও আর চিকেন রেজালা এনে দিলো সুন্দর করে সাজিয়ে আর আরাফের জন্য আলাদা প্লেটে। তুর্না জোর করে মাহবুবকে খাইয়ে দিলো নিজের হাতে। মাহবুব এখনো নিশিকে দেখেনি। একটু পর কাজি যখন এলো তখন তুর্না নিশিকে এনে মাহবুবের পাশে বসায়। মাহবুব মাথা নিচু করে বসে আছে। দেখেনি ও নিশিকে৷ শুধু পা দেখা যাচ্ছে। পায়ে গাঢ় আলতা পরা। কবুল বলে মাহবুব রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করে দিলো আর নিশিও৷ তুর্না তখন দুজনকেই মিষ্টি খাওয়ায়। বিয়ের পর‍ যখন মাহবুব উঠে দাঁড়ালো তখন মাহবুবের পাঞ্জাবির ব্রোঞ্জের সাথে নিশির হাতের বিয়ের মালা আটকে যায়। নিশি তখন প্রথম মাহবুবের দিকে তাঁকায় আর মাহবুব ও। মাহবুব নিশির দিকে তাঁকিয়ে তাঁকিয়েই ব্রোঞ্জ থেকে মালার সুতোটা ছুটালো কিন্তু মুখে একটাও কথা বলেনি। আরাফ তুর্নাকে আলাদা ডেকে নিয়ে বলছে,

-তোমায় তো একবার ওই বাসায় যেতে হবে।
-কেনো ভাইয়া?
-বাসর ঘর সাজানো হয়নি। ওরা এখান থেকে বেরোতে বেরোতে আমরা ফুল কিনে এনে সাজানোটা কমপ্লিট করে ফেলতে পারি।
-একদম ভুলে গেছি। দাঁড়ান ভাইয়া আম্মুকে বলে আসি।
-বাট ওরা যাতে টের না পায়।
-আচ্ছা।

তুর্না আম্মুকে সব বলে আরাফের সাথে বেরিয়ে যায়। আরাফ বলেছে রাতে আবার তুর্নাকে বাসায় ছেড়ে যাবে। মাহবুব জিজ্ঞেস করলো ওরা কোথায় যাচ্ছে কিন্তু তুর্না কথা কাটিয়ে নিয়ে চলে গেলো৷ ওরা যাওয়ার পর নিশির আম্মু নিশিকে আর মাহবুবকে আলাদা ঘরে পাঠায় কথা বলার জন্য। নিশি সে ঘরে গিয়ে দাঁড়িয়েই থাকে। মাহবুব ও চুপ করে থাকে। মাহবুবকে ওর ভাই কল দিচ্ছে৷ মাহবুব রিসিভ করে,

-হুম বল।
-ভাইয়া ভালো আছো? কাল থেকে তোমায় ফোন দিচ্ছি কিন্তু ধরছো না!
-ব্যস্ত ছিলাম একটু।
-কি করছো এখন?
-এইত কিছুক্ষণ আগে বিয়ে করলাম।
-কিহহহহ? কাকে? কীভাবে?
-নিশিকে।
-কি বলছো তুমি ভাইয়া? মজা করছো না তো?
-নাহ।
-তুমি বাসায় আসবেনা?
-না।
-ভাইয়া, আমি আব্বু আম্মুকে বলব। তারা আসুক আর না আসুক নেক্সট উইকে আমি চিটাগং আসছি।
-আসো।
-আচ্ছা এখন তাহলে আমি রাখছি।
-বাই।

ফোন কাটার পর মাহবুব নিশিকে বলল,

-বউ সাজে তোমায় অপুর্ব লাগছে। কখনো ভাবিনি যে বিয়েটা হবে।
-নিশি চুপ।
-তুমি নাকি সারাদিন কিছু খাও নি? খেয়ে নাও। আন্টিকে বলছি খাইয়ে দিতে।
-নাহ তার দরকার হবেনা।

নিশি এই কথা বলে ঘুরতে যাবে তখনি ও মাথা ঘুরে ফ্লোরে পরে যায়। মাহবুব পেছনে ঘুরে দেখে নিশি ফ্লোরে পরে আছে। মাহবুব নিশিকে দ্রুত কোলে তুলে খাটে শোয়ায়। মাহবুব আন্টিকে ডাকছে আর নিশির চোখে মুখে পানি ছিটাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর নিশির জ্ঞান ফিরে আসে। নিশির জ্ঞান ফিরে আসার পর মাহবুব আন্টিকে বলে,

-সারাদিন না খেয়ে ছিলো তাই মাথা ঘুরে পরে গেছে। আন্টি আপনি ওকে খাইয়ে দিন। আমি এশারের নামাজ পড়ব।
-নামাজ পড়ার ওয়াক্ত তো শেষ তাই তুমি ওই ঘরটায় পর। আমি নিশিকে খাওয়াচ্ছি।
-হুম।

মাহবুব ইচ্ছে করেই নিশিকে খাওয়ায় নি। রাগ, জেদ, ভালবাসা সবকিছুই আছে মনের ভেতর। মাহবুব নামাজ পড়ে আরাফকে ফোন দেয়। আরাফের কাজ তখন অর্ধেক শেষ হয়েছে। আরাফ ফোন রিসিভ করেনি। মাহবুব আন্টিকে জিজ্ঞেস করে,

-নিশি এখানেই থাকবে আন্টি?
-তুমি রাখতে চাইলেও আমি রাখব না। আজ থেকে ও তোমার ঘরে থাকবে।

কথাটা শুনে মাহবুবের বুকের ভেতর একটা ভাললাগার ঢেউ বইতে শুরু করলো। কিন্তু মাহবুব বাইরে তা প্রকাশ করলো না। রাত সাড়ে দশটায় আরাফ আর তুর্না বাসায় আসে। আরাফ পরে ওদের নিয়ে যায়। নিশি যেতে চায়নি কিন্তু আম্মু পাঠিয়ে দিয়েছে। এত রাতে এই এলাকায় গাড়িও পাওয়া যাবেনা। আরাফ কই থেকে যেনো একটা রিক্সা ধরে আনলো। মাহবুব নিশিকে নিয়ে রিক্সায় করে চলে আসে আর আরাফ হেঁটে হেঁটেই আসে। চাঁদনি রাত আর সাথে নতুন বউ নিয়ে রিক্সায় ফিলিংস টাই আলাদা। মাহবুব তখন বলল,

-সব মিলে যাচ্ছে। বলেছিলাম না চাঁদনি রাতে, খোলা আকাশের নিচে দিয়ে তোমায় বউ করে নিয়ে যাব আর তোমার গাঁয়ের গহনা আর তুমি চাঁদের আলোয় ঝলমল করবে। আমি আমার কথা রেখেছি।

নিশি তখন ও চুপ করে আছে। মাহবুব বাড়ির সামনে গিয়ে রিক্সা থামায়। নিশি রিক্সা থেকে নেমে রাস্তায় হাত মেলে দাঁড়ায়। এত সুন্দর প্রকৃতি! চারদিকে পাহাড় আর মাঝে মাটির রাস্তা। পাশে একটা পুকুর যেখানে চাঁদের আলো চিকচিক করছে। মাহবুব নিশিকে বলে,

-এসো।
-হুম।

নিশি এই প্রথম ওর স্বপ্নের বাড়িতে ঢুকলো। বাড়ির প্রতিটা কোণা নিশির মনমতো শোপিস দিয়ে সাজানো। সব আসবাবপত্র নিশির পছন্দের ডিজাইনের। নিশির চোখ আটকে যায় দেয়ালগুলো দেখে। দেয়ালগুলোর এর কোণায় নিশির ছবি দিয়ে ফ্রেম করা। নিশি একবার ছোঁয় ওইটা। পুরো বাড়িটা কাঠের। শুধু ওয়াশরুমটা সিমেন্ট দিয়ে তৈরি আর টাইলস করা। বাড়ির ছাদটাও কাঠের ডিজাইন করা। নিশি অভিভূত হয়ে যায়। তিনটা বেডরুম আরেকটা ডায়নিং রুম, তার পাশে রান্নাঘর। বাড়ির জানালা গুলো ও কাঠের। নিশি যখন বেডরুমে পা দিলো তখন দেখলো খাটটা ফুল দিয়ে সাজানো। নিশির ভেতরটা তখন কেঁপে উঠলো। মাহবুব ডায়নিং এই বসেছিলো। নিশি ঘরে ঢুকে ফুলগুলো ছোয়। মাহবুব তখন আসে বেডরুমে।

চলবে#সাঁঝের_প্রেম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *